কিডনিতে পাথর কেন হয়? চিকিৎসা করবেন কীভাবে?

কিডনিতে স্টোন বা পাথর সাধারণত জটিল রোগ না হলেও চিকিৎসায় বিলম্ব করলে ক্রনিক এবং জটিল কিডনি রোগ হতে পারে। তাই কিডনি পাথরের লক্ষণ, কারণ ও চিকিৎসা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এই প্রবন্ধটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।

  • প্রতি দশজনের একজন জীবনকালে কিডনিতে পাথর রোগে আক্রান্ত হন

  • অপর্যাপ্ত পানি পান, খাদ্যাভ্যাস স্থূলতা ও লাইফ-স্টাইলের প্রভাবে এ রোগটি হতে পারে

  • প্রচুর পানি পান, ঔষধ, সাউন্ড ওয়েভ জটিল অবস্থায় সার্জারির মাধ্যমে এর চিকিৎসা করা হয়

 

কিডনি স্টোন কি?

কিডনি প্রতি মুহূর্তে আমদের শরীর থেকে রক্ত ছেকে ইউরিক এসিড, অক্সালেট, লবণ, বাড়তি ক্যালসিয়াম ইত্যাদি ক্ষতিকর পদার্থ দূর করছে। অপর্যাপ্ত পানি পান করলে, কিংবা কিছু খাদ্য অতিরিক্ত গ্রহণ করলে প্রস্রাবের ঘনত্ব বেড়ে, যার ফলে ঘন মূত্রের থেকে ছোট কঠিন পদার্থ তৈরি হয়। প্রথমে এই দানা আকৃতি নিলেও এর আকার বাড়তে থাকে যাকে কিডনিতে পাথর বা কিডনি স্টোন বলে। 

অন্যান্য কিডনির রোগ টের পাওয়া অনেকসময় কষ্টকর হলেও মূত্রের ধরণ ও কিছু উপসর্গ দেখে কিডনিতে পাথরের উপস্থিতি টের পাওয়া যায়।

 

কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ

কিডনি স্টোন বালির দানা থেকে শুরু করে মটরদানার কিংবা আরও বড় হতে পারে। যত বড় পাথর কিডনিতে তৈরি হয়, উপসর্গও তত প্রকট হয়ে ওঠে। কিডনিতে পাথর হলে বোঝার উপায়-

  • প্রস্রবে জ্বালাপোড়া

  • ঘোলা ও প্রস্রাবের পরিমাণ কম হওয়া।

  • কোমরের  দুইপাশে ব্যথা হওয়া

  • প্রস্রাবে রক্ত আসা

  • জ্বর ও কাঁপুনি

  • বমি হওয়া বা বমি ভাব।

কিডনিতে পাথরের কারণে তখনি ব্যথা শুরু হয় যখন পাথরটি কোনরকম বাঁধা ব্লকেজ তৈরি করে। বেশিরভাগ কিডনি স্টোন কিডনিতে কোন ক্ষতি ছাড়া বেরিয়ে যায়, কিন্তু ব্যথা ছাড়া নয়।

 

কিডনিতে পাথর কেন হয়?

  • কিডনিতে পাথর হবার একটি প্রধান কারণ হলো পর্যাপ্ত পানি পান না করা। এতে মূত্রের ঘনত্ব বেড়ে যায় ও নিয়মিত এমন চলতে থাকলে কিডনি স্টোনের সম্ভাবনা বাড়ে।

  • লবণ বেশি খাওয়া ও অক্সালেট যুক্ত খাবার বেশি খাওয়ার কারণেরও কিডনি স্টোনের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

  • অতিরিক্ত ওজন, 

  • মাংস বেশি খাওয়া,

  • খুব বেশি বা কম ব্যয়াম করলেও কিডনি স্টোন হতে পারে।

  • অনেকের ক্ষেত্রে ইনফেকশন ও পারিবারিক ইতিহাসও কিডনিতে পাথর এর জন্য দায়ী হতে পারে। 

 

কিডনি পাথর নির্ণয় করে কীভাবে?

কিডনিতে পাথর নির্ণয় করার জন্য প্রথমত ডাক্তার আপনার উপসর্গ গুলে শুনবেন ও ফিজিক্যাল চেকাপ করবেন। উপসর্গ শুনে পরবর্তী চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন অথবা, টেস্ট দিতে পারেন। সিটি স্ক্যান ও কিডনি ও ব্লাডারের এক্সরের মাধ্যমে পাথরের আকার, অবস্থান ও জটিলতার সম্ভাবনা বোঝার চেষ্টা করা হয়। চিকিৎসার আগে ও পরে এসব টেস্ট করার প্রয়োজন পড়তে পারে।

মূলত আপনার শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভর করে ডাক্তার বিভিন্ন চিকিৎসার উপায় গ্রহণ করতে পারেন। রক্তে ও মূত্রে ক্যলশিয়াম, ইউরিক এসিড ও অক্সালেট এর পরিমাপ করতে  ব্লাড টেস্ট ও ইউরিন টেস্ট করতে পারেন। চিকিৎসার মধ্যমে বেরিয়ে আসা পাথর পরীক্ষা করে ডাক্তার পরবর্তীতে কিডনি স্টোন প্রতিরোধের উপায় বলবেন।

 

কিডনি স্টোনের চিকিৎসা

কিডনিতে পাথর এর জন্য যেতে হবে একজন ইউরোলোজিস্ট এর কাছে। কিডনির ছোট পাথর সাধারণত নিজে হতেই প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে। কিন্তু বড় ও আটকে থাকা পাথরের জন্য চিকিৎসা প্রয়োজন হয়। কিডনির পাথরের অবস্থান ও ধরণের উপর নির্ভর করে ডাক্তার নানাবিধ চিকিৎসা পদ্ধতি অনুস্মরণ করতে পারেন। 

বেশিরভাগ কিডনির পাথর ৫-১০ মিলিমিটার এর মধ্যে হয়ে থাকে যা সাধারণত তৈরি হওয়ার ১-২ সপ্তাহের মধ্যে বের হয়ে যায়। একারণে অনেক সময় ডাক্তারেরা শুধু প্রচুর পানি খাওয়ার ও অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন যাতে পাথর ঠিকভাবে বের হয়ে যেতে পারে। ব্যথা কমানোর জন্য  ibuprofen বা diclofenac জাতীয় ব্যথানাশক ঔষধও প্রেসক্রাইব করতে পারেন।

প্রাথমিক ভাবে পাথর অপসারণ না করা গেলে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে পাথরের আকার ও অবস্থান নির্ণয় করার পর উচ্চতর চিকিৎসা যেমন সার্জারি, লেজার বার সাউন্ড ওয়েভের প্রয়োজন বিবেচনা করা হয়। উচ্চতর চিকিৎসা প্রয়োজন হয় যখন-

  • পাথরটি ১০ মিলিমিটার থেকে বড়।

  • দীর্ঘস্থায়ী তীব্র ব্যথা সৃষ্টি করে।

  • ৪ সপ্তাহের মধ্যে পাথর বের না হলে।

  • জটিলতার সৃষ্টি হলে।

 

কিডনিতে পাথর হলে কি ওষুধ খেতে হবে?

কিডনি স্টোন সহজে বের করে দিতে আলফা ব্লকার জাতীয় ঔষধ উপকারী হতে পারে। ২৮ টি গবেষণায় দেখা গেছে এ জাতীয় ঔষধ নিন্ম অংশের পেশীকে শিথিল করে যাতে করে কিডনি স্টোন সহজে বেরিয়ে আসতে পারে। ৫-১০ মিলিমিটার কিডনি স্টোন ৫০% ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই বের হয়ে আসে, অন্যদিকে আলফা ব্লকার ব্যাবহারে কিডনি স্টোন বের করে ফেলার সম্ভাবনা হয় ৭৩%। চিকিৎসক রোগীর অবস্থা অনুসারে এই ওষুধ দিয়ে থাকেন।

 

কিডনি পাথর কি গলিয়ে ফেলা সম্ভব?

