ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ!
স্তন ক্যান্সার কি ও এর লক্ষণসমূহ , স্তন ক্যান্সারের কারণ, সঠিকভাবে স্তন ক্যান্সার নির্ণয় ও চিকিৎসা এবং সর্বোপরি স্তন ক্যান্সার নিয়ে আমাদের ভুল ধারণাগুলো নিয়েই আজকের লেখা
তাহামিনা আক্তার পেশায় একজন স্কুল টিচার। বেশ কিছু দিন ধরে ক্ষুধা মন্দায় ভুগছিলেন এবং ক্রমশ ওজন কমে যাচ্ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের পুরো শরীর ডাক্তারি পরীক্ষা করাবেন। পঁয়তাল্লিশ পেরোনোর পর সব নারীর বছরে অন্তত একবার পরীক্ষা করানো উচিত, এটা তিনি জানতেন। বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার সময় চিকিৎসক সন্দেহ করেন তাহমিনা ক্যান্সার হয়েছে। স্তন পরীক্ষার পর চিকিৎসক এটি নিশ্চিত হলেন। হঠাৎ করেই তাহমিনার জীবনে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল।
স্তন ক্যান্সার একটি ভয়ানক ব্যাধি। নারীদের জন্য আতংক। এই ক্যান্সারে ৫০ বছরের উর্ধ্বে নারীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। মহিলাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার হার, মৃত্যুহার এবং গুরুত্ব বিবেচনায় স্তন ক্যান্সার প্রথম স্থানে রয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সালে বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১২,৭৬৪ জন যা ক্যান্সারে আক্রান্ত মোট রোগির ৮.৫% আর শুধুমাত্র মহিলা রোগীর ক্ষেত্রে ১৯%। আর আক্রান্ত রোগীর মধ্যে মৃত্যুহার ৫০%।
সঠিক জ্ঞান এবং সচেতনতার অভাবে প্রতি বছর নারীরা ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যান্সার নির্ণয় করতে পারলে এর প্রতিকার করা সম্ভব।
স্তন ক্যান্সার নিয়ে যেসব ভুল ধারণা রয়েছে
-
পরিবারের কারো ক্যান্সার থাকা মানে ক্যান্সার হওয়াঃ এটি সম্পুর্ণ ভুল ধারণা। ক্যান্সার যে কারো, যে কোনো সময় হতে পারে। পরিবারে কারো থাকলেই যে ক্যান্সার হবে তার বাধ্যবাধকতা নেই।
-
যদি আপনি একটি স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখেন, নিয়মিত অনুশীলন করেন, স্বাস্থ্যকর খাবার খান এবং অ্যালকোহল বর্জন করেন, তবে আপনাকে স্তন ক্যান্সারের বিষয়ে চিন্তা করতে হবে নাঃ যদিও এই কাজগুলি স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করতে সহায়তা করে কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে পারে না।
-
ব্রা পরিধান করলে স্তন ক্যান্সার হয়: ব্রা এর কারণে স্তন ক্যান্সার হওয়ার কোনও প্রমাণ নেই।
-
ডিওডোরেন্ট ব্যবহার করলে স্তন ক্যান্সার হয়ঃ এটি ও একটি ভুল ধারনা। এখন পর্যন্ত এর প্রমাণ পাওয়া যায় নি। তবে ডিওডোরেন্ট এর সুরক্ষা নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে।
-
স্তন ছোট হলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমঃ এটি একটি মারত্মক ভুল ধারণা। আকারের সাথে স্তন ক্যান্সার কোনো সম্পর্ক নেই।
-
বেশি পরিমাণে চিনি খাওয়ার ফলে স্তন ক্যান্সার হয়ঃ চিনি স্তন ক্যান্সারের কারণ হওয়ার কোনও প্রমাণ নেই।
-
ম্যামোগ্রাম এর মাধ্যমে স্তন ক্যান্সার শনাক্তকরণের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়ঃ ম্যামোগ্রাফি যদিও আমাদের কাছে প্রাথমিক শনাক্তকরণের সেরা কৌশল, তবে এটি সর্বদা প্রাথমিক স্তরে স্তন ক্যান্সারের শনাক্ত করতে পারে না।
-
বুকে চাকা বা শক্ত জাতীয় কিছু থাকলেই তা ক্যান্সারঃ হরমোনের পরিবর্তন বা বয়সের সাথে বুকে শক্ত জাতীয় কিছুর উপস্থিতি টের পেতে পারেন। নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখতে হবে আসলেই সেটা চাকা নাকি ক্যান্সার।
-
প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মূল হওয়া স্তন ক্যান্সার খুব কমই পুনরাবৃত্তি হয়: প্রাথমিক স্তরে স্তন ক্যান্সারে প্রতিকার হলেও পরবর্তীতে আবার ক্যান্সার ফিরে আসার ঝুঁকি থাকে।
-
স্তন ক্যান্সার কেবল মধ্যবয়সী এবং বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রেই ঘটে: কিন্তু অল্প বয়সি মহিলাদের স্তন ক্যান্সার হতে পারে এমনকি কিছু পুরুষদের ক্ষেত্রেও হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
স্তন বা ব্রেস্ট ক্যান্সার কি?
স্তন ক্যান্সার হচ্ছে স্তন ও এর অন্যান্য অংশের কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। একটি স্তন তিনটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত: ক্ষুদ্র উদগতাংশ ( লোবিউল), নালী এবং সংযোজক টিস্যু। আর এই তিনটি অংশের মধ্যেই স্তন ক্যান্সার সৃষ্টি হয়।
স্তন ক্যান্সার রক্তনালী এবং লসিকা নালীর মাধ্যমে স্তনের বাইরে ছড়িয়ে যেতে পারে। যখন স্তনের ক্যান্সার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে তখন এটিকে মেটাস্ট্যাসাইজড (স্থানান্তরণ) বলে।
বিভিন্ন ধরণের স্তন ক্যান্সারের মধ্যে কয়েকটি হ'ল -
১) ইনভেসিভ ডাকটাল কার্সিনোমা - ক্যান্সার কোষগুলি স্তন টিস্যুর অন্যান্য অংশে নালীগুলির বাইরে বৃদ্ধি পায়। এই ক্যান্সার কোষগুলি শরীরের অন্যান্য অংশগুলিতেও স্থানান্তর বা মেটাস্ট্যাসাইজ হতে পারে।
২) ইনভেসিভ লোবুলার কার্সিনোমা - ক্যান্সার কোষগুলি লবিউল থেকে স্তনের টিস্যুতে ছড়িয়ে পড়ে যা একদম কাছাকাছি থাকে। এই ক্যান্সার কোষগুলি শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে যেতে পারে।
স্তন ক্যানসার কেন হয়?
বয়:সন্ধিকালের পরে একজন মহিলার স্তন চর্বি, সংযোজক টিস্যু এবং কয়েক হাজার লোবিউল দিয়ে গঠিত হয়। এগুলি ক্ষুদ্র গ্রন্থি যা বুকের দুধ খাওয়ানোর জন্য দুধ উৎপাদন করে। ক্ষুদ্র টিউব বা নালীগুলি স্তনের দিকে দুধ বহন করে নিয়ে যায়।
ক্যান্সারের ফলে কোষগুলি অনিয়ন্ত্রিতভাবে বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। কোষগুলি তাদের জীবনচক্রের স্বাভাবিক পর্যায়ে মারা যায় না। এই অতিরিক্ত কোষের বৃদ্ধি ক্যান্সার সৃষ্টি করে কারণ টিউমারটি পুষ্টি এবং শক্তি ব্যবহার করে এবং তার চারপাশের কোষকে বঞ্চিত করে।
স্তন ক্যান্সার সাধারণত দুধ নালীগুলির অভ্যন্তরীণ আস্তরণে বা লোবিউলগুলি তে শুরু হয়। সেখান থেকে এটি শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে। ব্রেস্ট ক্যান্সারের উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ
-
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে থাকে
-
সন্তাকে নিয়মিত বুকের দুধ না খাওয়ালে স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা থাকে
-
জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। যেমন বিআরসি ১ এবং বিআরসি ২ নামের জিনের মিউটেশন ৫% থেকে ১০% ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
-
সারক্ষন ব্রা পরে থাকা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। কারণ সারদিন এর ঘাম, আদ্রতা জমে থাকা সব মিলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। ঘুমানোর সময় ব্রা না পরাই ভাল।
-
হরমোন যেমন ইস্ট্রোজেন এর প্রভাবে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। মাসিক বন্ধ হওয়ার পর অনেক মহিলা আছে যার রিপ্লেসমেন্ট থেরাপী গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কাদের বেশি?
স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৮০ জনেরই বয়স ৫০ এর উপড়ে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি ফ্যাক্টর এমন কিছু যা স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার বেশি সম্ভাবনা তৈরি করে। তবে এক বা একাধিক স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিপূর্ণ কারণগুলির অর্থ এই নয় যে আপনি স্তন ক্যান্সারে নিশ্চিত আক্রান্ত হবেন। স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ার সাথে যুক্ত যেগুলিগুলির মধ্যে রয়েছে,
-
পুরুষদের স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার তুলনায় মহিলারা অনেক বেশি সম্ভাবনা রয়েছে।
-
বয়স বাড়ার সাথে সাথে আপনার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-
যদি আপনার স্তন বায়োপসি থাকে যা সিটুতে (LCIS) লোবুলার কার্সিনোমা বা স্তনের অ্যাটাইপিকাল হাইপারপ্লাজিয়া পেয়ে থাকে তবে আপনার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়বে।
-
যদি আপনার একটি স্তনে ক্যান্সার থাকে তবে অন্য স্তনে আপনার ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে।
-
আপনার মা, বোন বা কন্যা যদি বিশেষত অল্প বয়সে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তবে আপনার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তবুও, স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত বেশিরভাগ রোগীর এই রোগের কোনও পারিবারিক ইতিহাস নেই।
-
উত্তরাধিকারী জিন যা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে এমন কিছু জিন পরিবর্তনের ফলে বাবা-মা থেকে বাচ্চাদের কাছে যেতে পারে। সর্বাধিক পরিচিত জিন মিউটেশনগুলিকে বিআরসিএ 1 এবং বিআরসিএ 2 হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এই জিনগুলি স্তন ক্যান্সার এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি ব্যাপক পরিমাণে বাড়িয়ে তুলতে পারে তবে সেগুলো ক্যান্সারকে অনিবার্য করে তোলে না।
-
সাধারণত স্থূলকায় ব্যক্তিদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
-
অল্প বয়সে পিরিয়ড শুরু হলে। ১২ বছর বয়সের আগে পিরিয়ড শুরু হলে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
-
দেরিতে মেনোপজ শুরু হলে। যদি বেশি বয়সে মেনোপজ শুরু হয় তবে স্তন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
-
যেসব মহিলারা ৩০ বছরের পরে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম দেয় তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
-
যেসব মহিলারা কখনও গর্ভবতী হননি তাদের এক বা একাধিক গর্ভধারণ করা মহিলাদের তুলনায় স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি থাকে।
-
যদি আপনি শিশু বা অল্প বয়স্ক হিসাবে আপনার বুকে বিকিরণের চিকিত্সা পেয়ে থাকেন তবে আপনার স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
-
যেসব মহিলারা হরমোন থেরাপির ওষুধ গ্রহণ করেন যা এস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন একত্রিত করে মেনোপজের লক্ষণ ও লক্ষণগুলির চিকিৎসা জন্য স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। মহিলারা এই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করলে স্তনের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
-
মদ্যপান, অ্যালকোহল পান করা স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
স্তন ক্যান্সারের লক্ষণ!
স্তন ক্যান্সারের নানা রকম লক্ষণ দেখা যায়। প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণ দেখা দিলেই সুচিকিৎসায় স্তন ক্যান্সরের নিরাময় সম্ভব। কিন্তু সচেতনতার অভাবের কারণে এই সামান্য লক্ষণই মৃত্যুর ঝুঁকি হয়ে যায়। স্তন ক্যান্সরের লক্ষণগুলো হচ্ছে,
-
স্তন ক্যান্সারের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে স্তনের ঘন টিস্যুগুলির একটি দলা বা স্তনের মধ্যে একটি পিণ্ডের উপস্থিতি টের পাওয়া যা স্তনের চারপাশের টিস্যু থেকে আলাদা একটা অনুভূতি সৃষ্টি করে।
-
স্তনের আকার, উচ্চতা বা চেহারার পরিবর্তন
-
বগল বা স্তনে ব্যথা যা মাসিক চক্রের সাথে পরিবর্তিত হয় না
-
স্তনের ত্বকে লালচেভাব দেখা যায় যা দেখতে অনেকটা কমলার পৃষ্ঠের মতো
-
স্তনবৃন্তের উপরে বা চারপাশে ফুসকুড়ি হতে পারে
-
স্তনবৃন্ত থেকে রক্ত সহ স্রাব বের হতে পারে
-
নিমজ্জিত বা বিপর্যস্ত স্তনবৃন্ত
-
স্তনবৃন্ত বা স্তনের ত্বকের চারপাশের রঞ্জক অঞ্চলগুলি শক্ত হয়ে যায় বা ছুলে যায়
স্তন ছাড়া আরো কিছু উপসর্গ পরিলক্ষিত হয় স্তন ক্যান্সারের। যেগুলা গুরুত্বের সাথে আমলে নিতে হবে,
-
শ্বাস কষ্ট
-
ঘাড়ে বা বগলে দলা বা পিন্ড পরিলক্ষিত হয়
-
ওজন কমে যাওয়া
-
খিদে না পাওয়া
-
অবসাদ
বেশিরভাগ স্তনের পিণ্ড ক্যান্সারযুক্ত নয়। যাইহোক, মহিলাদের যদি তাদের স্তনের উপর দলা বা পিণ্ড হয় অথবা স্তনের কোন পরিবর্তন হলে যত তারাতারি সম্ভব পরীক্ষার জন্য ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
প্রাথমিক পর্যায়ে স্তন ক্যানসার নির্ণয়ের উপায়
স্তন ক্যান্সারে স্ব- মূল্যায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। স্ব-মূল্যয়ন এর জন্য স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা থাকা জরুরি। খেয়াল রাখতে হবে।
-
স্তনের হঠাৎ তীব্র ব্যাথার উপসর্গ আসলে কি সেটা বুঝতে হবে
-
স্তন থেকে কোন তরল পদার্থ বের হচ্ছে নাকি সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে
-
স্তনে ঘা দেখা দিল কিনা
-
স্তনের থাকার পরিবর্তন হচ্ছে কিনা
-
চাকা অনুভব স্তন ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণ। এদিকে অনেক খেয়াল রাখতে হবে
স্তন ক্যান্সার নির্ণয়ের পরীক্ষা সমূহ
বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা এবং পদ্ধতি স্তন ক্যান্সারের রোগ নির্ণয় নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
স্তন পরীক্ষাঃ ডাক্তার স্তনের কোন অংশে দলা বা পিণ্ড আছে কিনা এবং অন্যান্য লক্ষণগুলির জন্য স্তনযুগল পরীক্ষা করে থাকেন। পরীক্ষার সময়, ব্যক্তিকে তার হাতকে বিভিন্ন অবস্থানে রেখে বসে বা দাঁড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।
ইমেজিং পরীক্ষাঃ বেশ কয়েকটি পরীক্ষা স্তনের ক্যান্সার সনাক্ত করতে সহায়তা করতে পারে,
-
ম্যামোগ্রাম: ম্যামোগ্রাম এক ধরণের এক্স -রে যার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার নির্ণয় করা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যান্সার এত ছোট থেকে যে বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব হয় না। ম্যামোগ্রাম এমন চিত্র তৈরি করে যা ডাক্তারকে কোনও দলা বা অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করতে সহায়তা করে।
-
আল্ট্রাসাউন্ড: এই পরীক্ষাটি শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে ক্যান্সার পিণ্ড নির্ণয়ে সহায়তা কর। ক্যান্সার পিণ্ডটি কঠিন নাকি তরলে পূর্ণ তা বোঝা যায় আল্ট্রাসাউন্ড এর মাধ্যমে।
-
এমআরআই: চৌম্বকীয় অনুরণন ইমাজিং (এমআরআই) স্তনের বিভিন্ন চিত্রকে একত্রিত করে ডাক্তারকে ক্যান্সার বা অন্যান্য অস্বাভাবিকতা সনাক্ত করতে সহায়তা করে। একজন চিকিত্সক ম্যামোগ্রাম বা আল্ট্রাসাউন্ডের ফলো-আপ হিসাবে এমআরআই প্রস্তাব করে থাকেন। যারা স্তন ক্যান্সারের অধিক ঝুঁকিতে থাকেন চিকিত্সকরা কখনও কখনও তাদের জন্য স্ক্রিনিংয়ের জন্য এমআরআই ব্যবহার করেন।
-
বায়োপসিঃ বায়োপসিতে স্তন টিস্যুর একটি নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং পরীক্ষাগার বিশ্লেষণের জন্য প্রেরণ করা হয়। কোষগুলি ক্যান্সারযুক্ত কিনা তা বায়োপসির মাধ্যমে দেখা যায়। যদি ক্যান্সারযুক্ত হয় তবে কি ধরণের ক্যান্সার বা ক্যান্সার হরমোন সংবেদনশীল কিনা তাও বায়োপসির মাধ্যমে নির্ণয় করা যায়। এছাড়া বায়োপসির মাধ্যমে টিউমারের বিভিন্ন অবস্থা জানা যায়। যেমন টিউমার আকার, টিউমারটি কতদূর ছড়িয়েছে, টিউমারটি ইনভেসিভ (আক্রমণাত্মক) নাকি নন-ইনভেসিভ ইত্যাদি। বায়োপসির মাধ্যমে ব্যক্তির প্রতিকার পাওয়া সম্ভব কিনা এবং চিকিত্সার সঠিক পদক্ষেপ এর ধারণা পাওয়া যায়।
স্তন ক্যান্সারের পর্যায়সমূহ
আক্রান্ত রোগীর স্তন কোষগুলো স্বাভাবিক স্তনের তুলনায় কি রকম পরিবর্তন হয়েছে এবং কত দ্রুত এই অস্বাভাবিক কোষ বিভাজন বৃদ্ধি পাচ্ছে তার উপর ভিত্তি করে স্তন ক্যান্সারকে ৩টি গ্রেডে ভাগ করা যায়,
গ্রেড ১- এটি দেখতে সাধারন কোষের মত এবং ধীরে ধীরে ছড়ায়।
গ্রেড ২- এখানে কোষটি একটু বড় দেখায়। কোষ এর আকৃতি পাল্টে যায়।
গ্রেড ৩- সাধারণ কোষের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন থাকে এবং কোষ অনেক বড় হয়ে যায়।
স্তন ক্যান্সারের বিভিন্ন স্টেজ
একজন চিকিৎসক টিউমারের আকার ও ব্যাপ্তি অনুসারে এবং এটি শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে কিনা সে অনুযায়ী একজন রোগীর ক্যান্সার কি অবস্থায় আছে তা নির্ণয় করে।
স্টেজ ০: এই ধাপ ডাকটাল কার্সিনোমা হিসাবে পরিচিত। এই ধাপে ক্যান্সার কোষগুলো নালীগুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে এবং পার্শ্ববর্তী টিস্যুগুলিতে আক্রমণ করে না।
স্টেজ ১: এই পর্যায়ে টিউমারটি ২ সেন্টিমিটার জুড়ে বিস্তৃত হয়। এটি কোনও লিম্ফ নোডকে প্রভাবিত করে
স্টেজ ২: টিউমারটি ২-৫ সেন্টিমিটার বড় হয় এবং নোডগুলির কাছাকাছি ছড়িয়ে যেতে শুরু করে।
স্টেজ ৩: টিউমারটি ৫ সেন্টিমিটারের চেয়ে বড় হয় এবং এটি বেশ কয়েকটি লিম্ফ নোডে ছড়িয়ে পড়ে।
স্টেজ ৪: টিউমারটি অন্যান্য দূরবর্তী অঙ্গ গুলিতে যেমন, হাড়, লিভার, মস্তিষ্ক বা ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ে।
স্তন ক্যান্সারের চিকিত্সা
স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসা কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে। যেমন ক্যান্সারের ধরণ এবং ধাপ, হরমোনের প্রতি রোগীর সংবেদনশীলতা, বয়স, সম্পূর্ণ দেহের অবস্থা এবং রোগীর পছন্দসমূহ।
স্তন ক্যান্সারের প্রচলিত চিকিৎসা পদ্ধতি
১. ব্রেস্ট কনজার্ভেশন সার্জারি অর্থাৎ অস্ত্রোপচারঃ ক্যান্সারের বিস্তার এড়াতে স্তনের কিছু অংশ অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বাদ দেওয়া সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি। এখানে শুধুমাত্র স্তনের আক্রান্ত অংশকে অপসারণ করা হয়। একে রিকন্সট্রাক্টিভ (পুনর্নির্মাণ যোগ্য) সার্জারি বলে। অর্থাৎ পুনরায় অস্ত্রোপচার করে স্তন ইমপ্ল্যান্ট এর মাধ্যমে পূর্বের চেহারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
২. রেডিয়েশন থেরাপিঃ একজন ডাক্তার বিভিন্ন পর্যায়ে ক্যান্সারের জন্য রেডিয়েশনের পরামর্শ দিতে পারেন। প্রাথমিক পর্যায়ে, রেডিয়েশন থেরাপি অস্ত্রোপচারের আগে টিউমারের আকার হ্রাস করতে বা পরবর্তীতে ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে সহায়তা করে। পরবর্তী পর্যায়ে, এটি উপশমকারী হিসাবে রোগীর ব্যথা উপশম করতে পারে।
রেডিয়েশন থেরাপিতে এক ধরণের মেশিন ব্যবহার করা হয় যা শরীরের একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে লক্ষ্য করে রেডিয়েশনের তরঙ্গ ছুড়া হয়।
আরেক ধরনের রেডিয়েশন থেরাপি আছে যেখানে স্থায়ীভাবে বা অস্থায়ীভাবে শরীরের অভ্যন্তরে একটি তেজস্ক্রিয় পদার্থ স্থাপন করা হয়।
৩. কেমোথেরাপিঃ কেমোথেরাপি হচ্ছে এন্টি-ক্যান্সার ঔষধ ব্যাবহারের মাধ্যমে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার প্রক্রিয়া। কেমোথেরাপির ঔষধগুলি ক্যান্সার কোষের বিভাজন এবং পুনরায় উৎপাদন করার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে। এটি একটি একক ঔষধ বা কয়েকটি ঔষধর সংমিশ্রণে হতে পারে। কেমোথেরাপিতে সারা শরীরের ক্যান্সার কোষকে আক্রমণ করে অথবা নির্দিষ্ট অংশের কোষকে লক্ষ্য করে আক্রমণ করা হয়।
চিকিৎসকরা নিম্নোক্ত কারণে কেমোথেরাপির পরামর্শ দিতে পারেন,
-
অস্ত্রোপচারের আগে টিউমার সংকুচিত করতে
-
অস্ত্রোপচারের পরে কোনও অবশিষ্ট ক্যান্সার কোষ অপসারণ করতে এবং পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধ করতে
-
রোগের অগ্রগতি মন্থর করতে এবং পরবর্তী পর্যায়ে লক্ষণগুলি হ্রাস করতে। এমনকি যদি কোনও নিরাময়ের সম্ভাবনাও থাকে না
কেমোথেরাপির কিছু ক্ষতিকারক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে-
-
চুল পড়ে যাওয়া
-
ক্লান্ত বোধ হয়
-
হাত পায়ের নখ নীল হয়ে যাওয়া
-
ডায়রিয়া বা কোষ্ঠকাঠিন্য
-
রক্তক্ষরণ
-
রক্ত স্বল্পতা
-
মুখে শ্লেষ্মা হতে পারে
-
ক্ষুধামান্দ্য
-
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা
৪. হরমোন ব্লকিং থেরাপিঃ চিকিত্সা শেষে হরমোন সংবেদনশীল স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে হরমোন ব্লকিং থেরাপি দেওয়া হয়। যে সব রোগীরা সার্জারি, কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপির জন্য উপযুক্ত নয় তাদের জন্য হরমোন ব্লকিং থেরাপি একমাত্র বিকল্প হতে পারে।
৫. জৈবিক থেরাপি বা নির্দিষ্ট লক্ষ্যযুক্ত ড্রাগ থেরাপি: লক্ষ্যযুক্ত ঔষধগুলি নির্দিষ্ট ধরণের স্তন ক্যান্সারকে ধ্বংস করতে পারে। এই থেরাপির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-
-
ট্রাস্টুজুমাব (হারসেপটিন)
-
ল্যাপটিনিব (টেকেরব)
-
বেভাসিজুমব (অ্যাভাস্টিন)
স্তন ক্যান্সারের অত্যাধুনিক কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি
নিত্যনতুন আবিষ্কারের ফলে চিকিৎসা সেবায় নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। আজকাল স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসায়ও নতুন নতুন কিছু টেকনোলজি ব্যাবহার করা হচ্ছে,
১. ন্যানোটেকনোলজিঃ এই পদ্ধতিতে ন্যানো (অতি ক্ষুদ্র) আকারের উপযুক্ত ওষুধ নির্ভুলতার সাথে ক্যান্সার কোষগুলিকে নিশানা করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
২. নিউক্লেয়িক অ্যাসিড টেকনোলজিঃ এখানে ক্যান্সার জিন এর বিকাশ ঔষুধ এর মাধ্যমে দমন করা যায়।
৩. ইমিউনোডুলেশনঃ এই পদ্ধতিতে ক্যান্সার কোষগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়াতে সাইটোকাইনস এর ব্যবহার করা হয়। সাইটোকাইনস মূলত শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত কিছু কোষ থেকে উৎপন্ন হয় যার প্রভাব ক্যান্সার কোষের উপর রয়েছে।
বিশ্বজুড়ে স্তন ক্যান্সার এর প্রভাব
বিশ্বজুড়ে স্তন ক্যান্সার মেয়েদের জন্য একটি ভয়াবহ ঘাতকের নাম। পৃথিবীতে সারা বছর ৫-৭ লাখ রোগী মার যায় এই স্তন ক্যান্সার। দ্রুত চিকিৎসা এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে স্তন ক্যান্সর নিরাময় সম্ভব কিন্তু অনেক নারীর ক্ষেত্রে তা ধরা পরে দেরীতে। কিন্তু আমেরিকাতে ৮০% স্তন ক্যান্সার প্রাথমিক এবং দ্বিতীয় স্তরেই নির্ণয় করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে ভারতে ধরা পরে তৃতীয় এবং চতুর্থ ধাপে। উন্নত দেশগুলোতে ধারণা করা হয় একজন মহিলা যদি পূর্ণবয়স্ক যেমন (৮৫-৯০) বছর হয় তাহলে তার সারা জীবনে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভবনা প্রতি ৮ এ ১। মারা যাওয়ার সম্ভবনা প্রতি ২৭ এ ১।
স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধের কার্যকরী উপায়
-
স্তনের সচেতনতার জন্য স্তনের স্ব-পরীক্ষার করা।
-
মহিলাদের বুকের দুধ খাওয়ানো এবং মাসিকের পরে এইচআরটি ব্যবহারের জন্য বিকল্পগুলি বিবেচনা করা উচিত, কারণ এগুলিও ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলতে পারে।
-
দৈনন্দিন জীবনে শত ব্যস্ততার মধ্যেও ব্যয়াম করা। প্রতি সপ্তাহে অন্তত পাঁদিন ব্যায়ম করলে স্তন ক্যান্সসের ঝুঁকি কমানো যায়।
-
এটি অতি প্রয়োজনীয় বিষয় খাবরের তালিকাতে সুষম ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়। তেলযুক্ত খাবার ও জাংক ফুড বর্জন করুন। ক্যান্সার প্রতিরোধে মাছ খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া ভালো।
-
হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি ক্যান্সার হওয়ার অন্যতম কারন। তাই ক্যান্সারে ঝুঁকি কমাতে থেরাপি ব্যবহার না করাই ভালো।
-
শরীরের ওজন একটি অন্যতম বিষয়। সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতে হলে শরীরের ওজন ঠিক রাখা উচিৎ।
-
স্তন ক্যান্সারের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা মহিলাদের জন্য প্রতিরোধমূলক অস্ত্রোপচারও একটি বিকল্প।
-
অ্যালকোহল বা মদ পানে বিরত থাকা।
বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সার ঘরে ঘরে বিস্তৃত হচ্ছে। সচেতনতার অভাবেই স্তন ক্যান্সার এখন মারাক্তক ঝুঁকিপূর্ণ রোগ। তাই সবাইকে সর্তক হতে হবে। বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকা এবং বিভিন্ন সংবাদ এবং যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি বেশি ক্যান্সার সচেতনতা সম্পর্কে প্রচার করতে হবে।