রমজানে হ্যালিটোসিস বা মুখের গন্ধ দূর করার ৯টি উপায়

রোজাদারদের মুখে হালকা একটু গন্ধ এমনিতেই থাকে, এটা স্বাভাবিক একটা বিষয়। কিন্তু যখন এই দূর্গন্ধ বেশি হয়ে যায় এবং এর কারনে আমরা কারো সাথে কথা বলতে চাইনা বা কনফিডেন্স কমতে থাকে, তখন এটি চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

রমজান মাসে মুখে দূর্গন্ধ হওয়া খুবই কমন একটি সমস্যা। এই সমস্যা প্রায় সব বয়সের মানুষেরই হয়ে থাকে। রোজা রেখে অফিস করা, বাজার করা বা বাইরে অন্যান্য কাজে গেলে আমরা কমবেশি প্রায় সবাই এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়ি। বিভিন্ন কারনে রমজান মাসে মুখের দূর্গন্ধ বেড়ে যেতে পারে এবং এই সমস্যা দূর করারও রয়েছে বিভিন্ন উপায়। এসব নিয়েই আলোচনা করবো আজকের আর্টিকেলে।

রমজানে হ্যালিটোসিস বা মুখে দূর্গন্ধ হওয়ার কারণ

প্রথমেই যা জানা প্রয়োজন তা হলো, মুখে দূর্গন্ধ শুধুমাত্র রমজান মাসে না, বরং যেকোনো সময়ে হতে পারে। হ্যালিটোসিস ট্রিগার করে এমন যেকোনো কিছু যদি আপনি করেন তাহলেই হ্যালিটোসিস দেখা দিতে পারে। কিন্তু রমজান মাসে যেহেতু আমাদের খাদ্যাভ্যাস, ওরাল হাইজিন এবং বিপাক ক্রিয়ায় বেশ কিছুটা পরিবর্তন আসে, তাই এই সময়ে হ্যালিটোসিস বাড়তে পারে। আরো কিছু কারণ হলো:

খাদ্যাভ্যাসে বিশেষ পরিবর্তন

কিছু ক্ষেত্রে দূর্গন্ধ দেখা দিতে পারে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে, যেমন- intermittent fasting (বা রোজা), water fasting, কিটো ডায়েট (keto diet) ইত্যাদি। ওজন কমানোর জন্য এই পদ্ধতিগুলো ইদানিং খুবই জনপ্রিয় হচ্ছে, কারণ এই পদ্ধতিতে দ্রুত ওজন কমানো সম্ভব। কিন্তু এর একটি কমন সাইড ইফেক্ট হিসাবে মুখে দূর্গন্ধের সমস্যা দেখা দেয়।

কিটো ডায়েটের ক্ষেত্রে, শরীরে কিটোন রিলিজ হওয়া এবং ফ্যাট বার্ন হওয়ার প্রক্রিয়াকে কিটোসিস বলে। এর মাধ্যমে খাবার হজম হয়ে কিটোন সৃষ্টি হয় যা একটি গন্ধযুক্ত উদ্বায়ী পদার্থ। আবার, অতিরিক্ত প্রোটিন যুক্ত খাবার খেলে তা শরীরের মধ্যে ভেঙে অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরী করে যার কারণেও মুখে দূর্গন্ধ হতে পারে।

ওরাল হাইজিন মেনে না চলা

নিয়মিত ব্রাশ এবং ফ্লস না করলে মুখের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দূর্গন্ধ হতে পারে। 

ধূমপান

রোজা রেখে বেশিরভাগ মানুষ ধূমপান করেন না, কিন্তু ইফতারের পর তো একটু টান দিতে সমস্যা নেই, তাইনা? চেইন স্মোকারদের এটা খুবই কমন একটা সমস্যা। তারা ভাবেন যে ব্রাশ করলেই স্মোকিং এর গন্ধ চলে যাবে। স্মোকিং এর গন্ধ যায় ঠিকই, তবে সাইড ইফেক্ট হিসাবে নিয়ে আসে হ্যালিটোসিস।

এছাড়া কাঁচা পেঁয়াজ, রসুন ইত্যাদি খেলেও মুখে দূর্গন্ধ দেখা দেয়। কিছু কিছু ওষুধের কারণেও এই সমস্যা হতে পারে।

ডেন্চার পরিষ্কার না করা

যেসব রোগী ফুল ডেন্চার (কৃত্রিম দাঁত লাগানোর একটি উপায়) বা পার্টিয়াল ডেন্চার ব্যাবহার করেন, তাদের মুখে দূর্গন্ধ হতে পারে সেটা ঠিকমতো পরিষ্কার না করলে।

অন্যান্য রোগের লক্ষণ

দাঁত অথবা শরীরের অন্যান্য অংশের কিছু রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেও হ্যালিটোসিস হতে পারে, যেমন— ডায়জেস্টিভ সিস্টেমের কোনো রোগ, সাইনাস, নাক অথবা গলার কোনো রোগ, ডায়াবেটিস, কিডনি বা লিভারের সমস্যা, দাঁতে ক্যাভিটি বা মাড়িতে কোনো সমস্যা হলে হ্যালিটোসিস হতে পারে।

বিশেষ করে পাকস্থলীর স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে অনেক সময় মুখে গন্ধ সমস্যা হয়। প্রোসেসড্ এবং রিফাইনড্ খাবার খাওয়ার কারণে খাবার হজমে বিভিন্ন সমস্যা হয়, মেটাবলিক রেট কমে যায়। এসব খাবার আমাদের অন্ত্রে থাকা ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলে যার জন্য পাকস্থলী ঠিকমতো কাজ করতে পারেনা।

ড্রাই মাউথ

রোজায় দীর্ঘ সময় ধরে খাবার বা পানি না খাওয়ার ফলে মুখের লালা নিঃসরণ কমে যায়। মুখের লালা ব্যাকটেরিয়ার বিল্ড আপ হতে বাঁধা দিয়ে মুখগহ্বরের পরিবেশ ঠিক রাখতে সহায়তা করে। লালা নিঃসরণ কমে গেলে মুখ শুকিয়ে আসে, এই অবস্থা কে ড্রাই মাউথ বলে। এর ফলে মুখে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং হ্যালিটোসিস দেখা দেয়।  

মিষ্টি খাবার

চিনি, গ্লুকোজ ও অন্যান্য মিষ্টি খাবার হলো ব্যাকটেরিয়ার খাদ্য। রমজানে বিশেষ করে ইফতারে অনেকেই লেবু চিনির শরবত, রুহ আফজাসহ বিভিন্ন মিষ্টি খাবার খেয়ে থাকেন। এসব মিষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দাঁতের উপরের স্তরে লেগে থাকে, সেগুলো খেয়ে ব্যাকটেরিয়া সংখ্যাবৃদ্ধি করে, আর ব্যাকটেরিয়া বেড়ে গেলেই দেখা দেয় হ্যালিটোসিস।

হ্যালিটোসিস দূর করার উপায়

মুখের দূ্ূর্গন্ধ দূর করতে চাইলে কি কারণে আপনার মুখে দূর্গন্ধ হচ্ছে তা বুঝতে হবে আগে। এরপর সেই কারণগুলো এড়িয়ে চললেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দূর্গন্ধ হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা থাকেনা।  

১. কিটো ডায়েটের কারণে মুখে দূর্গন্ধ হওয়া অথবা জিহবায় মেটালিক টেস্ট পাওয়া একটি সাধারণ ঘটনা। এতে বোঝা যায় যে আপনার পাকস্থলী তার কাজ ঠিকভাবেই করছে। তবে, যারা ঠিকমতো দাঁত পরিষ্কার করেন না তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। তাই দাঁত এবং জিহ্বা নিয়মিত সঠিকভাবে পরিষ্কার রাখলে এবং মিন্ট ব্যাবহার করলে এই সমস্যা দূর হতে পারে।

২. ওরাল হাইজিন মেনে চললে কিটো ডায়েটের পাশাপাশি রমজানেও মুখের দূর্গন্ধ থেকে বেঁচে থাকা যায়। ইফতার ও সেহরির পর নিয়মিত দাঁত ব্রাশ করা, জিহ্বা পরিষ্কার করা, ফ্লস বা মেসওয়াক করা, মাউথওয়াশ ব্যাবহার করার মাধ্যমে ওরাল হাইজিন মেইনটেইন করা যায়। লবণ-পানি দিয়ে কুলকুচি করলেও ব্যাকটেরিয়া মারা যায় এবং ইনফ্লামেশন থাকলে তা কমে যায়।

আপনাকে একসাথে সবগুলো পদ্ধতিই ব্যাবহার করতে হবে তা নয়, ব্রাশ করার পাশাপাশি নিজের জন্য অন্য পদ্ধতি গুলোর মধ্যে যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন। তবে যেটাই ব্যাবহার করুন খেয়াল রাখতে হবে দুই দাঁতের ফাঁকে যেন খাবারের কণা আটকে না থাকে।

৩. পানিশূন্যতা বা ড্রাই মাউথের কারণে হ্যালিটোসিস দেখা দিলে খেয়াল রাখতে হবে শরীরে পানির পরিমাণ যেন কমে না যায়। ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করার চেষ্টা করতে হবে। যদি প্রস্রাবের পরিমাণ কম মনে হয়, রং কিছুটা হালকা বাদামি বা হলুদ মনে হয়, অথবা প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া করে তাহলে বুঝতে হবে শরীরে পানিশূন্যতা রয়েছে। চা, কফি, গ্রিনটি সহ অন্যান্য ক্যাফেইন যুক্ত পানীয় শরীরে ডিহাইড্রেশন বাড়ায়। তাই এসব পানীয় যত কম পরিমাণে নেওয়া যায় ততো ভালো। 

৪. মিষ্টি খাবার, কোমল পানীয় খাওয়া বাদ দিতে হবে, অথবা এসব খাবারের পরিমাণ কমাতে হবে।

৫. যদি ধূমপানের কারণে মুখে দূর্গন্ধ হয় তাহলে ধূমপান ছাড়তে হবে (ধূমপান করা কখনোই উচিত নয়),

৬. মুখে ডেন্চার, রিমুভেবল দাঁত অথবা অন্য কোনো অ্যাপ্লায়েন্স লাগানো থাকলে তা নিয়মিত খুলে পরিষ্কার করতে হবে। 

৭. যদি শরীরের অন্যান্য সমস্যার কারণে হ্যালিটোসিস দেখা দেয় তাহলে সেই সমস্যার ট্রিটমেন্ট করালে হ্যালিটোসিসও ভালো হয়ে যায়। 

হজমে সমস্যা হলে তা সারাতে প্রোবায়োটিকস্ দারুন কাজ করে। এগুলো অন্ত্রে ভালো ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যাবৃদ্ধি করে, ফলে মেটাবলিজম বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন ধরনের ফার্মেন্টেড খাবার, যেমন দই, টকদই, কিমচি ইত্যাদিতে প্রচুর পরিমাণে প্রোবায়োটিক থাকে। অথবা ডাক্তারের পরামর্শে প্রোবায়োটিক ট্যাবলেটও খাওয়া যেতে পারে। 

৮. কাঁচা পেঁয়াজ, রসুনসহ তীব্র গন্ধযুক্ত খাবার খাওয়া কমাতে হবে। 

৯. মুখের দূর্গন্ধ কোনো বিশেষ ওষুধের কারনে হয়ে থাকলে ডাক্তারকে বলে ওষুধ পরিবর্তন করতে হবে। যদি ওষুধ পরিবর্তন করা সম্ভব না হয় তাহলে মিন্ট, মাউথ ফ্রেশনার ইত্যাদি ব্যাবহার করে দূর্গন্ধকে মাস্কিং করা যেতে পারে।

উপরের নিয়মগুলো সঠিকভাবে মেনে চলার পরেও যদি হ্যালিটোসিস ভালো না হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। কিছু সমস্যা থাকে যা ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট ছাড়া ভালো হয়না, এসব ক্ষেত্রে ডাক্তার দেখানো জরুরি।  

শেষ কথা

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হ্যালিটোসিসের কারন বুঝে সেই অনুযায়ী ঘরোয়াভাবে কিছু উপায় অবলম্বন করলে এই সমস্যা অনেকটা কমে আসে। কিন্তু যদি না কমে তাহলে প্রফেশনাল হেল্প নিতে হবে। ডাক্তারের কাছে গেলে তিনি ডায়াগনোসিস করে ট্রিটমেন্ট দিলে এই সমস্যা সম্পূর্ণভাবে ভালো হয়ে যায়। 

Default user image

নিশাত বিনতে সাইফ, লেখক, আস্থা লাইফ

আসসালামু আলাইকুম। আমি বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা করছি। প্রতিদিন কলেজে অনেক রোগী দাঁতের সমস্যা নিয়ে আসেন যেগুলোর প্রধান কারণ দাঁতের স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতনতা এবং সঠিকভাবে দাঁতের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতা। আস্থা ব্লগের নিয়মিত লেখক হয়ে সবাইকে এই বিষয়ে সচেতন করে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। উদ্দেশ্য একটাই—সুস্থ দাঁত, সুন্দর হাসি যেন ছড়িয়ে দিতে পারি সাধারণ মানুষের মধ্যে।

Related Articles