অগ্নিকান্ড, ভূমিকম্প ও দুর্যোগে জীবন বাঁচাতে যা জানা প্রয়োজন

দুদিন পরপরই কোথাও না কোথাও আগ্নিকান্ড, সড়ক দুর্ঘটনা, লঞ্চডুবিসহ নানা রকম দূর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে হাজারে-হাজার। তাছাড়া ভূমিকম্পের আশঙ্কা তো আছেই। এমন একটা দুর্যোগে যদি আপনি পড়ে যান, তাহলে কি করবেন? কিভাবে রক্ষা করবেন আপনার জীবন ও স্বাস্থ্য? কিভাবে অন্যদের সাহায্য করবেন? যে কোন সচেতন পাঠকই স্বীকার করবেন বর্তমান পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নগুলো একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। এইসব পরিস্থিতিতে জানা আর না জানাই গড়ে দিতে পারে জীবন মৃত্যুর ব্যবধান। বিভিন্ন দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় কিভাবে নিজেকে ও প্রিয়জনদের সুস্থ্যতা নিশ্চিৎ করবেন সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানব এই প্রবন্ধটিতে।

অঘটন বলে কয়ে আসে না। কিন্তু যে ঘটনা গুলো প্রতিনিয়ত ঘটছে, তাকে কি অঘটন বলা যায়? এতোই কি ফেলনা মানুষের জীবন। নিমতলি, রানাপ্লাজা, তাজরিন গার্মেন্টস, সম্প্রতি বঙ্গবাজার সহ একের পর এক ঘটেই চলেছে ঘটনা গুলো। অব্যাবস্থাপনায় যেমন দুর্ঘটনা বাড়ছে, সেই সাথে স্পষ্ট হয়ে উঠছে জরুরী অবস্থা নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষ কতটা প্রস্তুতিহীন। ঢাকা বা বড় শহরগুলোতে যেন একরকম সৃষ্টিকর্তার ভরসায়ই মানুষে ঠাসা দালানগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। এমন একটা পরিবেশে আমাদের সাথে কোন দুর্ঘটনা যে কোনদিন ঘটবে না, এমন নিশ্চিন্ত জীবনের বিলাসীতা বোধয় কারোই নেই। সে কারণেই এসব দুর্যোগ মোকাবেলার প্রথমিক তথ্য গুলো আমাদের সকলেরই খুব স্পষ্ট ভাবে জেনে রাখা উচিত। আসুন প্রথমেই প্রবন্ধটির মূল অংশে চলে যাই।

অগ্নিকান্ড

অগ্নিকানান্ড ঘটলে কি করণীয়, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিকান্ডের প্রতিকারের ব্যাবস্থা সমুহ জানা। অগ্নিকান্ডের ঘটনা প্রতিকারের পদক্ষেপ গুলো খেয়াল করুন:

  • প্রত্যেক বাসা ও স্থাপনা গুলোয় এমন তিনটা পথ রাখা প্রয়োজন যা দ্রুত দুর্ঘটনাস্থল থেকে বের হওয়ার জন্য ব্যাবহার করতে পারবেন। বলাই বাহুল্য বেশিরভাগ বিল্ডিং গুলোতে শুধু একটাই নির্গমন পথ থাকে। কোন দূর্ঘটনায় যদি সেই প্রবেশ পথ বন্ধ হয়ে যায়, পুরো ভবনই মৃত্যুপুরীতে রূপ নেবে। 

  • যা করতে পারেন তা হলো বারান্দার রেলিং এ একজন মানুষ বের হতে পারে এমন একটা গেট বানিয়ে রাখা। উঁচু ভবন হলে দড়ি দিয়ে বানানো সিঁড়ি রাখতে পারেন। সিঁড়ি না থাকলেও, দমকল বাহিনী সেখান থেকে আপনাকে উদ্ধার করতে পারবে। মূলত পরিবারের সাথে আগে থেকেই পালানোর অন্তত একটা বিকল্প পথ ভেবে রাখবেন। এক ঘর হতে অন্য ঘরে যেন দরজা ছাড়াও জানালা দিয়ে যাওয়া যায় তেমন ব্যাবস্থা বাড়ি বানানোর সময় নিশ্চিত করবেন। 

উন্নত বিশ্বের  বেডরুমের জানালা এমন ভাবে তৈরি করা হয়, যেন পূর্ণবয়স্ক থেকে শিশুরাও প্রয়োজনের সময় জানালা দিয়ে বের হয়ে আসতে পারে। বিকল্প পথে বাসা থেকে বের হতে দুই-তিন মিনিটের বেশি সময় লাগা উচিৎ না।

  • প্রত্যেকটি বাসায়ই অন্তত একটা করে ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখা জরুরী। হঠাৎ আগুন লেগে গেলে যা ব্যাবহার করে তৎক্ষনাৎ আগুন নিভিয়ে ফেলা যায়। জীবন ও সম্পদের মূল্যের কাছে ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মূল্য যৎসামান্য।

  • শহরের ভবনগুলোতে বেশিরভাগ আগুনের সূত্রপাত ঘটে বৈদ্রুতিক ত্রুটির কারণে। তাই উন্নতমানের বৈদ্রুতিক সরঞ্জাম ব্যাবহার করা নিশ্চিত করবেন।

  • কোন দুর্ঘটনার সূত্রপাত হলে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন তৎক্ষনাত বন্ধ করে দেওয়ার উপায়টি জানতে হবে। এই সামান্য কাজটিই একটি ছোট দূর্ঘটনাকে ভয়াবহ দূর্ঘটনায় রূপ নেওয়া থেকে আটকাতে পারে।

  • ঘরের স্মোক এলার্ম হতে পারে আগুন থেকে বাঁচার সবচেয়ে কার্যকর একটি উপায়। এলার্ম ধোয়া সেন্স করে আপনার ঘুমানোর সময়ও আগুন লাগার জানান দেবে। এটি ব্যবহারে সম্ভাব্য আগুন লাগার পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করে বড় বিপদ এড়িয়ে যাওয়া যায়। স্মোক এলার্ম প্রতিমাসে চেক করা ও বছরে দুইবার ব্যাটারি পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • ঘরের একটি নিরাপদ জায়গায় ফাস্ট এইড, গ্যাস মাস্ক, শুকনো খাবার, টর্চ লাইট, গজ কাপড় সংকটকালে দরকার হতে পারে এমন জিনিস রেখে দেবেন। কোন কারণে বাসা থেকে বের হওয়ার সুযোগ না থাকলে এই জিনিসগুলো আপনার প্রাণ বাঁচাতে পারে।

আগুন লেগে গেলে করণীয়

ধরুন এমন আগুন লেগে গেছে যা আপনার পক্ষে নিয়ন্ত্রণযোগ্য না। বাথরুমে গিয়ে পানির বালতি নিয়ে আসা ভুলে যান। আগুন বেড়ে গেলে ফায়ার এক্সটিংগুইশারেও কাজ হয় না। আপনার কাছে এক্সটিংগুইশার থাকলে ও আগুন তখনো দ্রুত ছড়িয়ে না গিয়ে থাকলে নিরাপদ দূরত্বে থেকে নেভানোর চেষ্টা করুন। যদি নিয়ন্ত্রনে না আসে বৃথা চেষ্টা করবেন না। এমন অবস্থায় নিন্মক্ত পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করুন।

  • আগুন যেখানে লেগেছে সেই স্থানের গেট আটকে দিন। শান্ত থাকুন।

  • ফায়ার সার্ভিসকে কল দিয়ে আপনার লোকেশন জানান।

  • সম্ভব হলে খুব দ্রুত ভবনটি পরিত্যাগ করুন। আর গমন কালে প্রতিবেশিদের নিরাপদ স্থানে যাবার তাগাদা দিন। মূল রাস্তা বন্ধ থাকলে বিকল্প রাস্তা দিয়ে যান। বিকল্প রাস্তা আবার ঝুঁকি পূর্ণ না হয় তা খেয়াল রাখবেন। দুই তলা হলে বারান্দা থেকে ঝুলে লাফ দিতে পারবেন। তিন তলা হলে দড়ির সিঁড়ি ছাড়া চেষ্টা করার দরকার নেই। আপাতত ধরে নেই আপনার নির্গমনের সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে।

  • আপনার আর আগুনের ভেতর সবগুলো গেট আটকে দিন। একটি গেটও বেশ অনেক খানি গুরুত্বপূর্ণ সময় বাঁচাতে পারে।

  • একটা রঙিন কাপড় বা টর্চ লাইট দিয়ে জানালা থেকে ফায়ার সার্ভিসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। এতে তারা আপনার অবস্থান জেনে উদ্ধারের ব্যাবস্থা করতে পারবেন।

  • ফায়ার এক্সটিংগুিশার হাতের কাছে রাখুন। সম্ভব হলে ভারী জামা কাপর পড়ে পানি দিয়ে ভিজিয়ে নিন। 

  • এমন পরিস্থিতিতে আগুনের চেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে ধোয়া। আগ্নি দূর্ঘটনায় বেশিরভাগ মানুষ আগুনের আগে ধোয়ার কারণে অক্সিজেনের অভাবে চেতনা শুন্য হয়ে মারা যান। অনেক ক্ষেত্রে আগুনকে দরজা বন্ধ করে আটকানো গেলেও ধোয়া আটকানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে বাইরের দিকের জানালা খুলে দিন। সেই সাথে কাপড় ভিজিয়ে দরজার ফাঁকা ও ভেন্টিলেটর গুলো ঢেকে দিন। 

  • অনেক সময় আগুন আপনার পর্যন্ত পৌঁছাবে না। কিন্তু ধোয়ার কারণে একটি নির্গমন পথ সম্পুর্ণ আটকে থাকতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে একটি কাজ চালানোর মত রেস্পিরেটর তৈরি করা আপনার জীবন বাঁচাতে পারে। রেস্পিরেটর তৈরি করতে একটি বোতল কেটে আপনার মুখের সাইজ করে নিন। বোতলের মুখের দিকটায় বাসন ধোয়ার স্পঞ্জ ভিজিয়ে গুজে দিন। এমন ব্যাবস্থা করুন যেন ওর ভেতর দিয়ে শ্বাস নিলে বাতাস যেন শুধু স্পঞ্জ এর ভেতর দিয়েই আসে। এই রেস্পিরেটর আপনাকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সময় বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। যদি এটা সম্ভব না হয়, কাপড় ভিজিয়ে মুখে বেধে রাখুন। যদিও এটি তেমন কার্যকর না, তবু ধোয়ার ভেতরে বাড়তি দু মিনিট সচেতন থাকতে সাহায্য করবে। এমন পরিস্থিতিতে প্রত্যকটা সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ।

  • ছাদে যাওয়া থেকে বিরত থাকুন। ছাদ থেকে উদ্ধার কাজ অত্যন্ত কঠিন এবং সব ধোয়া সবসময় উপরের দিকেই উঠবে। অর্থাৎ এমন পরিস্থিতিতে ছাদে ওঠা এড়িয়ে চলাই ভালো।

ভূমিকম্প হলে কি করবেন?

বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বাংলাদেশের মত একটি ঘনবসতি অঞ্চলে একটি বিধ্বংসী ভূমিকম্প হলে, কি অবস্থা দাঁড়াবে কল্পনাও করা কঠিন। আসুন জেনে নেই ভূমিকম্প হলে কি করবেন।

  • যেখানে যে অবস্থায় আছেন, সেখানেই হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়েন। এবার আস্তে আস্তে মোটা পিলার বা শক্ত টেবিল জাতীয় জায়গায় অবস্থান করুন।

  • ভূমিকম্পের সাথে সাথে দৌড়ে সিঁড়ি ব্যাবহার করবেন না। লিফট ব্যাবহারও এড়িয়ে চলুন।

  • বিছানায় থাকলে উল্টে হামাগুড়ি দিয়ে মাথার উপর বালিশ রেখে অপেক্ষা করুন।

  • স্টেডিয়াম, শপিং মল ইত্যাদি স্থানে থাকলে জনতার সাথে দৌড়ে বের হওয়ার চেষ্টা করবেন না। ভিড় ও চাপাচাপিতে বের হতে গিয়ে অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। ব্যস্ত না হয়ে মাথায় হাত দিয়ে নিচু হয়ে বসে পড়ুন।

  • কনক্রিটের নিচে আটকা পড়লে চিৎকার করে দৃষ্টি আকর্ষন করবেন না, এতে শক্তি ক্ষয় হবে। বরং কিছু দিয়ে রডে বাড়ি মেরে শব্দ করার চেষ্টা করুন।

  • যদি সম্ভব হয়, নিরাপদ স্থানে অবস্থান করার আগে বিদ্যুত ও গ্যাসের লাইন বন্ধ করে ফেলুন।

  • কাচের জানালা ও ভারী আসবাবপত্র থেকে দূরে থাকুন।

  • ঝাঁকুনি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত ভেতরেই অবস্থান করুন। ভূমিকম্পের ধাক্কা থামার পর হুড়োহুড়ি না করে ভবন ত্যাগ করুন। 

  • গাড়িতে থাকলে নিরাপদ স্থানে পার্ক করে, গাড়িতে অবস্থান করুন। বাইরে থাকলে খোলা জায়গায় যান।

পরিশেষ

অগ্নিকান্ড, ভূমিকম্প সহ অন্যান্য দূর্যোগে মাথা ঠান্ডা রেখে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া রক্ষা করতে পারে আপনার ও আপনার পরিবারের জীবন। দূর্যোগের আগেই তা মোকাবেলার প্রস্তুতি রাখা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সর্বপরি আপনার ও আপনার পরিবারের নিরাপদ জীবন কামনা করে শেষ করছি।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles