শিশুর নিউমোনিয়া হলে করণীয়!
নিউমোনিয়া কী? কীভাবে বুঝবেন নিউমোনিয়া হয়েছে? এই রোগের কারণ কি? নিউমোনিয়া থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি?
আপনি কি জানেন সারাবিশ্বে প্রতি ৩৯ সেকেন্ডে একটি শিশু মারা যাচ্ছে শুধু মাত্র নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে এবং প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ২২০০ শিশু? এর প্রভাব এতই ভয়াবহ যে শধু মাত্র নিউওমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন যে পরিমাণ শিশু মারা যায় সেটা অন্য কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার রেকর্ড নেই। তুলনামূলকভাবে ২০১৮ সালে, ডায়রিয়ার কারণে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৪৩৭০০০ জন এবং ম্যালেরিয়াতে আক্রান্ত হয়ে ২৭২০০০ জন শিশু মারা গেছে কিন্তু নিউমোনিয়া তে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে প্রায় ৮ লক্ষ শিশু। পাঁচ বছর অথবা তার কম বয়সী শিশুদের প্রায় ১৫ শতাংশ মৃত্যু হয় এই নিউমোনিয়ার কারণে।
বিশ্বব্যাপী, প্রতি ১০০,০০০ শিশুর মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ১৪০০ এরও বেশি এবং প্রতি বছর ৭১ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু মারা যাচ্ছে নিউমোনিয়ায়। নিউমোনিয়ার সবচেয়ে বড় মহামারি দেখা গিয়েছিলো দক্ষিন এশিয়ায় এবং মধ্য আফ্রিকাতে। দক্ষিন এশিয়ায় প্রতি এক লাখ শিশুর মধ্যে প্রায় ২৫০০ শিশু এবং মধ্য আফ্রিকাতে প্রায় ১৬২০ জন ছিলো এই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। যদিও এই মৃত্যুর হার অনেকটা কমে এসেছে কারণ ২০০০ সালের পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৫৪ শতাংশ এবং ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার কমেছে ৬৪ শতাংশ। অর্থাৎ এতে কোনো সন্দেহ নেই যে নিউমোনিয়া এখনও বেশীরভাগ শিশুর মৃত্যুর প্রধান কারন তাই আমাদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে নিউমোনিয়ার প্রভাব
বর্তমানে আমাদের দেশে শিশু মৃত্যুর হার ২.৪৭ শতাংশ, ২০১৮ সালে যা ছিলো ২.৬৮ শতাংশ আর এই মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হলো নিউমোনিয়া। আমাদের দেশে প্রতি তিন ঘন্টায় প্রায় চার জন শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ার কারণে যাদের বয়স পাঁচ বছরের কম অথবা একটু বেশী এবং ৮০,০০০ শিশু প্রতি বছর ভাইরাসজনিত তীব্র শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতায় হাসপাতালে ভর্তি হন; বিশেশজ্ঞদের মতে সংক্রমণের মোট সংখ্যা সম্ভবত অনেক বেশিও হতে পারে। বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর প্রায় ২৮% এবং প্রতিবছর প্রায় ৫০,০০০ শিশু মারা যায় নিউমোনিয়ার কারণে।
ইউনিসেফ সহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠানের একটি জরিপে জানা যায় ২০১৮ সালে আমাদের দেশে ১২ হাজারেরও বেশী শিশু মারা গিয়েছে শুধু মাত্র নিউমোনিয়ার কারণে, যার অর্থ দাঁড়ায় ২০১৮ সালে প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু এই নিউমোনিয়ার আঘাতে পৃথিবীর বুক থেকে চলে গিয়েছে এবং এটি ছিলো ৩য় প্রধান কারণ শিশু মৃত্যুর জন্য। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর দিকে দিয়ে বিশ্বের ১৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪ তম, এবং তালিকায় ২য় স্থানে রয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও ৩য় স্থানে পাকিস্তান।
নিউমোনিয়া কী?
নিউমোনিয়া ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের একটি রোগ যা এক বা উভয় ফুসফুসের বায়ু থলিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। ব্যাকটিরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাক সহ বিভিন্ন জীবের কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে। স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি নামের এক ধরণের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ নিউমোনিয়া রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত। নিউমোনিয়া সাধারণত ৬৫ বছরের বেশী বয়স্ক ব্যক্তি এবং অল্পবয়সী শিশুদের মধ্যে বেশী দেখা যায় কারণ জীবনকালের এই দুই অবস্থাতেই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে অথবা বয়স্করা দীর্ঘদিন বিভিন্ন রোগে ভোগার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় তখন তাদের মধ্যে নিউমোনিয়া বেশী দেখা দেয়। নিউমোনিয়ার ভয়াবহতা মৃদু বা হাল্কা থেকে জীবনের জন্য হুমকি স্বরুপ হতে পারে, তাই প্রাথমিক অবস্থাতেই একে গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
নিউমোনিয়ার লক্ষণ
নিউমোনিয়ার লক্ষণগুলি সাধারণত নির্ভর করে সংক্রমণের জীবাণুর ধরণ, রোগীর বয়স এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই উপসর্গগুলি প্রায়শই সাধারণ সর্দি বা ফ্লুর মতো হয়ে থাকে কিন্তু কিছুকিছু ক্ষেত্রে এগুলি দীর্ঘস্থায়ী হয়। নিউমোনিয়ার প্রধান লক্ষণগুলি হলোঃ
১. শ্বাস বা কাশি হলে বুকে ব্যথা হয়
২. ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়স্কদের মধ্যে বিভ্রান্তি বা মানসিক সচেতনতার পরিবর্তন দেখা যায়।
৩. কফ তৈরি করে এমন কাশি
৪. অবসাদ
৫. জ্বর, ঘাম এবং কাঁপুনি
৬. শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে কম
৭. বমি বমি ভাব, বমিভাব বা ডায়রিয়া
৮. নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া
নবজাতক এবং শিশুদের ক্ষেত্রে সাধারণত সংক্রমণের কোনও চিহ্ন দেখা যায় না। তবে নিউমোনিয়ার ফলে তাদের বারবার বমি হতে পারে, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসতে পারে, কাশি হতে পারে, ক্লান্ত এবং শক্তিহীন দেখা যায়, বা শ্বাস নিতে এবং খেতে অসুবিধা হতে পারে।
শিশুর শ্বাসকষ্ট বোঝার উপায়
২-১১ মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক হার সাধারণত প্রতি মিনিটে ৫০ এর কম এবং ১ বছর থেকে ৫ বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক মাত্রা মিনিটে ৪০ অথবা তার কম থাকে। কিন্তু যদি ২-১১ মাস বয়সী শিশুদের শ্বাস-প্রশ্বাসের হার মিনিটে ৫০ এর বেশি থাকে এবং ১ বছর থেকে ৫ বছরের শিশুর শ্বাস-প্রশ্বাসের হার মিনিটে ৪০ এর বেশি হয়ে থাকে অর্থাৎ শিশুটি যখন ঘনঘন নিঃশ্বাস নিবে তখন আমরা বুঝবো শিশুটির শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তাই সাধারণ জ্বর-কাশিতে আক্রান্ত শিশু যদি এমন ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় এবং নিঃশ্বাস নেওয়ার সময় শিশুর বুকের নিচেরভাগ ভেতরের দিকে ঢুকে যায় তাহলে শিশুটি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে বলে ধরা হয়ে থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট নিউমোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ। যদি নিউমোনিয়ার ধরণ খুব গুরুতর হয়ে থাকে তাহলে শিশু বুকের দুধ খেতে পারবে না, পানি খেতে পারবে না, খিঁচুনি হবে, হাঁটতে কষ্ট হবে এবং পুষ্টিহীনতায় ভুগতে পারে।
সাধারণ সর্দি কাশি থেকে নিউমোনিয়াকে চেনার উপায়
নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে শুরুর দিকে সাধারণ সর্দি, কাশি এবং জ্বরের মতো লক্ষণ প্রকাশ পায় তাই অনেকেই বুঝতে পারে না তার নিউমোনিয়া হয়েছে। কিন্তু যদি কিছুদিন পর থেকেই সময়ের সাথে এই লক্ষণগুলির তীব্রতা বাড়তে থাকে যেমন, কাঁপুনি দিয়ে বারবার জ্বর আসছে এবং কিছুতেই কমছে না, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে, কাশির সাথেসাথে বুকের ব্যথাও বেড়ে চলেছে, রোগীর মাথায় যন্ত্রণা করছে তখন বুঝবেন রোগীর নিউমোনিয়া হয়েছে অথবা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশী এবং দেরী না করে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। যদি রোগীর সাধারণ সর্দি কাশি হয়ে থাকে তাহলে ওষুধ দেওয়ার পর খুব দ্রুত ভালো হয়ে যাবে আর যদি রোগী নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে সাধারণ সর্দি কাশির চিকিৎসায় তেমন ফল পাওয়া যাবে না।
সামান্য ঠান্ডা থেকে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভবনা
শীতকালে আমাদের সবারই প্রায়শই সর্দি কাশি হয়ে থাকে, কিন্তু যদি ভেবে থাকেন এই সর্দি কাশি সামান্য ঠান্ডা লাগাতে থেকে হয়েছে এবং অবহেলা করেন তাহলে ভুল করবেন। কারণ সামান্য ঠান্ডা লাগা থেকেও আপনার অথবা আপনার বাচ্চার নিউমোনিয়া হয়ে যেতে পারে। শীতকাল হলো নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী অণুজীবের জন্য উপযুক্ত সময় কারণ পরিবেশের তাপমাত্রা খুব কম তারা উপযুক্ত আবহাওয়ায় আরও বেশি সক্রি হয়ে ওঠে। তবে সামান্য ঠান্ডা লাগলেই সবারই নিউমোনিয়াইয় আক্রান্ত হবার সম্ভবনা থাকে সেটা কিন্তু সঠিক নয়। আমাদের মধ্যে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে বেশি তাদের এই ভয় কম। কারণ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে নিউমোনিয়ার একটি সম্পর্ক রয়েছে। তাই এটি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিশু এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে দেখা যায় কারণ তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল। তাই এদের ক্ষেত্রে সামান্য ঠান্ডা থেকে হওয়া সর্দি কাশিকেও অবহেলা করা ঠিক নয়।
কখন ডাক্তারের সাক্ষাৎ করতে হবে?
আপনার যদি শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, টানা জ্বর ১০২ এফ (৩৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) বা ততোধিক জ্বর বা নিয়মিত কাশি এবং পুঁজ সহ কাশি হলে আপনাকে অবশ্যই দেরী না করে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। বয়স্ক মানুষ যার বয়স ৬৫ বছরেরও বেশি এবং ২ বছরের কম বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে উপরোক্ত লক্ষন গুলি প্রকাশ পাওয়ার সাথে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ অথবা ক্যান্সারের রোগী যারা কেমোথেরাপি গ্রহণ করছে তাদের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকে তাদের নিয়মিত ডাক্তারের সাক্ষাৎ করা উচিত এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত, অন্যথায় তাদের জীবনের জন্য নিউমোনিয়া হুমকি স্বরুপ হয়ে যেতে পারে।
নিউমোনিয়ার কারণ
বিভিন্ন ধরণের ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের কারণে নিউমোনিয়া হতে পারে। আমরা যে বায়ুতে শ্বাস নিই তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাস এবং আমাদের শরীর সাধারণত এই জীবাণুগুলিকে বাঁধা দেয় যেন আমাদের ফুসফুসকে সংক্রামিত করতে না পারে। তবে কখনও কখনও জীবাণুগুলি আমাদের শরীরে প্রবেশ করলেও আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারণে সেটি মারা যায়। কিন্তু শিশু অথবা বয়ষ্কদের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল থাকায় এই জীবাণু খুব সহজে সংক্রমিত করতে পারে, আর এইখান থেকেই হয় নিউমোনিয়ার সৃষ্টি। সংক্রমণের ধরনের উপর ভিত্তি করে নিউমোনিয়াকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
১. পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সংক্রমিত নিউমোনিয়া
এই ধরণের নিউমোনিয়া সাধারণত আমাদের আশেপাশের পরিবেশ, বিভিন্ন ধরণের মানুষের সাথে চলাচল, আমরা নিঃশ্বাসের সাথে যে বাতাস গ্রহণ করি সেখানে থাকা অণুজীবের কারণে হয়ে থাকে। এই নিউমোনিয়ার প্রধান দুইটি কারণ হল ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া।
ভাইরাল নিউমোনিয়ার প্রধান কারণগুলি হ'ল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস এবং শ্বাস প্রশ্বাসের সিনসিটিয়াল ভাইরাস (আরএসভি)। ৫ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের নিউমোনিয়ার সবচেয়ে সাধারণ কারণ ভাইরাস। ভাইরাল নিউমোনিয়া সাধারণত হালকা হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি খুব মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে।
স্ট্রেপ্টোকোকাস নিউমোনিয়া (নিউমোকোকাস) নামক এক ধরণের ব্যাকটেরিয়া ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়ার একমাত্র প্রধান কারণ। এই ধরণের নিউমোনিয়া নিজে থেকেই বা আপনার সর্দি বা ফ্লু হওয়ার পরে ঘটতে পারে। এটি ফুসফুসের একাংশকে (লোব) প্রভাবিত করতে পারে তাই এটি লোবার নিউমোনিয়া নামেও পরিচিত। ব্যাকটেরিয়ার মতো আরও একটি অনুজীব আছে মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া, যার কারণেও নিউমোনিয়া হতে পারে। কিন্তু এটি নিউমোনিয়ার অন্যান্য ধরণের চেয়ে সাধারণত হালকা লক্ষণ তৈরি করে, তাই এটি অতটা গুরুতর নয়।
২. হাসপাতাল থেকে সংক্রমিত নিউমোনিয়া
আপনি অন্য কোনো রোগের জন্য হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থাতেও নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হতে পারেন। এই ধরণের নিউমোনিয়া খুব গুরুতর হতে পারে কারণ এই ধরণের নিউমোনিয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে আরও প্রতিরোধী হয়ে উঠে যাকে বলা হয় অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এবং এই ধরণের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যাক্তি ইতিমধ্যে অসুস্থ হয়েই হাসপাতালে আছেন তাই তার জন্য এই নিউমোনিয়া আরো বেশী বিপজ্জনক হয়ে থাকে। যে সকল ব্যক্তি ভেন্টিলেটরে থাকেন, প্রায়শই আইসিউতে থাকেন, তাদের এই ধরণের নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যেহেতু এই ধরণের নিউমোনিয়ার সংক্রমণ হাসপাতাল থেকেই শুরু হয় তাই এই নিউমোনিয়াকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বলা হয়ে থাকে হাসপাতাল থেকে সংক্রমিত নিউমোনিয়া (Hospital Acquired Pneumonia)।
নিউমোনিয়া কীভাবে ছড়ায়?
নিউমোনিয়া বিভিন্ন উপায়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। সাধারণত যে ভাইরাস এবং ব্যাকটিরিয়া ফুসফুসকে সংক্রমিত করে সেগুলো নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীর নাক বা গলায় থেকে কাশি বা হাঁচির মাধ্যমে বাতাসের সাথে মিশে যায় এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তখন এই বাতাস নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কোনো সুস্থ মানুষের শরীরে প্রবেশ করলে সে নিউমোনিয়ায় সংক্রমিত হয়। এছাড়াও আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্তের মাধ্যমে নিউমোনিয়া ছড়িয়ে যেতে পারে। সন্তান জন্মের পূর্বে মা যদি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত থাকেন তাহলে সন্তানেরও নিউমোনিয়া হবার সম্ভবনা থাকে, তাছাড়া আক্রান্ত ব্যাক্তির রক্ত অন্য কারো শরীরে প্রবেশ করলে, ব্যাবহার করা ব্লেড অথবা সুচ অন্য কেউ ব্যাবহার করলেও নিউমোনিয়া ছড়ানোর সম্ভবনা থাকে। আক্রান্ত ব্যাক্তি যেখানে সেখানে থুঃথুঃ, কফ ফেললে সেখান থেকেও বায়ুর মাধ্যমে নিউমোনিয়া ছড়িয়ে থাকে।
অপ্রচলিত বা এটিপিকাল নিউমোনিয়া
আধুনিক ডায়াগনস্টিক পরীক্ষাগুলি সহজলভ্য হওয়ার আগে, গবেষকরা লক্ষ্য করেছিলেন যে কিছুকিছু নিউমোনিয়া বিশিষ্ট প্রথাগত সাধারণ নিউমোনিয়ার তুলনায় একটু ভিন্ন, যেমন-
১. সাধারণত হয়ে থাকা নিউমোনিয়া থেকে একটু আলাদা ধরণের লক্ষন দেখা যায়
২. বুকের এক্স-রেতে ভিন্ন কিছুর উপস্থিতি
৩ এন্টিবায়োটিকের প্রতি কম সংবেদনশীল, অর্থাৎ সাধারণত যেসকল এন্টিবায়োটিক ব্যাবহার করা হয়ে থাকে, এই ধরণের নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে তারা কাজে আসে না।
৪. ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস শনাক্ত করার প্রচলিত পদ্ধতিতে তাদের শনাক্ত করা যায় না
চিকিৎসাবিজ্ঞানে গবেষকগণ এই ধরণের নিউমোনিয়াকে ব্যাতিক্রম বা ভিন্নধর্মী নিউমোনিয়া বা অপ্রচলিত বা এটাইপিকাল নিউমোনিয়া (Atypical Pneumonia) বলে থাকেন।
এই নিউমোনিয়া হতে পারে কিছু ভিন্নধর্মী ব্যাকটেরিয়ার কারণে, সেগুলো হলো-
-
ক্ল্যামিডিয়া নিউমোনিয়া (Chlamydia pneumoniae)
-
ক্ল্যামিডিয়া পিত্তচি (Chlamydia psittaci)
-
লেজিওনেলা নিউমোফিলা (Legionella pneumophilae)
-
মাইকোপ্লাজমা নিউমোনিয়া (Mycoplasma pneumoniae)
নিউমোনিয়া ঝুঁকির প্রধান কারণ
নিউমোনিয়া যে কাউকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দুটি বয়সের গ্রুপগুলি হল:
-
যে শিশুরা ২ বছর বা তার চেয়ে কম বয়সী
-
যাদের বয়স ৬৫ বা তার বেশি বয়সের
অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে:
১. পারিপার্শ্বিক পরিবেশ- আপনি যদি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা ইউনিটে থাকেন তবে আপনার নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি, বিশেষত যদি আপনি এমন কোনো যন্ত্রের পরিচর্যায় থাকেন যা আপনাকে শ্বাস নিতে সহায়তা করে যেমনঃ ভেন্টিলেটর তাহলে নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বায়োমাস জ্বালানী (যেমন কাঠ বা গোবর) দিয়ে রান্না করলে উৎপন্ন তাপ এবং ধোঁয়া অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ ঘটায় তখন আপনার নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
২. দীর্ঘমেয়াদী রোগ- দীর্ঘমেয়াদী অসুখ যেমন হাঁপানি, হৃদরোগ শিশু এবং বয়স্ক উভয়দের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বাড়ায়
৩. ধূমপান- বয়স্ক রোগীদের নিউমোনিয়ার অন্যতম একটি কারণ হলো ধূমপান। সিগারেটে থাকা নিকোটিন নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়া এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে দেহের প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে দুর্বল করে ফেলে।
৪. দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থা- যাদের এইচআইভি / এইডস রয়েছে, যাদের অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে, বা যারা দীর্ঘকাল ধরে কেমোথেরাপি বা দীর্ঘমেয়াদী স্টেরয়েড গ্রহন করে তাদের নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে কারণ এসবকিছু দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে দুর্বল করে দেয়। বেশিরভাগ সুস্থ বাচ্চারা তাদের প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে, তবে যেসব শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। অপুষ্টি বা অপুষ্টিজনিত কারণে বিশেষত যেসব শিশুদের বুকের দুধ করানো হয় না তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং তারা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশী থাকে।
নিউমোনিয়ার জটিলতা
নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা খুব বিপদজনক অবস্থানে আছে তাদের ক্ষেত্রে পূর্বে আলোচিত লক্ষণ গুলি ছারাও নিউমোনিয়ার ফলে একজন রোগীর আরও বিভিন্ন ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং তারা নিউমোনিয়ার জন্য চিকিৎসা নেওয়াকালীনও এইসব জটিলতা দেখা যেতে পারে।
১. ব্যাকটেরিমিয়া বা রক্তে প্রবাহে ব্যাকটেরিয়া- আপনার ফুসফুস থেকে নিউমোনিয়ার ব্যাকটিরিয়া রক্ত প্রবাহে প্রবেশ করতে পারে যার ফলে রক্তের মাধ্যমে সংক্রমণটি শরীরের অন্য অঙ্গগুলিতে ছড়িয়ে দিতে পারে এবং অঙ্গগুলি অকেজো করে দিতে পারে।
২. শ্বাসকষ্ট এবং বুকে ব্যাথা- যদি আপনার নিউমোনিয়া গুরুতর হয় বা আপনার ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী কোনো রোগ হয় তাহলে আপনার পর্যাপ্ত অক্সিজেন নিতে সমস্যা হতে পারে, তখন শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ার পাশাপাশি বুকে ব্যাথা হতে পারে। আপনার শ্বাসযন্ত্রের যন্ত্র (ভেন্টিলেটর) ব্যবহার করতে হতে পারে।
৩. ফুসফুসে পানি জমে যাওয়া (প্ল্যুরাল ইফিউশন)- নিউমোনিয়ার কারণে ফুসফুস এবং বুকের গহ্বরের (প্লুরা) মাঝামাঝি টিস্যুগুলির স্তরগুলির পাতলা জায়গায় তরল তৈরি হতে পারে বা জমা হতে পারে যাকে আমরা বলে থাকি ফুসফুসে পানি চলে আসা। যদি তরলটি ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত হয় তবে আপনার এটি অবশ্যই অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করতে হতে পারে।
৪. ফুসফুসে ফোঁড়া- ফুসফুসের একটি গহ্বরে যদি পুঁজ গঠন হয় তখন এর চারপাশে রক্ত জমাট বেঁধে ওই নির্দিষ্ট স্থান ফুলে যায় এবং ফোঁড়ার মতো দেখা যায়। তখন খুব ব্যাথা অনুভব হতে পারে। এটি সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিত্সা করা হয কিন্তু কখনও কখনও, অস্ত্রোপচার বা দীর্ঘ সুঁচ বা নল দিয়ে রক্ত যুক্ত পুঁজ অপসারণ করার প্রয়োজন হতে পারে।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসা
নিউমোনিয়া ব্যাকটেরিয়া অথবা ভাইরাস ঘটিত হওয়ায় সাধারণত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসা করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। কিন্তু মাঝেমাঝে হয়তো রোগীর অবস্থার উপর নির্ভর করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা সম্ভব হয়ে উঠে না তাই চিকিৎসকেরা আগে থেকেই চিকিৎসা শুরু করে দেন। কারণ বাচ্চা এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম হওয়ায় দ্রুত চিকিৎসা না করলে যেকোনো সময় নিউমোনিয়া থেকে বিভিন্ন ধরণের জটিলতা হতে পারে যেমন হার্ট ফেইলর।
নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার করে থাকেন চিকিৎসকেরা এবং পছন্দের অ্যান্টিবায়োটিক হল অ্যামোক্সিসিলিন এবং এইচআইভিতে সংক্রামিত শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস করতে প্রতিদিন অ্যান্টিবায়োটিক কোট্রাইমক্সাজোল দেওয়া হয়। নিউমোনিয়ার চিকিৎসায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুখে খাওয়ার জন্য ঔষধ দেওয়া হয়ে থাকে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসা যাওয়া করে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হয়।
সাধারণত দুই ধরণের নিউমোনিয়া হয়ে থাকে, একটি হলো সাধারণ পর্যায়ের নিউমোনিয়া এবং অন্যটি মারাত্মক পর্যায়ের নিউমোনিয়া। বাচ্চার নিউমোনিয়া যদি মারাত্মক পর্যায়ের হয়ে থাকে তাহলে চিকিৎসা একটু জটিল হয়ে থাকে কারণ এসময় বাচ্চারা মুখে ওষুধ খেতে পারে না বা মুখ দিয়ে খেলেও পেটে রাখা তার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না, বমি করে বের করে দেয়। তাই এইসব বাচ্চাদের হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরামর্শ দিয়ে থাকে চিকিৎসকেরা এবং হাসপাতালে নিয়মিত ইনজেকশন, অ্যান্টিবায়োটিক, অক্সিজেন এসবের মাধ্যমে নিবিড় পরিচর্যার মধ্যে রাখা হয়।
রোগীর পরিস্থিতি যদি সাধারণ পর্যায়ের হয়ে থাকে অর্থাৎ রোগী যদি মুখ দিয়ে খেতে পারে এবং রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হয়, তখন চিকিৎসকেরা রোগীকে মুখে খাওয়ার ঔষধ দিয়ে থাকেন। শিশুদের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক সাসপেশন এবং বড়দের ক্ষেত্রে ট্যাবলেট অথবা ক্যাপস্যুল দেয়া হয়ে থাকে। এসময় সাধারণত এক সপ্তাহ ধরে অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হয়। যেহেতু নিউমোনিয়া আক্রান্ত বাচ্চার সাধারণত জ্বর থাকে তাই অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি কাশি থাকে, অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি প্যারাসিটামলও দেওয়া হয়ে থাকে। নিউমোনিয়ার অন্যতম আরেকটি উপসর্গ হলো কাশি এবং শ্বাসকষ্ট। এটি ভেষজ চিকিৎসা দিয়ে কমানো যেতে পারে। তুলসী পাতার রস এবং মধু কাশি এবং শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য যথেষ্ট কার্যকরী।
সাধারণ অথবা মারাত্মক যেই পর্যায়ের নিউমোনিয়া হোক না কেনো, এসময় রোগীর পুষ্টিকর খাদ্য এবং পানীয় সম্পর্কে অত্যন্ত যত্নবান হতে হবে এবং যেহেতু নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর হার অন্য সব রোগ থেকে অনেক বেশি, তাই যেকোনো ধরণের পরিস্থিতিতেই দ্রুততার সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।
নিউমোনিয়া প্রতিরোধ
অসুস্থ্য হওয়ার পরে চিকিৎসার থেকে নিউমোনিয়া প্রতিরোধে আমাদের মনযোগী হওয়া উচিত কারণ শিশু মৃত্যুহার হ্রাস করার জন্য নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিউমোনিয়া প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে নিউমোকোক্কাস, হাম এবং হুপিং কাশি এর বিরুদ্ধে টিকাদান। পর্যাপ্ত পুষ্টি শিশুর প্রাকৃতিক সুরক্ষা উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি এবং জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শুধু মাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর মাধ্যমে একটি শিশুর পর্যাপ্ত পুষ্টি নির্ধারণ হয়ে থাকে। নিউমোনিয়াকে প্রতিরোধ করতে হলে আমাদের নিম্নলিখিত বিষয় গুলোর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
১. ভ্যাকসিনের মাধ্যমে আমরা নিউমোনিয়া এবং কিছু ধরণের ফ্লু প্রতিরোধ করতে পারি, এর জন্য আপনাকে সবার আগে চিকিৎসকের সাথে কথা বলতে হবে। টিকাদানের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সময়ের সাথেসাথে এই ভ্যাকসিন নেওয়া যাবে। চিকিৎসকরা ২ বছরের কম বয়সী বাচ্চা এবং ২ থেকে ৫ বছর বয়সী শিশু যারা নিউমোনিয়া রোগের বিশেষ ঝুঁকিতে আছে তাদের জন্য নিউমোনিয়া ভ্যাকসিনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
২. শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে নিয়মিত আপনার হাত ধৌত করুন এবং হাত ধৌতকরণে সাবান বা অ্যালকোহল ভিত্তিক স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন।
৩. ধূমপান শ্বাস প্রশ্বাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে আপনার ফুসফুসের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাকে নষ্ট করে দেয়, তাই নিউমোনিয়া প্রতিরোধে আপনাকে ধূমপান মুক্ত থাকতে হবে এবং আপনার শিশু যেনো পরোক্ষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
৪. অপরিণত বা স্বল্প ওজনের শিশুরা পরবর্তীতে খুব সহজেই নানান রোগে আক্রান্ত হতে পারে কারণ অপরিণত বা অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক কম থাকে। তাই গর্ভাবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী মায়েদের যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি সকল প্রকার প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। শিশু জন্ম গ্রহণের পর প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে এবং ৬-২৪ মাস পর্যন্ত বুকের দুধের পাশাপাশি অন্যান্য খাবার খাওয়াতে হবে যাতে করে সে অপুষ্টিতে না ভোগে।
৫. শিশুকে সময়মত সরকারিভাবে প্রদত্ত সবগুলো টিকা দিতে হবে।
বয়ষ্কদের নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন
৬৫ বছর অথবা তার চেয়ে বেশী বয়স্কদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করার জন্য দুই ধরণের ভ্যাকসিন রয়েছে এবং দুইটি ভ্যাকসিনই নিরাপদ এবং কার্যকরী। কিন্তু দুইটি এক সাথে দেওয়া যায় না।
১. নিউমোকোক্কাল পলিস্যাকারাইড ভ্যাকসিন (পিপিএসভি-২৩)
৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক রোগীদের জন্য পিপিএসভি-২৩ ভ্যাকসিনের একটি কোর্স নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
২. নিউমোকোক্কাল কনজুগেট ভ্যাকসিন (পিসিভি-১৩)
৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়স্ক রোগী যারা পিপিএসভি-২৩ এর কোনো ডোজ না পেয়ে থাকেন অথবা তার যদি এমন অবস্থা হয় যা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল করে ফেলে, সেরিব্রোস্পাইনাল তরল বের হয়ে যায়, কোক্লিয়ার ইমপ্লান্ট করার প্রয়োজন পড়ে তখন তাকে পিসিভি-১৩ এর কোর্স দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
যদি চিকিৎসক কখনো দুইটি ভ্যাকসিনই নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন অথবা আপনি নিজে থেকে দুইটি ভ্যাকসিন নিতে চান তাহলে,
-
সবার আগে পিসিভি-১৩ নিতে হবে, এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পিপিএসভি-২৩ নিতে হবে।
-
আপনি যদি আগে থেকেই পিপিএসভি২৩ নিয়ে থাকেন, তাহলে কমপক্ষে ১ বছর অপেক্ষা করতে হবে পিসিভি-১৩ নেওয়ার জন্য।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং ইউনিসেফ (UNICEF) নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ার জন্য একীভূত গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যান (জিএপিপিডি) বাস্তবায়নে কাজ করছে। এর প্রধান লক্ষ্য হলো বাচ্চাদের নিউমোনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধ করা।
চিকিত্সার সাথে নিউমোনিয়া নিয়ন্ত্রণকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে তারা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।
১. শিশুকে নিউমোনিয়া থেকে রক্ষা করতে হলে জন্মের পর অবশ্যই প্রথম ৬ মাস শুধুমাত্র মায়ের বুকের দুধ এবং পরবর্তীতে পর্যাপ্ত পরিপূরক খাদ্য খাওয়াতে হবে।
২. শিশুকে নিয়মিত সবগুলো টিকা দিন, সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার রাখুন, এইচআইভি সংক্রামিত শিশুদের ক্ষেত্রে কোট্রাইমক্সাজোল প্রফাইল্যাক্সিস নিন।
৩. নিউমোনিয়ার চিকিত্সার মাধ্যমে প্রতিটি অসুস্থ শিশুকে সঠিক ধরণের যত্নের ব্যবস্থা করতে হবে যেমন স্বাস্থ্যকর্মী, যেকোন ধরণের স্বাস্থ্যসেবা, তাদের প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক এবং অক্সিজেন যেন পেতে পারে সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশ, ভারত, কেনিয়া, উগান্ডা এবং জাম্বিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশ নিউমোনিয়া এবং ডায়রিয়ার নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা তীব্র করার জন্য জেলা, রাজ্য এবং জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করেছে। আরও অনেকগুলি তাদের জাতীয় শিশু স্বাস্থ্য এবং শিশুদের বেঁচে থাকার কৌশলগুলিতে ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়া নির্দিষ্ট পদক্ষেপের সমন্বিত করেছে। অনেক দেশের ক্ষেত্রে মিলেনিয়াম ডেভলপমেন্ট গোলের এজেন্ডায় স্পষ্টভাবে একটি অগ্রাধিকারের পদক্ষেপ হিসাবে প্রতিরোধযোগ্য ডায়রিয়া এবং নিউমোনিয়ায় মৃত্যুর সমাপ্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।