দ্রুত পেটের গ্যাস কমানোর উপায় কি? জেনে নিন ১০ টি টিপস!

গ্যাসের সমস্যা বাংলাদেশের একটি জাতীয় সমস্যা। আমাদের খাদ্যাভাস এবং জীবনযাত্রা এর জন্য অনেকটা দায়ী। আমারা যদি জানি যে কোন কোন খাবার খেলে গ্যাস সৃষ্টি হয়, গ্যাস থেকে আমরা কিভাবে মুক্তি পেতে পারি এবং গ্যাস প্রতিরোধে আমাদের করণীয় কি হবে তবে সহজেই গ্যাসের সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পারি।

গ্যাস কি স্বাভাবিক?

গ্যাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের হজমের একটি স্বাভাবিক অংশ। প্রতিদিন ১৩ থেকে ২১ বার গ্যাস নির্গত হওয়া আমাদের শরীরের স্বাভাবিক কার্যাকালাপের অন্তর্ভুক্ত।  তবে এই গ্যাস আটকা পড়ে বা ভালভাবে চলাচল করতে ব্যর্থ হলে বুকে কিংবা তলপেটে ধারালো ছুরাঘাতের মতো অনুভূত হয়। 

আপনি যখন কোনও খাবার বা পানীয় গ্রহণ করেন, তখন আপনার খাবারটি আপনার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল (জিআই) ট্র্যাক্টের মধ্য দিয়ে যায়। আপনার জিআই ট্র্যাক্টটি আপনার মুখ, খাদ্যনালী, পেট, ছোট অন্ত্র, বৃহৎ অন্ত্র (যার মধ্যে কোলন এবং মলদ্বার অন্তর্ভুক্ত) এবং মলদ্বার নিয়ে গঠিত। যেহেতু আপনি খাওয়া, পান করা, কথা বলা ইত্যাদি কাজের সাথে দেহের ভেতর বায়ু  নিয়ে আসেন, সেই বায়ুটি আপনার জিআই ট্র্যাক্টের মধ্য দিয়েও যেতে হয়। এটি আপনার দেহের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে একাধিক আপত্তিজনক  লক্ষণ দেখা দেয়। এদের মধ্যে রয়েছে-

  • ঢেকুর ওঠা

  • গ্যাস নির্গমন

  • পেট ফুলে যাওয়া

  • পেটে ব্যথা

অতিরিক্ত গ্যাসের কারণসমূহ

প্রায়শই দেখা যায়, আপনি যা খাচ্ছেন তার ফলেই আপনার গ্যাস তৈরি হচ্ছে। খাবারগুলি প্রথমে আপনার ক্ষুদ্র অন্ত্রের মধ্যে হজম হয়। আর অবশিষ্ট যেগুলি হজম হয়নি তা আপনার দেহের কোলনের মধ্যে ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাক এবং ইষ্টের সাথে ফার্মেন্টেড বা গাঁজান হয়। এই প্রক্রিয়ায় মিথেন এবং হাইড্রোজেন উৎপাদন হয়, যা ফ্ল্যাটাস  বা গ্যাস হিসাবে বের হয়ে যায়।

বেশীরভাগ লোকেরাই তাদের খাদ্যাভাস পরিবর্তন করতে পারলে গ্যাস সম্পর্কিত উপসর্গগুলি হ্রাস করতে পারে। এর জন্য কোন খাবারগুলি আপনাকে গ্যাসের পরিমাণ বাড়িয়ে দিচ্ছে তা একটি খাবার ডায়েরিতে লিখে রাখা শ্রেয়। 

যে খাবারগুলি আপনার গ্যাস বাড়িয়ে দেয়-

  • উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাদ্য যেমন বিভিন্ন ধরণের বীন, সবজি, ফলমূল, আস্ত শস্যদানা আপনার গ্যাস উৎপাদনের কারণ। যদিও উচ্চ ফাইবারযুক্ত খাবারগুলি গ্যাসের উৎপাদন বাড়ায়, তবে আপনার পরিপাকতন্ত্র শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখতে এবং রক্তে শর্করার এবং কোলেস্টেরলের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এইসব ফাইবার অপরিহার্য।

  • তেলে ভাজাপোড়া খাদ্য যেমন বিভিন্ন প্রকার স্ন্যাক্স, পিঁয়াজু, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস ইত্যাদি খাওয়ার ফলেও দেহে অতিরিক্ত গ্যাস হতে পারে।

  • ডালজাত্য খাদ্য এবং বিভিন্ন প্রকার ডাল খাওয়ার ফলেও গ্যাসের প্রভাব দেখা দেয়।

  • যেসব খাদ্যে ল্যাক্টোজ রয়েছে যেমন দুধ, পনির সহ বিভিন্ন ডেইরি প্রোডাক্ট খাওয়ার ফলে গ্যাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়।

  • অত্যাধিক খাওয়ার কারণে দেহে গ্যাস জমা হতে পারে।

  • খাওয়া বা পান করার সময় বায়ু গিলে ফেলার কারণে পেটে ফোলাভাব দেখা দিতে পারে। খাওয়ার সময় কথা বলার কারণে এইরকম হতে পারে।

  • চুইং গাম খাওয়ার ফলে অনেক সময় গ্যাসের সমস্যা দেখা দেয়।

  • ধূমপান কিংবা তামাক চিবানোর কারণেও অত্যাধিক গ্যাস দেহে জমা হতে পারে।

  • অনেক সময় বিভিন্ন শারীরিক অবস্থা আপনার পাচনতন্ত্রকে প্রভাবিত করে, যেমন ইনফ্লামেটরি বাউয়েল সিন্ড্রোম, আলসারেটিভ কোলাইটিস, বা ক্রোহনের রোগ, বা ছোট্ট অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ালীর অত্যধিক বৃদ্ধি। এসবের কারণে গ্যাস অত্যাথিক মাত্রায় তৈরি হতে পারে।

গ্যাস এবং তার উপসর্গগুলি থেকে আমরা কিভাবে মুক্তি পেতে পারি?

আটকে থাকা গ্যাসের কিছু সহজ প্রতিকার যার জন্য আপনাকে কোন ডাক্তারের শরণাপ্রার্থী হওয়ার প্রয়োজন নেই যা হোম  রেমেডিস নামে পরিচিত। যেমন-

১) গ্যাস আসার সাথে সাথে বের করে দেওয়া

গ্যাস ধরে রাখলে অস্বস্তি এবং পেট ব্যথা বা ফোলাভাব হতে পারে। এই লক্ষণগুলি এড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হল সহজভাবে গ্যাস ছাড়তে দেওয়া। আপনি যদি নিশ্চিত হন যে আপনার লক্ষণগুলি অবশ্যই আটকা পড়ে থাকা গ্যাসের সাথে সম্পর্কিত তাহলে কোনও প্রাইভেট জায়গায় বা বাথরুমে যান এবং নিজেকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করুন। মনে রাখবেন, আপনার সিস্টেমে যত কম গ্যাস থাকবে ততই আপনার ব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা কম হবে।

২) ইন্টেসটাইন বা অন্ত্রের যত্ন নিন  

আমাদের বাউয়েল মুভমেন্ট বা অন্ত্রের আন্দোলন খুবই জরুরি। নিজের বাড়িতে আরাম না পাওয়া পর্যন্ত মলত্যাগের অপেক্ষা করবেন না। এটি খুবি জরুরী কারণ আপনি যখন আপনার বৃহৎ অন্ত্রের পেশীগুলির গতিবেগকে ত্বরান্বিত করবেন, তা গ্যাসকে আপনার সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করবে।

৩) হাঁটাচলা করা

পেটে গ্যাস জমলে ঘরের মধ্যে কিংবা আশেপাশে হাঁটলে দারুণ সুফল পাওয়া যায়। এই চলাচলের ফলে মূলত গ্যাস নির্গমনে সহয়তা হয়।

৪) ম্যাসাজ করা

অনেক সময় ব্যাথার স্থানে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে ম্যাসাজ করলেও ব্যাথা কমে থাকে, যদিও খুব সতর্কতার সাথে এই ম্যাসাজ করা উচিত।

৫) ব্যয়াম করা

বিভিন্ন ব্যয়ামের মাধ্যমে দেহে উৎপাদিত অতিরিক্ত গ্যাসকে বের করে দেওয়া সম্ভব। হাঁটাচলার সাথে সাথে বিভিন্ন ব্যয়াম যেমন দৌড়ানো, দড়ি লাফ ইত্যদি আপনাকে গ্যাস ত্যাগে সহায়তা করতে পারে।

৬) বিভিন্ন চা সেবন

গরম পানি কিংবা পেপারমিন্ট টি, ক্যামোমাইল টি, আদা চা প্রভৃতি সেবনের ফলে ব্যাথা থেকে উপশম পাওয়া যায়। দুপুরে এবং রাতে খাবার পূর্বে ক্যামোমাইলের চা  সেবনের ফলে পেটে আটকে থাকা গ্যাস, কিংবা ফেঁপে থাকা পেটের যন্ত্রণা থেকে খুব তাড়াতাড়ি মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তাই এই চা সেবনের অভ্যাস করুন।

৭) অ্যাপেল সিডার ভিনিগার

এক টেবিল চামচ আপেল সিডার ভিনেগারকে চা অথবা পানিতে মিশিয়ে পাতলা করে নিন। মিশ্রণটি দিনে তিনবার খাবার আগে খাবেন যতদিন না আপনার উপসর্গগুলো কমে যায়। 

৮) লবঙ্গ বা লবঙ্গের তেল

লবঙ্গ এবং লবঙ্গ তেল হজমের জন্য এনজাইম উৎপাদন করে যা পেটের ফোলাভাব এবং গ্যাস হ্রাস করতে সহায়তা করে। প্রায় ২৫০ মিলি পানিতে দুই থেকে পাঁচ ফোঁটা লবঙ্গ তেল মিশ্রিত করুন। এটি খাওয়ার পরে পান করলে দারুণ উপকার পাওয়া সম্ভব।

৯) সিমেথিকোন জাতীয় ঔষুধ

সিমেথিকোন একটি ওভার-দ্য কাউন্টার (ওটিসি) ওষুধ যা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিভিন্ন নামে পাওয়া যায়। সিমেথিকোন আপনার পেটে গ্যাস বুদবুদগুলি একীকরণ করে কাজ করে, যাতে সহজে গ্যসগুলি বের হয়ে যায়। অনুগ্রহ করে ডোজিং নির্দেশাবলী অনুসরণ করুন, এবং যদি আপনি অন্য ওষুধ গ্রহণ করেন বা গর্ভবতী হন তবে আপনার ডাক্তারের সাথে এই ওষুধটি নিয়ে আলোচনা করে নিন।

১০) ডীপ ডায়াফ্রেমেটিক শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ

ডীপ ডায়াফ্রেমেটিক বা গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস পেটের ব্যথা বা গ্যাস কমিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারে, তবে এটি  শুধুমাত্র সম্ভব আপনি যদি নিয়মিতভাবে অনুশীলন করে থাকেন । যেহেতু স্ট্রেস কমানোর জন্য এই জাতীয় শ্বাস প্রশ্বাসের কার্যকর, তাই সময় করে  এটি শেখা উচিত। 

গ্যাস প্রতিরোধে আমাদের করণীয়

আমাদের দেহে উৎপাদিত অতিরিক্ত গ্যাসসমূহ রোধে শুধু খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনলেই চলবে না। সেইসাথে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যেমন-

  • খাবারের সময় বসে খেতে হবে এবং আস্তে আস্তে চিবুতে হবে।

  • যখন খাবার খাবেন এবং কথা বলার সময় খুব বেশি বাতাস না নেওয়ার চেষ্টা করুন।

  • চিউইং গাম বন্ধ করুন।

  • সোডা এবং অন্যান্য কার্বনেটেড পানীয় এড়িয়ে চলুন।

  • ধূমপান কিংবা তামাকের গুড়া এড়িয়ে চলুন।

  • নিয়মিত শরীরচর্চা করুন, যেমন খাওয়ার পরে হাঁটাচলা করা।

  • স্ট্র- এর মাধ্যমে পানি কিংবা যেকোন পানীয় পান করা থেকে বিরত থাকুন। 

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

আপনার গ্যাস বা গ্যাসের ব্যথা যদি মারাত্মক হয় তবে দেরি না করে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন। অনেক সময় রক্তাক্ত মল বা পায়খানা, মলের ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন, বারংবার মল ত্যাগের সময় পরিবর্তন, কোষ্ঠকাঠিন্য বা ডায়রিয়া, অবিরাম বা বারবার বমি বমি ভাব দেখা দিলে অবশ্যই উচিত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। দীর্ঘক্ষণ পেটে ব্যথা কিংবা বুকে ব্যাথা দেখা দিলেও অবিলম্বে ডাক্তারের শরণাপ্রার্থী হতে হবে।

 

পরিশেষে, গ্যাস আপনার জন্য বেদনাদায়ক হতে পারে তবে সাধারণত এটি বিপজ্জনক নয়। যদি গ্যাসের ব্যথা বা ফোলাভাব আপনার জন্য সমস্যার কারণ অয়ে দাঁড়ায় তবে আপনার খাদ্যাভাস এবং জীবনযাত্রার দিকে নজর দিতে হবে। উপরে উল্লেখিত নিয়মকানুন মেনে চললে অনেকটাই রেহাই পাওয়া সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় খাদ্যাভাস এবং জীবনযাত্রার পরিবর্তন গ্যাসের সমস্যা থেকে আপনাকে পুরোপুরি নিরাময় এনে দিতে পারে।

Default user image

নুসফাক মাহমুদ, লেখক, আস্থা লাইফ

বর্তমানে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে অধ্যায়নরত। ভালোবাসেন সিরিজ দেখতে, বই পড়তে, লেখালেখি করতে আর সময় পেলেই সমুদ্র-পাহাড় কিংবা এদিক সেদিক বেড়াতে। বয়সের সাথে আবিষ্কার করছেন এক নতুন অজানা বিশ্ব- স্বপ্ন দেখেন নিজের সামর্থ্য থেকে মানুষকে আলোকিত করতে।

Related Articles