হোমিওপ্যাথি কি আদৌতে কার্যকর নাকি পুরোটাই মনের সান্ত্বনা?

হোমিওপ্যাথি কি পার্শপ্রতিকৃয়া বিহীন প্রাকৃতিক চিকিৎসা ব্যবস্থ্যা? নাকি পুরোটাই ভাওতাবাজি! তাই যদি হবে, এত কাল ধরে এই চিকিৎসা পদ্ধতি কিভাবে টিকে আছে? এর উত্তর মিলতে পারে প্লাসিবো ইফেক্ট থেকে। আসুন জেনে নেই বিস্তারিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু সৈন্য গুরুতর আঘাত পেয়ে সৈন্যদের হাসপাতালে ভর্তি হতেন। সেনাক্যাম্পের দ্বায়িত্বরত ডাক্তার হেনরী বিচার সেই সময় একটি আশ্চর্যজনক বিষয় খেয়াল করেন। 

ঘটনাটা ছিলো এমন, একদিন যুদ্ধে হতাহত অনেকজন সেনাকে হাসপাতালে আনা হলো। কারো হাত ভেঙে গেছে, কারো কাঁধে গুলি লেগেছে, কারো পা জখম ইত্যাদি। 

স্বাভাবিক ভাবেই যুদ্ধের ভেতর যথেষ্ট ব্যাথানাশক ঔষুধের ঘাঢতি ছিলো। সে পরিস্থিতিতে ডাক্তারেরা পড়ে যান মহা বিপদে, একদিকে আহত সৈন্যদের আহাজারি, অন্যদিকে ঔষধের স্বল্পতা। সে সময় এক নার্স সৈন্যদের শান্তনা দেবার জন্য লবন পানি সিরিঞ্জে ভরে সবাইতে ইনজেকশন দিয়ে দিলেন। 

আশ্চর্যজনক ভাবে সকল আহত সৈন্যের ব্যাথা অনেকখানি কমে আসলো। পুরো যুদ্ধেই হেনরী বিচার এই চিকিৎসা প্রদান করলেন। পরবর্তিতে যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে বিস্তর গবেষণার পর ফলাফল দাঁড়ালো, কাউকে কোন রোগের ঔষধ বলে শুধু চিনির ট্যাবলেট খাওয়ালেও সে ঔষধ কাজ করে ও রোগের উপসর্গ কমিয়ে আনতে সাহায্য করে। মূলত এটিকেই প্লাসিবো ইফেক্ট বা সুগার ক্যাপসুল ইফেক্ট বলা হয়। 

প্লাসিবো ইফেক্ট অদ্ভুৎ হলেও এটি আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা সম্পুর্ণ প্রমাণিত। শুধু মানসিক নয়, প্লাসিবো ইফেক্ট শরীরের জৈবরাসায়নিক পরিবর্তন ঘটিয়ে রোগের উপসম ঘটাতে সাহায্য করে। তবে অবশ্যই এটি সব রোগের জন্য কার্যকর নয়। এটি ব্যাথা, দুর্বলতা, সহ রোগের উপসর্গগুলো কমিয়ে ফেলতে পারে।

প্লাসিবো ইফেক্টের একটু পরিচিতি পাওয়া গেল। কিন্তু এর সাথে হোমিওপ্যাথির কি সম্পর্ক? তার আগে চলুন জেনে আসা যাক হোমিওপ্যাথি কি ও এর কার্যপদ্ধতি।

হোমিওপ্যাথির ইতিবৃত্তান্ত

হোমিওপ্যাথি বহু বছর ধরে চলে আসা একটি প্রাচীন ও বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি। বিশ্বের হিসাবে এটিকে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি বলা হচ্ছে, কিন্তু আসলে আমাদের দেশ সহ বহু অনুন্নত জায়গায় হোমিওপ্যাথিই বেশিরভাগ রোগের জন্য প্রথম পছন্দ। স্পষ্টতই, বিভিন্ন রোগে রোগীরা উপকার পান বিধায়ই হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আগ্রহী হন। এর পক্ষে বিপক্ষে কিছু বলার আগে আমাদের এর ভেতরকার তথ্য গুলো জানা প্রয়োজন। পরবর্তি কয়েকটা পয়েন্টে এর মূল বিষয়গুলো উপস্থাপন করছি।

হোমিওপ্যাথির ভিত্তি

হোমিপ্যাথির ভিত্তি হলো, পানি তার ভেতর সকল স্মৃতি ধরে রাখতে পারে। স্মৃতি ধরে রাখা বলতে, কোন স্থানের পানিতে কি মেশানো হয়েছিলো তার স্মৃতি সেই পানির মধ্যে সবসময় থেকে যায়, তাতে যত বেশি পানি মেশানো হোক না কেন! ব্যাপারটা অস্পষ্ট লাগতে পারে। পরবর্তি পয়েন্টে আশা করছি বুঝতে পারবেন।

হোমিওপ্যাথির অন্য একটি নীতি হলো, বিষে বিষক্ষয়। অর্থাৎ আপনাকে মৌমাছি কামড়ালে, মৌমাছির বিষেই সেই ব্যাথার ঔষধ পাওয়া যাবে।

হোমিওপ্যাথির ঔষধ যেভাবে বানানো হয় 

হোমিওপ্যাথির বই যারা লেখেছেন, তারা বিভিন্ন রোগের জন্য বিভিন্ন ভেসজ ও প্রস্তুত প্রণালির কথা বলে গেছেন। ধরা যাক কোন একটা ভেসজ গাছের পাতা জ্বরের ঔষধ তৈরিতে কাজে লাগে। সেই পাতার রস সংগ্রহ করে প্রথমে একফোটা একটি পানির পাত্রে নেওয়া হয়। তারপর সেই পাত্র থেকে একফোটা অন্য আরেকটি পানির পাত্রে নেওয়া হয়। এতে করে মূল যে (কথিত) ঔষধ উপাদান থাকে তার ঘনত্ব হালকা হতে থাকে। এভাবে বহুবার এ প্রক্রিয়া চালিয়ে গেলে যা দাঁড়ায়, তা মহাসমুদ্রে একফোটা তরল ফেলার মত। অর্থাৎ ওই দ্রবণে ঔষধের কোন অস্তিত্বই আর থাকে না। কিন্তু হোমিওপ্যাথিকদের দাবি, পানি ঔষধের কার্যকরণ মনে রেখেছে, ও এটি রোগ সারাতে সাহায্য করবে। পরবর্তিতে ওই পানি টুকু দিয়ে সিরাপ বা চিনির ট্যাবলেট বানিয়ে রোগীকে খাওয়ানো হয়।

আমাদের সাধারণ জ্ঞান দিয়েই হোমিওপ্যাথির মূল বিষয়গুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। অন্যদিককে আধুনিক বিজ্ঞান বলছে হোমিওপ্যাথির কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। কোন প্রমাণ ও যুক্তি দিয়ে এই চিকিৎসাপদ্ধতির কোন কিছুই ব্যাখ্যা করা যায়না। তবে…

হোমিওপ্যাথি কিভাবে কাজ করে?

শুরুতে যে প্লাসিবো ইফেক্টের কথা বলছিলাম, সেই প্লাসিবো ইফেক্ট-ই হোমিওপ্যাথির মূল পুঁজি বলা চলে। তবে তার সাথে মানবদেহের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কয়েকটা পয়েন্টে হোমিওপ্যাথির কার্যপদ্ধতি তুলে ধরা যাক।

প্লাসিবো ইফেক্ট

যখন কোন রোগের জন্য আমরা ঔষধ গ্রহণ করি, আমাদের দেহ শারিরীক মানুষিক ভাবে আমাদের দেহ সেই ঔষধের প্রতিক্রিয়ার জন্য তৈরি হয়ে যায়। সে ঔষধে যদি কোন ঔষধি গুনাগুন নাও থাকে, আমাদের মন ও শরীর উপসর্গ কমে আসছে উপলব্ধি করে। যেটা রোগ সারিয়ে তোলার কাজ না করলেও, অসুখের কষ্টের উপসম প্রদান করে। 

হোমিওপ্যাথি ঔষধেও একই বিষয়টি কাজ করে। ঔষধ গ্রহণ করার পর রোগী আশা করে থাকেন, এবার তার অসুখের উপসম হবে, সেখানে কোন ঔষুধি গুনাগুন না থাকার পরও। একটু মনস্তাত্বিক দিক থেকে ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা যাক।

ব্যাথা, জ্বর ও অন্যান্য উপসর্গ শরীর এর স্বাভাবিক নিরাপত্তা ব্যাবস্থা। শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করলে জ্বর এনে শরীর বোঝাতে চায় তোমার এখন শরীরের যত্ন নেওয়া উচিত। কেটে গেলে ব্যাথা লাগে যেন আমরা কাটা জায়গার যত্ন নেই, ও সাবধানে থাকি। অতঃপর শরীর যখণ টের পায় যে সমস্যা হচ্ছিলো তার প্রতিকারে ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছে, তখন সে তার উপসর্গ কমিয়ে ফেলে। ব্যথা যেখানে লাগে, ব্যাথার উৎপত্তি সেখানে নয়, আমাদের মস্তিষ্কে। আশাকরি হোমিওপ্যাথি ও প্লাসিবো ইফেক্টের সম্পর্ক বুঝতে পেরেছেন।

শরীরে স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা

আমাদের শরীর অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যে কোন সাধারণ রোগ থেকে নিরাময় হতে পারে, এবং তাও কোন প্রকার ঔষধের সাহায্য ছাড়া, যদিও প্রক্রিয়াটি একটু ধীর। জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, ফোঁড়া, চর্মরোগ এধরণের যত সাধারণ রোগ আছে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সময়ের সাথে নিজে নিজে সারিয়ে তোলে, বেশিরভাগ ঔষধই উপসর্গ কমাতে ও শরীরের সারিয়ে তোলার প্রকৃয়াকে দ্রুত করে থাকে। 

এই কথাটি বেশ প্রচলিত যে, হোমিওপ্যাথি ধীরে কাজ করে। কিন্তু মূলত শরীর ধীরে ধীরে নিজেকেই সুস্থ্য করে তোলে। সেই সাথে প্লাসিবো ইফেক্টের কারণে উপসর্গও কিছুটা কম থাকে। এই দুটি মূল বিষয়কে পুঁজি করে শত শত বছর ধরে এলকোহলে ডুবানো চিনির গুটি ঔষধ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। এমনকি আজকের দিনেও সারা পৃথিবীতে বাৎসরিক হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ও চিকিৎসার ব্যায় প্রায় ২১ বিলয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। 

সাধারণ মানুষ কেন হোমিওপ্যাথির দিকে ঝোঁকেন?

হোমিওপ্যাথির পেছনে ঝোঁকার বেশ অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থ-সামাজিক কারণগুলো বেশি বড় ভূমিকা রাখে। অধিকাংশ নিন্মবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষেরও ধারণা এই যে, সাধারণ ডাক্তার দেখালে একগাদা টেস্ট ধরিয়ে দেবেন, একগাদা ঔষধ, ভিজিট সহ অন্যান্য খরচ দিয়ে বিরাট আর্থিক টানাপোড়া শুরু হয়ে যাবে। তারচেয়ে হোমিওপ্যাথি সস্তা ও নিঃঞ্ঝাট চিকিৎসা, একটু সময় না হয় লাগলো।

অনেক ক্ষেত্রে রোগীর অর্থনৈতিক অবস্থার বাইরেও কুসংষ্কারের কারণে অনেকে হোমিওপ্যাথি গ্রহণ করেন। এমন শোনা যায় কিছু রোগ হোমিওপ্যাথিতে খুব সহজে সেরে ওঠে। যৌন, চর্ম ও অন্যান্য গোপন রোগের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা গ্রহণের হার অনেকাংশে বেশি।

বাংলাদেশের সাধারণ চিকিৎসা ব্যাবস্থার দুর্নীতি ও দুর্ভোগের কারণেও অনেক মানুষ প্রচলিত চিকিৎসা গ্রহণ করতে চান না। তবে হোমিপ্যাথিও সম্পুর্ণ ভ্যাজাল মুক্ত নয়। অনেক সময় এলোপ্যাথির অনেক ঔষধ হোমিওপ্যাথির ঔষধ হিসেবে প্রেসক্রাইব করা হয়। তবে এটিকে ভ্যাজাল বলা যায় কিনা, সে নিয়ে দ্বীমত থাকতে পারে।

আমাদের দেশে এখনো বিভিন্ন হোমিওপ্যাথিক কলেজ ও হাসপাতাল বিদ্যমান। শিক্ষার্থিরা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সেসব জায়গায় ভর্তি হয়ে হোমিওপ্যাথির উপর উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করছেন(!)

হোমিওপ্যাথি কি ক্ষতিকর?

তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না' সিনেমাটায় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার একটা করুণ দিক উঠে আসে। এক হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার তার সন্তানের জ্বর এলে নিজের তৈরি হোমিওপ্যাথিক ঔষধ খাওয়ান। তিনি বাচ্চার চাচার এনে দেওয়া এলোপ্যাথিক ঔষধ ফেলে দেন। মূলত তিনি তার সন্তানের জীবন বাজি রেখে তার বদ্ধমূল হোমিও চিকিৎসার অহঙ্কার ছাড়তে পারেন না। শেষমেশ বাচ্চাটি মারা যায়। 

হোমিওপ্যাথির একমাত্র ভালো দিক বোধয় এর কোন সরাসরি ক্ষতিকর দিক নেই, এবং কোন পার্শ প্রতিক্রিয়াও নেই (কার্যকারীতাও নেই)। অবশ্য সে ঔষধ যদি আসল হয়ে থাকে তবে। 

তবে আরেটু গভীর ভাবে চিন্তা করলে হোমিওপ্যাথি আসলে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। বড় সড় রোগের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার উপর নির্ভর করা নিছক বোকামী ছাড়া কিছু না। যে কোন রোগ নির্ণয়ের জন্য মেডিক্যাল টেস্টের কোন বিকল্প নেই।

শেষকথা

পৃথিবীতে আমাদের স্বাস্থ্যই আমাদের সবচেয়ে বড় সম্পদ অথচ অনেক ক্ষেত্রে কোন যাচাই বাছাই ছাড়াই আমরা নিজেদের স্বাস্থ্যকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেই। যে কোন অসুখ হলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানোর মাধ্যমেই আপনি নির্দিষ্ট ভাবে জানতে পারবেন আপনার শরীরিক সমস্যা ও তার সঠিক চিকিৎসা। যোকোন প্রকার অবৈজ্ঞানিক ঔষধ এড়িয়ে চলুন, তা সে ফুটপাতে বিক্রি করা ব্যাথার মলম হোক কিংবা হোমিওপ্যাথি।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles