এবারের ঈদে সুস্বাস্থ্যে সম্পর্ক গুলোর যত্ন নিন
ঈদে বাঙালীদের বাড়ি ফিরতে বলা ও সম্পর্কের যত্ন নিতে বলার বিশেষ প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। জ্যাম, ভিড়, গরম, দীর্ঘ পথ কোন কিছুই যেন আমাদের বাড়ি ফেরার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় না। উল্টো আমরাই যেন বহির্বিশ্বের মানুষের কাছে, সম্পর্কের যত্ন কিভাবে নিতে হয় তার একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারি। তবে এর একটা অন্য দৃষ্টিকোণও আছে। চলুন পরবর্তি অংশে সে সম্পর্কে জানা যাক।

বাংলাদেশীদের সামাজিক সম্পর্কের বিভিন্ন দিক
আমাদের কাছে মানুষের সম্পর্ক এতো বেশি স্বাভাবিক আর অকপট যে, আমরা অনেক সময় সুস্থ্য সম্পর্কের গুরুত্ব আর সামাজিক সম্পর্কহীনতার সমস্যা উপলব্ধি করতে পারি না। সেই সাথে অসুস্থ্য সম্পর্ক ত্যাগ করার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করতে পারি না। একজন এভারেজ এমেরিক্যান বা ব্রিটিশ জানবেন, তার মানসিক ও শারিরীক ভাবে সুস্থ্য থাকতে হলে, সামাজিক মেলামেশা প্রয়োজনন আছে। তার জন্য তার বন্ধু প্রয়োজন, আত্মীয় সজনদের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। কিন্তু বাঙালীর তা জানার প্রয়োজন বেশিরভাগ সময়ই হয় না বললেই চলে।
যেমন ধরুন, পরিচিত মুখ দেখলেই আমরা কুশল বিনিময় করি, সালাম দেই, আমরা খুব সহজেই বন্ধু হয়ে যাই, আমরা গল্প করতে ভালোবাসি এবং পরিবার ও বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া আমাদের একরকম আবশ্য কর্তব্য।
কোন মানুষের সাথে ১০ মিনিট কথা বললেই আমরা বন্ধু হিসেবে মেনে নেই, এমনটা খুব বেশি জায়গায় দেখা যায় না বললেও চলে। তবে এখানে জীবন সহজ নয়। নানারকম দায়িত্ব, বাড়তে থাকা খরচের সাথে তাল মিলিয়ে অর্থ উপার্জন, পরিবার ও সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এই করতে গিয়ে আমাদের এই সুন্দর হাসিখুশি জীবনখানা পরিণত হয় টানা কাজ করতে থাকা একেকটা রোবটের মত।
বিশেষ করে যারা পরিবার ছেড়ে দূরে অফিস করেন ও সেখানে অন্য লোকেদের সাথে বাসা ভাগাভাগি করে থাকেন। হয়ত মাসের পর মাস একটু মনখুলে হেসে কথা বলবেন এমন হয়নি। অথচ বাসার জন্য মন কাঁদে, ফোনে কথা বলে মন ভরে না। এই গল্পটা টা বানোয়াট নয়। দেশের লক্ষ লক্ষ মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবি ও ছাত্রদের গল্প এটা। স্ত্রী নিয়ে থাকলেও গ্রামে বাবা-মা পুরোনো মানুষজন বেড়ে ওঠার সেই জায়গার জন্য খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক। ঈদের এই সময়ে কখনো স্ট্রেশন গুলোতে দাঁড়িয়ে একটু লক্ষ্য করলেই মানুষের চোখে মুখে বাড়ি যাবার একাগ্রতা খুব সহজেই দেখা দেবে। কদিন দূরে থাকলে আপনি নিজের ভেতরও সেই মড়িয়া ভাবটা দেখতে পারবেন।
চেনা পরিবেশ, প্রিয় মানুষের কাছে যে প্রশান্তি পাওয়া যায়। তার তুলনা পৃথিবীর কোন বিলাসীতার সাথে করা যাবে না। তাই এই ঈদে যতটুকু সময়ই পান, প্রিয় মানুষদের সাথে অতিবাহিত করার চেষ্টা করুন ও প্রত্যেক মুহুর্ত আলাদা ভাবে গুরুত্ব দিন।
সুস্থ্য আনন্দময় সম্পর্কের সাথে আপনার মানসিক ও শারিরীক স্বাস্থ্যও ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছে। চলুন পরবর্তি অংশে সুন্দর সম্পর্কের উপকারীতা সম্পর্কে জেনে নেই।
শারিরীক ও মানসিক স্বাস্থ্যে সুন্দর সম্পর্কের প্রভাব
শরীরের সুস্থ্যতা একটা বড় নিয়ামত, কিন্তু মানুসিক সুস্থ্যতাও যে সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন অনেকেই করতে পারেন না। যদিও শারিরীক অনেক কিছুই মানসিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। আসুন আমাদের উপর সুস্থ্য সম্পর্কের প্রভাব জেনে নেই।
স্বাভাবিক হরমোন নিঃসরন
মানুষ সামাজিক জীব এবং সমাজ ছাড়া সে বাঁচতে পারে না। আমাদের শরীরও সেটা জানে, এবং সম্পর্কের যত্ন নিলে ভালো লাগার হরমোন নিঃসৃত হয়। যা মাথা শান্ত রাখে, কাজে মন বসে ও অন্যান্য বিরক্তি দূর হয়।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
এমনটা কি কখনো খেয়াল করেছেন, বাসা থেকে দূরে থাকার কারণে সহজেই অসুস্থ্য হয়ে পড়ছেন। এমনটা কিন্তু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণে হতে পারে। সুস্থ্য স্বাভাবিক সম্পর্ক যেমন আমাদের মন ভালো রাখে, তেমনি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও উদ্দিপ্ত করে যা বিভিন্ন রোগ থেকে বেঁচে থাকার জন্য দরকারী।
দীর্ঘজীবন
নিঃসঙ্গ মানুষেরা অন্যান্য সুস্থ্য সম্পর্কের মানুষের চাইতে দ্রুত মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ জীবনের জন্য সুস্থ্য সম্পর্ক ও মানসিক স্থিরতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূরাণ। রোগ প্রতিরোধ, মানসিক ও আবেগিক ভারসাম্য বজায় থাকার কারণে শরীর ও মন ঠিক ভাবে কাজ করে যা দীর্ঘ জীবনের জন্য দরকারী। আর ভালো সঙ্গী সবসময় একে অন্যের প্রতি যত্নশীল থাকেন, যা স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
নিঃসঙ্গতার সমস্যা
"সুস্থ্য সম্পর্কের উপরকারীতা" এই কথাটা কেমন একটু বেমানান। কারণ সুস্থ্য সম্পর্কের সাথে উপকারের চাইতে স্বাভাবিকত্ব ধরে রাখা বেশি জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ সুস্থ্য সম্পর্কের মাধ্যমে আপনার জীবনে ভারসাম্য থাকবে। কিন্তু জীবন থেকে এই জিনিস টুকু বাদ চলে গেলে খুব বাজে ভাবে বিষিয়ে উঠতে পারে আপনার জীবন। চলুন জেনে আসি নিঃসঙ্গতার সমস্যা সমুহ।
অবসাদ
প্রতিটি মানুষের জন্যই যোগাযোগ স্থাপন ও কথাবার্তা বলা তার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটির অভাবে ক্রমশ অবসাদে পতিত হওয়া খুব স্বাভাবিক। অবসাদ, ডিপ্রেশন, কাজে আগ্রহ না পাওয়া এই সবই নিঃসঙ্গতার ফলাফল।
খাবারে অরূচি
নিঃসঙ্গ মানুষের খাবারে অরুচির সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে শরীর ভেঙে যাওয়া অস্বাভাবিক না। আবার উল্টোটাও হতে পারে। অনেকে নিঃসঙ্গতায় বান্জি ইটিং বা অতি ভোজন করেন। যা মুটিয়ে যাওয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার উদ্রেক ঘটায়।
কাজে অমনোযোগ
অনেক সময় দেখা যায় অনেকে বিসিএস বা বিভিন্ন প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষার জন্য একা একা পড়ালেখা করার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিঃসঙ্গতা আপনার কাজের গতি অনেকাংশেই কমিয়ে দিতে পারে। তাই খেয়াল রাখবেন, যতই ব্যস্ত থাকুন চেষ্টা করবেন কিছুটা সময় প্রিয় মানুষের সাথে কাটাতে। দেখা করা, কথা বলা কাজে দেয় কিন্তু স্পর্শ সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তাই সুযোগ পেলে আলিঙ্গন, হ্যান্ডশেক করতে ভুলবেন না।
স্ট্রেস
স্ট্রেস বলতে হৃদগতি বেড়ে যাওয়া, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, অস্থির বোধ করা, মানসিক চাপ বোধ হওয়া ইত্যাদির সমষ্টিকে বোঝায়। খুব বেশি সময় নিঃসঙ্গতাবোধের কারণে এমনটা হতে পারে। একটা বিষয় মাথায় রাখবেন, নিঃসঙ্গ হওয়া আর নিঃসঙ্গ বোধ করা এক নয়। অনেকেই আছেন নিঃসঙ্গ হয়ে বিরাট ফুর্তিতে জীবন কাটাচ্ছেন। কিন্তু নিঃসঙ্গ বোধটা বেশি খারাপ। অনেক ক্ষেত্রে নিঃসঙ্গ কষ্টকর না হলেও খারাপ প্রভাব থাকতে পারে।
অসুস্থ্য সম্পর্ক এড়িয়ে চলুন
আমাদের সম্ভবত সম্পর্কের যত্ন নেওয়ার চাইতে বিষাক্ত সম্পর্ক এড়িয়ে যাওয়া শেখাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুধু মাত্র চক্ষু লজ্জা আবার অনেক ক্ষেত্রে অনেক দিনের অভ্যাসের কারণে অসুস্থ্য সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর একটা প্রচলন রয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো এড়িয়ে চলা উচিত এবং তা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। যে সম্পর্কে আপনার আগ্রহ নেই, আনন্দ লাভ করছেন না, সেটা চালিয়ে যাওয়া সময় নষ্ট ব্যতিত কিছু নয়।
মানিয়ে চলুন সবখানে
মানুষের বাড়ি হয় ছোট কটা ঘর কয়েকজন মানুষ নিয়ে। এলাকার সবাইও ছোট্ট একটা জায়গায় থাকেন। স্কুল কলেজ বৃহত্তর হলেও জীবনের প্রশস্ততার কাছে তা কিছুই না। অর্থাৎ এটা মেনে নিতে হবে যে পৃথিবীর যেকোন প্রান্তে বেঁচে থাকতে হলে কিছুটা নিঃসঙ্গ হতে হয় সবাইকে। কিন্তু সব পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া ও নতুন নতুন সম্পর্ক তৈরি করার মধ্যেই আপনি নিঃসঙ্গতার দানবকে বস করতে পারেন।
অফিসে ঢোকার আগে দারোয়ানকে কেমন আছে জিজ্ঞেস করুন, কলিগদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন, চায়ের দোকানদারের সাথে কথা বলুন। এই ছোটখাটো কাজের মাধ্যমেই কিন্তু নিঃসঙ্গতা অনেকটাই দূরে রাখা যায়।
পরিশেষে
অর্থ, সম্পদ, সাফল্য সব জাগতিক জিনিসের পেছনে ছুটে আমরা অনেক সময় সুখের আসল অর্থটা ভুলে যাই। যত বড় বড় অর্জনই আপনার থাকুক না কেন, সুস্থ্য উপভোগ্য সম্পর্ক না থাকলে সে সবই বৃথা। তাই চলুন সচেতন ভাবে সম্পর্কের যত্ন নিতে শিখি, কাছের মানুষকে সময় দেই ও বিষাক্ত সম্পর্ক গুলো এড়িয়ে চলি।