ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈষম্য আর নয়! বয়স্ক রোগীদের জন্য কি করতে হবে?
ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈষম্য শুধু আমার এবং আপনার ব্যাপার নয় বরং এটা প্রত্যেকেরই ভাবনার বিষয়। আর বয়স্কদের জন্য সেটি আরো চ্যালেঞ্জিং এবং জটিল হতে পারে। এই বৈষম্য দূর করার জন্য আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
-
বিশ্বের ৫০% জনসংখ্যাই সম্পূর্ণ পরিসরে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত।
-
স্বাস্থ্য সেবায় ব্যবধান বা বৈষম্য সব দেশের জন্যই একটি চরম বাস্তবতা যা নেতিবাচকভাবে জীবনের সকল স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করে।
-
উচ্চ-আয়ের দেশগুলিতে শৈশবে ক্যান্সার ধরা পড়লে বেঁচে থাকার হার যেখানে ৮০ ভাগ সেখানে নিম্ন-আয়ের দেশগুলিতে তা মাত্র ২০ ভাগ।
-
জরায়ুমুখের ক্যান্সারে ৯০% এরও বেশি মৃত্যু হয় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে।
-
ক্যান্সারের কারণে বছরে প্রায় ১ কোটি মানুষ মারা যায় এবং তাদের মধ্যে প্রায় ৭০% মানুষের বয়স হচ্ছে ৬৫ বা তার বেশি। তবুও বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে কার্যকর চিকিৎসা পাওয়ার জন্য অসম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়।
-
উদ্বাস্তু জনসংখ্যার ক্ষেত্রে ক্যান্সারের শেষ পর্যায়ে গিয়েই রোগ ধরা পড়ে যা রোগটির সবচেয়ে খারাপ ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়।
-
চিকিৎসা পেশায় অংশগ্রহণে বৈষম্য থাকার কারণে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ক্ষেত্রে ক্যান্সার নির্ণয় করার হার সবচেয়ে কম।
-
ক্যানসারের চিকিৎসা সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহরের রোগীদের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ রয়েছে যা কিনা উচ্চ আয়ের দেশের জন্যও প্রযোজ্য যেমন, আমেরিকা।
বর্তমান সময়ের ভয়ংকর রোগগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো এই ক্যান্সার। কারণ প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগ সহজে ধরা পড়ে না এবং শেষ পর্যায়ে এর ভালো কোনো চিকিৎসা দেয়াও সম্ভব হয় না। তাই এ রোগে মৃত্যুহার অনেক বেশি। এর চিকিৎসায় বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলেও পুরোপুরি কার্যকর কোনও পদ্ধতি বা ওষুধ এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। তবে প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পরলে এই রোগ নিরাময়ের সম্ভাবনা বেশি থাকে। কিন্তু বিশ্বব্যাপী ক্যানসার চিকিৎসায় বৈষম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে।
ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈষম্য: ৭টি বাঁধা যা ক্যান্সারের যত্নের পথে দাঁড়ায়
-
লিঙ্গ বৈষম্য
-
সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্য বাঁধা
-
দারিদ্র্য এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থা
-
গ্রামীণ-শহুরে বিভাজন
-
বয়স বৈষম্য
-
উদ্বাস্তু পরিস্থিতি এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি
-
যৌন আদর্শগত বৈষম্য
বয়স্কদের জন্য ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করে। কেননা একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর তাদের ডায়াবেটিস, হৃদরোগ সহ অন্যান্য জটিল রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে। এমনকি তারা সুস্থ থাকলেও একজন কম বয়সী ব্যক্তির চেয়ে তাদের দেহ চিকিৎসায় ভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। যেমন বয়স্কদের কেমোথেরাপির ফলে গুরুতর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
বয়স্কদের উপর ক্যান্সার চিকিৎসার প্রভাব
অন্যান্য চিকিৎসার মতো অস্ত্রোপচারে সবসময়ই ঝুঁকি রয়েছে। বয়স বেশি হলে এই ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। তাই অস্ত্রোপচারের আগে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো সম্পর্কে খেয়াল রাখা উচিত-
হার্টের কার্যকারিতা
অস্ত্রোপচার হার্টের সমস্যাকে আরো বৃদ্ধি করতে পারে। তাই অস্ত্রোপচারের আগে হার্টের কার্যকারিতা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ। বয়স্কদের হৃদরোগ বা অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের সমস্যা কম বয়সীদের তুলনায় বেশি হয়। এছাড়াও, হার্ট রক্তচাপের পরিবর্তনগুলোকে সহ্য নাও করতে পারে যা অস্ত্রোপচারে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।
কিডনির কার্যকারিতা
অস্ত্রোপচারের সময় এবং পরে শরীরকে সচল রাখতে বিভিন্ন ধরনের ঔষুধ ব্যবহার করা হয়। কিডনিকে এই ওষুধগুলো সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। কিডনী এই কাজে ব্যর্থ হলে অস্ত্রোপচারে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে।
লিভারের কার্যকারিতা
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সাধারণত লিভারে কম রক্ত প্রবাহিত হয়। তাই অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত অষুধগুলো যদি লিভার ভাঙতে ব্যর্থ হয় তবে দেহে এগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে।
ফুসফুসের কার্যকারিতা
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ফুসফুসের কার্যকারিতা কমতে থাকে। এম্ফিসেমা বা ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ থাকলে এগুলো অস্ত্রোপচারে ব্যবহৃত অ্যানাস্থেসিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এছাড়াও ফুসফুসের এ সমস্যাগুলি অস্ত্রোপচারের পরে নিউমোনিয়া হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, যা পরবর্তীতে গুরুতর হতে পারে।
বয়স্ক ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা বৈষম্য
দুর্ভাগ্যবশত, সময়ের সাথে বাংলাদেশ এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্যান্সার আক্রান্ত বয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসচেতনতার বৃদ্ধিও এক্ষেত্রে কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বিনিয়োগ থেকে আক্রান্তদের বিভিন্ন চাহিদাগুলোর দিকেও দৃষ্টিপাত করা উচিত। তবে এতে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে-
-
বয়স্ক ব্যক্তিদের সাথে ক্যান্সার নিয়ে আলোচনার সুযোগের অভাব যা এ ব্যাপারে তাদের সচেতনতা বৃদ্ধিতে বাধার সৃষ্টি করে
-
জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা নীতিতে জেরিয়াট্রিক বা বয়স্ক ক্যান্সার রোগিদের অসম অর্ন্তভুক্তি
-
সীমিত সচেতনতা এবং বিদ্যমান নির্দেশিকা, শিক্ষাগত সংস্থান এবং ক্যান্সার গবেষণায় বয়স্কদের অসম অন্তর্ভুক্তি
-
জেরিয়াট্রিক অনকোলজির ব্যাপারে সীমিত তথ্য, বিশেষজ্ঞদের অপ্রাপ্যতা, ক্যান্সার ব্যবস্থাপনা এবং ক্যান্সারের যত্নের বিষয়ে চিকিৎসকদের অনিয়মিত অন্তর্ভুক্তি
বর্ণিত এই বিষয়গুলো বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ক্যান্সার আক্রান্ত বয়স্কদের যথাযথ যত্নে বাধা সৃষ্টি করছে।
সমাধান
কিছু নির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং এর সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারবো।
মহামারীর এ সময়কালে ক্যান্সার আক্রান্ত বয়স্কদের সঠিক পরিচর্যা
করোনা মহামারীর এ সময়ে ক্যান্সার এবং বার্ধক্যজনিত বিষয়গুলোর সাথে সম্পর্কিত পেশাদার এবং ক্যান্সার রোগীদের প্রতিনিধিদের ক্যান্সারে আক্রান্ত বয়স্ক রোগীদের জন্য যত্ন ও চিকিৎসার সর্বোচ্চ মান বজায় রাখতে সঠিক ক্লিনিকাল সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জনস্বাস্থ্য নীতিগুলোর সঠিক প্রয়োগ করতে হবে।
ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পুনর্গঠন
আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকার, বিভিন্ন একাডেমি এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে বয়স্কদের জন্য ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে।
রোগী-কেন্দ্রিক ক্যান্সারের যত্ন নেয়া
ক্যান্সার এবং অন্যান্য এনসিডিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের যথাযথ যত্ন নিশ্চিত করতে তাদের বিভিন্ন চাহিদার উপর মনোযোগ দিয়ে প্রতিটি রোগীর প্রতি আলাদা ক্যান্সারের যত্ন গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হবে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে জোর দেয়া
গবেষণায় দেখা গেছে নিয়মিত কিছু ব্যাপার মেনে চললে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকখানি কমানো যায়। যেমন- নিয়মিত ব্যায়াম, সঠিক খাদ্যভ্যাস (প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি, ফলমূল এবং আঁশজাতীয় খাবার গ্রহণ ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাস করে), নিয়মিত চেকআপ এবং ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ ইত্যাদি।
এছাড়াও ক্যান্সার চিকিৎসায় বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে আমরা সম্মিলিতভাবেই কাজ করতে পারি-
-
ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন এবং শিক্ষিত করা
-
চিকিৎসকদের দক্ষতা এবং জ্ঞানের সাথে সাথে কীভাবে বৈষম্য ক্যান্সার সেবাকে প্রভাবিত করে সে সম্পর্কে অবহিত করা
-
হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার এবং বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে প্রদত্ত প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা
-
নীতি ও কর্মসূচীর মাধ্যমে কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণকে জোরালোভাবে সম্বোধন করা যা মানুষের স্বাস্থ্যকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে
-
অর্থ এবং মানুষ উভয় ক্ষেত্রেই সম্পদ বৃদ্ধি করতে হবে যা ক্যান্সার গবেষণার জন্য নিবেদিত
-
দেশ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যা
পরিশেষে
ক্যান্সার নামক এই মরণব্যাধি নিয়ন্ত্রণের সর্বোত্তম উপায় এর প্রতিরোধ। বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগের ঝুঁকি বেশি থাকায় তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেয়া অত্যধিক প্রয়োজন। এছাড়া ক্যান্সারের ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শারিরীক যেকোনো সমস্যায় ডাক্তারের সঠিক ও নিয়মিত পরামর্শই পারে ক্যান্সার ঝুঁকি কমাতে। বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ২০২২-২০২৪ এ ক্যান্সার আক্রান্তদের যত্নের সকল বাধা অতিক্রম করে তাদের একটি সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনাই আমাদের এবারের লক্ষ্য।