সুস্থ থাকতে যন্ত্রবিহীন ৫টি উপকারী ও ঘরোয়া ব্যায়াম
সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন নিয়মিত শরীর চর্চা বা ব্যায়াম করা। তবে আমাদের অধিকাংশেরই ধারণা ব্যায়াম করতে অনেক যন্ত্রের প্রয়োজন, কিন্তু খালি হাতেই যে অসংখ্য ব্যায়াম করে শরীর সুস্থ রাখা যায় তা আমরা সঠিক ভাবে জানি না। এই আর্টিকেলে আমরা যন্ত্রপাতি ছাড়া ব্যায়াম তথা ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম সম্পর্কে জানবো।

সবে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠলো আয়ান। এই বয়সেই ওজন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই। ওজন শুনেই স্বাস্থ্য নিয়ে অনুমান করতে পারছেন নিশ্চই! ছোট বয়সেই আয়ানের এই ওজন ও স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত এর পরিবার। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আয়ানকে রোজ কমপক্ষে ৩০ মিনিট ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজের পরামর্শ দেন। অন্যদিকে ষাটোর্ধ আফজাল সাহেব ডায়বেটিসে আক্রান্ত। ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য ডাক্তার তাকে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের পাশাপাশি ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজের পরামর্শ দেন।
ব্যায়াম কী?
শরীরকে সুস্থ, কর্মক্ষম ও রোগমুক্ত রাখতে শরীরচর্চার বিকল্প নেই। শরীরচর্চার মধ্যে ব্যায়াম অন্যতম। ব্যায়াম বলতে শারীরিক কসরতকে বোঝানো হয়। শরীরকে সতেজ ও নির্মলতা দান করে ব্যায়াম। বয়স ও শরীরের সক্ষমতার উপর ব্যায়ামের ভিন্নতা থাকলেও তা কার্যকরী। ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরের রক্ত সঞ্চালন ভালো ভাবে হওয়ার পাশাপাশি শরীর ও মন প্রফুল্ল থাকে।
ব্যায়ামের উপকারিতা
-
ব্যায়াম শরীরকে ফিট রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শরীরচর্চা।
-
ব্যায়ামকে মহাঔষধী বললেও ভুল হবে না, কেননা অনেক রোগ আছে যা অনেক বছর বয়ে বেরানো হচ্ছে, ওষুধ খেয়েও কাজ হচ্ছে না কিন্তু নিয়মিত কিছুদিন ব্যায়াম করে রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে কিংবা প্রশমিত হয়েছে।
-
ব্যায়ামের উপকারিতার তালিকা বেশ চওড়া। শরীর ফিট রাখার পাশাপাশি ব্যায়াম শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়
-
সেই সাথে বিষণ্ণতা কমাতেও সাহায্য করে ব্যায়াম।
-
ঘুমের ঘাটতি পূরণ করতে সাহায্য করে ব্যায়াম, অর্থাৎ সুনিদ্রার জন্য ব্যায়াম উপকারী।
-
সর্বোপরি সুস্থ জীবন যাপনের জন্য ব্যায়াম অত্যন্ত কার্যকরী।
ব্যায়ামের প্রকারভেদ
ব্যায়ামের কার্যকারিতা ও ধরণের উপর ভিত্তি করে ব্যায়ামকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন-
-
সাধারণ ব্যায়াম
-
যোগ ব্যায়াম
-
যান্ত্রিক ব্যায়াম
যে সকল ব্যায়াম কোনো রকম যন্ত্রপাতি ছাড়া করা যায় তা সাধারণ ব্যায়ামের পর্যায়ে পরে। আমরা এ পর্যায়ে কিছু সাধারণ ব্যায়াম সম্পর্কে
যন্ত্রবিহীন ব্যায়ামের তালিকা
১. ওয়ার্ম আপ
ওয়ার্ম আপ অনেক পরিচিত একটি শব্দ। যে কোনো ব্যায়াম বা খেলা শুরুর আগে ওয়ার্ম আপ করা একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। যন্ত্রবিহীন ব্যায়ামের তালিকায় নিঃসন্দেহে ওয়ার্ম আপকে রাখা যায় কারণ এটিও এক ধরণের ব্যায়াম।
ওয়ার্ম আপ একটি সহজ ও সাধারণ ব্যায়াম। ওয়ার্ম আপ অনেক ভাবে করা যায়। আমরা এখানে একটি পদ্ধতি সম্পর্কে আলেকপাত করবো।
পদ্ধতি
ওয়ার্ম আপের এই পদ্ধতিটি বেশ প্রচলিত ও জনপ্রিয়। এই পদ্ধতিতে চেয়ারের সহযোগিতায় ওয়ার্ম আপ করা হয়।
-
শুরুতে একটি চেয়ার নিতে হবে যার উপর আপনি বসতে পারবেন আবার চাইলে চেয়ার থেকে উঠতে পারবেন। এবার চেয়ারে একবার বসতে হবে, আবার উঠে দাঁড়াতে হবে ।
-
এক্ষেত্রে প্রতিবার সম্পূর্ণ রূপে বসতে এবং সম্পূর্ণ রূপে উঠে দাঁড়াতে হবে । এই ব্যায়ামের সময় হাত দুটিকে শরীরের বাইরের দিকে করজোর করার মত করে রাখতে হবে।
এভাবে অনবরত অন্তত ১ মিনিট করতে হবে। সম্পূর্ণ ভাবে বসা ও সম্পূর্ণ দাঁড়ানো হচ্ছে কিনা এর পাশাপাশি রাখতে হবে প্রক্রিয়াটি যেন খুব দ্রুত বা খুব ধীর গতিতে না হয়।
২. কাঁধের ব্যায়াম
যন্ত্রবিহীন ব্যায়াম বা ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজের মধ্যে অন্যতম একটি ব্যায়াম হলো কাঁধের ব্যায়াম। এটি অত্যন্ত সহজ ও উপকারি একটি ব্যায়াম। কাঁধের ব্যায়ামের পদ্ধতি খুব সহজবোধ্য ও আরামদায়ক হওয়ায় খুব সহজেই এটি আয়ত্ব করা যায়।
পদ্ধতি
কাঁধের ব্যায়াম একটি সহজ সহজ পদ্ধতির ব্যায়াম। এই ব্যায়াম করতে প্রয়োজন একটি চেয়ার এবং পানি ভর্তি দুটি হাফ লিটারের বোতল।
-
চেয়ারে বসে ২ হাতে ২টি বোতল নিয়ে কাঁধ বরাবর হাত ২টি বাইরের দিকে নিয়ে হাতের কনুই একটু বাঁকা করে নিতে হবে।
-
এভাবে হাত রেখে ১ থেকে ২০ পর্যন্ত গুনতে হবে বা ২০ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হবে।
-
এরপর হাত ভাজ করা অবস্থায় হাত ২টি কাঁধের কাছে এনে উপরের দিকে নিয়ে পুণঃরায় ১-১০ পর্যন্ত গুনে বা ১-১০ সেকেন্ড অপেক্ষা করে হাত স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে হবে।
এভাবে এই ব্যায়াম দৈনিক ১০-১২ বার অনুশীলন করতে হবে।
৩. পুশ-আপ
পুশ-আপ একটি উপকারী ও পরিচিত ব্যায়াম। বডি শেপ এর জন্য পুশ-আপ অত্যন্ত কার্যকরী একটি ব্যায়াম। তবে এই ব্যায়াম সবাই করতে পারে না। আবার অনেকে পারলেও সঠিক নিয়মে করতে পারে না। অনেক ধরণের পুশ-আপ রয়েছে যেমন: হাঁটু পুশ-আপ, ওয়াল পুশ-আপ, ডিক্লাইন পুশ-আপ, পুশ-আপ ক্ল্যাপ ইত্যাদি। এখানে পুশ আপের প্রচলিত একটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হলো।
পদ্ধতি
-
প্রথমে হাতের তালু মেঝেতে রেখে বুক ধীরে ধীরে মেঝেতে ঠেকিয়ে শুয়ে পড়তে হবে। অতঃপর হাত বুক বরাবর দুই পাশে বাইরে থাকবে। পা দুটি সমান্তরালে সোজা রাখতে হবে।
-
পুশ আপের ক্ষেত্রে মাথা শরীরের সমান্তরাল রাখতে হবে এবং দৃষ্টি সামনে রাখতে হবে।
-
অতঃপর পায়ের পাতা মাটিতে রেখে এবং আঙ্গুল গুলো নিচের দিকে ও গোড়ালি উপরের দিকে হাত দুটোতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে শরীরকে মাটি থেকে উপরে উঠাতে হবে।
-
শরীর একদম সোজা রেখে , আপার ব্যাক ও লোয়ার ব্যাক একদম সোজা রাখতে হবে।
-
যখন হাত একদম সোজা হবে, তখন থেমে দম ছাড়তে হব।
-
এরপর মাটির দিকে ধীরে শরীর নিচে নামাতে হবে, হাত একই ভাবে রেখে কনুই ভেঙ্গে নামতে থাকবে, শরীর প্রায় মাটিতে ঠেকবে তবে কনুই মাটিতে ঠেকনো যাবে না।
-
পা দুটো সোজা জোড়া করে রাখতে হবে। হাতের উপর ভর দিয়ে অনুশীলন করতে হবে এবং দম নিতে হবে।
এভাবে শরীরের সামর্থ্য অনুযায়ী দৈনিক অনুশীলন করতে হবে এই ব্যায়ামটি।
