কর্মজীবি নারী পুরুষের যেভাবে রোজা রাখা উচিৎ

নারী হোক বা পুরুষ, একজন কর্মজীবী মানুষের দিনের সিংহভাগ সময় যেখানে কর্মক্ষেত্রে কেটে যায়, সেখানে রোজা রেখে প্রাত্যাহিক কাজকর্ম ঠিক রেখে ইবাদত বন্দেগিতে নিয়োজিত হওয়া কিছুটা কঠিনই বটে। তবে রমজানে প্রাত্যাহিক কাজের রুটিন, খাওয়া- দাওয়া, বিশ্রাম, শরীরচর্চা- এ বিষয়গুলো একটু পরিবর্তন করতে পারলে চাকুরী/বাইরের কাজ করে রোজা রাখা ও ইবাদত করা অনেকটা সহজ হয়ে যায়। আমাদের আজকের আলোচনা কর্মজীবি নারী পুরুষের রমজানে করণীয়, খাওয়া দাওয়া,ঘুম ও শরীরচর্চার রুটিন এবং আনুষঙ্গিক নানা বিষয় নিয়ে।

রোজা রেখে একজন কর্মজীবী নারী পুরুষ যেভাবে তার কাজ সঠিক সময়ে ও সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করতে পারে

রমজানের মূল উদ্দেশ্য রোজা পালনের মাধ্যমে সংযম ও ইবাদত ও যিকিরের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা। কিন্তু রমজান মানে প্রাত্যহিক কাজে শিথিলতা নয়। কারণ ইসলাম কখনো কর্মহীনতা কে সমর্থন করেনা। সুতরাং কর্মজীবী নারী পুরুষদের যেমন নামাজ, ইবাদত, জিকির আদায় করতে হবে তেমনি নিজেদের কর্মক্ষেত্রের কাজের ব্যাপারেও অবহেলা করা যাবেনা। কিন্তু রাস্তার জ্যাম, বাসায় ফেরার ঝক্কি, বাসায় এসে ইফতার বানানোর প্রস্তুতি- সবমিলিয়ে বিকেল হতে না হতেই  শরীর একদম নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তাহলে আমাদের কি করা উচিৎ?

আসুন তাহলে জেনে নেই, রোজা রেখে একজন কর্মজীবী নারী পুরুষ যেভাবে তার কাজ সঠিক সময়ে ও সুন্দর ভাবে সম্পন্ন করতে পারে-

পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম

রমজানে কর্মজীবীদের সবথেকে বেশি সমস্যায় পড়তে হয় যে বিষয়টি নিয়ে সেটা হলো ঘুমের রুটিন।রমজানে যেহেতু সেহেরীর কারণে ঘুমের অভ্যাসের  ব্যাপক পরিবর্তন হয়, একজন কর্মজীবীকে চেষ্টা করতে হবে স্বাভাবিক সময়ের  বাইরে সে ঘুমটুকু পুষিয়ে নিতে। তা নাহলে মেটাবলিজমের সমস্যা ছাড়াও অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে সারাদিন ক্লান্তি, অবসন্নতা, তন্দ্রাভাব, কাজে অমনোযোগ আসবে। সারা মাস এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাওয়াও খুব স্বাভাবিক।

বেশি রাতে ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে রমজানে এটি আরও বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। রমজানের শুরু থেকেই কর্মজীবীদের ঘুমের রুটিন ঠিক করতে হবে। আপনি চাইলে ইফতারের পর, তারাবির নামাজের আগেই কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারেন। তারাবির নামাজ পড়ে চেষ্টা করবেন ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতে। 

আপনার কাজ ভাগ করে নিন

গুরুত্বপূর্ণ মিটিং, কল, ভিডিও কনফারেন্স যেগুলোর ক্ষেত্রে বেশি এনার্জি ও মনোযোগ দরকার, সেগুলো দিনের প্রথমভাগেই সেরে ফেলুন।বেশি জরুরি ও বেশি জটিল কাজগুলো আগে করুন, তাহলে মানসিক চাপ ও কম থাকবে।

অনলাইনে ভার্চুয়াল মিটিং

জুম বা গুগল মিট এর মাধ্যমে আপনি মিটিংগুলো সম্পন্ন করতে পারেন। আরেকটা জায়গায় যেয়ে মিটিং করতে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই অনেক এনার্জি নষ্ট হবে। তাছাড়া এই এক্সট্রা সময়টুকু আপনি অন্য আরেকটা কাজেও লাগাতে পারবেন। এক্ষেত্রে অপর পক্ষের সাথে আগেই কথা বলে নেয়া দরকার। আর এসব ক্ষেত্রে অফিস বা কোম্পানিগুলোর এইচ আর ম্যানেজার বা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল ব্যাক্তি রমজানের শুরুতেই তাদের সংশ্লিষ্ট ক্লায়েন্টদের সাথে কথা বলে নিতে পারেন।

ব্রেক এ নামাজ আদায় করার পাশাপাশি হালকা হাঁটাহাঁটি বা ব্যয়াম করতে পারেন। এতে ব্রেকের পর কাজে মনোযোগ আসতে সুবিধা হবে।

অফিসের কাজ অফিসেই শেষ করুন

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের অনেক সময় বাসায় এসেও রাতে অফিসের কাজ করতে হয়। রমজানে ইফতার বা তারাবির পর কাজে মনোযোগ দেয়া যেমন কঠিন, তেমনি এসময়ে অফিসের কাজ করতে গেলে তারাবি বা নফল ইবাদতে সময় দেয়া যায়না। রোজা রাখার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু ইবাদত, সেহেতু অফিসের কাজ অফিসেই শেষ করে আসা উচিত অফিসের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের এ বিষয়টি বিবেচনায় রাখা উচিত।

ইচ্ছাশক্তি

রমজানে‌ কর্মজীবীদের যে বিষয়টা অবশ্যই থাকতে হবে তা হল ইচ্ছাশক্তি। রোজা রেখে কাজ ঠিকভাবে করা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও কাজের উৎসাহ উদ্দীপনা আপনার কর্মশক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দিবে।

কর্মজীবী নারী পুরুষদের রোজা রেখে কাজ করার জন্য ফিট থাকতে খাবার ব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত

একটি সুষম ডায়েট অনুসরণ করুন

কর্মজীবী নারী পুরুষদের সারাদিন রোজা রেখে নিজেদেরকে কাজের জন্য কর্মক্ষম রাখার জন্য সঠিক খাবার মেন্যু নির্ধারন করা জরুরি। রমজানে একটি সঠিক ডায়েট আপনাকে রোজা রেখে সারাদিন সক্রিয় থাকতে সাহায্য করবে। শুধু কর্মজীবী নারী-পুরুষ না, যারা বাড়িতে থাকেন তাদের জন্যও একটি সুষম ডায়েট মেন্যু মেনে চলা দরকার।

খাবার মেন্যু নির্ধারণের ক্ষেত্রে খাবারের পুষ্টিগুণের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। যা খেতে ভালো লাগছে এমন মুখরোচক খাবার না, যা খেলে শরীর ঠিক থাকবে, সারাদিন কাজে এনার্জি পাওয়া যাবে, এমন খাবার নিয়ে রমজানে ডায়েট প্ল্যান নির্ধারণ করতে হবে। রান্নায় সয়াবিন তেলের পরিবর্তে সরিষা, সূর্যমুখী তেল বা অলিভ অয়েল ব্যবহার করতে পারেন।

অনেকে ভাবেন রমজানে সারাদিন না খেয়ে থাকা হয় সেজন্য শরীর কর্মক্ষম রাখতে ইফতার ও সেহরিতে বেশি খাওয়া দরকার। রমজানে সেহরি ও ইফতারে যে প্রয়োজনের বেশি খেতে হবে এরকম কিন্ত না। সেহরিতে বেশি খেলে বরং আপনি দিনে অবসন্নতা ও তন্দ্রাচ্ছন্নতা অনুভব করবেন। 

ইফতার

সারাদিনের কর্মব্যস্ততার সাথে ভিড়,জ্যাম,পরিবহনে ভোগান্তির পর বাসায় ফিরে ইফতার বানানোর মতো শক্তি অবশিষ্ট থাকেনা। এজন্য দেখা যায়, কর্মজীবী নারী-পুরুষরা অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় দোকান থেকে ইফতার নিয়ে আসেন। বারবার ব্যবহার করা এসব তেলে ভাজা খাবার শরীরের জন্য কতটা  ক্ষতিকর তা আমরা সবাই জানি। 

বাইরের এসব অস্বাস্থ্যকর খাবার না কিনে ইফতারের জন্য বাসায় হাল্কা কিছুর ব্যবস্থা করা উচিত। কয়েকটা খেজুর, দই-চিড়া, সবজি, মৌসুমী ফলমূল, লেবুর শরবত, ফলের জুস এসব দিয়ে ইফতার করা ভালো। মাঝে মধ্যে রুচির  পরিবর্তন করতে ডালের বা সব্জির বড়া বা খেতে পারেন, তবে অবশ্যই বাসায় তৈরি করা।

পুষ্টিবিদদের মতে, ইফতারে একবারে একসাথে বেশি খাবার খেয়ে ফেলা উচিত না। মাগরিবের নামাজের পর ক্ষুধা থাকলে আবার হালকা কিছু খেতে পারেন। অনেকে ইফতারে ভরপেট খেয়ে রাতে কিছুই খান না। কিন্তু তারাবির নামাজের পর রাতের খাবার খেয়ে নেয়া ভালো বা ইফতারে অল্প কিছু খেয়ে মাগরিবের নামাজের পরই রাতের খাবার খেয়ে নিতে পারেন। 

তেলে ভাজা খাবার বা বেশি চিনি বা ক্যালরিযুক্ত খাবার সবসময় এড়িয়ে যান। ভাজাপোড়া মুখরোচক খাবার গ্যাস, বদহজম, পাতলা পায়খানার মত সমস্যা সৃষ্টি করবে, কর্মজীবীদের জন্য যেটি আরো বিব্রতকর।

রাতের খাবার

রমজানে রাতের খাবারে ভাত, লাল আটার রুটি, ডাল, সবজি, শাক, মাছ, মুরগির মাংস অর্থাৎ সহজপাচ্য খাবার খেতে পারেন।

সেহরি

অনেকে রাতের খাবার খেয়ে সেহরিতে কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু কর্মজীবীদের সারাদিন কর্মক্ষম থাকতে সেহরিতে পরিমিত পরিমাণে হলেও খাবার গ্রহণ করা জরুরি। সেহরিতে ভাত বা রুটি, সবজি, ডাল, মাছ, মুরগির মাংস, সালাদ, ডিম, দই, চিড়া খেতে পারেন।

প্রতিদিনের ইফতার ও সেহরিতে পরযাপ্ত পরিমাণে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার জাতীয় খাবার খেতে হবে। যেসব খাবারে ফাইবার আছে সেগুলো আপনাকে দীর্ঘক্ষণ ভরপেট রাখবে। 

কর্মজীবী নারী পুরুষদের সারাদিন শরীরকে সতেজ ও কর্মক্ষম রাখার জন্য অবশ্যই প্রযাপ্ত পরিমাণে পানি, ফলমূল ও শাকসবজি গ্ৰহণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু কাজের জন্য নয়, কর্মক্ষেত্রে আসা যাওয়া ও আনুষঙ্গিক কাজের জন্য আপনার শরীরের এ জাতীয় খাবার বেশি দরকার। এ ডায়েট প্ল্যানটি শুধু কর্মজীবী রাই না, বরং সকল রোজাদার ব্যক্তিই অনুসরণ করতে পারেন।

পর্যাপ্ত পানি পান

রোজা রেখে কর্মস্থলে আসা যাওয়া, টানা কাজ করার জন্য নিজেকে হাইড্রেটেড রাখা জরুরি। ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত অবশ্যই কমপক্ষে আটগ্লাস পানি পান করতে হবে এবং ইফতারের পর চা-কফি যথাসম্ভব কম পান করতে হবে। কিন্তু তাই বলে সেহরিতে একসাথে অনেক পানি খাওয়া ঠিক না। ইফতারে পানি ও শরবত ২ গ্লাস, সেহরিতে ২ গ্লাস ও বাকি পানি ইফতার থেকে সেহরির মাঝের সময়ে কিছুক্ষণ পরপর খেতে হবে। পানি কম খাওয়ার কারণে অনেক সময় প্রসাবে জ্বালাপোড়া হয় যেটা কর্মক্ষেত্রে খুবই যন্ত্রণাদায়ক একটি সমস্যা। 

রোজা রেখে ব্যায়াম করবেন কি না?

স্বাস্থ্য সচেতন প্রতিটি মানুষের যে কথাটি  অবশ্যই মাথায় আসবে তা হল রোজা রেখে ব্যায়াম করা উচিত হবে কিনা। রোজা রেখে অবশ্যই ব্যায়াম করা যাবে। তবে সময়টা শুধু পরিবর্তন করতে হবে। স্বাভাবিক সময়ে সাধারণত সকালে ব্যায়াম বা বিকালে হাঁটাহাঁটি করা হয়। রমজানে আপনি ইফতার বা তারাবির পর বা সেহেরির আগে/পরে ব্যায়াম বা হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। অফিস ব্রেকে হালকা একটু হাঁটাহাঁটি বা নামাজের পর হালকা ব্যয়াম আপনার শরীর ও মন দুটোই চাঙা করবে।

রমজানে অফিসে ইফতার করতে হলে কর্মজীবীরা যা করবেন

অনেক সময় দেখা যায়, কাজের বেশি চাপ থাকলে-যেমন ডেডলাইন মিট করার মত ক্ষেত্রে কর্মজীবিদের অফিসে ইফতার করতে হয়‌। সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ করমজীবীরাই কাছাকাছি কোন রেস্টুরেন্টে যেয়ে ইফতার করে থাকেন বা ইফতার অর্ডার করে থাকেন যার প্রায় সবই বারবার ব্যবহার করা পোড়া তেলে ভাজা মুখরোচক খাবার। 

কয়েকদিন টানা অফিসে ইফতার করতে হলে অফিসেই সবাই মিলে ইফতারের ছোটখাটো আয়োজন করা যায়।ভাজা পোড়া এড়িয়ে খেজুর, দই- চিড়া, ভেজানো কাঁচা ছোলা, সেদ্ধ ডিম, শরবত, আপেল, পাকা পেঁপে, তরমুজ‌ ও অন্যান্য মৌসুমী ফল দিয়ে ইফতার সেরে নিতে পারেন। 

তাছাড়া এখন অনেকে হোমমেড খাবার ডেলিভারি দিয়ে থাকেন যেটা রেস্টুরেন্টের খাবারের থেকে মানের দিক থেকে অনেকটাই ভালো ও নিরাপদ। কয়েকদিন টানা অফিসে ইফতারের ক্ষেত্রে কর্মজীবীরা খাবার ডেলিভারির অ্যাপগুলো থেকে সহজেই হোমমেড ইফতার প্যাকেজ অর্ডার করে নিতে পারেন।

শেষকথা

রমজানে রোজা রাখার যেমন আধ্যাত্মিক গুরুত্ব অনেক বেশি, একইভাবে নিজে সুস্থ থেকে নিজের কাজ ও দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার গুরুত্বও অনেক। কারণ সিয়াম বা রোজা শুধু আমাদের আধ্যাত্মিক ও চারিত্রিক পবিত্রতার শিক্ষা দেয়না বরং সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা নিজের কর্ম ও দায়িত্ব-কর্তব্য  সততা, সংযম ও নিষ্ঠার সাথে পালন করার তাগিদ দিয়েছেন। তাই রমজানে কর্মজীবী নারী পুরুষদের কাজের জন্য যেমন রমজানের ইবাদত-জিকিরকে প্রভাবিত করা যাবেনা, তেমনি রোজা রেখে নিজের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও সঠিকভাবে পালন করতে হবে। আর এজন্যই পুরো রমজান জুড়ে প্রয়োজন একটি সুস্থ লাইফস্টাইল ও সুষম ডায়েট চার্ট মেনে চলা।

Default user image

মেঘলা, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি মেঘলা। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছি। ভালো লাগে পাহাড় আর ঝর্ণায় ঘুরতে। পছন্দের কাজ বাগান করা আর বিভিন্ন রেয়ার গোলাপ সংগ্রহ করা। বই পড়ার শখ থেকেই লেখালেখির শুরু। আস্থা লাইফের হেলথ ব্লগগুলো লিখতে ভালো লাগে, পাঠকদের সচেতন করার পাশাপশি নিজেও অনেক নতুন কিছু জানতে পারি।

Related Articles