ভিটামিন ডি-এর অভাবে যে ১২ টি লক্ষণ দেখা দিতে পারে!
দীর্ঘমেয়াদে ভিটামিন ডি-এর অভাবে রিকেটস, হাড় বেঁকে যাওয়ার মত রোগ হতে পারে। তাই চলুন জেনে নেই ভিটামিন ডি স্বল্পতার লক্ষণ, প্রতিরোধ, ও চিকিৎসা পদ্ধতি।
শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণ ভিটামিন ডি গ্রহণ বা উৎপন্ন না হওয়াই মূলত ভিটামিন ডি এর স্বল্পতা। উৎপন্ন হবার কথা বলছি কারণ, ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস হলো সূর্যের আলো। আমাদের দেহের ক্লোরেস্টরল থেকে সূর্যের অতি বেগুনী রশ্নির সাহায্যে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হয়। খুব কম খাদ্য-ই পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি প্রদান করে এবং প্রকৃত পক্ষে শুধু খাবারের মাধ্যমে ভিটামিন ডি অভাব পূরণ সম্ভব নয়। নগর জীবনে যেখানে সূর্য ওঠার আগে আগেই অফিসে পৌঁছানো এবং সূর্যাস্তের পর ঘরে ফেরা, সেখানে ভিটামিন ডি এর অভাব হওয়া খুবই স্বাভাবিক!
জেনে অবাক হবেন, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০% মানুষ ভিটামিন ডি এর অভাবে ভোগেন। প্রাথমিক উপসর্গ মারাত্বক না হবার কারণেই ভিটামিন ডি এর অভাব বোঝা ও এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। ভিটামিন ডি শরীরে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের মাত্রা নিয়ন্ত্রন করতে সাহায্য করে। যার মূলত আমাদের হাড়, দাঁত ও পেশি সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
দীর্ঘমেয়াদে ভিটামিন ডি এর স্বল্পতা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে রিকেটস ও বড়দের অস্টিওম্যালাশিয়া রোগ সৃষ্টি করে। দুটো রোগেই দেহের বিভিন্ন হাঁড় বেঁকে যাওয়ার মত জটিলতা দেখা দেয়। তাছাড়া ক্যান্সার, ডায়বেটিস, কিডনীরোগ ও উচ্চরক্তচাপ এর মত জটিল রোগের সাথে ভিটামিন ডি এর যোগ রয়েছে। তাই প্রাথমিক উপসর্গ লক্ষ করা ও স্বল্পতা পূরণে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরী।
যেভাবে বুঝবেন আপনি ভিটামিন ডি স্বল্পতায় ভুগছেন
ভিটামিন ডি আমাদের শরীরের অতি প্রয়োজনীয় ভিটামিন গুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু তবুও বেশিরভাগ মানুষই ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ, ও ভিটামিন ডি এর অভাবে কি কি উপসর্গ দেখা দিতে পারে সে বিষয়ে অজ্ঞাত। ভিটামিন ডি এর এর অভাব বুঝতে পারলে খুব সহজেই কিছু জটিলতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। চলুন চেনে আসা যাক কিভাবে বুঝবেন আপনি পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ করছেন না-
১) দেহের বিভিন্ন পেশিতে ব্যথা
শরীরের বিভিন্ন পেশিতে ব্যথা অপর্যাপ্ত ভিটামিন ডি গ্রহণের নির্দেশক হতে পারে। আমাদের শরীরের পেশি গুলো সঠিকভাবে কাজ করার জন্য ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন পড়ে। ভিটামিন ডি আমাদের পেশিতে প্রবেশ করে পেশির কার্যকারিতা ও নমনীয়তা রক্ষা করে। যারা ব্যায়াম করে পেশি বানান, তাদের প্রচুর পরিমানে ভিটামিন ডি গ্রহণ করতে হয়।
২) হাড়ে যন্ত্রণা
প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পর আমাদের শরীরে হাড়ের বৃদ্ধি থেমে যায়। কিন্তু হাড়ের প্রতিটি কোষ প্রতিনিয়ত মারা যায় এবং নতুন কোষ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এই প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন হতে ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন পড়ে। তাই ভিটামিন ডি এর অভাব জনিত কারণে হাড়ে ব্যাথা হয়ে থাকে।
৩) সারাক্ষণ ক্লান্তি ভাব
কিছু করছেন না, তবুও সারাদিন ক্লান্ত লাগছে, বা কাজ করতে গেলে শুধু ঘুম পাচ্ছে। কিছুতেই এই ক্লান্তির দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছেন না। এই লক্ষন গুলো নির্দেশ করে আপনার শরীরে ভিটামিন এর অভাব থাকতে পারে।
আমাদের শরীরে শক্তি উৎপন্ন হতে ভিটামিন ডি প্রয়োজন হয়। শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাবে ক্লান্তিভাব, অসময়ে ঘুম চলে আসা ইত্যাদি উপস্বর্গ দেখা দেয়।
৪) দ্রুত হাঁপিয়ে যাওয়া
ছোটখাটো কায়িক পরিশ্রম যেমন, সিঁড়ি দিয়ে ওঠা, একটু জোরে হাঁটা এমন কাজ করতে গিয়ে অত্যাধিক হাঁপিয়ে যাওয়া নির্দেশ করে আপনার ভিটামিন ডি এর ঘাটতি রয়েছে। পূর্ববর্তি পয়েণ্টে উল্লেখ করেছি, ভিটামিন ডি শরীরে শক্তি উৎপাদনে প্রয়োজন পড়ে। ঠিক একই কারণেই দ্রুত দম ফুরিয়া যাওয়া বা হাঁপিয়ে যাওয়ার মত সমস্যা দেখা দেয়।
৫) বিষণ্ণতা
আপনার তেমন কোন দুঃখ নেই, সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন, তবুও ঘন ঘন যদি মেজাজ পরিবর্তন বা বিষণ্ণতা অনুভব করেন তবে আপনার খাদ্যাভাসে ভিটামিন ডি সংযোজন আর সূর্যের আলোয় বেড়িয়ে আসা উচিৎ।
ভিটামিন ডি এর ঘাটতি আপনার শরীরের সাথে মনের উপর ও প্রভাব ফেলে। ভিটামিন ডি যেমন আমাদের মস্তিষ্কের সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়, তেমনি মস্তাষ্কের যে অংশ আমাদের মুড বা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে সে অংশ নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্য ভিটামিন ডি প্রয়োজন। গবেষকরা মানব মস্তিষ্কের মুড নিয়ন্ত্রণকারী অংশে ভিটামিন ডি রিসিপ্টর এর খোঁজ পেয়েছেন।
৬) ভালো ঘুম না হওয়া
ঘুম না আসা বা ঘুমালেও ঘুম গাঢ় না হওয়া ভিটামিন ডি এর অভাব প্রকাশ করে। মানুষের মস্তিষ্কের ঘুম নিয়ন্ত্রণকারী অংশেও ভিটামিন ডি এর প্রভাব লক্ষনীয়।
৭) অতিরিক্ত মাথা ঘেমে যাওয়া
পুরো শরীরের তুলনায় অতিরিক্ত মাথা ঘামাও শরীরে ভিটামিন ডি এর অপর্যাপ্ততা নির্দেশ করে।
৮) চুল পড়া
বয়সের সাথে সাথে চুল পড়া স্বাভাবিক কিন্তু চুল পড়া ভিটামির ডি এর অভাবেও হয়ে থাকে। আমাদের চুলের ফলিকিউলস বা গোড়া সুস্থ রাখতে ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন পড়ে।
৯) ক্ষত বা ঘা সারতে দেরী হওয়া
আমাদের দেহে ক্ষত সেরে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় ভিটামিন ডি এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। ক্ষত দেরীতে সারার কারণে ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যায়। এই সমস্যা আরও গুরুতর হয়ে দাঁড়ায় যখন ভিটামিন ডি অভাবজনিত কোন রোগীর সার্জারী বা অপারেশন করানো হয়।
১০) মাথা ঘোরা ও বমি-বমি ভাব
আমাদের কানে অবস্থিত তরলে যদি অস্বাভাবিক বার্তা পৌছায় তবে মাথা ঘোরা ও বমি-বমি ভাব দেখা দিতে পারে। এজন্য বাসে উঠলে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে যান ও বমি করেন। এই সমস্যাটি এমনি এমনি ও হতে পারে যদি কারো ভিটামিন ডি এর অভাব থেকে থাকে।
১১) হৃদরোগ
দীর্ঘদিন ভিটামিন ডি স্বল্পতায় ভোগার ফলে হৃদরোগ এর ঝুঁকি বেগে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে ভিটামিন ডি স্বল্পতার সাথে হৃদরোগ সহ উচ্চরক্তচাপ, স্টোক এর সাথে যোগ রয়েছে।
১২) ওজন বেড়ে যাওয়া
কখনো ভেবেছেন অনেক মোটা মানুষ কেন শত চেষ্টা করেও ওজন কমাতে পারেন না। এর সাথে ভিটামিন ডি এর একটি সংযোগ রয়েছে। ভিটামিন ডি আমাদের দেহে গৃহীত ক্যালরি ভাঙতে সাহায্য করে, যে ক্যালরি ভাঙে না তা আমাদের দেহে ফ্যাট হিসেবে জমা হয়। ভিটামিন ডির স্বল্পতা তাই ওজন বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। এখানেই শেষ নয়। একজন স্বাভাবিক মানুষের চাইতে মোটা মানুষের ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন ২-৩ গুণ হয়ে থাকে। এ পর্যায়ে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ না করার ফলে মানুষ আরো মোটা হতে থাকে। ওজন কমানোর জন্য ডায়েট, ব্যায়ামের সাথে ভিটামিন পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ করা উচিৎ।
“হৃদরোগকে বলুন অসম্ভব, স্বাস্থ্যকর খাবারেই সব সম্ভব”। হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর ১৫টি কার্যকরী উপায়
স্থুলতা এবং অতিরিক্ত ওজন: আপনার কী জানা উচিৎ এবং কী করা উচিৎ?
ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণে করণীয়
সূর্যের আলো: পূর্বেই উল্লেখ করেছি, ভিটামিন ডি এর প্রাথমিক উৎস হল সূর্য। দৈনিক ১৫-২০ মিনিট সূর্যের আলোয় থাকার মাধ্যমে শরীরে ভিটামিন ডি এর অভাব পূরণ করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সকাল দশটা থেকে দুপুর তিনটার মধ্যে রোদ পোহানো সবচাইতে কার্যকরী। যাদের ত্বক গাঢ় রঙের তাদের সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি উৎপন্ন হবার হার কম, তাই তাদের ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্যের উপরে তুলনামূলক বেশি জোর দেওয়া উচিৎ।
ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার: অল্প কিছু খাবার মানুষকে ভিটামিন ডি প্রদান করে। এই কারণেই বিশ্বজুগে এত মানুষ ভিটামিন ডি স্বল্পতায় ভুগে থাকেন। ভিটামিন ডি এর প্রধান উৎস হলো সূর্য। সূর্যের অতি বেগুনী রশ্নি আমাদের ত্বকে ভিটামিন ডি উৎপন্ন করতে সাহায্য করে।
-
চর্বিযুক্ত মাছ ভিটামিন ডি এর ভালো উৎস।
-
যেকোনো ধরনের মাশরুমে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন ডি থাকে। যারা মাছ খেতে ভালোবাসেন না, তারা মাশরুমকে বেছে নিতে পারেন।
-
ডিম ভিটামিন ডি এর নির্ভরযোগ্য উৎস। উল্লেখ্য ভিটামিন ডি পেতে সম্পূর্ণ ডিম-ই খেতে হবে। ডিমের সাদা অংশ প্রোটিন ও কুসুম খনিজ ও বিভিন্ন ভিটামিন পরিপূর্ণ।
-
দই খাওয়ার মাধ্যমে ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন মেটানো যায়। দই হজম সহায়ক, ও পরিপাকতন্ত্রে উপকারী ব্যাক্টেরিয়ার যোগান দেয়।
-
পনিরে ভিটামিন ডি থাকে।
-
প্রচলিত ফলের মধ্যে একমাত্র মাল্টা ভিটামিন ডি এর ভালো উৎস। মাল্টার জুস ক্যালশিয়াম, ভিটামিন সি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান এরও ভালো উৎস।
ভিটামিন ডি স্বল্পতার চিকিৎসা
ভিটামিন ডি স্বল্পতায় কারণে যদি গুরুতর কোন জটিলতা সৃষ্টি না করে, তবে ভিটামিন ডি স্বল্পতার চিকিৎসা খুব সহজ। পর্যাপ্ত পরিমান ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ ও পরিকল্পনা মাফিক রোদে বেড়ানোর মাধ্যমে খুব সহজেই ভিটামিন ডি স্বল্পতার প্রাথমিক সমস্যা গুলো দূর করা যায়।
ভিটামিন ডি স্বল্পতা মেটানোর তৃতীয় পদ্ধতি হলো ভিটামিন ডি এর সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ। তবে অবশ্যই সতর্কতার সাথে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এটি গ্রহণ করতে হবে। কারণ অতিরিক্ত ভিটামিন ডি গ্রহণ হিতে-বিপরীত করতে পারে।
ভিটামিন ডি স্বল্পতার কারণে তুলনামূলক জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিলে, ভিটামিন ডি গ্রহণের সাথে সাথে একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ অত্যাবশ্যক।
ভিটামিন ডি এর স্বল্পতায় ভোগা যতটা সহজ, এ থেকে পরিত্রাণের উপায় তারচেয়েও সহজ, যদি না খুব বেশি দেরি করে ফেলেন। তাই অবহেলা নয়, প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতা।
এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আশেপাশের মানুষদের জানানোর মাধ্যমে আপনিও হতে পারেন মানব কল্যাণে অংশীদার।