৪. পায়ের ব্যায়াম
সহজ, জনপ্রিয়ও কার্যকরী একটি ব্যায়াম হলো পায়ের ব্যায়াম। এই ব্যায়ামটি যন্ত্র ছাড়া অর্থাৎ ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ। খুব সহজে ঘরে বা বাড়িতে থেকেই এই ব্যায়ামটি করা যায়।
পদ্ধতি
-
এই ব্যায়ামটি করতে প্রথমে মেঝেতে চিৎ হয়ে শুতে হবে।
-
শোয়ার পর পায়ের পাতা দুটি একসাথে উঁচু কিছুর (যেমন:চেয়ার, টেবিল) উপর তুলে দিতে হবে।
-
এরপর আস্তে আস্তে মেঝে থেকে হিপ উপরের দিকে তুলতে হবে এবং সেই সাথে পায়ের হাঁটু ভাজ করে নিজের দিকে আনার ভঙ্গি করতে হবে।
-
ব্যায়ামটি করার সময় সচেতন থাকা জরুরী। কেননা খেয়াল রাখতে হবে যেন পেটে প্রেশার না পরে।
পায়ের এই ব্যায়ামটি থাই, হিপ কমতে যেমন সাহায্য করার পাশাপাশি পেটের চর্বিও কমিয়ে থাকে।
৫. ওয়াল স্কোয়াট
যন্ত্রপাতি বিহীন ঘরে বা বাড়িতে করা যায় এমন একটি জনপ্রিয় ব্যায়াম ওয়াল স্কোয়াট। শরীর ফিট রাখার পাশাপাশি এই ব্যায়ামটি থাই এবং হিপের শেপ সুন্দর করে থাকে।
পদ্ধতি
-
এই ব্যায়ামের শুরুতেই দেয়ালে পিঠ ঠেঁকিয়ে দাঁড়াতে হবে।
-
ঠিক ভাবে দাঁড়ানোর পর পা দুটিকে দেয়াল থেকে ১ ফুট দূরে সরিয়ে নিতে হবে।
-
অতঃপর দেয়ালের উপর প্রেসার দিয়ে আর হাঁটুর উপর ভর করে হাফডাউন হতে হবে।
-
এরপন কিছুটা বসার ভঙ্গি করতে হবে যেন ৯০ ডিগ্রী এঙ্গেলে বেণ্ট হয়। প্রথম অবস্থায় যতক্ষণ স্ট্যামিনা বা ধৈর্য্য থাকে ততক্ষণ করতে হবে । ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেলে এভাবে ১ মিনিট থাকার চেষ্টা করতে হবে । তারপর আস্তে আস্তে সময় বাড়িয়ে নেয়া যেতে পারে।
এগুলো ছাড়াও আরো অনেক ধরণের ব্যায়াম রয়েছে তবে এগুলো জনপ্রিয় হওয়ায় এই ব্যায়াম গুলো সম্পর্কে অবগত রাখা হলো।
ব্যায়াম ও খাদ্য সচেতনতা
ব্যায়াম একটি নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম। নিয়মিত ব্যায়াম করলে কিছু নিয়ম মেনে চলা জরুরী। এর মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্যাভ্যাস। ব্যায়ামের সাথে খাদ্যাভ্যাসের সম্পৃক্ততা অনেক বেশি। কেননা খাদ্যই শরীরে পুষ্টি জোগায়।
ব্যায়াম শুরুর অন্তত দুই ঘণ্টা আগে ভারী খাবার খাওয়া প্রয়োজন। ভারী খাবার খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্যায়াম করা যেমন ঠিক না তেমনি একদম খালি পেটেও ব্যায়াম করা যাবে না। তবে ব্যায়াম শুরুর আধা ঘণ্টা আগে একদম অল্প করে ফল খাওয়া যেতে পারে।
একটানা দীর্ঘ সময় ব্যায়াম করা ঠিক নয়। বিরতি নিয়ে ব্যায়াম করতে হবে। বিরতির সময় এক-দুই ঢোক পানি পান করে যেতে পারে । তবে বেশি পানি পান করা যাবে না। ব্যায়াম শেষ করার পর পর কোনো ধরনের ভারী খাবার খাওয়া যাবে না। তবে অল্প পরিমাণ প্রোটিন শেক পান করা যেতে পারে । এতে শরীরের কর্মক্ষমতা ফিরে আসে এবং সতেজ হয়।
পরিশেষে
ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ বা যন্ত্রবিহীন ব্যায়ামের উপকারিতা ও এর পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা জেনেছি। ব্যায়াম করলে সচেতন ভাবে করতে হবে কেননা ভুল নিয়মে ব্যায়াম করলে শরীরের ক্ষতির আশঙ্কা বেশি থাকে। সেই সাথে খাদ্যাভ্যাসেও সচেতনতা রাখতে হবে।
সর্বোপরি নিজে ফিট থাকার জন্য ব্যায়াম করতে হবে এবং সব ধরণের সচেতনতা, সীমাবদ্ধতা খেয়াল রাখতে হবে।