এই তীব্র গরমে স্বাস্থ্য সমস্যা এড়াতে যে ৮টি কাজ করবেন

সাম্প্রতিক সময়ে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তীব্র গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা ও দেশের অন্যান্য এলাকা। এই প্রচণ্ড গরমে সুস্থ থাকাটা বেশ কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আজ তাহলে গরমে সুস্থ থাকার কয়েকটি টিপস জেনে নেয়া যাক।

তীব্র গরমে আমাদের প্রত্যেকেরই জীবন ধারণ কঠিন হয়ে উঠেছে। গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দুই এক পশলা বৃষ্টি হলেও তাতে গরমের তীব্রতা কমেনি। এই অস্বস্তিকর পরিবেশকে অসহনীয় করে তুলতে পারে বিভিন্ন রকমের স্বাস্থ্য সমস্যা। তাই এই গরমের মধ্যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেন না হয় সেজন্য আমাদের সবার সতর্ক থাকা উচিত এবং স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা উচিত।

 

১. পর্যাপ্ত পানি পান করুন

গরমে আপনার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হলো পানি। তীব্র গরমে শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে পানি বের হয়ে যায়। এর পাশাপাশি আবহাওয়া থাকে শুষ্ক। সব মিলিয়ে শরীরে প্রয়োজনীয় পানির অভাব দেখা দেয় যাকে আমরা Dehydration বা পানিশূন্যতা বলে থাকি। 

ডিহাইড্রেশনের সমস্যা দূর করতে দিনে পর্যাপ্ত পানি পান করুন। পানির পাশাপাশি লেবুর শরবত, ডাবের পানি, তাল শাঁস, তরমুজ জাতীয় ফল খেতে পারেন। এসব ফল খেলে শরীরের আর্দ্রতা বজায় থাকে এবং এর মাধ্যমে পানিশূন্যতার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

যাদের অতিরিক্ত ঘাম হয়, তাদের ক্ষেত্রে শরীরে ইলেক্ট্রলাইটস বা আয়রনের অভাব হতে পারে। এজন্য মাঝেমধ্যে স্যালাইন বা গ্লুকোজ জাতীয় ড্রিংকস খেতে পারেন।

প্রচন্ড গরমে পানিশূন্যতার দরুণ প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হয়ে যেতে পারে। এজন্য প্রস্রাবের রঙের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

 

 

২. বাইরের খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হোন

গরমে বদহজম বা পেট খারাপ হওয়া খুবই কমন একটি সমস্যা। বাইরের ভাজাপোড়া তেল মসলাযুক্ত খাবার এই সময় না খাওয়াই ভালো। যাদের নিয়মিত অনেকটা সময় বাইরে থাকতে হয় তারা বাসা থেকে লাঞ্চ বক্স নিয়ে যাবার চেষ্টা করুন। নিতান্তই যদি বাইরে খেতে হয় তবে স্বাস্থ্যকর কোনো জায়গা থেকে খাবার কিনে খেতে হবে। কোনো অবস্থাতেই স্ট্রিট ফুড জাতীয় অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া যাবে না।

বাড়িতেও ছোট মাছ, সবজি, ডাল জাতীয় খাবার রান্না করতে পারেন। পোলাউ রোস্ট জাতীয় গুরুপাক খাবার এই সময়ে না খাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এসময় প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় সবজি ও তাজা ফল রাখতে হবে। চর্বি বা স্নেহজাতীয় খাবারের পরিমাণ কমিয়ে আমিষ জাতীয় খাবার বেশি করে খেতে হবে। কোনো খাবার কাঁচা বা আধা সিদ্ধ খাওয়া যাবে না।

 

৩. চা-কফি এড়িয়ে চলুন

আমাদের অনেকেরই দিন শুরু হয় এক কাপ আগুন গরম চা দিয়ে। শহর এলাকায় চায়ের পরিবর্তে অনেকে কফি দিয়ে নাস্তা সারেন। গরমের দিনে এই অভ্যাসে খানিকটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন। চা, কফি, কোমল পানীয়, বিভিন্ন এনার্জি ড্রিংকস, চকোলেট, চকোলেটের ফ্লেভার যুক্ত অন্যান্য খাবার - এতে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন থাকে। যা কিছুটা হলেও শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে। এছাড়াও কিছু কিছু গবেষণায় ক্যাফেইনকে শরীর ডিহাইড্রেট করে এমন উপাদান হিসেবে বলা হয়েছে। যদিও এই গবেষণার ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ, তবুও গরম কালে চা বা কফির পরিমাণ কম রাখাই উচিত।

 

৪. এসির ব্যাপারে সতর্ক থাকুন

গরম এলেই এসি কেনার ধুম পড়ে যায়। এই সুযোগে এসির দামও বেশ কিছুটা বেড়ে যায়। তবে এসি ব্যবহারের নিয়ম কানুন জানা না থাকলে এ থেকেও স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি হতে পারে।

বাইরে থেকে গরমে তেতেপুড়ে এসেই এসি চালিয়ে বসা যাবে না। প্রথমে ফ্যানের বাতাসে কিছুটা ঠান্ডা হয়ে নিন, এরপর শরীরের ঘাম একটা পাতলা কাপড় দিয়ে মুছে নিয়ে তবেই এসি চালানো উচিত। প্রচন্ড ঘর্মাক্ত অবস্থায় এসির বাতাসে বরং ঠান্ডা বসে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকে।

শুধু এসি কিনে ফেলাই কোনো সমাধান নয়। কোন ধরনের রুমে কোন ধরনের এসি বসানো উচিত এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা নিয়ে তবেই এসি কিনুন। এসির বাতাস ঘরকে শুষ্ক করে ফেলে। এসি কেনার পাশাপাশি রুমের আর্দ্রতা বজায় রাখার জন্য একটি Humidifier কিনে ফেলতে পারেন। নয়ত ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, ঠোঁট ফেটে যাওয়ার মত উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

 

 

৫. বাইরে যাবার প্রয়োজনীয় উপকরণ

সকাল ১০ টা থেকে দুপুর ৩ টা পর্যন্ত সময়টাতে গরম সবচেয়ে বেশি থাকে। চেষ্টা করবেন এই সময়ে যেন বাইরে বের হতে না হয়। আপনি কর্মজীবী বা স্কুল কলেজ গামী শিক্ষার্থী হলে এর আগেই যেন কর্মক্ষেত্রে পৌছে যান সেই চেষ্টা করতে হবে।

অবশ্যই রোদে যাবার আগে সানস্ক্রিন লাগিয়ে নিন। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি বিভিন্ন চর্মরোগ এমনকি স্কিন ক্যান্সার পর্যন্ত তৈরি করতে পারে। তাই বাসা থেকে বের হবার আগে ব্যাগে পানি, রোদচশমা, ছাতা অবশ্যই নিতে হবে।

এই সময়ে অতিরিক্ত পরিশ্রম করা থেকে বিরত থাকুন এবং সম্ভব হলে ভিড় আছে এমন জায়গা এড়িয়ে চলুন। সাথে করে গলায় ঝুলিয়ে রাখার ছোট ফ্যান বা ব্যাগে বহনযোগ্য ছোট একটা হাত পাখা নিয়ে নিতে পারেন। যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, তারা কিছু সময় পরপর ৫ মিনিটের ব্রেক নিয়ে নিন।

 

 ৬. সাদা রঙের পোশাক পরিধান করুন

ঘরে বাইরে পোশাক নির্বাচনের জন্য সাদা বা এজাতীয় হালকা রঙ বেছে নিন। কালোসহ অন্যান্য রঙিন কাপড়ের তাপ শোষণ ক্ষমতা বেশি। যে কাপড় যত বেশি তাপ শোষণ করে, সে কাপড় তত বেশি উত্তপ্ত হয়। ফলে সে কাপড় পরলে তত বেশি গরম অনুভূত হয়৷ গরমের দিনে সাদা কাপড় এত উপর আপতিত সূর্য রশ্মির প্রায় সবটাই প্রতিফলিত করে। ফলে খুবই অল্প পরিমাণ তাপ শোষিত হয়। তাই সাদা বা হাল্কা রঙের কাপড় পড়লে গরম কম লাগে।

গরমের দিনে অন্যান্য জর্জেট বা অন্য কোনো সিনথেটিক কাপড়ের পরিবর্তে হালকা সুতি কাপড়ের জামা ব্যবহার করুন। বাইরে বের হতে হলে ঢিলাঢালা সুতির জামা যাতে বাতাস চলাচল করে এমন পোশাক বেছে নিন।

 

৭. হতে পারে চর্মরোগ

এই গরমে স্কিন ডিজিজ অর্থাৎ বিভিন্ন রকম চর্মরোগ এর প্রকোপ দেখা যায়। বিশেষ করে যাদের ঘাম বেশি হয় তাদের ক্ষেত্রে প্রথমে ঘামাচি হয়। এরপর চুলকানি এবং তা থেকে পরে ছত্রাক সংক্রমণ হতে পারে। আবার যারা নোংরা অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকেন বা অল্প জায়গায় অনেক লোক গাদাগাদি করে থাকেন তাদের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন রকম চর্মরোগ দেখা দেয়।

ঘামে ভেজা জামা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বদলে ফেলা উচিত। যাদের বেশি ঘাম হয়, তারা বাইরে যাবার সময় পানি, রোদচশমা এসব জিনিসের পাশাপাশি এক সেট অতিরিক্ত পোশাক সঙ্গে রাখতে পারেন। গরম আর্দ্র আবহাওয়ায় যেকোনো সংক্রমণ দ্রুত ছড়ায়। এজন্য ঘামে ভেজা পোশাক যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বদলে ফেলা উচিত।

 

 

৮. হিট স্ট্রোকে সতর্ক থাকুন

গরমে যে সমস্যার কথা সবচেয়ে বেশি শোনা যায় তা হল হিট স্ট্রোক। প্রচণ্ড গরমে শরীরের তাপ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে গেলে তাকে হিট স্ট্রোক বলে। হিট স্ট্রোকের কিছু লক্ষণ রয়েছে। যেমন- 

  • ঘাম না হওয়া,

  • মাথা ব্যথা, 

  • ঘাড় ব্যথা, 

  • মাথা ঘুরানো, 

  • বমি বমি ভাব, 

  • অসংলগ্ন কথাবার্তা, 

  • খিচুনি, 

  • হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।

হিটস্ট্রোক এড়াতে যথাসম্ভব ঘরের ভেতরে বা ছায়াযুক্ত স্থানে থাকুন। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করুন। একটু পর পর গামছা বা তোয়ালে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে তা দিয়ে মাথা ঘাড় হাত পা মুছে নিন।

আপনার আশেপাশে কারো হিট স্ট্রোক হয়ে গেলে বা এর লক্ষণ প্রকাশ পেলে যত দ্রুত সম্ভব শরীরের তাপমাত্রা কমানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। হিট স্ট্রোক আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিয়ে কোনো ঠান্ডা জায়গা যেখানে ফ্যান বা এসি আছে এমন জায়গায় শুইয়ে দিতে হবে। রোগীর ঘাড়ে বগলে কুচকিতে আইস ব্যাগ চেপে ধরতে হবে। এতেও যদি অবস্থার উন্নতি না হয় তাহলে যত দ্রুত সম্ভব রোগীকে নিকটস্থ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে নিয়ে যান।

 

আরও পড়ুন:

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles