খুশকি দূর করার কার্যকরী ৮টি ঘরোয়া উপায়!
পৃথিবীর প্রতি ১০০ জন মানুষের ৫০ জনই খুশকির সমস্যায় ভুগে থাকেন। কারো কারো ক্ষেত্রে সমস্যাটি খুব বাজে আকার ধারণ করে। খুশকি দূর করার জন্য এর পেছনে দায়ী কারণগুলোও জেনে রাখলে একটি সম্মুখ ধারণা পাওয়া যাবে। সেই সঙ্গে শুধু ঘরোয়া কিছু পদ্ধতি অনুস্বরণ করেই খুশকি থেকে নিস্তার সম্ভব। চলুন জেনে আসি বিস্তারিত।
খুশকি মানুষের জন্য খুব সাধারণ একটি সমস্যা হলেও খুশকির উপস্থিতি নানা ভাবে আমাদের জীবন মান এ চুলের স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে থাকে। খুশকির কারণে চুলকানি, জ্বলুনি ভাব ও ক্ষেত্র বিশেষে চুল পড়ার সমস্যাও দেখা দেয়। চুলের স্বাস্থ্য নির্ভর করে সুস্থ্য হেয়ার ফলিকিউলস ও মাথার ত্বকের উপর। খুশকি মাথার ত্বক ও হেয়ার ফলিকিউলসের ক্ষতি সাধন করে যার ফলে চুল বেড়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট পুষ্টি পায় না। সেই সাথে অস্বস্তি তো আছেই। একটা ভ্যাপসা গরমের দিনে খুশকি জনিত চুলকানির চেয়ে অস্বস্তিকর আর কি হতে পারে? তবে আশা করা যায় যায় এই প্রবন্ধ পড়া শেষে আপনি খুশকির দূর করার জন্য যথেষ্ট তথ্য পেয়ে যাবেন।
খুশকি কেন হয়?
আমাদের দেহের প্রতিটি ছোট ছোট কার্যাকলাপও খুব সুক্ষ সুক্ষ কোষ ও অনুবীক্ষনিক জীব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জীববিজ্ঞানে যত ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে পড়ালেখা করবেন বিষয়টা ততই মজার হতে থাকবে। তবে চলুন গল্পচ্ছলে খুশকির পেছনে বিজ্ঞানের গল্পটাও জেনে আসা যাক। মানুষের জন্মের কয়েক ঘন্টার ভেতরই তার মাথার ত্বকে এক ধরণেন ছত্রাক/ ইস্ট বাসা বাঁধে যার নাম হলো ম্যালাসিজিয়া। পৃথিবীর সব মানুষের মাথাতেই ম্যালাসিজিয়ার বসবাস। কিন্তু প্রায় অর্ধেক মানুষের মাথায় ম্যালাসিজিয়ার কারণে খুশকি জাতীয় সমস্যা তৈরি হয়।
আমাদের মাথার স্ক্যাল্পে ম্যালাসিজিয়ার বসবাস খুবই সাধারণত একটি প্রক্রিয়া। এমনকি আমাদের শরীরে প্রত্যেকটি অংশে (আক্ষরিক অর্থেই) কোন না কোন অনুজীব বাসা বাঁধে। আমারদের মাথার ত্বকের ক্ষেত্রে তা হলো ম্যালাসিজিয়া। ম্যালাসিজিয়া কিভাবে খুশকির কারণ হয়ে ওঠে? আমাদের মাথায় ও সারা শরীরেই হেয়ার ফলিকিউলস থাকে যেখান থেকে মূলত চুল গজিয়ে ওঠে। ঐ ফলিকিউলসে চুল গজানোর পরও কিছুটা সংকীর্ণ ফাঁকা অংশ থেকে যায়। ঐ স্থান গুলোই হলো ম্যালাসিজিয়ার সবচেয়ে প্রিয় বাসস্থান। কারণ হেয়ার ফলিকিউলসের গোড়ায় এক ধরণের গ্রন্থি থাকে যা সিবাম নামের এক ধরণের তেল জাতীয় পদার্থ উৎপন্ন করে। সিবাম আমাদের চুলের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করার শরীরের অভ্যন্তরীণ তেল। ম্যালাসিজিয়া সাধারণ ঐ সিবাম তেল দিয়েই তার আহার সম্পন্ন করে থাকে। এজন্যই আমাদের মাথার ত্বক হলো আমাদের দেহের সবচাইতে তৈলাক্ত অংশ। ম্যালাসিজিয়া যখন ঐ তেল দিয়ে তার আহার সম্পন্ন করে তখন কিছু অবশিষ্ট পড়ে থাকে।
একটু ভেঙে বলি। সিবাম তেল দুই ধরণের ফ্যাটি এসিড দিয়ে তৈরি, একটি হলো স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড অন্যটি আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড। ম্যালাসিজিয়া ঐ তেল ভেঙে স্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড গ্রহন করে পড়ে থাকে শুধু আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিড। পড়ে থাকা ফ্যাটি এসিড অসম্পৃক্ত হওয়ার কারণে ত্বকের সাথে মিশে যায় এতে ত্বকের পানি বের হয়ে যায় এবং ত্বকের ক্ষতি হয়ে থাকে। আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা এটাকে একটা ঝুঁকির ব্যাপার হিসেবে দেখে ও এর কারণে চুলকানির মত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ত্বকের ক্ষতি ঠিক করার জন্য আমাদের দেহ দ্রুত ব্যাবস্থা গ্রহণ করে ও ক্ষতস্থানে নতুন কোষ উৎপাদন করা শুরু করে। স্বাভাবিকভাবে আমাদের চামড়ার বাহিরের অংশ প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে এবং একটি কোষ করে ঝরে যাচ্ছে। তাই তা সহজে লক্ষনীয় না। কিন্তু খুশকির ক্ষেত্রে অপরিপক্ক কোষ বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। নতুন কোষ উৎপন্ন হওয়ার পর, সেই আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি এসিডের অংশ সহ বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক উঠে আসে। এটাই মূলত খুশকি। যদিও অন্য কিছু কারণেও খুশকি হয় তবে মিলাসিজিয়া জনিত খুশকিতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ ভোগেন।
মানুষের শরীরে সিবাম নিষ্কাশনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে কি পরিমাণ খুশকি আপনার মাথায় হতে পারে। সিবাম তেল এর নিষ্কাশন এর পরিমাণ নির্ভর করে মানুষের বয়স, হরমোন ও অন্যান্য শরীরবৃত্তিয় কার্যকলাপ এর জন্য। মূলত বয়ঃসন্ধি ও পঞ্চাশোর্ধ মানুষের খুশকি বেশি হয়ে থাকে। নারীদের চাইতে পুরুষদের খুশকি হওয়ার প্রবণতা বেশি। যদিও সব মানুষের মাথার ত্বকে ম্যালাসিজিয়ারর বসবাস তবু শুধু অর্ধেক মানুষের ভেতর ম্যালাসিজিয়ার কারণে খুশকি দেখা যায়। যদিও এর কারণটা এখনো স্পষ্ট নয়। ধারণা করা হয় যাদের খুশকি হয় না তাদের মাথার ত্বক আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয় না। এ বিষয়ে সবে বিষদভাবে গবেষণা শুরু হয়েছে।
খুশকি দূর করার পদ্ধতি
খুশকি দূর করার একটি কার্যকরী পদ্ধতি হলো এন্টিড্যানড্রফ শ্যাম্পু। অনেক সময় ছত্রাক জনিত খুশকিতে এন্টিড্যানড্রফ শ্যাম্পু কাজ নাও করতে পারে। সেক্ষেত্রে একজন হেয়ার স্পেশালিস্টকে দেখানোর প্রয়োজন পড়তে পারে। হেয়ার স্পেশালিস্ট বলতে পারবেন ঠিক কোন কারণে আপনার খুশকি হচ্ছে। কিছু ঘরোয়া পদ্ধতিও খুশকি দূর করতে বেশ কার্যকরী। চলুন পরবর্তি অংশে খুশকি দূর করার ঘরোয়া পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যাক।
খুশকি দূর করার ঘরোয়া পদ্ধতি
খুশকি মুক্ত চুল পেতে এন্টিড্যানড্রফ শ্যাম্পুর বিপরীতে ঘরোয়া টোটকাও সমান কার্যকরী। উপকরণ গুলো আপনি আপনার বাসায় কিংবা পার্শবর্তি বাজারেই খুব সহজে পেতে পারেন। চলুন একে একে সবগুলো পদ্ধতি জেনে নেওয়া যাক। আপনার সুবিধা মত এক বা একাধিক পদ্ধতি অবলম্বন করে খুব সহজেই মুক্তি পেতে পারেন খুশকি থেকে।
১) এলোভেরা
এলোভেরার ব্যাক্টেরিয়া ও ফাংগাস নিরোধক গুনাগুনের কারণে এটি খুশকি দূর করার একটি কার্যকরী উপায়। এলোভেরার জুস বের করে গোসলের দশ মিনিট আগে মাথার ত্বকে ব্যবহার করলে খুব ভালো কাজে দেয়। এটি চুল ও মাথার ত্বককে মশ্চারাইজ করে যার ফলে চুলের স্বাস্থ্যও উন্নত হয়। সপ্তাহে তিনদিন মাথায় এলোভেরা ব্যবহার করে খুশকি থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
২) অলিভ ওয়েল
অলিভ ওয়েল মাথার ত্বকের শুষ্কভাব দূর করে ও ক্ষতিগ্রস্থ ত্বক দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করে। গোসলের দশ মিনিট আগে উষ্ণ গরম অলিভ ওয়েল মাথার ত্বকে মাসাজ করলে খুশকি থেকে নিস্তার পেতে পারেন। গোসলের সময় কম ক্ষার যুক্ত শ্যাম্পু ব্যবহার করে তেল ধুয়ে ফেলবেন।
৩) নারিকেল তেল
নারিকেল তেল চুলের যত্নে বহুল ব্যবহৃত ও অত্যান্ত উপকারী। রাতে ঘুমের আগে বা গোসলের কিছুক্ষন আগে নারকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। এটি মাথার ত্বকের ভেতর হেয়ার ফলিকিউলসের গভীরে ঢুকে গিয়ে চুল ও ত্বককে পুষ্টি যোগায় ও শুষ্কভাব দূর করে।
ত্বকের যত্নে নারকেল তেল এর চমৎকার কিছু গুণাগুণ!
৪) বেকিং সোডা
আমাদের রান্নাঘরের বেকিং সোডা খুশকি দূর করতে বেশ উপকারী। বেকিং সোডার অনুজীব প্রতিরোধী বৈশিষ্ট খুশকি দূর করার করতে সাহায্য করে। এক টেবিল চামচ বেকিং সোডা গোসলের সময় ভেজা চুলে ১-২ মিনিট ঘষুন এবং সাথে সাথে ধুয়ে ফেলুন। বেশিক্ষণ রাখলে এটি চুলকে শুষ্ক করে ফেলতে পারে।
৫) এসপিরিন
এসপিরিনে অবস্থিত স্যালাসিলিক এসিড খুশকি জনিত জ্বালাভাব দূর করতে ও ত্বকের ক্ষতি সরিয়ে তুলতে সাহায্য করে। উল্লেখ্য এসপিরিন এন্টিড্যানড্রফ শ্যাম্পুরও একটি সক্রিয় উপাদান। দুইটি এসপিরিন ট্যাবলেট গুড়ো করে শ্যাম্পুর সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করলে খুব ভালো উপকার পেতে পারেন।
৬) লেবু ও দই
লেবুর সাইট্রিক এসিড অনুজীব প্রতিরোধী অন্যদিকে দই হলো একটি প্রাকৃতিক মশ্চারাইজার। অর্থাৎ এই দুইটির মিশ্রণ ব্যবহারে মাথার ত্বকের অনুজীবও দূর হয় এবং ক্ষতিগ্রস্থ ত্বকেও সেরে ওঠে। এক বাটি দই এর ভেতরে একটি লেবু সম্পূর্ণ চেপে নিন। এরপর গোসলের আগে মাথায় এটির ব্যবহার করে একটি হেয়ার মাস্কের মত তৈরি করুন। দশ মিনিট অপেক্ষা করে কম ক্ষার যুক্ত শ্যাম্পু সহকারে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে দুই বার এটি ব্যবহার করে খুশকির সমস্যা দূর করতে পারেন।
৭) ভিনেগার
ভিনেগার হলো একটি জৈব এসিড যা মাথার ত্বকের এসিডিটি বাড়িয়ে তোলে। এসিডিক পরিবেশ ফাংগাস এর বৃদ্ধি হ্রাস করে। ভিনেগারে আরেকটি উপকারিতা হলো এটি আপনার চুলোর উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। এক কাপ পানিতে সমপরিমাণ ভিনেগার মিশিয়ে দশ মিনিট পর ধুয়ে ফেলতে হবে। এক সপ্তাহ প্রতিদিন ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
৮) ডিমের কুসুম
ডিমের কুসুমে মাথার ত্বকের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও প্রটিন থাকে। এটি মাথার ত্বককে মশ্চারাইজ করেও খুশকি দূর করে। দুটি কাঁচা ডিমের কুসুম আলাদা করে একটু মিশিয়ে মাথার ত্বকে প্রলেপ লাগান। একটি পলিথিন ব্যাগ দিয়ে মাথা আধা ঘণ্টা ঢেকে রাখুন। এরপর ভালোভাবে শ্যাম্পু করে চুল ধুয়ে ফেলুন। এই পদ্ধতি সপ্তাহে দুই বার ব্যবহারে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
খুশকি যদিও খুব বিরক্তিকর, তবুও এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনেরই অংশ। খুশকির জন্য দায়ী ম্যালাসিজিয়া ফাংগাস মাথার ত্বককে অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া থেকে সুরক্ষিত রাখে। তাই খুশকির অাধিক্য দূর করাটাই উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। দৈনিক বা খুব ঘনঘন খুশকি নিরোধী রাসায়নিক ও ফাংগাস প্রতিরোধী উপকরণ ব্যবহার ক্ষেত্র বিশেষে হিতে বিপরীত ঘটাতে পারে।