শীতে গৃহস্থলির পরিচ্ছন্নতা: সুস্থ থাকুন পুরো শীত জুড়ে

বেশিরভাগ মানুষের জন্যই শীত বেশ উপভোগ্য একটি ঋতু। তবে শীতের সাথেই আসে বিভিন্ন শীত জনিত রোগ-বালাই। পুরো শীতটা স্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে চাই একটু বাড়তি সতর্কতা। সুস্থ থেকে শীত উপভোগ করতে পরিচ্ছন্নতার দিকে বাড়তি মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। আসুন জেনে আসি কি কি করলে সহজে কিভাবে শীত জনিত সমস্যা গুলো মোকাবেলা করা সম্ভব।

শীতের আমেজ বেশ জেঁকে বসেছে। সেই সাথে ঋতু পরিবর্তন জনিত সর্দি-জ্বরও হাজির। এমনটা হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু আপনার আবাসস্থল যদি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন না হয়, পুরো শীতেই ঠান্ডা-কাশি আপনাকে বেশ ভোগাবে। তার সাথে এলার্জি ও অন্যান্য শ্বসনতন্ত্রের রোগব্যাধি তো আছেই। তাই অবহেলা নয়, শীতে সুস্থতা চাইলে পরিষ্কার পরিছন্নতাকে দিতে হবে প্রথম গুরুত্ব।

শীত একটি শুষ্ক ঋতু তাই ত্বক ও শরীরের প্রতি বাড়তি যত্ন নিতে হয়। তা না হলে ত্বক হয়ে যায় শুষ্ক ও রুক্ষ। ঠিক তেমনি ঘর বাড়ির অভ্যন্তরীণ পরিচর্যার প্রয়োজন। সব কিছুরই একটু বাড়তি যত্ন নিতে হয় এই ঋতুতে। এই ঋতুতে বলতে গেলে বৃষ্টি হয়ই না, তাই চারপাশ ধুলাবালিময় হয়ে থাকে। আর দরজা জানালা আটায় রেখেও দেখা যায় ঘরে ময়লা জমে, আসবাবপত্রে ধুলার আস্তর পরে থাকে। যা পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা অতি অত্যাবশ্যক। কারন এই ধুলায় অনেকে এলার্জির সমস্যা হয়, আর যাদের এজমার সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য এই ধুলাবালি খুবই ভয়ংকর। এই সময় মশার উপদ্রপও দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের গৃহব্যবস্থাপনা ও গৃহায়ন বিভাগের প্রভাষক শারমিন সুলতানা বলেন - " শীতকালে মশার উপদ্রব বেড়ে যায় তাই বাড়িঘর বিশেষ করে পর্দা ও বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা প্রয়োজন।”

তিনি আরও বলেন , “শুধু মশার উপদ্রব কমাতেই নয় সুস্থ থাকতে ও এলার্জির সমস্যার সমাধানে সচেতন থাকতেও ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা দরকার। এইসময় নিয়মিত ঘরবাড়ি ঝাড়ামোছা করা উচিত। অনেকে মনে করেন শীতে খুব একটা ঘর মোছার প্রয়োজন নেই, এটি সম্পূর্ণ ভুল কথা। শীতকালে নিয়মিত ঘর মুছলে এলার্জি জাতীয় সমস্যা কম দেখা দেয়।"

শীতে গৃহস্থলির পরিচর্যা কেন করবেন?

শীতকাল শুষ্ক মৌসুম হিসাবেও পরিচিত। তাই চারদিকে ধুলাবালির পরিমান বেশি থাকে আর ঘরবাড়ি ময়লাও হয় খুব দ্রুত। একদিন পরিস্কার না করলেই আসবাবপত্র থেকে শুরু করে সব জায়গায় ধুলার পরত পরে যায়।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোন বিকল্পই নাই। নিজের সাথে সাথে জামা কাপড় থেকে শুরু করে ঘরবাড়িও অবশ্যই পরিচ্ছন্ন রাখা উচিত। 

যেহেতু শীত শুষ্ক মৌসুম আর তাই এই ঋতুতে ধুলা মাত্রাও বেশি। ধুলাবালি সবার শরীরের জন্যই ক্ষতিকর।

যাদের ডাস্ট এলার্জি রয়েছে তাদের জন্য তো খুবই ক্ষতিকর। যাদের ডাস্ট এলার্জি রয়েছে তাদের হাঁচি কাশি মানে ঠান্ডা জনিত সমস্যা থেকে শুরু করে অনেক সময় নিঃশ্বাস নিতেও সমস্যা হয়। তাই ডাস্ট এলার্জি যাদের আছে তাদের অবশ্যই নিজের সাথে সাথে ঘর নিজের রুম অবশ্যই ধুলা মুক্ত রাখতেই হবে। 

যাদের বাসায় ছোট শিশু রয়েছে সেই ঘরবাড়িও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা আবশ্যক। শীতের সময় বিভিন্ন রকম জীবাণু আর ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হয়। যা শিশুদের অসুস্থ করে। বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও তুলনামূলক কম থাকে তাই ধুলাবালি থেকেও নানা রকম ফ্লু হয়ে থাকে। যেমন:

  • ইনফ্লুয়েঞ্জা

  • শ্বাস প্রশ্বাস সংক্রামনজনিত ভাইরাস

  • ব্রঙ্কিওলাটিস ইত্যাদি।

নানাবিধ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কাশি ও শ্বাস প্রশ্বাসে গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। আর তাই যে ঘরে শিশু রয়েছে সেই ঘরবাড়ি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা আবশ্যক।

শুধুমাত্র আসবাবপত্র বা জামাকাপড়েই ধুলা পরে না। থালাবাসন বা রান্নার সামগ্রীতেও ধলা জমতে পারে। হাঁড়িপাতিল থালাবাসন প্রতিদিন ভালো করে ধুয়ে-মুছে পানি ঝরিয়ে শুকিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে। এতে ধুলা জমার সম্ভাবনা থাকবে না আর রোগজীবাণু সংক্রামিতও হবে না।

মোটকথায়, পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কোন বিকল্পই হয় না। আর শীতকালে যেহেতু ধুলার পরিমান বেশি থাকে তাই নিজেদের শারিরীক সুস্থতার জন্যই এই সময় ঘরবাড়ি পরিস্কার করে রাখা উচিৎ।

মোটামুটি আমরা সকলেই ঘরবাড়ি পরিস্কার করি। কিন্তু ঘরবাড়ি পরিস্কারের কিছু সহজ উপায় রয়েছে। এই পদ্ধতিতে পরিস্কার করলে সহজে কম সময়ে ঘর পরিস্কারের পদ্ধতি সম্পর্কে আমরা জানবো আর কেন পদ্ধতিতে পরিস্কার করলে ঘরের মোটামুটি সব কিছুই পরিস্কার হয়েছে বলে নিশৃচিত হতে পারবো সে সম্পর্কে আসুন জেনে নেই :- 

শীতে গৃহস্থলির পরিচর্যা কিভাবে করবেন? 

শীতে গৃহস্থলি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর রাখার উপায় গুলো জেনে নিন,

  • ধুলাবালি থেকে মুক্তি পেতে সাধারণত আমরা শীতকালে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে রাখি।এতে ধুলাবালি কম জমলেও ঘরে আলো বাতাস তেমন ঢুকতে পারে না। এই ক্ষেত্রে দুই স্তর বিশিষ্ট পর্দা ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে ঘরের ভিতর ধুলা কম আসে। এই ক্ষেত্রে হালকা কালার ও পাতলা কাপড়ের পর্দা বাহিরের দিকে এবং গাঢ় রং এর ও একটু মোটা কাপড়ের পর্দা ঘরের ভিতরের দিকে লাগালে আলো বাতাস ঘরে না ঢুকার সমস্যা সমাধান হবে এবং ধুলাও ঘরে তেমন ঢুকবে না।

  • তবে শীতকালে পর্দা তেমন ধোয়া হয় না। সেক্ষেত্রে নিয়মিত আসবাবপত্র পরিষ্কার পাশাপাশি শলার ঝাড়ু দিয়ে পর্দা ঝেড়ে পরিস্কার করে নিতে হবে। পারলে মাসখানেক পর পর পর্দা ধুয়ে নিতে পারলে খুবই ভালো।

  • দিনের অনেকটা সময় আমরা শোয়ার ঘরে কাটাই। তাই এই ঘরটি পরিচ্ছন্ন রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় প্রতিদিনের কাজের তালিকায় শোয়ার ঘরের আসবাবপত্রে ধুলা পরিস্কার ও জিনিসপত্র ঠিকঠাক গুছিয়ে রাখা আবশ্যক।

  • শীতকালে গরম কাপড় (গায়ের চাদর, সুয়েটার ইত্যাদি), লেপ, কম্বল, পাপোষ অবশ্যই ভালো করে রোদে দিয়ে গরম করে শলার ঝাড়ু দিয়ে ঝেড়ে তারপর ব্যবহার করতে হবে। কারন শীত চলে গেলে এই সব গরম জিনিস আমরা আলমারিতে সংরক্ষণ করি। আর বেরই করা হয় না। তখন এতে কার্বাই জমতে পারে যা কারো জন্যই ভালো না আর যাদের ডাস্ট এলার্জি রয়েছে তাদের জন্য তো সর্বনাশ। দীর্ঘ দিন বদ্ধভাবে থাকার ফলে এটি ঠান্ডা হয়ে থাকে বা ভেজা ভেজা লাগে। তাই রোদে না দিয়ে ব্যবহার ও সংরক্ষণ কোনটাই করা উচিত নয়।

গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক শারমিন সুলতানা পরামর্শ দেন -  "  যাদের ডাস্ট এলার্জির সমস্যা রয়েছে তাদের অবশ্যই সচেতনতা অবলম্বন করতে হয়ে এবং লোমজাতীয় পোশাক পরিধান না করাই শ্রেয়। 

কম্বল সরাসরি ব্যবহার না করে তাতে একটি সুতির কাভার লাগিয়ে ব্যবহার করলে এধরনের সমস্যা হয় না। এছাড়াও তাদের সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

উল বা পশমজাতীয় পোশাক ব্যবহারে অসুবিধা থাকলে ফ্লানেল বা অন্যকোনো কৃত্রিম তন্তুর তৈরি ভারি পোশাক ব্যবহার করা ভালো।"

শীতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা

শীতে ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কিছু টিপস জেনে নিন।

  • শীতকালে ফ্লোর মোছার সময় মাঝে মাঝে গরম পানি দিয়ে মুছে নিলে ভালো হয়।  পানিতে ডেটল বা সেভলন বা সাবানের গুড়া দিয়ে মুছে নিতে হবে। 

  • বারান্দার ও জানালার গ্রিল প্রতিদিন না পারলেও একদিন পর পর ভিজা কাপড় দিয়ে মুছে নিতে হবে। কারন শীতকালে এই গ্রিলেই বেশি ধুলা জমে আর বাতাসের সাথে তা ঘরে আসে। 

  • ফ্লোর পরিস্কারের পাশাপাশি যদি কার্পেট বিছানো থাকে তবে সেটিও ডেইলি ঝেড়ে নিতে হবে এবং সপ্তাহ অন্তর রোদে দিতে হবে। সোফা ও কার্পেট পরিস্কারের জন্য ভেকুয়াম ক্লিনার ব্যবহার করা যেতে পারে।

  • প্রায় সব বাসায়ই বুক সেলফ থাকেই। একটি একটি করে বইয়ের ধুলা পাতলা কাপড় দিয়ে ঝেড়ে নিতে হবে এবং ঘর সাজানোর শো পিস কাপড়কে ভিজিয়ে ভালো করে জল নিংরে নিয়ে মুছতে হবে।

  • ধুলাবালি তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে বলে ঘরের আনাচে কানাচে ধুলা বেশি জমে এবং ঝুলও হয় বেশি। তাই সপ্তাহে একদিন এগুলা পরিস্কার করে নিতে হবে।

  • ঘরের আসবাবপত্র যেমন - খাট, ড্রেসিং টেবিল, ফ্যান, লাইট, শোকেস, আলমারি, ফ্রিজ, টিভি, কম্পিউটার ইত্যাদি শুকনা কাপড় দিয়ে মুছে নিতে হবে। তবে ধুলা বেশি জমলে ভিজা কাপড় দিয়ে মুছলে পরিস্কার হয়ে যাবে।

  • বর্তমানে অনেকেই শখের ঘরের জানালায় বা বারান্দায় শখের বাগান করে থাকেন। আর টবে রাখা মাটি থেকেও ঘর বারান্দা নোংরা হতে পারে। তাই গাছ পরিচর্চার পর এবং গাছে পানি দেবার পর টপের গায়ে লেগে থাকা মাটি ও চারপাশের ময়লা সুন্দর করে পরিস্কার করে নিতে হবে। 

সর্বোপরি, যেহেতু পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কোন বিকল্প নাই এবং একে ইমানের অঙ্গ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।  তাই প্রতিদিন নানারকম  কাজের তালিকায় ঘর পরিস্কার করা অবশ্যই রাখতে হবে।  প্রতিদিন না হলেও একদিন পর পর অবশ্যই ঘরের ধুলা পরিস্কার করে নেয়া উচিত। যাদের এলার্জির সমস্যা রয়েছে তাদের ধুলা পরিস্কারের আগে মাক্স ও হাতে গ্লাবস্ পরে নিতে হবে। যাতে কোনভাবেই ধুলার জন্য কষ্ট পেতে না হয়।ঘর পরিস্কারের পর গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিতে পারলে আরও ভালো হয়। ঘরে নানা রকমের আসবাবপত্র থাকে যা প্রতিদিন পরিস্কার করা সম্ভব না। সেক্ষেত্রে একেক দিন একেক জিনিস পরিস্কার করে নিলে ঘর পরিস্কার রাখা যাবে সহজেই।

শেষ কথা

ঘর আমাদের সবচেয়ে শান্তির জায়গা। তাই যে ঘরে আমাদের বসবাস, সারাদিনের ক্লান্তির পর ঘরে ঢুকে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি সেই ঘরটিকে পরিস্কার করে গুছিয়ে রাখা আমাদেরই কর্তব্য। তাই প্রতিটি  নিবাস হোক পরিস্কার পরিচ্ছন্ন ও নিরাপদ।

Default user image

ত্রপা চক্রবর্তী, লেখক, আস্থা লাইফ

নিজেকে ও নিজের মতামতটাকে উপস্থাপনের লক্ষ্যে এই লেখালিখির পেশায় হাতে খরি। মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে ভাষা তবে অনেকেই আছেন যারা হয়তো অনেক কিছু বলে উঠতে পারেন না বা বোঝাতে পারেন না। আর লিখালিখি হয়তো সেই জড়তাটা দূর করতে সহায়তা করে, মুখে বলতে না পারা কথা লিখে অনায়াসে বলা যায়। মুক্তভাবে চিন্তা করতে ভালোবাসি। গল্প, হৈ চৈ করতে ভালোবাসি, রেগে গিয়ে হেরে জেতে চাই না আর ভালো লাগে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে এবং ঔ জায়গার সম্পর্কে মানে ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে। মনে প্রানে বিশ্বাস করি প্রতিটা মানুষের মাঝে এমন কিছু তো আছেই যা তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে ও সুন্দর করে। পরচর্চা না করে কারো চর্চা বিষয় হওয়াটাকে সৌভাগ্যের মনে করি।" একদিনে হবে না তবে একদিন ঠিকই হবে" এই বিশ্বাসটা জাগিয়ে তোলার লক্ষ্য উৎসাহিত করার এবং আমার সোনার বাংলাদেশটাকে উন্নত দেশ হিসাবে দেখার স্বপ্ন দেখি।

Related Articles