নবজাতক সামলে যে ৬টি উপায়ে বাবা-মা তাদের শরীরটাকে ফিট রাখবেন

সবার আগে শিশুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে গিয়ে যদি বাবা-মা নিজেরাই অসুস্থ হয়ে যান তবে তা হয়ে যাবে হিতে বিপরীত। তাই আপনাকে নিজের স্বাস্থ্য ঠিক রেখেই বাচ্চার যত্ন নিতে হবে। আর এর জন্য আপনাকে কতগুলি কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

সংসারে একজন নতুন অতিথির আগমনী বার্তার চেয়ে খুশির সংবাদ বোধহয় ধরণীর বুকে আর কিছুই হতে পারে না। এমন অবস্থায় সন্তানসম্ভবা মায়ের প্রতি সবারই বিশেষ নজর থাকে। গর্ভাবস্থায় যেন মাকে কোনরকম মানসিক চাপ সইতে না হয়, কোন আঘাত যেন না লাগে, কোন কষ্ট যেন না হয়, সেজন্য পরিবারের প্রতিটা সদস্যই অত্যন্ত সতর্ক থাকে। অবশেষে যখন শিশু জন্ম নেয়, তখন তো খুশিতে সবাই আত্মহারা। কে আগে কোলে নেবে, কে খাওয়াবে, কে ডায়াপার বদলে দেবে তাই নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। শিশুর জন্মের পর প্রথম ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ মোটামুটি এভাবেই দিন কেটে যেতে থাকে। তবে সকল আবেগই একসময় কিছুটা স্তিমিত হতে বাধ্য। কারণ আমরা সবাই আসলে বাস্তবতার হাতে জিম্মি। তাই দিন গড়ানোর সাথে সাথে শিশুর দেখাশোনা করার মতো মানুষের সংখ্যাও কমতে থাকে। একসময় ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে যায় যে শুধুমাত্র বাবা-মাই হয়ে ওঠে শিশুর একমাত্র যত্নকারী।

এমন পরিস্থিতিতে বাবামায়েদের পক্ষে নিজেদের শরীরের দিকে তাকাবার সুযোগ একদমই হয়ে ওঠে না। কারণ যত দিন যায়, শিশু আস্তে আস্তে আরও বেশী সময় এবং মনোযোগ দাবী করতে থাকে। এই হয়ত সে খাওয়ার জন্য চিৎকার করছে, এই হয়ত আবার সে শুয়ে থাকতে চাইছে না, এই দেখা গেলো সে কোলে উঠে বাইরে যেতে চায়, এই হয়ত আবার হিসু করে বিছানা ভিজিয়ে ফেললো। একের পর এক এভাবে কাজ করতে করতে শিশুর বাবা-মা, বিশেষ করে মায়েরা, এমনকি ঠিকমতো খাওয়া-ঘুমের সুযোগটুকুও পান না। ফলে দিনদিন তারা আরও দুর্বল হয়ে পড়েন। শরীর ভেঙে যায়, চোখের নীচে কালি পড়ে যায়, সারাক্ষণ এক অবসাদ আর ক্লান্তি। তবু একটুও ফাঁকি দেবার উপায় নেই। কারণ সন্তান এ পৃথিবীতে সবার আগে। তাই আজ আমরা আলোচনা করতে চাই যে কিভাবে সন্তানকে সম্পূর্ণ সময় দিয়েও নিজেদের শরীরের দিকে খেয়াল রাখা যায়। কারণ সন্তানকে ভালো রাখতে গেলেই নিজের সুস্থ্যতা দরকার।

তাই, বাচ্চা সামলে নিজে সুস্থ্য থাকতে চাইলে যে কৌশলগুলো অবলম্বন করবেন-

১. অভ্যাস পরিবর্তন করুন

শিশুর জন্মের পূর্বে আপনারা হয়ত জীবনযাপনের জন্য একটা নিয়ম অনুসরণ করতেন এবং তাতেই অভ্যস্ত ছিলেন। যেমন সকালে রান্না করা, দুপুরে গোছল, সময়মত খাওয়া, রাতে আগেভাগেই ঘুমিয়ে পড়া, ইত্যাদি। তবে শিশুর জন্মের পর আপনারা চাইলেও এসবের কোনটাই সময়মত বা আপনার ইচ্ছা অনুযায়ী করতে পারবেন না। তাই এসব অভ্যাসের ব্যাপারে অতিরিক্ত কঠোর না হয়ে বরং ফ্লেক্সিবল থাকুন। যখন যেভাবে সময় পাবেন তখন সেভাবেই সেরে নেবেন, এই নীতিতে চললে আপনাদের সুবিধা হবে। রান্না বা ঘর গোছানোর মতো ঝামেলার কাজগুলো বাবুর ঘুমিয়ে থাকার সময় সেরে নিন। প্রয়োজনে যে কোন একজন বাবুর দিকে খেয়াল রাখুন যাতে আরেকজন তার প্রয়োজনীয় কাজটুকু সেরে নিতে পারে।

২. নিজেদের মধ্যে রুটিন ভাগ করে নিন

শিশু জন্মাবার সাথে সাথে তার কোন রুটিন থাকে না। সে যখনতখন কান্না করতে পারে, খেতে চাইতে পারে, হিসু/হাগু করতে পারে। তাই এই সময়টাতে শিশুর জন্য কোন রুটিন তৈরি করা কোনভাবেই সম্ভব না। তবে আস্তে আস্তে যখন শিশু একটু বড় হয় তখন তার খাওয়া, ঘুম, বা অন্যান্য কর্মকাণ্ড সাধারণত একটা অভ্যাসে পরিণত হয়। তখন শিশুর দিকে খেয়াল রাখার জন্য বাবা মা একটা রুটিন তৈরি করে নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নিতে পারেন। এক্ষেত্রে যখন মা শিশুর খেয়াল রাখবেন তখন বাবা বিশ্রাম করবেন বা নিজের কাজ করবেন। আবার যখন বাবা খেয়াল রাখবেন তখন মা বিশ্রাম/খাওয়া সেরে নেবেন। এভাবে নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে কাজ ভাগ করে নিলে একই কাজের জন্য দুজন দৌড়ে দুজনকেই দুর্বল হয়ে পড়তে হবে না। শিশু যে প্রতিদিন রুটিন অনুযায়ী চলবে তেমনটা নাও হতে পারে। তবে মোটা দাগে এভাবে আপনারা কিছুটা সময় নিজেদের জন্য দিতে পারবেন।

৩. শিশুর নানী/দাদীকে নিজেদের কাছে রাখুন

যারা চাকরী বা ব্যাবসায়ের সুবাদে অন্য শহরে থাকেন তারা বিশেষভাবে লোকবলের অভাবে থাকেন। ঘরের নিত্যনৈমিত্তিক কাজের জন্যই যেখানে লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, সেখানে শিশুর দেখাশোনা করার মতো লোকের খোঁজ পাবার চিন্তা করা নিতান্তই বাতুলতা। এমন পরিস্থিতিতে শিশুর নানী বা দাদীকে নিজেদের সাথে থাকার জন্য অনুরোধ করতে পারেন। এতে আপনার দুটো সুবিধা হবে। আপনার শিশুর শৈশবকালীন শিক্ষা যথাযথ হবে এবং শিশুর যত্ন বা শারীরিক বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ মতামত পাবেন। তবে অনেক পরিবারেই দেখা যায় নানী বা দাদী আসলেও তারা একটানা বেশীদিন থাকতে পারেন না। কারণ তাদের নিজেদেরও সংসার রয়েছে। এক্ষেত্রে আপনারা পালাক্রমে তাদের রাখার বন্দোবস্ত করতে পারেন। এক মাস নানী থাকলেন তো আরেক মাস দাদী – এভাবে।

৪. যৌথ পরিবারে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ

বিয়ের পর একই শহরে থাকার পরেও অনেকে আলাদা সংসার করতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এমন একক পরিবারে বাবা মা দুজনেই যদি চাকুরীজীবী হন তাহলে শিশুর দেখাশোনা করা হয়ে ওঠে একেবারেই অসম্ভব। তখন স্বাভাবিকভাবেই মায়ের চাকুরী ছাড়তে হয়। যদি কোন মা নিজের সন্তানের কথা ভেবে এ সিদ্ধান্ত নিতে চান তাহলে তো নিতেই পারেন। তবে যদি তিনি মনে করেন যে চাকুরী করাটা প্রয়োজন, সেক্ষেত্রে একক পরিবার ছেড়ে আবার যৌথ পরিবারে বসবাস শুরু করতে পারেন। তবে এটা করার জন্য আপনাদেরকে আগে থেকেই পরিকল্পনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী চাকুরী বা ব্যাবসায়ের ক্ষেত্র শিশুর দাদা অথবা নানা বাড়ির শহরে শিফট করে আনতে হবে। এতে করে শিশুর দেখাশোনা করার মতো মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়বে তেমনি আপনারাও নিজেদের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সময় পাবেন।

৫. শিশুর দেখাশোনা করার লোক বা ন্যানী নিয়োগ দেয়া

এটা ঠিক যে আমাদের সমাজে ন্যানী পেশাটা এখনও সম্মানজনক অবস্থানে যায়নি। তাই এই পেশাজীবী খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। এমন অবস্থায় আপনি দুটো উপায় অবলম্বন করে দেখতে পারেন। শহরাঞ্চলে অনেক ছাত্রী থাকে যারা অন্য শহর থেকে পড়াশোনার জন্য এখানে আসে। তাদের মধ্যে অনেকেই পড়াশোনার খরচ অথবা হাতখরচ মেটাবার জন্য বাচ্চা পড়ায় বা অন্য কোন পেশায় জড়িত থাকে। চেনাজানার মধ্যে তেমন কেউ থাকলে তাকে আপনার শিশুর দেখাশোনার দায়িত্ব নেবার জন্য প্রস্তাব দিতে পারেন। অনেকে আছে যারা বাচ্চাকাচ্চা বিশেষভাবে পছন্দ করে, তেমন কেউ হলে খুব সহজেই আপনার প্রস্তাবে সম্মত হতে পারে। অথবা আপনার গ্রামের বাড়ির এলাকা থেকে কাউকে নিয়ে আসতে পারেন যে আপনার বাসায় থাকবে, খাবে, এবং বেতনের বিনিময়ে আপনার বাচ্চার দেখাশোনা করবে।

৬. ডে কেয়ার সেন্টার

নিজের শিশু রক্তের সম্পর্কের কারও কাছে ছাড়া অন্যের জিম্মায় রেখে যাবার সিদ্ধান্তটা খুবই কঠিন। এবং অনেকেই ডে কেয়ার সেন্টার এর কনসেপ্টটাকে এখনও ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেননি। আমরাও মনে করি বিকল্প ব্যাবস্থা থাকলে একজন শিশুকে ডে কেয়ার সেন্টারে রাখবার দরকারই পড়ে না। তবে এটাও ঠিক যে অনেক পরিবারের হাতে উপরে বর্ণিত ব্যাবস্থাগুলোর মধ্যে কোনটাই থাকে না। তখন তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে ওঠে এই ডে কেয়ার সেন্টার। এমন পরিস্থিতিতে নিজেরা খুব ভালোভাবে খোঁজখবর নিয়ে একটা আস্থাভাজন ডে কেয়ার সেন্টার নির্বাচন করুন। লক্ষ্য রাখতে হবে তাদের সেন্টারে শিশুর খেয়াল রাখার দায়িত্বে যারা আছেন তারা যেন প্রশিক্ষিত এবং আন্তরিক হন। প্রয়োজনে শিশুকে সারাদিন না রেখে বরং কয়েক ঘণ্টা রাখতে পারেন যাতে আপনারা কিছুটা হলেও বিশ্রামের সুযোগ পান।

শিশুর যত্ন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে নিজেদের শরীরের দিকে খেয়াল দেয়াও একেবারে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ একটানা বছরখানেক অনিয়ম আর বিশ্রামের অভাবে থাকলে শরীর এতটাই খারাপ অবস্থানে চলে যেতে পারে যেখান থেকে ফেরত আসার আর কোন উপায় থাকে না। তাই শিশুর সুন্দর এবং মজবুত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই নিজেদের শরীরের যত্ন নেবার জন্য সময় বের করুন। কারণ একজন সুস্থ্য বাবা মা-ই পারেন শিশুকে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠতে সর্বাত্মক সহায়তা করতে।

আরও পড়ুনঃ

Default user image

শফিকুল বাশার কাজল, লেখক, আস্থা লাইফ

পিতামহ-পিতামহী অনেক শখ করিয়া নাম রাখিয়াছিলেন শফিকুল বাশার কাজল। ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক সম্পন্ন করিবার পর খানিক এই কাজ, কতক ওই কাজ করিয়া অবশেষে ২০১৩ সালের শেষ হইতে ‘সামাজিক মতে বেকারত্ব’ অর্থাৎ কিনা লেখালেখিকেই জীবিকা অর্জনের একমাত্র উপায় হিসাবে বরণ করিয়া লইয়াছি। অদ্যাবধি অন্ততপক্ষে আট-দশখানা দিশী-বিদিশী কোম্পানি এবং অগণিত ব্যক্তিবিশেষের জন্যে প্রায় চল্লিশ সহস্রাধিক লেখা নামে-বেনামে সম্পন্ন করিবার সুযোগ হইয়াছে। ভালোবাসি নিজের পরিবার, সন্তান, এবং ফুটবল।

Related Articles