পাইলস থেকে মুক্তি পেতে কি করবেন?

অর্শ বা পাইলস হলো মলদ্বারের মাংস বৃদ্ধি পাওয়ার রোগ। স্বাভাবিক ভাবেই রোগটি বেশ অস্বস্তিকর ও কিছু ক্ষেত্রে যন্ত্রণাদায়ক। যদি প্রথমিক অবস্থায় সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, তবে অপারেশন এমনকি ডাক্তারের কাছেও যাবার প্রয়োজন নাও পড়তে পারে। পাইলস রোগটি যতই পুরোনো হয় এর জটিলতা ও নিরাময় তত কঠিন হতে থাকে। তাই আর দেরি না করে চলুন জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিত।

ব্যবসায়ী ‘বাবুল’ সাহেব লম্বা সময় ধরে পাইলসের সমস্যায় ভুগছেন। বহুদিন এই অসুখের বিড়ম্বনা সহ্য করার পরও সেরে যাবার কোন নাম গন্ধ নেই, বরং যেন আরও বেড়ে চলেছে। আর এদিকে লজ্জায় এ বিষয়ে কারো সাথে কথাও বলেন নি, ডাক্তারও দেখাননি। অনেক আগে একবার এলাকায় পোস্টার দেখে আজীবন গেরান্টি ওয়ালা চিকিৎসা করিয়েছেন, তবে সেই "আজীবন" এর মেয়াদ মাত্র সপ্তাহ খানিকে এসে ঠেকেছিলো। এরপর সাহস করে তার এক বন্ধু কাছে বিষয়টি জানালে, তিনি 'বাবুল' সাহেব কে কলোরেক্টাল সার্জন এর কাছে সুপারিশ করেন। ডাক্তারের কাছে যাবার পর, ডাক্তার অপারেশন এর কথা বলেন। ডাক্তার জানান, আগে দেখা করলে হয়ত অপারেশন পর্যন্তও যাওয়া লাগতো না। শেষমেশ ছোট্ট একটা অপারেশন এর পর অল্প দিনের ভিতরে 'বাবুল' সাহেব স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন। পাইলস হোক বা অন্য যেকোনো রোগ, প্রথমে একটু ঝামেলা মনে হলেও, শুরুর দিকেই চিকিৎসা ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ-ই পরবর্তীতে দীর্ঘমেয়াদী ও জটিলতর সমস্যা থেকে বাঁচাতে পারে।

পাইলস কি? কেন হয়?

পায়খানার রাস্তায় মাংসপেশির অস্বাভাবিক বৃদ্ধিই হলো পাইলস বা অর্শ। পাইলস হলে মলত্যাগের সময় ব্যথা হওয়া, রক্ত আসা, মলদ্বারের শেষপ্রান্তে গোটার মত বা আরও বড় মাংসপেশির বৃদ্ধি লক্ষ করা যায়।

আমাদের পায়ুপথের শেষ প্রান্তে এক জাতীয় পেশি থাকে যার নাম হলো এনাল কুশন। এনাল কুশনের কাজ হলো পায়পথের রাস্তাটি বন্ধ রাখা ও প্রয়োজনে খুলে গিয়ে মলত্যাগে সহায়তা করা। এই এনাল কুশন তিনটি ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত। এই তিনটি অংশের কোনটি বা সবগুলো যদি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় তাহলে পাইলস হয়েছে বলা হয়। সাধারণত পাইলস ব্যথা হীন হয়ে থাকে, তবে অনেক সময় মাঝারি  থেকে তীব্র ব্যথা হতে পারে।

পাইলসের উপসর্গ সমূহ

পাইলসের উপসর্গ বিভিন্ন রকমভেদ হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে কয়েকটি উপসর্গ দেখা দিতেও পারে নাও দিতে পারে। 

  • মলদ্বার থেকে তাজা রক্ত পড়া

সাধারণত টিস্যু পেপার, বা প্যানের গায়ে উজ্জল লাল রক্ত দেখা যায়। সবক্ষেত্রে রক্ত পড়বে এমন না, তবে রক্তপড়া পাইলসের লক্ষন হতে পারে। রক্ত যদি লাল না হয়ে গাঢ় খয়েরী রঙের হয় তাহলে বুঝতে হবে তা পাইলসের জন্য হয়নি, অন্য জটিলতা থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের শরনাপন্ন হওয়া উচিৎ।

  • এনাল কুশন ফুলে পায়ুপথ দিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে

তখন পায়ুপথে বাড়তি গোটার মত নরম অংশ টের পাওয়া যায়। এই বাড়ন্ত অংশটি বাড়তে বাড়তে আঙুলের মত বড় হয়ে যেতে পারে, কিংবা মলত্যাগের সময় বের হয়ে আসতে পারে। পাইলসের অংশটি একাই ঢুকে যেতে পারে বা হাত দিয়েও ঢোকানো লাগতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এনাল কুশন এত বড় হয়ে যেতে দেখা যায়, যা আর ভেতরে যাবার অবস্থায় থাকে না, যদিও এটি অপেক্ষাকৃত বিরল।

  • পায়ুপথে ব্যথা হতে পারে

যদিও সবক্ষেত্রে ব্যথা হতে দেখা যায় না। যদি পায়ুপথের বাইরে এনাল কুশনের স্ফিত অংশ বের হয়ে থাকে ও তাতে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ব্যথা হতে পারে। এ ব্যথা সাধারণত ১-২ দিন স্থায়ী হতে পারে। ব্যথা তীব্র হলে একজন কলোরেক্টাল ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কিছু ঘরোয়া পদ্ধতিতেও ব্যথা উপশম করা যায়, প্রবন্ধটির পরবর্তী অংশে সে বিষয়ে জানতে পারবেন।

  • পায়ুপথে চুলকানী হতে পারে

  • পায়ুপথ থেকে শ্লেষ্মা জাতীয় পদার্থ বের হতে পারে

  • পায়খানার পরও পেট পরিষ্কার হয়নি এমন অনুভূত হতে পারে

পাইলসের চিকিৎসা

পাইলস জটিল কোন রোগ নয়। সুস্থ জীবন পদ্ধতি পাইলস এর জটিলতা অনেকাংশে কমিয়ে দিতে পারে। তাছাড়া পাইলস হলে কিছু পদ্ধতি অবলম্বন বেশ উপকারে আসে। একটা বিষয়, পাইলস এর মত রোগ নিয়ে প্রায় সব মানুষই শারিরীক সমস্যার সাথে সাথে মানসিক ভাবেও বেশ অস্বস্তিতে থাকেন। অন্য রোগ হলে দেখা যায়, দিন দুএক পরে হলেও ডাক্তার এর কাছে যাবেন, কিন্তু পাইলস বা এজাতীয় রোগীদের মধ্যে একটু কষ্ট করে হলেও ডাক্তার দেখানো এড়িয়ে চলার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু একটা জিনিস ভেবে দেখুন, বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা তাদের কর্ম জীবন উৎসর্গ করেন এসব রোগীদের জন্য। তাদের পড়ালেখা, বড় বড় ডিগ্রি, কর্মজীবন শুধু আপনার রোগ নিরাময় এর জন্য উৎসর্গীত, এবং তিনি সারাজীবন একই কাজ করবেন। তাই প্রয়োজন বোধ করলে লজ্জা ঝেঁড়ে ফেলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াতে দ্বিধা করা বোকামী। তবুও যেহেতু ঘরোয়া চিকিৎসা বেশ কাজে দেয় ও পাঠকের চাহিদাও তাই, সেজন্য ঘরোয়া চিকিৎসা অংশটিকে গুরুত্ব দেওয়া হলো। মনে রাখবেন, ঘরোয়া চিকিৎসায় যদি ৭ দিনে কোন উন্নতি না হয়, তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। 

ইশপ গুলের ভুষি

ইশবগুলের ভুষি এ রোগের সবচেয়ে কার্যকর ও বহুল ব্যবহৃত ঔষধ। পাইলস দূর করার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করা। ইসবগুলের ভুষি কোষ্ঠকাঠিন্যতে উপকারী। মনে রাখবেন এটি সাধারণ শরবত নয়, এটি একটি ঔষধ যা ঠিকমতো কাজ করতে সঠিক উপায়ে গ্রহণ করতে হবে কারণ এতে পার্শপ্রতিক্রিয়াও বিদ্যমান। ইসবগুলের ভুষি গ্রহনের নিয়ম-

  • প্যাকেটের গায়ে উল্লেখিত পরিমান ইশবগুলের ভুষি পরিমানমতো পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে যেন শরবতটির রং ইশৎ ঘোলাটে ও পরিষ্কার হয়।

  • শরবতটি প্রস্তুত করার সাথে সাথে খেয়ে ফেলতে হবে।

  • দিনে দুই বার ইসবগুলের ভুষি খেতে হবে এবং খাবার গ্রহণের পর খেতে হবে। তবে ঘুমানোর আগে খাওয়া যাবে না।

  • দিনে অন্তত দুই লিটার পানি পান করতে হবে, অন্যথায় ইশবগুলের ভুষি পেটের নাড়িভুড়ির মুখ আটকে খুব বাজে পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এমন হলে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।

রাতে ঘুমানোর আগে, পেটে ব্যথা বা বমি ভাব হলে কিংবা যদি কয়েকদিন মলত্যাগ না হয় তাহলে ইশবগুলের ভুষি গ্রহণ করা উচিৎ নয়। একটানা দু - তিন দিনের বেশি ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ইশব গুলের ভূষি খাওয়া উচিৎ নয়।

ব্যথানাশক ঔষধ

পাইলসের ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে। তবে কিছু কিছু ব্যথানাশক ঔষধ পাইলসের ব্যথায় ব্যাবহার সম্পুর্ণ নিষেধ। যেমন, ট্রামাডল ও আইবুপ্রোফেন।

পাইলসের ব্যথা অস্বস্তি ও নিরাময়ে নিন্মক্ত পদক্ষেপ গুলো নিতে পারেন-

  • দিনে তিনবার পাইলসের জায়গাটা কুসুম গরম পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে পারেন। এক্ষেত্রে একটি বড় গামলার কুসুম পানিতে পটাশিয়াম পারমম্যাগনানেট এর এক চিমটি মিশিয়ে তার উপর বসে থাকলে উপকার পাবেন অথবা শুধু লবনও দিতে পারেন।

  • কাপড়ে বরফ পেঁচিয়ে পায়ুপথের গোটাগুলোর উপর লাগাতে পারেন। 

  • পায়ুপথ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও শুষ্ক রাখবেন।

  • পায়খানা চেপে রাখবেন না বা খুব বেশি জোর দিয়ে পায়খানা করবেন না।

  • লম্বা সময় ধরে মলত্যাগ করবেন না।

খাদ্যাভাস ও লাইফস্টাইল

খাদ্যাভাস ও লাইফস্টাইল পাইলস এর সমস্যা নিয়ন্ত্রণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। 

  • প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।

  • প্রচুর পানি পান করতে হবে।

  • দৈনিক একটু হলেও শারীরিক পরিশ্রম করতে হবে। খু্ব ভারী কিছুর প্রয়োজন নেই, সামান্য ২০-৩০ মিনিট হাঁটাও কোষ্ঠকাঠিন্য জনিত সমস্যা দূর করতে উপকারী।

এই তিনটি জিনিস মেনে চললে কয়েকদিনের ভেতরে কোষ্টকাঠিন্য দূর হয় ও কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পাইলসের সমস্যা নিয়ন্ত্রণে আসে।

কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

  • একটানা ৭ দিন বাসায় চিকিৎসার পরও উন্নতি না হলে। বা বারবার পাইলসের সমস্যা হলে।

  • বয়স ৫৫ এর বেশি হয় ও প্রথমবার পাইলস দেখে দেয়।

  • পাইলস থেকে পুঁজ বের হতে থাকে।

  • যদি খুব জ্বর ও কাঁপুনি হয়।

  • যদি প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়।

  • যদি তীব্র ব্যাথা হয়।

  • যদি পায়খানা গাঢ় কালো রঙের হয়ে থাকে।

কোন ডাক্তারের কাছে যাবেন?

মনে রাখবেন, পাইলস এর যে কোন ধরনের চিকিৎসা করতে একজন সার্টিফাইড ডাক্তার প্রয়োজন, যাকে MBBS পাশ করার পরও পায়ুপথের রোগের উপরে বিশেষ ডিগ্রি নিতে হয়। কোন ভাবেই সার্টিফিকেশন ছাড়া কোন পোস্টার, বিজ্ঞাপন দেখে হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যাবেন না। পাইলসের সমস্যার জন্য একমাত্র কলোরেক্টাল বিশেষজ্ঞ ডাক্তার শতভাগ নিশ্চিত ভাবে সঠিক চিকিৎসা দিতে পারেন। 

পাইলস নিয়ে সাধারণ কিছু প্রশ্ন

১) কখন পাইলসের অপারেশন প্রয়োজন?

রোগীর অবস্থা গভীর পর্যায়ে পৌছালে অপারেশনের প্রয়োজন হয়। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরে নির্ধারণ করবেন অপারেশন প্রয়োজন কি না।

২) অপারেশনে কাটাছেড়ার প্রয়োজন হয় কি? লংগো অপারেশন কি?

সব অপারেশনে কাটাছেড়ার প্রয়োজন হয় না। আর এখন খুবই ভাল অপারেশনে বা সার্জারী সম্ভব। কোন ধরনের দৃশ্যমান কাটাছেড়া ছাড়াই মেশিনের মাধ্যমে পাইলস সার্জারী সম্ভব। একে “লংগো” ( LONGO) অপারেশন বলা হয়। এর রেজাল্টও ভালো। আগে পাইলস সার্জারীর পর ঘা শুকাতে দেড় থেকে দুই মাস লাগতো, এখন এসবের কোন ঝামেলাই নাই। অপারেশনের পর রোগী দ্রুত সেরে উঠে এবং কাজে যোগ দিতে পারেন।

৩) পাইলসের অপারেশনের খরচ কেমন?

পাইলসের অপারেশনের রকমভেদ আছে, তাছাড়া হাসপাতাল ভেদেও খরচ ভিন্ন। সরকারী হাসপাতালে ‘লংগো’ অপারেশনে ৫০-৬০ হাজার ও ‘ডায়টমি’ অপারেশনে ১০-১২ হাজার খরচ হয়। অবস্থা ভেদে অনেক সময় লাখ টাকাও চলে যেতে পারে। লংগো অপারেশনের ১-২ দিনের ভেতরই বাড়ি চলে যেতে পারবেন।

৪) পাইলসের অপারেশনের পর কি আবার দেখা দেবার সুযোগ আছে?

সঠিকভাবে চিকিৎসা হলে পাইলস একেবারে সেরে যায়।

 

পাইলস জটিল রোগ নয় তবে এর কারনে ভেগান্তি প্রায় অসীম। সেই সাথে লজ্জা দ্বিধাও মানসিক অবসাদের কারণ হয়ে থাকে। আমাদের শরীরে কোন অঙ্গই অপ্রয়োজনীয় নয়, তাই যেকোনো রোগব্যাধিই সঠিক সময়ে সারিয়ে তোলাটাই হলো বুদ্ধিমানের কাজ।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles