নবজাতক শিশুর টিকার তালিকা - যে ৬টি ভ্যাক্সিন দিবেন!
ভাক্সিনেশন বা টিকাদান কি , কিভাবে নিতে হয়? ভাক্সিনেশন এর সময়তালিকা এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বে ভাক্সিনেশন এর অবস্থা।
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর ভ্যাক্সিনেশনের ফলে ২৫ লক্ষ মৃত্যু প্রতিরোধ হয়। ভ্যাক্সিনেশনের পরিপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতি সাতটির মধ্যে একটি শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার এই তথ্যের উপর ভিত্তি করে বলা যায় যে, শিশুকালে যেসব রোগের ভ্যাক্সিন দেয়া হয় তা মোটামুটি ৮০-১০০% ইম্যুনিটি (শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা) তৈরী করতে পারে। একটা দারুণ ব্যপার হল একটি নির্দিষ্ট জনসংখ্যার বেশীরভাগ মানুষকে ভ্যাক্সিনেশন করা গেলে ঐ সম্প্রদায়ের প্রায় সব সদস্য একই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা লাভ করতে পারে। আর এই প্রক্রিয়ায় ইনফ্লুয়েঞ্জা, রুবেলা, হাম, পোলিও-র মতো ভয়াবহ রোগের প্রতিরোধ করা সম্ভব।
এতো সফলতা সত্ত্বেও প্রতি বছর যে ৬৬ লাখ শিশু মারা যাচ্ছে তার অর্ধেকের মতো শিশু মৃত্যুর কারণ সংক্রমণকারী জীবাণু দ্বারা আক্রমণ।
শিশুদের ছয়টি সংক্রমণকারী রোগ প্রতিরোধে কার্যকর টিকা আছে। আর রোগগুলি হলো ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টঙ্কার, পোলিও, যক্ষ্মা ও হাম। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই ৬টি রোগের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শিশুদের রোগ প্রতিরোধ অর্থাৎ টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালে ১২ থেকে ২৩ মাস বয়সী মাত্র ২% শিশুকে এসব রোগের টিকাদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। ১৯৮০-র দশকের শেষভাগে গৃহীত সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (EPI-ইপিআই) মাধ্যমে ১৯৯৩ সালের মধ্যে প্রায় ৭৪% শিশুকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনা সম্ভব হয় এবং ১৯৯৮ সালের দিকে কোনো কোনো টিকার ক্ষেত্রে এটি ৮৫ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছায়। শিশুদের সর্বজনীন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধমূলক টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। এটি সম্ভব হয়েছে মানুষের মধ্যে ভাক্সিনেশনের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কারণে।
কাজেই সুস্বাস্থ্যময় ভবিষ্যতের জন্যে সময়মত এবং সঠিকভাবে ভাক্সিনেশন তথা রোগ প্রতিরোধকারী টিকা গ্রহণ অপরিহার্য। ভাক্সিনেশন সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখাটাও অনেক জরুরী।
ভ্যাক্সিনেশন এর মৌলিক ধারণা
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক অনন্য অবদান হচ্ছে ভ্যাক্সিনেশন বা টিকাদান। একটি নির্দিষ্ট প্যাথোজেনের (আক্রমণকারী বস্তু যেমন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদি) বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পদ্ধতিই হচ্ছে ভ্যাক্সিনেশন।
মূলত জীবাণুর নির্যাস থেকেই ভ্যাক্সিন প্রস্তুত করা হয়। আর জীবাণুর সাধারণত দুইটি বৈশিষ্ট্য থাকে, একটি হল রোগ সৃষ্টি করা (Pathogenecity)। আরেকটি হচ্ছে শরীরের ভেতরে সেই প্রাসঙ্গিক রোগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য কিছু সক্রিয় পদার্থ (Antibody) তৈরী করা। আর যখনই ভ্যাক্সিন তৈরী করা হয় রোগ সৃষ্টির করার সে ক্ষমতা সেটি নষ্ট করে দেয়া হয়। তবে অপর বৈশিষ্ট্যটি ঠিক রাখা হয়। ফলত জীবাণুরা দেহে রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় না, বরংঞ্চ সেই সংশ্লিষ্ট জীবানু রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এন্টিবডি তৈরি করা শুরু করে।
এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সুবিধা হল এই জীবাণুগুলো মেমোরি সেল গঠন করে ফলে পরবর্তীতে একই ধরনের জীবাণু আবার যদি প্রবেশ করে তাহলে এই মেমোরি সেলগুলো সহজেই জীবাণুদের সনাক্ত করতে পারে। যার ফলে শরীরের ইম্যুনিটি দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। আবার কখনো কখনো একটি ভ্যাক্সিনের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য এর সাথে আরেকটি ভ্যাক্সিনের যোগ করা হয়। একে সহযোগী (Adjuvant) ভ্যাক্সিন বলে। যেমন অ্যানথ্রাক্স ভ্যাক্সিনের সাথে যদি পারটুসিস ভ্যাক্সিন যোগ করা হয় তাহলে অ্যানথ্রাক্সের কাজ করার গতি বৃদ্ধি পাবে। আবার ভ্যাক্সিন সংরক্ষণ এর জন্য এর সাথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রিজারভেটিভ (Preservative) মেশানো হয়।
তাই বলা যায়, ভ্যাক্সিনেশন হচ্ছে সকল প্রকার সংক্রামক রোগ নিরাময়ের এক অনন্য কার্যপদ্ধতি।
ভ্যাক্সিনেশন এর ইতিহাস ও বিবর্তন
ভ্যাক্সিন বা টিকা দেওয়ার প্রচলন প্রায় শত শত বছর আগের একটি পদ্ধতি বলা চলে। অনেক আগে প্রায় সপ্তদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ সন্নাসীরা সাপের কামড় এবং মহামারীত্ব থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য বিষ পান করেছিলেন। যাই হোক, পশ্চিমাবিশ্বে এডওয়ার্ড জেনারকে “ভ্যাকসিনোলোজি”এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যখন তিনি ১৭৯৬ সালের দিকে তের বছরের এক বালক কে গোবসন্তের জীবাণু প্রয়োগ করেছিলেন এবং যা স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রদর্শন করেছিল। পরবর্তীতে ১৭৯৮ সালে গুটিবসন্তের মতো মহামারী রোগের টিকা প্রথম তৈরি হয়। আঠার এবং উনিশ শতকে, বিশ্বব্যাপী গুটিবসন্ত নির্মূলকরণে ব্যাপক ভাবে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হয় এবং ১৯৭৯ সালে এর সমাপ্তি ঘটে।
এছাড়া বিজ্ঞানী লুইস পাস্তুরের পরীক্ষাগুলি যথারীতি ১৮৯৭ সালে লাইভ অ্যাটিনুয়েটেড কলেরা ভ্যাক্সিন এবং ১৯০৪ সালে ইনঅ্যাকটিভেটেড অ্যানথ্রাক্স ভ্যাক্সিন তৈরিতে বিশদ ভূমিকা রেখেছিল। উনিশ শতকের পরবর্তী সময়ে প্লেগ ভ্যাক্সিনও আবিস্কার হয়। ১৮৯০ ও ১৯৫০ এর মধ্যে বিসিজি ভ্যাক্সিন সহ ব্যাকটেরিয়ার ভ্যাক্সিনের বিকাশ প্রসার লাভ করেছিল যা এখনো প্রচলিত বা ব্যবহৃত হচ্ছে।
১৯২৩ সালের কথা, আমরা এতোক্ষণে আধুনিক যুগে চলে এসেছি। সেই সময় আলেকজান্ডার গ্লেনি নামক একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন যিনি এই ১৯২৩ সালে ফর্মালডিহাইড দিয়ে টিটেনাস টক্সিন নিষ্ক্রিয় করার জন্য একটি পদ্ধতি সিদ্ধহস্ত করেছিলেন। ১৯২৬ সালের দিকে ডিপথেরিয়ার বিরুদ্ধে একটি ভ্যাক্সিন তৈরি করতে এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
এভাবে সময়ে সময়ে মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন রোগের ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হয়েছে। এখনও বিজ্ঞানীরা নতুন নতুন রোগের টিকা আবিষ্কারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন ।
ভ্যাক্সিনের প্রকারভেদ
অনেক ধরণের ভ্যাক্সিন রয়েছে, যেগুলি তাদের প্রস্তুতির জন্য ব্যবহৃত অ্যান্টিজেন দ্বারা শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। ভ্যাক্সিনগুলির গঠন প্রণালী প্রভাবিত হয় কতগুলি বিষয়ের উপর, যেমন তাদের কীভাবে ব্যবহার করা হয়, কীভাবে সংরক্ষণ করা হয় এবং কীভাবে প্রয়োগ করা হয়। বিশ্বব্যাপী ভ্যাকসিনগুলির চারটি প্রধান ধরণ রয়েছে।
১) লাইভ অ্যাটিনুয়েটেড ভ্যাক্সিন (জীবিত কিন্তু দূর্বল টিকা)
এই ধরণের ভাক্সিনগুলি তাদের রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া থেকেই তৈরি করা হয়। লাইভ ভ্যাকসিনগুলি রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর দুর্বল রূপ বা অংশটি ব্যবহার করে। এই জীবাণুগুলোর দুইটি অংশ রয়েছে যার একটি ক্ষতিকারক আরেকটি উপকারী। জীবাণুর এই ক্ষতিকারক অংশটিকে ল্যাবরেটরির সক্রিয় পরিবেশে ধবংস করা হয়। আর উপকারী অংশটি প্রাকৃতিক সংক্রমণের মতো এতটাই অনুরূপ যে তারা ভ্যাক্সিন দেওয়া ব্যক্তির ভেতর সংক্রমণের বিরুদ্ধে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে উদ্দীপিত করে। ফলে একটি শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী প্রতিরক্ষা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। সর্বাধিক লাইভ ভ্যাকসিনের মাত্র ১ বা ২ ডোজ আপনাকে একটি জীবাণু এবং এটির সৃষ্ট রোগের বিরুদ্ধে আজীবন সুরক্ষা দিতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, ব্যাকটেরিয়া সম্বলিত বিসিজি (BCG) ভ্যাক্সিন, ভাইরাস সম্বলিত পোলিও, মিজলস, রোটাভাইরাস, ইয়েলো ফেভার ভ্যাক্সিন ইত্যাদি।
২) ইনঅ্যাকটিভেটেড ভ্যাক্সিন (নিষ্ক্রিয় টিকা)
নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিনগুলি জীবাণুর মৃত বা নিষ্ক্রিয় অংশ ব্যবহার করা হয়। এদের ক্ষতিকর অংশ কেমিক্যাল এবং ইউভি-রেডিয়েশন দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এরা একটি নির্দিষ্ট জীবানুর বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। এরা লাইভ ভ্যাক্সিনের তুলনায় কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং অধিক স্থিতিশীল কিন্তু লাইভ ভ্যাকসিনগুলির মতো শক্তিশালী প্রতিরক্ষা করবে না। তবে এদের সঠিক কার্যকারিতা পাওয়ার জন্য একাধিক ডোজ বা বুস্টার শট দেওয়ার প্রয়োজন হয়।
উদাহরণস্বরূপ, হেপাটাইটিস এ ভ্যাক্সিন, জাপানিজ এনাসেফালিটিস ভাইরাস ভ্যাক্সিন।
৩) টক্সয়েড ভ্যাক্সিন
প্রোটিন নির্মিত টক্সিনের উপর ভিত্তি করে এই ধরণের ভ্যাক্সিন তৈরি হয়। এই ধরণের ভ্যাক্সিন তাপমাত্রা, আলো এবং পরিবেশের আর্দ্রতার প্রতি কম সংবেদনশীল। আর এই কারণে এই ধরণের ভ্যাক্সিন অধিক স্থিতিশীল হয়। টক্সয়েড ভ্যাকসিনগুলি জীবাণু দ্বারা তৈরি টক্সিন (ক্ষতিকারক উপাদান) ব্যবহার করে। এই ভ্যাকসিনগুলিতে প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা পুরো জীবাণুর পরিবর্তে জীবাণুর নির্দিষ্ট অংশে হয়। অর্থাৎ প্রতিরোধের প্রতিক্রিয়াটি শুধুমাত্র টক্সিনকে লক্ষ্যযুক্ত করে। উদাহরণ হিসেবে, ডিপথেরিয়া টক্সোয়েড ভ্যাক্সিন, টিটেনাস টক্সয়েড ভ্যাক্সিন ইত্যাদি।
অন্যান্য ভ্যাকসিনের মতো এক্ষেত্রেও রোগের বিরুদ্ধে চলমান সুরক্ষা পেতে বুস্টার শটের প্রয়োজন হতে পারে।
৪) সাব ইউনিট, রিকম্বিন্যান্ট, পলিস্যাকারাইড এবং কনজুগেট ভ্যাক্সিন
এই ভ্যাক্সিনগুলি জীবাণুর নির্দিষ্ট অংশ ব্যবহার করে। যেমন এর প্রোটিন, সুগার, অথবা ক্যাপসিড (জীবাণুর চারপাশে একটি আবরণ)। এর ফলে ভ্যাক্সিনগুলি জীবাণুর মূল অংশগুলিকে লক্ষ্য করে খুব শক্ত প্রতিরোধ ক্ষমতা দেয়। এগুলি প্রায় সবাইকে দেওয়া যায় বিশেষত যাদের দুর্বল প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। এই ভ্যাক্সিনগুলির একটি সীমাবদ্ধতা হল রোগের বিরুদ্ধে চলমান সুরক্ষা পেতে আপনার বুস্টার শটের (সহায়ক ডোজ) প্রয়োজন হতে পারে।
এই ভ্যাক্সিনগুলি যেসব রোগ থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়,
-
এইচ আই বি (হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা টাইপ বি)
-
হেপাটাইটিস বি
-
এইচ পি ভি (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস)
-
হুপিং কাশি (ডিটিএপি সম্মিলিত ভ্যাকসিনের অংশ)
-
নিউমোকোকাল রোগ
-
মেনিনোকোকাল রোগ
-
সিঙ্গলস রোগ বা কোঁচদাদ
ভবিষ্যতের ভ্যাক্সিন
আপনি কি জানেন যে বিজ্ঞানীরা এখনও নতুন ধরণের টিকা তৈরিতে কাজ করছেন? এখানে দুটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ রয়েছে,
-
ডিএনএ ভ্যাকসিনগুলি তৈরি করা সহজ এবং সাশ্রয়ী এবং তারা শক্তিশালী, দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধমূলক কার্যকারিতা দেয়।
-
রিকম্বিন্যান্ট ভেক্টর ভ্যাকসিনগুলি (প্ল্যাটফর্ম ভিত্তিক ভ্যাকসিনগুলি) একটি প্রাকৃতিক সংক্রমণের মতো কাজ করে, তাই তারা জীবাণুগুলির সাথে লড়াই করার জন্য বিশেষত আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষণ দেয়।
৬টি গুরুত্বপূর্ণ ভ্যাক্সিন যা শিশু মৃত্যুরহার কমায় ও সুস্থ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করে
ইপিআই (EPI) অর্থাৎ এক্সপান্ডেড প্রোগ্রাম অন ইমুনাইজেশন বা সম্প্রসারিত টিকা দান কর্মসূচি হলো বিশ্বস্বাস্থ্যসংস্থা কর্তৃক টিকাদান কর্মসূচি, যার লক্ষ্য সারা পৃথিবীর সকল শিশুকে এ কর্মসুচির অধীন নিয়ে আসা।
তারই ধারাবাহিকতায় ইপিআই (EPI) এই ৬টি ভ্যাক্সিন সারাবিশ্বের সব শিশুর জন্যে নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। আসুন জেনে নিই কোন ভ্যাকসিন কোন কোন রোগের জন্য দেওয়া হয়।
১) বিসিজি
বিসিজি ভ্যাকসিন যক্ষ্মা থেকে রক্ষা করে, যা টিবি নামেও পরিচিত। টিবি একটি গুরুতর সংক্রমণ যা ফুসফুস এবং কখনও কখনও শরীরের অন্যান্য অংশ যেমন হাড়, অস্থিসন্ধি এবং কিডনিকে প্রভাবিত করে। এর ফলে মেনিনজাইটিসও হতে পারে। বিসিজি ভ্যাকসিন জন্মের ঠিক পর পরই দেওয়া উচিত।
যারা ইমিউনোসাপ্রেসড ওষুধ দ্বারা চিকিৎসাধীন রয়েছেন তাদের মধ্যে এই টিকা দেওয়া উচিত নয়। কারণ এই ভ্যাকসিনের ডিএনএ স্ট্রেইনটি খুব দ্রুত প্রতিলিপি (রেপ্লিকেশন) তৈরি করতে পারে যা গুরুতর সংক্রমণের কারণ হয়ে দাড়াতে পারে। এর মধ্যে সেই সব শিশুরাই বেশি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যাদের মায়েরা গর্ভবতী বা বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় ইমিউনোসাপ্রেসড ট্রিটমেন্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
২) পেন্টাভ্যালেন্ট
ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, টিটেনাস, হেপাটাইটিস-বি ও ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিষেধক হিসেবে পেন্টাভ্যালেন্ট ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুকে ৫টি মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
ডিপথেরিয়া কোরিনেব্যাকেরিয়াম ডিপথেরিয়া নামক একটি ব্যাকটিরিয়া দ্বারা সৃষ্ট যা মায়োকার্ডাইটিস (হৃদয়ের পেশী প্রদাহ), স্নায়ুর প্রদাহ এবং কিডনির সমস্যার কারণ হতে পারে। এটি সংক্রামিত বস্তু বা বায়ুর মাধ্যমে ছড়ায়।
পারটুসিসকে হুপিং কাশিও বলে যা অত্যন্ত সংক্রামক একটি বায়ুবাহিত ব্যাকটিরিয়া রোগ। এটি আক্রান্ত ব্যক্তিদের থেকে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে যাকে উচ্চ সংক্রামক শ্বাসকষ্টের রোগ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
হেপাটাইটিস বি (হেপবি) ভাইরাস লিভারের ক্যান্সারের প্রধান কারণ এবং এইচআইভির চেয়ে ৫০ গুণ বেশি সংক্রামক। সংক্রমণ বেশিরভাগ ছোট বাচ্চাদের মধ্যেই দেখা যায় তবে ভাইরাসটির মারাত্মক পরিণতিগুলি সাধারণত পরবর্তী জীবনে লিভার সিরোসিস বা লিভারের ক্যান্সার সহ দীর্ঘস্থায়ী রোগের আকারে শুরু হয়।
হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি হচ্ছে প্রাণনাশী সংক্রমক যা বিশেষত বাচ্চাদের মধ্যে মারাত্মক অসুস্থতার কারণ হয়ে দাঁড়ায় । লক্ষণসমুহ হচ্ছে, গুরুতর মাথাব্যথা, শক্ত ঘাড়, খিঁচুনি, তীব্র তন্দ্রা, জেগে উঠতে অসুবিধা, চেতনা হ্রাস হওয়া বা শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া ইত্যাদি।
টিটেনাস ক্লোস্ট্রিডিয়াম টেটানি নামক ব্যাকটিরিয়া দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রমণ। টিটেনাস একটি মারাত্মক রোগ যা খিঁচুনি এবং গুরুতর পেশীগুলির দীর্ঘায়িত সংকোচন সৃষ্টি করে যা মেরুদণ্ডের হাড় ভাঙার কারণ হতে পারে। এটি প্রায়শই কোনও ব্যক্তির ঘাড় এবং চোয়ালের পেশীগুলিকে লক করে দেয়, যার ফলে মুখ খুলতে বা গিলে ফেলা কষ্ট হয়।
৩) পোলিও ভ্যাক্সিন
পোলিও রোগটি পলিওমিলাইটিস পোলিও নামে পরিচিত। এটি মূলত পোলিও ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ যা কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে এবং অস্থায়ী বা স্থায়ী প্যারালাইসিস এর কারণ হতে পারে। প্রায় ০.৫% ক্ষেত্রে পেশী দুর্বলতা থাকে যার ফলে নড়াচড়া করতে সমস্যা হয়।
পোলিওর বিরুদ্ধে টিকা দেওয়ার জন্য দুই ধরণের ভ্যাকসিন পাওয়া যায় সেগুলি হল ওপিভি (ওরাল পোলিও ভ্যাকসিন) এবং আইপিভি (নিষ্ক্রিয় পোলিও ভ্যাকসিন)।
ওপিভি: পোলিও নির্মূলের লড়াইয়ে ওপিভি হল প্রধান টিকা। বিভিন্ন ধরণের ওপিভি রয়েছে, যার মধ্যে কোনটির একটি, কোনটির দুটি এবং কোনটির তিনটি পৃথক পৃথক সেরোটাইপ দিয়ে গঠিত। এগুলির প্রত্যেকের নিজস্ব কিছু সুবিধা এবং অসুবিধা রয়েছে। ওপিভিগুলি নিরাপদ এবং কার্যকর এবং তারা নির্দিষ্ট সেরোটাইপগুলির বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা দেয়। ওপিভি গুলি মুখে খাওয়ানো হয় ফলে সুই সিরিঞ্জ এর ঝামেলা পোহাতে হয় না। যেহেতু ওপিভি জীবিত জীবাণু দ্বারা গঠিত সেক্ষেত্রে পোলিও পুনরায় সংক্রমিত হতে পারে কিন্তু তা খুবই নগণ্য।
আইপিভি: আইপিভি হচ্ছে পলিওমিলাইটিস থেকে রক্ষা করার জন্যে বিশেষ ইঞ্জেকশন যা ওপিভি এর চেয়ে আরও ভাল সুরক্ষা নিশ্চিত করে। এতে ভাইরাসের নিষ্ক্রিয় (মৃত) রূপ ব্যবহিত হয় ফলে তা পুনরায় পোলিও সৃষ্টি করতে পারে না। আইপিভি বাহুতে বা পায়ে দেওয়া হয়।
৪) পিসিভি- নিউমোনিয়ার প্রতিষেধক
পিসিভি ভ্যাক্সিন মূলত নিউমোকক্কাল পলিস্যাকারাইড এর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ব্যবহৃত হয়, যা নিউমোনিয়ার একটি প্রধান কারণ হিসাবে স্বীকৃত। নিউমোনিয়ার ফলে সাধারণত শ্বাসনালী, সাইনাস এবং নাকের গহ্বর সংক্রামিত হয়।
৫) এম আর অর্থাৎ হাম ও রুবেলার প্রতিষেধক
এই ভ্যাকসিন দুটি রোগ প্রতিরোধের জন্যে ব্যবহার করা হয়,
হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক ভাইরাল সংক্রমণ যা বাতাসের মাধ্যমে ব্যক্তি থেকে শুরু করে ছড়িয়ে পড়ে। হাম আক্রান্ত ব্যক্তির নাক এবং গলা শ্লেষ্মায় থাকে এবং কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে অন্যের কাছে ছড়িয়ে যায়।
রুবেলা একটি ভাইরাসজনিত সংক্রামক রোগ। রুবেলাও একইভাবে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে, কাশি ও হাঁচির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
৬) টিটেনাস টক্সয়েড - টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার রোগের প্রতিষেধক
টিটেনাস বা ধনুষ্টংকার একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ যা প্রধানত মাংসপেশী ও স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। এর ফলে ঐচ্ছিক পেশী তন্তুর দীর্ঘায়িত সঙ্কোচন ঘটে যা পরবর্তীতে মেরুদণ্ডের হাড়ের হাড়ভাঙার কারণ হিসাবে যথেষ্ট ভুমিকা পালন করে।
টিটেনাস ব্যাকটিরিয়া দ্বারা সৃষ্ট হয় যা খোলা ক্ষতের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। ব্যাকটিরিয়াগুলি পেশীগুলিকে আরও শক্ত করে তোলে, ফলে মেরুদণ্ডের সংকোচন হয়। অবশেষে, শ্বাস নেওয়া আরও কঠিন হয়ে যায় এবং সংকোচন ঘন ঘন হতে থাকে।
সব বয়সের লোকেরা টিটেনাস পেতে পারেন। তবে এই রোগটি নবজাতক শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ এবং গুরুতর। একে নিউটোনাল টিটেনাস বলা হয়। গর্ভাবস্থায় বা গর্ভাবস্থার আগে বাচ্চাদের জন্মদানকারী মহিলাদের টিটেনাস টক্সয়েড টিকা দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা যায়। এটি যেমন মাকে সুরক্ষা দেয় এবং তেমনি ভ্রূণে টিটেনাস অ্যান্টিবডিগুলি স্থানান্তরিত করার মাধ্যমে তার শিশুকেও সুরক্ষা দেয়।
শিশুর রোগ প্রতিরোধের জন্যে আরো গুরুত্বপূর্ণ ৪টি ভ্যাক্সিন
১) দেড় মাস বয়সে কলেরা ভ্যাক্সিন
কলেরা একটি সংক্রামক রোগ যা ‘ভিব্রিও কলেরী’ নামক ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে হয়ে থাকে। কলেরার প্রধান উপসর্গ হল বারবার পাতলা পায়খানা সঙ্গে পেটব্যথা, পানির অভাবে শারীরিক দৌর্বল্য। মানব শরীরে এই রোগের সংক্রমণের প্রধান বাহক হচ্ছে পানি অথবা খাদ্য।
২) বার মাস বয়সে চিকেন পক্স (জলবসন্ত) এর ভ্যাক্সিন
জলবসন্ত ভাইরাস ঘটিত একটি রোগ যা অত্যন্ত ছোঁয়াচে। জলবসন্ত সাধারণত ১০ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে হয়ে থাকে, তবে যেকোন বয়সে এটি হতে পারে। এর ফলে চুলকুনি, ক্লান্তি ও জ্বর ছাড়াও চামড়ায় ফুসকুড়ির মতো দেখা যায়
৩) আঠার মাস বয়সে হেপাটাইটিস-এ এর ভ্যাক্সিন
হেপাটাইটিস এ একটি পানিবাহিত ভাইরাস। এটি পানি বা খাবার, কিংবা অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশনের কারনে ছড়িয়ে পড়ে। এটি মুখের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে। হেপাটাইটিস এ শরীরে প্রবেশের দুই মাসের মধ্যে চলে যায়, এর দীর্ঘমেয়াদী কোন প্রভাব থাকেনা।
৪) দুই বছর বয়সে টাইফয়েড এর ভ্যাক্সিন
টাইফয়েড জ্বর স্যালমোনেলা টাইফি নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে হয়ে থাকে। দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে প্রধানত দেহে এই জীবাণু ছড়ায়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার লোকজনের টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। জ্বরের সঙ্গে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, ক্ষুধামন্দা ও শারীরিক দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া ও বমি হতে পারে।
মহামারী প্রতিরোধে যুগান্তকারী ২টি ভ্যাক্সিন
১) ম্যালেরিয়ার টিকা
বিশ্বের প্রথম ম্যালেরিয়ার টিকা হিসেবে “মসকিউরিস্ক” নামক ভ্যাক্সিন অনুমোদন পেয়েছে। এ টিকাটি ইউরিপিয়ান ইউনিয়ন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, অফ্রিকার শিশুদের ওপর ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। ব্রিটিশ ওষুধ প্রস্তুতকারক গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন লিমিটেড এই ভ্যাক্সিনের উৎপাদন এবং মোড়কজাত করেছে। বিল গেটসের বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস নামক ফাউন্ডেশনটি যুগান্তকারী এ টিকা উৎপাদনে ব্যবসায়িক কোম্পানির পাশাপাশি অর্থিকভাবে সহায়তা দিয়েছেন । সম্প্রতি আরটিএস, এস বা মসকিউরিস্ক নামক এ ঔষধ ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি (ইএমএ) বিশ্বের প্রথম ম্যালেরিয়ার ভ্যাক্সিন হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে।
প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়ায় শুধু ২০১৩ সালেই অফ্রিকায় প্রায় ৫ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা গেছে। তার মধ্যে ৮০ ভাগই ছিল শিশু। তাই গ্ল্যাস্কোস্মিথক্লাইন ৩০ বছর পর্যন্ত বয়স্কদের মধ্যে ব্যবহারের জন্য এ টিকা প্রস্তুত করা শুরু করেছিল। এর আগে ২০১৩ সাল থেকেই কোম্পানিটি 'প্রোটোটাইপ এ' ভ্যাক্সিনটি অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের প্রধান নির্বাহী এই অনুমোদনকে যুগান্তকারী সিদ্বান্ত হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন।
২) ইবোলা ভাইরাসের টিকা
বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, গিনিতে পরীক্ষামূলক ভাবে এই টিকা প্রদান করা হয় এবং এর শতভাগ সফলতা দৃষ্টিগোচর হয়। ২০১৩ সালে পশ্চিম আফ্রিকার যে তিনটি দেশে ইবোলা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল গিনি তার একটি ছিল।
প্রাথমিকভাবে গিনির প্রায় ৬ হাজার মানুষকে ওই টিকা দেওয়া হয়। ১০ দিন পর তাদের কারো দেহে ইবোলা ভাইরাস পাওয়া যায়নি। যাদের টিকা দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে মাত্র একজনের শরীরে গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তার শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। যদিও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছেন। তবে শিশুদের উপর এই টিকার প্রভাব কী হবে তা জানা যায়নি। কারণ গবেষণায় কোনো শিশু অংশ নেয়নি।
১৯৭৬ সালে প্রথম পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়। সেবার প্রায় ১১ হাজার মানুষ ইবোলায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ২০১৩ সালে গিনিতে নতুন করে ইবোলার প্রাদুর্ভাব হয়, যা লাইবেরিয়া ও সিয়েরা লিওনে ব্যাপকভাবে ছড়ি পড়ে এবং এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়।
ভাক্সিনেশন এর সময়তালিকা : ইপিআই এর সহায়িকা অনুযায়ী ভ্যাক্সিনেশন এর ডোজ শিডিউল
শিশুদের নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি:
১৫-৪৯ বছর বয়সের মহিলাদের টিকাদান কর্মসূচি:
আপনার সন্তানের টিকাদানের সময় যে বিষয়গুলো অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে
১. সবগুলো টিকা সময়সূচি অনুযায়ী শেষ করতে হবে।
২. সর্বনিম্ন বিরতির আগে টিকা দিলে তা কার্যকরী হবে না এবং এই ডোজটি বাতিল বলে গণ্য হবে।
৩. পোলিও, পেন্টাভেলেন্ট, পিসিভি ও টিটি টিকার ডোজের বিরতির কোনো সর্বোচ্চ সীমা নেই। দুটি ডোজের মধ্যে সময় যদি ৬/১২ মাসেরও বেশি হয় তবুও আবার প্রথম থেকে টিকা দেয়া শুরু করা যাবে না। নুণ্যতম বিরতি পার হলেই পরবর্তী ডোজ টিকা দিতে হবে। অর্থাৎ প্রথম ডোজ দেয়ার ২৮ দিনের পরিবর্তে ২/৩ মাসের পরে হলেও দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে।
৪. টিকার স্থানে ফোড়া হলেও পরবর্তী টিকার ডোজ সময়সূচি অনুযায়ী দিতে হবে।
৫. বিসিজি দেয়ার পরবর্তী সময়ে শিশুর বাম বাহুতে যদি শক্ত দানা, দাগ বা ক্ষত চিহ্ন থাকলে বুঝতে হবে বিসিজি টিকা সফলভাবে কাজ করেছে। যদি কোনো দাগ না হয় তাহলে পেন্টাভ্যালেন্ট টিকার ৩য় ডোজ দেয়ার সময় পুনরায় বিসিজি টিকা দিতে হবে।
৬. জন্মের ১৪ দিনের মধ্যে শিশুকে এক ডোজ পোলিও টিকা খাওয়াতে হবে। তবে এই ডোজ “০” (জিরো) ডোজ হিসেবে গণ্য করতে হবে। পরবর্তীতে জন্মের ৬ সপ্তাহ বা ৪২ দিন বয়স থেকে নিয়ম মতো আরো ৪ ডোজ ওপিভি টিকা খাওয়াতে হবে।
৭. পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন দেওয়ার পর সাধারণত কোনো মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হয় না। তবে কদাচিৎ খিচুনি হতে পারে। যদি খিচুনি হয় তবে পুনরায় পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না। এই টিকাদানের পর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হিসেবে রিপোর্ট করতে হবে। ২৮ দিন পর ১ ডোজ টিটি টিকা দিতে হবে।
৮. পূর্বে শরীরে কোনো দানা উঠে থাকলে অথবা অতীতে কোনো সময়ে হাম/রুবেলা হয়ে থাকলেও সেই শিশুকে ৯ মাস পূর্ণ হলে ১ ডোজ এমআর টিকা এবং ১৫ মাস বয়স পূর্ণ হলে ১ ডোজ হামের টিকা (২য় ডোজ) দিতে হবে।
৯. ১৫ মাস বয়স পূর্ণ হলেই শিশুদের ১ ডোজ হামের টিকা দিতে হবে। ১৮ মাস বয়সের মধ্যে অবশ্যই হামের টিকা দেয়া শেষ করতে হবে। এটি হামের ২য় ডোজ হিসাবে গণ্য করা হবে।
১০. ১৫ বছর বয়সের সকল কিশোরীদের ১ ডোজ হাম ও রুবেলার (এমআর) টিকা, টিটি টিকার প্রাপ্য ডোজের সাথে বাহুর উপরের অংশে চামড়ার নিচে দিতে হবে। কিশোরী প্রাপ্য টিটি টিকার ডোজ বাম বাহুতে নিলে ডান বাহুতে এমআর টিকা দিতে হবে। পরবর্তীতে ঐ কিশোরীকে টিটি টিকার সময়সচি অনুযায়ী ৫ ডোজ টিটি টিকা শেষ করতে হবে।
১১. গর্ভবতী অবস্থায় এমআর টিকা দেয়া যাবে না। গর্ভাবস্থায় এমআর টিকা দিলে গর্ভের শিশুর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তাই এমআর টিকা দেওয়ার আগে অবশ্যই গর্ভবতী কিনা সেটা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিৎ।
১২. নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রমে পেন্টাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন ১ম ডোজ বাম উরুতে, ২য় ডোজ ডান উরুতে এবং ৩য় ডোজ বাম উরুতে দিতে হবে।
১৩. নিয়মিত টিকাদান কার্যক্রমে পিসিভি বা নিউমোনিয়া ভ্যাকসিন ১ম ডোজ ডান উরুতে, ২য় ডোজ বাম উরুতে এবং ৩য় ডোজ ডান উরুতে দিতে হবে।
১৪. একাধিক টিকা একই সাথে দেয়া যায়। এতে টিকার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে কোনো অসুবিধা হয় না এবং কোনো প্রতিক্রিয়াও হয় না। তবে প্রতিটি টিকা অবশ্যই শরীরের আলাদা আলাদা স্থানে দিতে হবে। প্রয়োজনে একই পায়ে একই সময়ে ১-২ ইঞ্চি (২.৫ সেমি থেকে ৫ সেমি) ব্যবধানে অন্য আরেকটি টিকা দেয়া যেতে পারে।
১৫. ইপিআই নিয়ম অনুযায়ী শুধুমাত্র ১৫-৪৯ বৎসরের কিশোরী/মহিলাদের টিটি টিকা দিতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো বয়সের কিশোরী/মহিলা এবং পুরুষ বা শিশুকে টিটি টিকা দেয়া যাবে না। এর ব্যতিক্রম হচ্ছে, যে শিশুর পেন্টাভ্যালেন্ট টিকা দেওয়ার পর খিচুনি হয়েছে তাকে পেন্টাভ্যালেন্ট টিকা না দিয়ে পরবর্তী নির্দিষ্ট সময়ে ১ ডোজ টিটি টিকা দিতে হবে।
কখন টিকা দেওয়া যাবে?
প্রায় সকল অবস্থায় টিকা দেয়া যায়। টিকা দিলে যে সামান্য জ্বর বা ব্যথা হয়; তার চেয়ে টিকা না দিয়ে রোগাক্রান্ত হওয়া অনেক বেশি ঝুকিপূর্ন।
অপষ্টিতে ভুগছে এমন শিশুকে অবশ্যই টিকা দিতে হবে। এই সব শিশুর দেহে রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কম থাকে। সুতরাং তার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করার জন্যই টিকা দেয়া বেশি জরুরী।
কখন টিকা দেয়া যাবে না?
১. অসুস্থ শিশুকে টিকা দেয়া যাবে না।
২. পূর্ববর্তী পেন্টাভ্যালেন্ট টিকা দেয়ার পর শিশুর খিচুনি বা অজ্ঞান হলে পরবর্তী পেন্টাভ্যালেন্ট টিকার ডোজ দেয়া যাবে না। এই ক্ষেত্রে পেন্টাভ্যালেন্ট টিকার বদলে ১ ডোজ টিটি টিকা দিতে হবে এবং শিশুকে অন্যান্য সকল টিকা (ওপিভি, এমআর, হাম) নিয়ম অনুযায়ী দিতে হবে।
৩. পূর্ববর্তী টিকা দেয়ার পর কোনো মারাত্বক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হলে পরবর্তী টিকা দেয়ার পূর্বে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
টিকাদান পরবর্তী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ও জটিলতা
টিকার সামান্য পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও তা খুব কম ক্ষেত্রেই মারাত্মক হয়ে থাকে। নিচের চার্টে বিভিন্ন টিকার সম্ভাব্য কী কী পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া ও জটিলতা হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে তা দেখানো হলো।
কলেরা, চিকেন পক্স বা জলবসন্ত , হেপাটাইটিস এ এবংটাইফয়েড এর টিকা ইপিআই তে দেয়া হয় না। তবে এই টিকা গুলো দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শে বিভিন্ন হাসপাতাল বা সাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে এই টিকাগুলো আপনার শিশুকে দিতে পারেন। নবজাতকের সুস্থতার জন্য প্রত্যেক বাবা মার উচিত টিকাদানের প্রত্যেকটা বিষয় সম্পর্কে সচেতন হওয়া।