করোনাভাইরাস আমাদের শরীরে কিভাবে কাজ করে?
কি এই করোনাভাইরাস? কিভাবে কাজ করে আমাদের শরীরে? করোনাভাইরাস ফুস্ফুসে কিভাবে আক্রমন করে? আসুন জেনে নেয়া যাক।
বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়ের নাম করোনাভাইরাস। মাত্র কয়েকমাস আগে ডিসেম্বর,২০১৯-এ চায়নার উহান শহরে প্রথম এই ভাইরাসের আবির্ভাব লক্ষ করা হয়। অথচ এত অল্প সময়ে এই ভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে পুরো বিশ্বের প্রায় ২০০ টি দেশে। বিশ্বব্যাপী এর প্রাদুর্ভাব ও দ্রুত বিস্তারের কারনে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে আতঙ্ক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ব্যাধিটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে।
করোনাভাইরাস কিভাবে কাজ করে আমাদের শরীরে?
করোনাভাইরাস হচ্ছে এক শ্রেণীর ভাইরাস যেটা মানুষের শ্বাসনালীর সংক্রমন ঘটায়। প্রথম অবস্থায় মৃদু জ্বর, শুকনো কাশি, গলা ব্যথা, ইত্যাদি হয়ে থাকে। সংক্রমন তীব্র হলে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় এমনকি ফুসফুস তার স্বাভাবিক কাজ করা বন্ধ করে দেয় যার ফলে অনেকের মৃত্যুও ঘটে থাকে। এই ভাইরাস মানুষের হাচি-কাশির মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে।
আমরা জানি করোনাভাইরাস আমাদের শরীরে মুখ, নাক, চোখ এবং কান দিয়ে প্রবেশ করতে পারে। প্রথমেই করোনাভাইরাস গলার অভ্যন্তরীণ শ্বাসনালীর আস্তরণের কোষগুলোকে আক্রমণ করে। পরবর্তীতে যে পথ দিয়ে বাতাস ফুসফুসে যাওয়া আসা করে সেই পথ এবং ফুসফুসের দিকে করোনাভাইরাস অগ্রসর হয়।
প্রথম অবস্থায় কোন লক্ষণ বা উপসর্গ ছাড়াই করোনাভাইরাস শরীরে অবস্থান করতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম লক্ষণ দেখা যায় ৫ দিনে তবে সেটা ১৪ দিন পর্যন্ত সময়ও লাগতে পারে। এই সময়কালকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড বলে অর্থাৎ ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পর থেকে প্রথম উপসর্গ দেখার সময়কাল।
প্রথম উপসর্গ হিসেবে জ্বর এবং শুকনো কাশি হয়। অনেকের ক্ষেত্রে শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা এবং মাথা ব্যথাও হতে পারে তবে জ্বর এবং শুকনো কাশি সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। পরবর্তীতে কাশির সাথে ঘন কফও বের হয়। মুলত কফ হচ্ছে ভাইরাসের আক্রমণে সৃষ্ট ফুসফুসের মৃত ত্বক। এ অবস্থায় আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যদি ভালো থাকে তাহলে এক সপ্তাহে হয়ত করোনাভাইরাসের বিপক্ষে জয়ী হওয়া সম্ভব। সুতরাং শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরী।
শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে ভাইরাসের প্রতিক্রিয়ায় ফুসফুসে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহ হয়। এখন এই ইনফ্লামেশন কি? সোজা বাংলায় যদি বলি- আমাদের হাতে যদি গরম পানি পড়ে তাহলে দেখা যায় হাতের ওই নির্দিষ্ট জায়গা ফুলে যায়, পানি জমে, লাল হয়ে যায় এবং জ্বালা পোড়া করে। এই ঘটনাকেই ইনফ্লামেশন বলা হয়।
করোনাভাইরাস দ্বারা ইনফ্লামেশনের কারণে বিন্দু বায়ুকনা ফুসফুসে আটকে থাকে এবং পানি দ্বারা পূর্ণ হয়। এ সময় শ্বাস-প্রশাস নিতে কষ্ট হয় এবং দম কমে যায়। এই দ্বিতীয় ধাপে অনেকের ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র) লাগে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখার জন্য।
যারা বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা একদমই দুর্বল এবং বয়স্ক তাদের ক্ষেত্রে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সংকটপূর্ণ অবস্থা হতে পারে। এ অবস্থায় শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা করোনাভাইরাসের বিপক্ষে লড়াই করা ছেড়ে দেয়। ফুসফুসে ইনফ্লামেশন অধিক হারে বেড়ে যায় যার ফলে ফুস্ফুস ঠিক মতো কাজ করতে পারে না। ফুস্ফুসের প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অক্সিজেন সরবারহ করা। ফুস্ফুস মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হওয়ায় শরীরের অঙ্গগুলো পর্যাপ্ত অক্সিজেন পেতে ব্যর্থ হয়, অঙ্গগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়, কিডনি রক্তকে পরিষ্কার করা বন্ধ করে দেয়, ইনটেঁসটাইন বা অন্ত্র এবং অন্ত্রের আস্তরণের ক্ষতি সাধন হয়, রক্তচাপ মারাত্তকভাবে কমে যায়। একটা পর্যায়ে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা হার মানে এবং করোনাভাইরাস বিজয়ী হয়।
আসুন এবার সংক্ষিপ্ত ভাবে জেনে নেয়া যাক করোনাভাইরাস ফুস্ফুসে কিভাবে আক্রমন করে?
ফুস্ফুস এপিথেলিয়াল কোষ দ্বারা গঠিত। করোনাভাইরাস এপিথেলিয়াল কোষের নির্দিষ্ট রিসিপটরে সংযুক্ত হয় এবং কোষের ভিতরে তার জেনেটিক উপাদান ছেড়ে দেয়। ফুস্ফুসের কোষের ভিতরে করোনাভাইরাসের এই জেনেটিক উপাদানের নির্দেশে অনুলিপি তৈরি হয় এবং পূর্ণবিন্যাস হতে থাকে। সময়ের সাথে কোষের ভিতরে অসংখ্য অনুলিপি তৈরি হয় এবং একসময় ফুস্ফুসের এপিথেলিয়াল কোষের আবরণ গলে গিয়ে ভাইরাসের অনুলিপিগুলো মুক্ত হয় এবং আশেপাশের আরও অনেক কোষকে আক্রান্ত করতে থাকে। এভাবে ফুস্ফুসে আক্রান্ত কোষের সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং হাজার হাজার ভাইরাস অনুলিপির সৃষ্টি হয়। এই ঘটনার শুরুতে অথবা শেষের দিকে প্রথম উপসর্গ হিসেবে জ্বর এবং শুকনো কাশি হয়ে থাকে।
ফুস্ফুসে ভাইরাসের উপস্থিতি টের পেয়ে আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো ভাইরাসগুলোকে আক্রমণ করে। আমাদের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী হলে রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো ভাইরাসগুলোকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। আর যদি আমাদের রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে থাকে তবেই ঘটে বিপত্তি। এ অবস্থায় উল্টো ভাইরাসগুলোই রোগ প্রতিরোধক কোষগুলোকে আক্রমণ করে। ফলে রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো ভাইরাসের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং প্রচুর পরিমাণ রোগ প্রতিরোধক কোষ ভাইরাসকে আক্রমন করে। সমস্যা হচ্ছে রোগ প্রতিরোধক কোষগুলো সংক্রমিত কোষের পাশাপাশি সুস্থ কোষকেও আক্রমন করে। এতে করে ফুস্ফুসের ক্ষতি হতে থাকে। এ সময় উপসর্গ হিসেবে কাশির সাথে কফ আসে।
ভাইরাসের আক্রমণ যদি অধিক হারে হতে থাকে এবং ফুস্ফুসের লক্ষ লক্ষ এপিথেলিয়াল কোষ আক্রান্ত হয় তবেই শুরু হয় মূল ঝামেলা। এ অবস্থায় ফুস্ফুসের রক্ষাকারী আস্তরণ বা মেমব্রেন এবং এলভিওলাইকে ভাইরাস আক্রান্ত করে। ফুস্ফুসের এলভিওলাই যার মধ্যে বিন্দু বায়ুকনা থাকে এবং অক্সিজেন আসা যাওয়া করে সেটা আক্রান্ত হবার কারণে শ্বাস কষ্ট শুরু হয় এবং অনেক সময় কৃত্রিম শ্বাসের দরকার পড়ে।
বিভিন্ন শারীরিক রোগ অথবা দুর্বলতার কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা যদি ভাইরাসের সাথে পেড়ে না উঠে তাহলে একসময় ফুস্ফুসের কার্যকারিতা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায় এবং এ সময় মৃত্যু অনেকটাই নিশ্চিত হয়ে পড়ে।
আমাদের উচিত হবে শুকনো কাশি এবং জ্বর দেখা দিলে সাবধান হয়ে যাওয়া, নিজেদেরকে আলাদা করে রাখা। আর যদি ৭ দিনের মধ্যে অবস্থার উন্নতি না হয় বরং কাশির সাথে কফ আসা শুরু হয় বা শ্বাস কষ্ট হয় তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া।
কোনও উপসর্গ না থাকলেও করোনাভাইরাসের বিপক্ষে যেসব প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হচ্ছে সেগুলো যথাযথভাবে পালন করতে হবে, অন্যকে উৎসাহিত করতে হবে এবং শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। যেহেতু করোনাভাইরাসের “কমিউনিটি ট্রান্সমিশন” হয় অর্থাৎ উৎস সম্পর্কে অজ্ঞাত থাকা অবস্থায় একজন থেকে আরেকজনের মধ্যে ছড়াতে পারে সুতরাং প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না এবং যেকোন ধরনের জন সমাবেশ এড়িয়ে চলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনও ভ্যাক্সিন বা ঔষধ বের হয়নি সেক্ষেত্রে একমাত্র সচেতনতাই হতে পারে করোনাভাইরাস প্রতিরোধের মাধ্যম।