দাঁত নিয়ে ৮টি ভুল ধারণা ও প্রতিকার
সঠিকভাবে দাঁত পরিষ্কার রাখা ও কোন কোন অভ্যাস দাঁতের জন্য ক্ষতিকর আর কোনগুলো মিথ বা কুসংস্কার এই প্রশ্নগুলোর উত্তরই আপনি পেয়ে যাবেন এই প্রবন্ধে। আশা করি লেখাটি পড়ার পর আপনার দাঁতের যত্ন নিয়ে ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ তৈরি হবে।

আদিম মানুষ তো দাঁত মাজে নি, তবে এখন কী দরকার?
পাঠকেরা যদি শিরনাম দেখেই ভ্রু কুঁচকে ফেলেন, তাহলে বলতে চাই, দাঁত মাজার প্রয়োজন নাই এই কথা বলা এই প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য নয়। তবে দাঁত মাজাকে কেন্দ্র করে ইন্টারনেটে ও বিভিন্ন জায়গায় যে ভুল ধারণা গুলো গড়ে দেওয়া হয়, এই প্রবন্ধটি সেই বিষয় গুলো চিহ্নিত করতে এটি লিখতে বসলাম।
১. প্রাচীনকালে মানুষ কি আসলেই দাঁত মাজত না?
দাঁত মাজার সবচেয়ে প্রাচীন ব্রাশ এর অস্তিত্ব পাওয়া যায় চীনে। যা এখন থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবহৃত হতো। মিশরে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগের মিসওয়াক পাওয়া গেছে। এই হচ্ছে মানব সভ্যতার ব্রাশ করার সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন। কিন্তু তার আগে মানুষ দাঁত মাজতো না, এবং সম্ভবত দাঁত মাজার প্রয়োজনও হতো না। প্রাচীন মানুষের চোয়ালের কঙ্কাল ও তার গঠন পরীক্ষা করে এই তথ্য গুলো পাওয়া যায়। তবে এখন এমন কি হলো, যে আমাদের দৈনিক দুই বেলা ব্রাশ করা লাগবে?
এই শুনে আপনি আবার এখনি ব্রাশ করা ছেড়ে দিয়ে মুনি-ঋষি হয়ে যাবার পরিকল্পনা করবেন না, পুরো লেখাটা আগে পড়ুন! মানুষের এখন কেন ব্রাশ করা লাগে, আগে কেন লাগতো না সে বিষয়টা বুঝতে পারলে আমরা আমাদের দাঁতের জন্য ক্ষতিকর অভ্যাস ও যত্নে করনীয় সম্পর্কে বুঝতে পারবো।
২. তবে এখন দাঁত মাজার কি দরকার?
প্রথমত সামাজিক কারণে মুখের পরিচ্ছন্নতা আমাদের দাঁত মাজার অভ্যাসের একটি বড় কারণ। কিন্তু মূল কারণটা হলো আমাদের খাদ্যাভ্যাস। আমরা প্রচুর পরিমাণে চিনি ও প্রসেসড ফুড যেমন কেক, পাউরুটি, জ্যাম, জেলি, ফাস্টফুড ও চকলেট এসব খেয়ে থাকি যা দাঁতের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। সেই সাথে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে অনীহাও দাঁতের গঠন দুর্বল হওয়ার একটি বড় কারণ। আমাদের দাঁতকে খুব বেশি খাটতে হয় না। বেশিরভাগ খাবার নরম ও খাওয়া পরিশ্রম সাধ্য নয়।
কিন্তু প্রাচীন মানুষেরা এতো সহজে খাবার গ্রহণ করে নি। তাদের খাবারের পুষ্টিগুন তাদের দাঁতকে মজবুত হতে ও ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করেছে। সেই সাথে তাদের খাবারে থাকতো প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। ফাইবার বা আঁশ যুক্ত খাবার দাঁত পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করতো।
কিন্তু আমাদের এই অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, আর বিভিন্ন ক্যামিক্যাল যুক্ত ও পুষ্টিহীন খাবার আমাদের দাঁতের বৈশিষ্ট পরিবর্তন করেছে। অর্থাৎ এই মুহুর্তে যদি কেউ দাঁত মাজা ছেড়ে দিতে চান তাহলে তা অবশ্যই হবে একটা ভুল পদক্ষেপ।
৩. হলুদ দাঁত মানেই কি অস্বাস্থ্যকর?
না হলুদ দাঁত মানে আপনার দাঁত এর স্বাস্থ্য ভালো নয় তা ঠিক না। বরং সাদা দাঁতের মত সামান্য হলুদ দাঁতও স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজের বিউটি স্টান্ডার্ডে শুধু সাদাটাই মানান সই। কিন্তু সাদা দাঁতের মত সামান্য হলুদ দাঁতও স্বাস্থ্যকর হতে পারে। কিন্তু দাঁত যদি ডেন্টাল ক্যাভিটি আর জমে যাওয়া প্লাকের জন্য হয়ে হলুদ হয়ে থাকে তা অস্বাস্থ্যকর। দাঁতের সাদা করার ট্রিটমেন্টও বেশ জনপ্রিয়। তবে উন্নতমানের ট্রিটমেন্ট না করালে তাতে দাঁতের ক্ষতিই হতে পারে।
৪. টুথপেস্ট কি আদৌ দরকারী?
ব্রাশ করার মত টুথপেস্টও আমাদের দাঁতের যত্নে একটি স্বাভাবিক উপকরণ। আমি পরস্পরবিরোধী থিউরিতে যাচ্ছি না, কিন্তু এটা নিয়েও আমাদের বেশ কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় ভুল ধারণা হলো পেস্ট ছাড়া ব্রাশ করা যায় না। কিন্তু আসলে ধারণাটি ভুল। ব্রাশ করা হয় মুখের প্লাগ দূর করতে, আর ব্রাশ দাঁতের ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে প্লাক কার্যকরী ভাবে পরিষ্কার করে। এখানে পেস্টের কোন ভূমিকা নেই। তবে মুখকে ফ্রেশ রাখতে ও দুর্গন্ধ দূর করতে পেস্ট সাহায্য করে।
পেস্ট দাঁতে প্লাগ জমা থেকে রক্ষা করে না। বরং কিছু কোম্পানীর পেস্ট তাৎক্ষনিক ভাবে দাঁত পরিষ্কার করলেও এতে থাকা কিছু উপাদান দাঁতে দ্রুত প্লাগ জমতে সাহায্য করে। এর ফলে আপনার আবার ব্রাশ করতে হয়, এবং এটি আপনাকে একটি সার্কেলে বেঁধে দেয়। তাই টুথপেস্ট আপনার দাঁত মাজার উপর কেমন প্রভাব ফেলছে তাও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। কিছু টুথপেস্ট একটু বেশি ঝাঁঝালো ও তা অনেক সময় দাঁতের এনামেল ও মুখের উপরিভাগের টিস্যুরও ক্ষতি করে বসে। অল্প একটু পেস্ট ব্যাবহারই যথেষ্ট, যেহেতু দাঁত পরিষ্কার রাখতে এর খুব একটা ভুমিকা নেই। তাই টুথপেস্ট ব্যবহারে সতর্ক থাকবেন। যে টুথপেস্ট আপনার দাঁতের জন্য সহনীয় সেটাই ব্যবহার করবেন।
৫. চিনি কি আসলেও দাঁতের ক্ষয় করে?
চিনি দাঁত ক্ষয়ে যাওয়ার কারণ নয়, কারণটি হলো চিনি যুক্ত খাবার গ্রহণ করার পর দাঁতে লেগে থাকা চিনি। দাঁতে লেগে থাকা চিনিতে ব্যাক্টেরিয়া কলোনি তৈরি করে, এবং ব্যাক্টেরিয়ার তৈরি উপাদানগুলো দাঁতের ক্ষয় করে। চিনি যুক্ত খাবার গ্রহণের পরে ঠিকমত মুখ পরিষ্কার করলে দাঁত ক্ষয় হওয়া থেকে নিস্তার পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুলকুচি করেই মুখ ও দাঁতে লেগে থাকা চিনি দূর করার যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে দাঁতের ক্ষয় হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়, কারণ তারা খাবার পর দাঁত পরিষ্কার করে না, ও তাঁদের দাঁত সুগঠিত নয়। ছোটবেলা থেকে মুখ পরিষ্কার রাখার অভ্যাস তৈরি করলে দাঁত সুস্থ্য রাখা সহজ হয়।
৬. ডেন্টিস্টের কাছে না গেলেই কি নয়?
দাঁতের সমস্যার কারণে যে ব্যথা হয়, তার তীব্রতার তুলনা অন্য কোন ব্যথার সাথে করা মুশকিল। কিন্তু আমাদের দেশে মানুষ একদম ঠেকায় না পড়লে ডেন্টিস্টের কাছে যেতে চান না বললেই চলে। কিন্তু বছরে অন্তত দুইবার ডেন্টাল চেকাপ ও দাঁতের জমা পাথর পরিষ্কার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
৭. দাঁত দিয়ে রক্ত পড়া কি অস্বাভাবিক?
বিভিন্ন কারণে দাঁত দিয়ে রক্ত পড়ার সমস্যা তৈরি হতে পারে। সুস্থ্য স্বাভাবিক দাঁতেও ব্রাশ করা বা ফ্লসিং (সুতো দিয়ে দাঁত পরিষ্কার) এর কারণে কিছুটা রক্তপাত হতে পারে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মাড়িতে ইনফেকশনের কারণে দাঁত দিয়ে রক্ত পড়তে পারে। মুখের সঠিক পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখলে তা মাড়িতে ব্যাক্টেরিয়াল ইনফেকশনেরর কারণ হতে পানে। সেক্ষেত্রে মাড়িতে ব্যথা, পুঁজ ও রক্ত বের হওয়ার মত উপসর্গ দেখা যায়। অনেকেই এ ধরণের সমস্যা অবহেলা করে ফেলে রাখেন কিংবা সস্তায় রাস্তা থেকে ভেসজ ঔষধ কিনে ব্যাবহার করেন যার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বরং অবহেলা করলে অবস্থা জটিলতর হওয়া ও দাঁতের দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৮. কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা কি কার্যকরী?
অনেকের ধারণা আছে যে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজলে দাঁত ভালো পরিষ্কার হয়। ব্যপারটি সত্য। কিন্তু সমস্যা হলো কয়লা দিয়ে ঘসে ঘসে দাঁত মাজলে দাঁতের ময়লার সাথে এনামেলও বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যার ফলে দাঁতের সেন্সিটিভিটি বেড়ে যেতে পারে। শিশু ও কম বয়স্কদের জন্য কয়লা দিয়ে দাঁত মাজা আরো বেশি ক্ষতিকর হতে পারে। সর্বোপরি কয়লা বা ছাই দিয়ে দাঁত মাজা এড়িয়ে চলাই ভালো।
মিসওয়াক দাঁতের জন্য সাধারণত উপকারী হয়ে থাকে। মিসওয়াকের অনেক রকম ধরণ হতে পারে। তবে খুব শক্ত মিসওয়াক ব্যবহার করলে কয়লার মত দাঁতের এনামেল ক্ষয় করতে পারে।
পরিশেষে
আধুনিক সমাজে দাঁতের যত্নের গুরুত্ব নতুন করে আর বলবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু দাঁতের যত্নে প্রয়োজনীয় প্রডাক্ট উৎপাদন কারী প্রতিষ্ঠান গুলো যেন আমাদের যা-তা বুঝিয়ে ব্যাবসাহিক ফায়দা না লুটতে পারে তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান। আবার অতিরিক্ত দাঁত ও মুখের অতিরিক্ত যত্ন নিতে গিয়ে এনামেল ক্ষয়, মুখের টিস্যুর ক্ষতির মত সমস্যাও তৈরি হতে পারে। বাৎসরিক দুই বার ডেন্টাল চেক আপ আর ডেন্টিস্টের পরামর্শ অনুযায়ী টুথপেস্ট ব্যাবহার ও দাঁত মাজার অভ্যাস তৈরি করাই সবচেয়ে ভালো।