অল্টারনেটিভ মেডিসিন বা বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি আসলে কতটুকু কার্যকর
হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, কাপিং, অ্যাকুপাংচার সহ বিভিন্ন বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা আমাদের পূর্ব পুরুষেরা হাজার বছর ধরে তৈরি ও ব্যবহার করে এসেছেন যা মূলত প্রকৃতি থেকে পাওয়া। এর মধ্যে কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল ধরতে পারাও কষ্টকর। আসলে এসব চিকিৎসা পদ্ধতির সত্যতা কী?
দ্রষ্টব্য: কারো ব্যবসায়িক ক্ষতি কে উদ্দেশ্য করে লেখাটি লেখা হয়নি, বরং বদ্ধমূল ধারণায় যেন কেউ সঠিক চিকিৎসার পরিবর্তে নড়বড়ে ভিত্তি সমৃদ্ধ চিকিৎসা গ্রহণে আগ্রহী না হন, এবং আগ্রহী হলেও সে সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রাখতে পারেন, সে জন্যেই এই লেখাটি।
ধরুন আপনি একদিন দেখলেন আপনার পছন্দের ফুটবল তারকা পিঠে কাপের মত বস্তু লাগানো ছবি দিয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলেন একে কাপিং বলা হয়, যার মাধ্যমে পিঠে ব্যথা ও দূষিত রক্ত শুষে বের করে দেয়। দেখে আপনারো আগ্রহ জাগলো। পরবর্তীতে দেশেই এমন একটি সার্ভিস পেয়ে পিঠে ব্যথার দফারফা করতে উদ্যত হলেন।
এটি খুব সাধারণ একটি ঘটনা। কাপিং, আকুপাংচার ও এ ধরণের বিকল্প চিকিৎসার মূল প্রতিষ্ঠান সমূহ, মিলিয়নকে মিলিয়ন ডলার খরচ করছে এসবের বিজ্ঞাপনের জন্য। কিন্তু ভাবুন, যখন কোন জটিল রোগাক্রান্ত ব্যক্তি, সুস্থতার আশায় কোন ফলহীন চিকিৎসা গ্রহণ করলেন, যার ফলে অর্থ ও স্বাস্থ্য তো নষ্ট হলোই, সঠিক চিকিৎসা পেতেও দেরি হয়ে গেল, যার পরিণাম কল্পনা করতে বলে আর কষ্ট দিতে চাই না।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের অকল্পনীয় উন্নয়ন সম্ভব হলেও, আজও ডজন খানিক এমন বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি এখনো টিকে আছে, যার ভিত্তিমূল ও রোগ সারানোর ক্ষমতার কোন সুস্পষ্ট বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। এই প্রবন্ধে আমার বিজ্ঞান লব্ধ জ্ঞান থেকে যতটা সম্ভব সঠিক নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করব।
চলুন মূল অংশে যাওয়ার আগে আমরা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় প্লাসিবো ইফেক্ট সম্পর্কে জেনে নেই।
প্লাসিবো ইফেক্ট কি?
বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে গেলে প্লাসিবো ইফেক্ট কথাটি বারবার আসবে। তাই চলুন আগে এটি সম্পর্কে জানা যাক। ২য় বিশ্ব যুদ্ধের সময় অনেক সৈনিক হতাহত হতেন, কিন্তু সে পরিমাণ ব্যাথানাশক ঔষধ ছিলো না। একদিন একজন নার্স বুদ্ধি করে সৈনিকদের শান্তনা দেওয়ার জন্য ব্যাথানাশক দেবার ভান করে পানি পুশ করেন। কিন্তু দেখা যায় যে নকল ঔষুধেও ঠিক আসলের মতই কাজ করছে।
এই ব্যাপারটিই হলো প্লাসিবো ইফেক্ট। কোন কিছু আপনার শরীরে কাজ করবে এমনটা বিশ্বাস করলে তার কাজ করবেই, আপনাকে যদি চিনির ট্যাবলেট খাওয়ানো হয় তাতেও শারীরিক উপসর্গের উপশম মিলবে।
মূলত বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি গুলো এই ব্যাপারটির সুবিধা নিয়েই সারা পৃথিবীতে তাদের ব্যবসার প্রসার করেছে। যদিও সব বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতিই অসত্য এমন নয়।
হোমিওপ্যাথি
হোমিওপ্যাথির উৎপত্তি হয় ১৭৯৬ সালে জার্মান শরীরতত্ববিদ স্যামুয়েল হ্যানিম্যান এর হাত ধরে, তারপর সারাবিশ্বেই এই বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি টি ছড়িয়ে যায়। কিন্তু আসলে কি হোমিওপ্যাথি কাজ করে? সত্যি টা হলো হোমিওপ্যাথির বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি ও কার্যকারিতা নেই।
এই কথাটি হয়ত অনেকেরই পছন্দ হবে না, অনেকে যুক্তি দিবেন, হোমিওপ্যাথি ধীরে হলেও কাজ করে। কিন্তু আসলে ধীরে যেটা সেরে যায় তা আমাদের শরীরের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গুণে, সেই সাথে প্লাসিবো ইফেক্টও অনেকাংশে দায়ী।
হোমিওপ্যাথি ঔষধ তৈরি কিভাবে করা হয়, সে বিষয়ে জানলেই কিছুটা আন্দাজ করতে পারবেন কেন এটি আধুনিক বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ বিপরীত। এই ঔষধ তৈরি হয় বিভিন্ন ঔষধি গাছের নির্যাস, পানিতে বারবার পাতলা করে। তাদের বিশ্বাস পানি সব কিছুর স্মৃতি ধরে রাখে, যার রোগ সারানোর ক্ষমতা রয়েছে।
ধরুন একটা পানি সহ পাত্রে এক ফোটা ভেষজ গাছের রস নেওয়া হলো। সেখান থেকে আবার এক ফোটা অন্য পানির পাত্রে নেওয়া হয়। সেখান থেকে এক ফোটা আবার অন্য পাত্রে। এভাবে বারবার করতে করতে একটি পর্যায়ে প্রাপ্ত পানি, ঔষধ বানানোর জন্য প্রস্তুত হয়।
শুধু হোমিওপ্যাথির কার্যকারিতা নিয়েই আমাদের একটি বিস্তারিত আর্টিকেল পড়তে পারেন এখানে।
কাপিং থেরাপি
শুরুতেই কাপিং চিকিৎসা পদ্ধতির কথা বলছিলাম। কাপিং থেরাপিরও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুব দুর্বল। কাপিং এর মাধ্যমে পিঠে কাপের মত শোষক লাগিয়ে শরীরের কিছুটা রক্ত বের করে নেওয়া হয়। তাদের দাবি, এতে দূষিত রক্ত বের হয়ে আসে। পিঠে ও কোমর ব্যথা সেরে ওঠে।
দূষিত রক্ত কিভাবে তারা শোষণ করেন তার কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। রক্তের আলাদা করে কোন দূষিত অংশ হয় না। রক্তের দূষণ থাকলে তা সমস্ত রক্তেই মিশে থাকবে।
আমাদের কিডনী প্রতি মুহূর্তে আমাদের রক্ত কে পরিষেধন করে দূষিত উপাদান আলাদা করে ফেলছে, যা আমাদের মূত্রের সাথে বের হয়ে আসছে। রক্তের দূষণ যদি বের করতেই হয়, আপনাকে ডায়ালাইসিস ম্যশিন ব্যবহার করতে হবে, যা কিডনী অকেজো হলে ব্যবহার করতে হয়।
সেখানে শুধুমাত্র শোষক কাপ লাগিয়ে রক্ত শোধন, পিঠে ও কোমরে ব্যথা সেরে যাওয়ার ব্যাপার টি অবান্তর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে, এই প্রক্রিয়ার প্লাসিবো ইফেক্ট বেশ শক্তিশালী। ধরুন আপনার মাথা ব্যথা হলে যদি কাজ হীন ট্যাবলেট দেওয়া হয় তাহলে ভালো বোধ করবেন। আবার যদি ক্যাপসুল দেওয়া হয় তাহলে আরো দ্রুত কাজ করবে, নকল ইনজেকশন দিলে কাজ করবে ক্যাপসুলের চেয়ে বেশি, আর নকল অপারেশন করলে তো কথাই নেই।
তার মানে চিকিৎসা দেখতে যত সিরিয়াস তার প্লসিবো ইফেক্টও তত বেশি। সে দিকের বিবেচনায় কাপিং বেশ সিরিয়াস চিকিৎসাই মনে হয়।
অ্যারোমাথেরাপি
অ্যারোমাথেরাপি বিভিন্ন প্রকার ভেষজ তেল, ফুল ও মশলা দিয়ে বাষ্পের মাধ্যমে গন্ধ দেওয়ার চিকিৎসা পদ্ধতি। এটির রোগ সারানোর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কিন্তু ভালো ব্যাপার টা হলো অ্যারোমাথেরাপি সুন্দর অনুভূতি দেয়, যা মন ভালো করতে আর স্ট্রেস রিলিফের জন্য ভালো কাজ করে।
অনেক ভালো অ্যারোমাথেরাপি সেন্টার এখন রোগ সারানোর দাবী ও করেন না। মোট কথা যদি উপভোগের জন্য হয়, ম্যসাজ এর মত অ্যারোমাথেরাপিও নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু রোগ সারানোর আশা নিয়ে না যাওয়াই ভালো।
আয়ূর্বেদিক
আয়ূর্বেদিক চিকিৎসা হলো, ভেষজ গাছপালা, শিকড়, ডাল ইত্যাদি ব্যবহার করে কর চিকিৎসা। প্রথমত সম্পূর্ণ আধুনিক ঔষধ পত্র অনেকাংশেই টিকে আছে ভেষজ উপাদানের উপর। অর্থাৎ এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভেষজ ঔষুধের রোগ সারানোর ক্ষমতা আছে।
অয়ূর্বেদিক চিকিৎসা শত শত বছর ধরে অনুশীলন ও উন্নয়ন করা হয়েছে। কিন্তু আজকের আধুনিক চিকিৎসার দুনিয়ায় ঠিক কতটুকু সত্যিকারের আয়ূর্বেদিক চিকিৎসা টিকে আছে তাও ভাববার বিষয়। তাছাড়া এখানে প্রতারণা ও ক্ষতিকর ঔষধ এর সম্ভাবনা অনেক বেশি।
তাই অযথা ঝুঁকি কেন নেবেন যেখানে আধুনিক চিকিৎসায় পাচ্ছেন নিশ্চিত আর নিরাপদ ঔষধ ও চিকিৎসা।
আকুপ্রেশার ও আকুপাংচার
বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতির দুনিয়ায় সবচেয়ে নোংরা বানিজ্যটা করে কিছু আকুপাংচার কোম্পানী। এটি একটি চাইনিজ চিকিৎসা পদ্ধতি যাতে বলা হয় শরীরের বিভিন্ন স্থানে চাপ প্রয়োগ করলে রোগ সারে ও বিভিন্ন উপকার পাওয়া যায়। যেমন ধরুন বৃদ্ধাঙ্গুলে চাপ দিলে চোখের রোগ সারে, কনুই এর নিচে চাপ দিলে পেটে ব্যথা উপশম হয়।
আবার বিভিন্ন পয়েন্টে সুই ফোটানোও এই চিকিৎসার অন্তর্গত, যাকে আবার আক্যুপাংচার বলা হয়। এখানে শেষ হলেও পারতো কিন্তু তারা বিভিন্ন ম্যাশিন ও প্রডাক্টও বিক্রি করে যা তাদের চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। যেমন পাথর বসানো ম্যট্রেস, চাপ দেওয়ার ম্যাশিন সহ আরো অনেক কিছু। এগুলোর কোন উপকার নেই তবু অসংখ্য মানুষকে ভুল-ভাল বুঝিয়ে উচ্চমূল্যে এসব যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সামগ্রী বিক্রি করা হয়।
পরিশেষ
বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ চিকিৎসার চাইতে সস্তা হওয়ায় অনেক মানুষ এ চিকিৎসায় আগ্রহী হন। আবার আনেকে জটিল রোগ মুক্তির আশায় বিকল্প চিকিৎসায় ভরসা করতে চান। কিন্তু প্রচলিত চিকিৎসার কোন বিকল্প নেই, কারণ পুরো পৃথিবী একসাথে এ চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজ করে। বছরের পর বছর ধরে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ট্রায়েলের পর একেকটি ঔষধ ও চিকিৎসা ব্যবহারের অনুমতি পায়।