চার ধরণের কিডনি স্টোন হতে পারে। 

  • ইউরিক এসিড স্টোন,

  • ক্যালশিয়াম স্টোন, 

  • স্ট্রুভাইট,  

  • সাসটিন। 

এর ভেতর ইউরিক এসিড ও ক্যালশিয়াম স্টোন বেশি হয়ে থাকে, এবং অন্য দুই ধরণের পাথর খুব একটা দেখা যায় না। এই সব গুলোর ভেতর শুধু ইউরিক এসিড কিডনি স্টোন ঔষধের মাধ্যমে গলিয়ে ফেলা সম্ভব। Alkaline citrate salts বা sodium bicarbonate অনেকসময় ইউরিক এসিড গলিয়ে ফেলতে ব্যবহার করা হয়। যদিও তার আগে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে পাথরের ধরণটা বোঝা জরুরী।

 

কিডনিতে পাথরের অপারেশন

কিডনিতে পাথর প্রাথমিক চিকিৎসায় বের করা না গেলেও ভয়ের কারণ নেই। পাথর বের করার জন্য একাধিক উন্নত মানের চিকিৎসা রয়েছে। কিডনি পাথরের অপারেশন নিন্মরূপ হতে পারে-

১. আল্টাসাউন্ড শক ওয়েভ

এটি উচ্চ শক্তি সম্পন্ন শব্দ তরঙ্গ পাঠিয়ে পাথর গুড়িয়ে দেওয়ার একটি উপায়।

২।। Ureterorenoscopy (URS)

এই পদ্ধতিতে প্রস্রাবের নালি দিয়ে সরু তার প্রবেশ করিয়ে কিডনির পাথর বের করা হয়। ২০ মিমি এর চেয়ে বড় পাথর এই পদ্ধতিতে ব্যাবহার করা হয়।

৩. Percutaneous nephrolithotripsy (PCNL)

এই পদ্ধতিতে তলপেটে সমান্য কেটে এন্ডোস্কোপ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয় ও তারপর লেজারের সাহায্যে বা যান্ত্রিক ভাবে পাথর ভেঙে ফেলা হয়।

 

কিডনি পাথর অপারেশন খরচ কত?

তথ্যসূত্র মতে কিডনির পাথর বের করতে লেজার বা এ ধরণের চিকিৎসার খরচ বেসরকারি হাসপাতালে ৫০-৬০ হাজার থেকে শুরু করে ১,৫০,০০০ পর্যন্ত হতে পারে। তবে তা রোগীর চিকিৎসা অবস্থার উপর নির্ভর করে। এছাড়া আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে কিডনিতে পাথর অপারেশন খরচ ওঠানামা করে।

আর আল্টাসাউন্ড শক ওয়েভ এর মাধ্যমে কিডনি পাথর অপারেশন খরচ ৪০,০০০ থেকে ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।

 

সারকথা

শেষ করার আগে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলো আবার জেনে নেই-

  • যেকোনো মানুষেরই কিডনি স্টোন হতে পারে

  • কিডনি স্টোন একবার হলে পরের বার হবার সম্ভাবনা পাঁচ গুন

  • প্রস্রাবে জ্বালা, কোমর ব্যথা, জ্বর, ঘোলা মূত্র কিডনি স্টোনের লক্ষণ

  • বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হয় না।

  • জটিল আকার ধারণ করলে আল্ট্রাসনিক শক, URS, PNCL ইত্যাদি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি।


 

আরও পড়ুনঃ

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles