মাইগ্রেন কি? মাইগ্রেনের ৪টি স্টেজ কি কি?

আপনাকে কখন মাইগ্রেন অ্যাটাক করবে তা জানা প্রায়ই কঠিনই। তবে মাইগ্রেনের স্টেজ ও তাদের লক্ষণ এবং এর ধরণ সম্পর্কে আপনার ধারণা থাকলে সহজেই মাইগ্রেন অ্যাটাকের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারবেন।

  • প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ মাইগ্রেন রোগটিতে ভুগে থাকেন। 

  • পুরুষের চেয়ে নারীদের মাইগ্রেনে ভোগার প্রবণতা প্রায় ৩ গুন।

“যার মাইগ্রেন আছে, তার কোন শত্রুর প্রয়োজন নেই”, এ কথাটা কতটুকু সত্য একজন মাইগ্রেন রোগীই অনুভব করতে পারেন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কি, অসহনীয় আর একটানা ব্যথায় একজন মাইগ্রেন রোগী কাতর হয়ে‌‌ ওঠেন। যার ফলে ব্যাহত হয় রোগীর জীবনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড।  প্রখরতা বাড়লে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যথায় একদম অসাড় হয়ে যেতে হয়। চলুন একদম গোড়া থেকে শুরু করে মাইগ্রেনের সমস্ত ইতিবৃত্তান্ত সম্পর্কে জানা যাক।

 

মাইগ্রেন কি?

মাইগ্রেন একটি স্নায়বিক (স্নায়ুতন্ত্র জনিত) বংশগত রোগ (প্রায় ৬০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে), যা মস্তিষ্কের স্পর্শকাতরতা, রক্ত সঞ্চালন ও রাসায়নিক গোলযোগ এর কারণে তীব্র ব্যথা সৃষ্ট করে। এটি এমন এক ধরণের মাথাব্যথা যা সাধারণত মাথার একপাশে প্রচণ্ড কেঁপে কেঁপে ব্যথা বা অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে।

মাইগ্রেন হলে প্রায়শই বমি বমি ভাব বা বমি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এটি আলো ও শব্দের প্রতি চরম সংবেদনশীল হয়। মাইগ্রেনের আক্রমণ কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন স্থায়ী হতে পারে এবং ব্যথা এতটাই খারাপ হতে পারে যে এটি আপনার দৈনন্দিন কাজকর্মকে মারাত্নকভাবে ব্যহত করে।

 

মাইগ্রেন "শুধু মাথাব্যথা" এর চেয়ে অনেক বেশি

বিভিন্ন ধরনের মাইগ্রেনের বিভিন্ন লক্ষণ বা উপসর্গ রয়েছে। এর অনেক বৈশিষ্ট্য বা লক্ষণ আছে যা মাইগ্রেনেরই একটি অংশ। মাইগ্রেনের স্টেজগুলি এবং তাদের লক্ষণগুলিই সাধারণ মাথাব্যথা থেকে মাইগ্রেনকে আলাদা করে। একটি লক্ষণ কতটা গুরুতর হতে পারে তার মধ্যেও পার্থক্য রয়েছে।

মাইগ্রেন অ্যাটাকের সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে-

  • মাথা ব্যথা

  • আলো, শব্দ এবং গন্ধের প্রতি সংবেদনশীলতা

  • বমি বমি ভাব (অসুস্থ বোধ)

  • বমি করা (অসুস্থ হওয়া)

  • অলসতা (শক্তির অভাব)

 

মাইগ্রেন অ্যাটাকের স্টেজগুলো

সাধারণত মাইগ্রেন শৈশব, বয়ঃসন্ধিকাল বা যৌবনের প্রথম দিকে শুরু হয় এবং ৪টি স্টেজ বা পর্যায়ে অগ্রসর হতে পারে- 

     ১. প্রোড্রোম: মাইগ্রেন শুরু হবার আগের উপসর্গ

     ২. অরা (Aura): ২০-৬০ মিনিট চোখের সামনে উদ্ভট আলো ও অন্ধকার দেখা,

     ৩. মাইগ্রেন অ্যাটাক: আসল মাইগ্রেন, এবং 

     ৪. পোস্ট-ড্রোম: মাইগ্রেন শেষের পর্যায়। 

তবে মাইগ্রেন আছে এমন সবাই কিন্তু সব স্টেজে নাও যেতে পারে। অর্থাৎ, প্রত্যেকে প্রতিটি পর্যায়ের সমস্ত লক্ষণগুলি অনুভব নাও করতে পারে। আবার স্টেজগুলি একটার সাথে আরেকটার ওভারল্যাপ বা সংমিশ্রণ হতে পারে।

আসুন মাইগ্রেনের স্টেজগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই-

১. প্রোড্রোম

এটিকে কখনও কখনও সতর্কতা স্টেজ হিসাবে বর্ণনা করা হয় যেখানে আপনার নির্দিষ্ট শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তন ঘটতে পারে। সাধারণত মাইগ্রেনের এক বা দুই দিন আগ থেকে আপনি সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পারেন যা আসন্ন মাইগ্রেনের বিষয়ে আপনাকে সতর্ক করে, যার মধ্যে রয়েছে-

  • ক্লান্ত বোধ করা

  • বার বার হাই তোলা

  • মুড সুইং

  • ডিপ্রেশন

  • ঘাড়ে অসাড় ভাব

  • ফুড ক্রেভিং (খাবার প্রবল ইচ্ছা)

  • বেশি মূত্র হওয়া

  • কোষ্ঠকাঠিন্য

এই অনুভূতিগুলো ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

২. অরা 

কিছু লোকের ক্ষেত্রে (৩০% মানুষের হয়), মাইগ্রেনের সময় বা হওয়ার আগে একটি অরা বা আভা দেখা দিতে পারে। তবে অরা ছাড়া মাইগ্রেন এই স্টেজে অন্তর্ভুক্ত নয়।

একটি ভিজ্যুয়াল অরা হচ্ছে একটি বৈদ্যুতিক বা রাসায়নিক তরঙ্গের মতো যা আপনার মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স জুড়ে চলে। ভিজ্যুয়াল কর্টেক্স হল আপনার মস্তিষ্কেরই অংশ যা ভিজ্যুয়াল সিগন্যাল প্রক্রিয়া করে। আর তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই আপনার ভিজ্যুয়াল হ্যালুসিনেশন হতে পারে।

প্রতিটি উপসর্গ সাধারণত ধীরে ধীরে শুরু হয় যা কয়েক মিনিটের মধ্যে তৈরি হয় এবং ২০-৬০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

মাইগ্রেন অরার উদাহরণগুলির মধ্যে রয়েছে-

  • দৃষ্টিশক্তির পরিবর্তন (দৃষ্টিতে ব্যাঘাত) যেমন, চোখে বিভিন্ন আলোর রেখা দেখা (গাঢ় দাগ, রঙিন দাগ, ঝকঝকে বা 'তারকা', জিগজ্যাগ লাইন, জ্যামিতিক আকৃতি ইত্যাদি)

  • ব্লাইন্ড স্পট বা অন্ধকার জায়গা দেখা

  • হঠাৎ করে কিছু না দেখা

  • মুখের একপাশ অবশ হওয়া ও পিন ফোটার মত ব্যথা

  • দুর্বলতা

  • ভার্টিগো বা মাথা ঘোরা

  • কথা বলায় এবং শ্রবণে পরিবর্তন হতে পারে

মাথাব্যথা ছাড়াই অরার লক্ষণগুলি থাকা সম্ভব, তবে এটিকে 'নীরব মাইগ্রেন' হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

৩. মাইগ্রেন অ্যাটাক

একটি মাইগ্রেন অ্যাটাক সাধারণত ৪ থেকে ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে যদি না কোন চিকিৎসা না নেওয়া হয়। তবে এই স্থায়িত্ব ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়।

মাইগ্রেনের সময়, আপনার যে লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে-

  • সাধারণত মাথার একপাশে যন্ত্রণা হওয়া, অনেক সময় দু পাশেই হয়,

  • ব্যথা ঘাড়, মাথার পেছন থেকে শুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে,

  • ব্যথা হার্টবিটের মত বাড়া কমা, কিংবা একটানা ভোতা যন্ত্রণা হওয়া,

  • তীব্র শব্দে, উজ্জ্বল আলোতে, এমনকি সাধারণ কথাবার্তায় ব্যথা বাড়া,

  • বমি ভাব ও বমি হওয়া।

৪. পোস্ট-ড্রোম

এটি মাইগ্রেন অ্যাটাকের চূড়ান্ত পর্যায়, এবং এই অবস্থা কয়েক ঘন্টা বা ক দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।

  • প্রচণ্ড দুর্বলতা,

  • শক্তি না পাওয়া,

  • মাথা ঠিক মত কাজ না করা‌,

  • হঠাৎ মাথা নড়াচড়া করলে অল্প সময়ের জন্য আবার ব্যথা হতে পারে।

 

মাইগ্রেনের ধরণ

অরা এর উপর নির্ভর করে মাইগ্রেন তিন প্রকার।

     ১. অরা সহ মাইগ্রেনের মাথাব্যাথা

     ২. অরা ছাড়া মাইগ্রেনের মাথাব্যথা

     ৩. শুধু অরা দেখা, মাথাব্যথা ছাড়া

আবার, মাইগ্রেনের পুনরাবৃত্তির উপর নির্ভর করে একে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়-

     ১. এপিসোডিক মাইগ্রেন (Episodic migraine): মাসে ১৫ টির কম মাইগ্রেন এটাক হলে।

     ২. ক্রোনিক মাইগ্রেন (Chronic migraine): মাসে ১৫ টির বেশি মাইগ্রেন এটাক হলে

 

শেষকথা

মাইগ্রেন অ্যাটাকের বিভিন্ন স্টেজ সম্পর্কে সচেতন হওয়া আপনার স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক হতে পারে। কারণ এটি আপনাকে মাইগ্রেেন অ্যাটাকের জন্য প্রস্তুত করতে, রোগ নির্ণয় করতে এবং কখন ব্যথানাশক ঔষুধ দেওয়া লাগতে পারে, কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে এবং আপনার নিয়মিত কাজগুলিকে মানিয়ে নিতে সহায়তা করতে পারে।

তাই মাইগ্রেনের স্টেজ অনুসারে আপনার একটি রেসকিউ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান থাকা জরুরী। আর অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে ভুলবেন না।

 

মাইগ্রেন নিয়ে আমাদের অন্যান্য লেখাগুলি-

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles