কীভাবে ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তি পাবো! শেষ পর্ব।

ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে সচেতনতা মূলক ধারাবাহিক লেখার এটি ৩য় ও শেষ পর্ব। ইন্টারনেট আসক্তির প্রভাব, ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় এবং সেক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব।

“ আমি আশঙ্কা করছি যেদিন প্রযুক্তি আমাদের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়াকে অধিগ্রহণ করে নিবে। এবং পৃথিবীতে থাকবে শুধু নির্বোধ প্রজন্ম ” --- আলবার্ট আইনস্টাইন। 

 

ইন্টারনেট আসক্তির প্রভাব

ইন্টারনেট আসক্তির প্রভাব বর্ণনা করা শেষ করা দুঃসাধ্য কাজ। কারণ আধুনিক সমস্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ সমস্যা হলো ইন্টারনেট দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যহত করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত, নৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। আজকাল প্রত্যেক শ্রেণীপেশার মানুষদের সাধারণ কর্মসূচির বাইরে নিষ্প্রয়োজনে দৈনিক কমপক্ষে দুই থেকে তিন ঘন্টা সময়কে দখল করে নিচ্ছে ইন্টারনেট। 

ছোট কোমলমতি শিশুরা যখন বাবা-মায়ের সংস্পর্শে থেকে ভালবাসার মধ্য দিয়ে সাধারণ ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করবে এবং খুব সুন্দর পারিবারিক মেলবন্ধন সম্পর্কে জানবে, ঠিক সেই সময়ে বাবা-মা নিজেরা যেমন ব্যস্ত ব্যক্তিগত অনলাইন দুনিয়ায় অন্যদিকে শিশুরাও পড়াশোনার বাইরে হাতে তুলে নিচ্ছে মোবাইল ফোন এবং নিত্য নতুন সকল আকর্ষণীয় বিনোদনের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।  ইন্টারনেটের সহজ্যলভ্যতার কারণে স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশের অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে ইন্টারনেট আসক্তি। আবার বিভিন্ন কর্মজীবী মানুষ তাদের গুরুত্বপূর্ণ অনেক কাজ ফেলে রেখেও ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছে। 

অধিকাংশ মানুষই প্রয়োজনের তুলনায় অধিক সময় ইন্টারনেট ব্যবহার করে দৈনন্দিন কাজের রুটিন সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে পারেনা। অনলাইন ব্যধিতে আসক্ত হওয়ার ফলে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমানো ও ঘুম থেকে জাগার পাশাপাশি সঠিক সময়ে কাজ না শেষ করার মানসিক চাপ এবং নিয়মিত অনলাইনে না যেতে পারার বিষনণ্ণতা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে বহুরকম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শুধু তাই নয়, ইদানিং দেখা যাচ্ছে পরিবারের সকলের অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনের কারণে সংসারে অশান্তি শুরু হয়েছে।

নৈতিক দিক থেকেও ইন্টারনেট আসক্তি প্রকটভাবে প্রভাব ফেলছে। কেননা মানুষের মধ্যে অশ্লীলতা ও অবাঞ্ছিত পর্ণ ওয়েবসাইটের কারণে নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে। ইন্টারনেটে অপব্যবহারের কারণে যে পরিমাণে জনবল তৈরি হতো এবং দক্ষ লোকবলের দ্বারা রাষ্ট্রীয় উন্নতি সম্ভব হতো সেখানে রাষ্ট্রীয় অবনতি তরান্বিত হচ্ছে। ইন্টারনেট আসক্তিতে জড়িয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ নানা প্রকার মানসিক রোগ ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার ‍শিকার হচ্ছে। 

পারস্পরিক যোগাযোগের বিঘ্নতার ফলে ব্যক্তিগত মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে। এছাড়া আত্মসংভ্রম ও সচেতনতার হার কমে যাচ্ছে ইন্টারনেট মুখী হওয়ার ফলে।   বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, যারা ইন্টারনেটে আসক্ত তারা নানা রকম সাইবার ক্রাইমে জড়িত। বিভিন্ন সময়ে আমরা জানতে পারি কিশোর-কিশোরীদের অবৈধ সম্পর্কের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিগত জীবনকে অন্ধকারে ঠেলে দেয় এমনকি অনেকে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে।

এছাড়াও ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে সমাজে বিশৃংখলা, অরাজকতা, পাপাচার, বিনাদ্বিধায় অন্যায় প্রবণতা, যৌনাচার, বিবাহবিচ্ছেদ, যৌথ পরিবার ভেঙ্গে একক পরিবার গঠন, নারী নির্যাতন, অনলাইনের মাধ্যমে যৌন বাণিজ্য, প্রতারণা সহ অসংখ্য সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই ইন্টারনেটের নেতিবাচক প্রভাব সত্যিকার অর্থে অবর্ণণীয়।

 

ইন্টারনেট আসক্তিতে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বা ক্ষয়ক্ষতি 

ইন্টারনেট আসক্তির ফলে প্রত্যক্ষভাবে শারীরিক ক্ষতি এবং যেসব ঝুঁকি রয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো,  

হরমোন জনিত সমস্যাঃ ইন্টারনেট আসক্তির সক্রিয়তার ফলে ব্রেইনে একধরনের ‘রিওয়ার্ড সেন্টার’ বা ‘প্লেজার প্যাথওয়ে’ নামক স্থান থেকে ডোপামিন হরমোন নিঃসৃত হওয়ার পাশাপাশি ওপিয়াটেস এবং অন্যান্য নিউরোকেমিক্যাল উপাদানসমূহের নিঃসৃত হওয়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। অতিমাত্রায় আসক্তির ফলে ধীরে ধীরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর আচরণে ও মেজাজে পরিবর্তন আসে। ডোপামিন হরমোনের অতিরিক্ত নিঃসৃত হওয়ার কারণে অন্যান্য আসক্তি, যেমন ধূমপান ও মাদক গ্রহণের মতো অভ্যাস গড়ে ওঠতে পারে।

মাথা ব্যথ্যাঃ দীর্ঘ সময় ধরে ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে অতিরিক্ত মাত্রায় ডোপামিন হরমোন নিঃসৃত হয় এবং ব্রেইনের উপর চাপ পরে। এছাড়া লম্বা সময় ধরে স্ক্রিন বা মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে মাথা ব্যথা শুরু হয়।

ঘাড় ব্যথাঃ ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তিরা দৈনিক প্রায় ৫-৬ ঘন্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করে। যা স্বাভাবিকভাবে মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করে ও ঘাড়ের নড়াচড়া কম হওয়া ও একনাগাড়ে স্ক্রিনে বা মনিটরে তাকিয়ে থাকার ফলে ঘাড় ব্যথা শুরু হয়।

চোখ কর্ণিয়া সমস্যা ও চোখ শুকিয়ে যাওয়াঃ ধারাবাহিকভাবে স্ক্রিনে ও মনিটরে তাকিয়ে থাকলে চোখ দিয়ে পানি আসতে থাকে। নিয়মিত এই সমস্যা হতে থাকলে একসময় চোখের কর্ণিয়া সমস্যা ও চোখ শুকিয়ে থাকে।

চোখের দৃষ্টি শক্তি কমে যাওয়া এবং দৃষ্টি হারানোর সম্ভাবনাঃ ঘন্টার পর ঘন্টা স্ক্রিনে বা মনিটরে তাকিয়ে কাজ করতে থাকলে চোখে পলক কম পড়ে এবং চোখের বিশ্রাম কম হয়। তাই ধীরে ধীরে দৃষ্টি শক্তিতে প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘ সময় ধরে চোখের উপর প্রভাব পড়ার কারণে চিরদিনের জন্যও দৃষ্টি হারানোর সম্ভাবনা থাকে।

ইনসোমনিয়াঃ ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিদিন মধ্যরাত কিংবা সারারাত ইন্টারনেট ব্যবহারে ব্যস্ত থাকে। ফলে দীর্ঘদিনের রাত জাগার কারণে তাদের ইনসোমনিয়া রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে।

পিঠে ও কোমড়ে ব্যথাঃ ইন্টারনেটে বিনোদন লাভের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা চেয়ারে বসে থাকতে হয়। এর ফলে মেরুদন্ডের উপর খুব চাপ পড়ে এবং ধীরে ধীরে কোমড় ও পিঠে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। এমনকি নিয়মিত অভ্যাসের কারণে হাড় ক্ষয় ও মেরুদন্ডের জয়েন্ট ক্ষয় শুরু হতে পারে।

হাতে ও আঙ্গুলের জয়েন্ট এ ব্যথাঃ প্রতিদিন অনেক সময় ধরে কম্পিউটারের কী-বোর্ড ও ফোনে টাইপ করার কারণে হাতে ব্যথা ও আঙ্গুল ব্যথা হতে পারে।

শারীরিক অবসাদ ও কার্যক্ষমতা হ্রাস হওয়াঃ দীর্ঘদিনের ইন্টারনেট আসক্তির ফলে শারীরিক দুর্বলতা ও নানা রকম শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এর ফলে শারীরিক শক্তি কমে যায়, ক্লান্তি চলে আসে এবং কার্যক্ষমহীন করে তুলে।

চুল পড়া ও মাথা পাতলা হয়ে যাওয়াঃ রাত জেগে ইন্টারনেট ব্যবহার করা ও অতিমাত্রায় ইন্টারনেটে আসক্ত থাকার ফলে সিবাসিয়াস গ্লান্ড হতে অতিরিক্ত সিবাম নির্গত হয়। যার ফলে চুল পড়া শুরু হয় এবং মাথা পাতলা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

শারীরিক ওজন বৃদ্ধিঃ প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে শারীরিক চলাচল কম হয়। ফলে মেদ বাড়তে পারে ও শরীরের ওজন বৃদ্ধি পায়।

যৌন অক্ষমতা ও যৌন মিলনে অনিহাঃ ইন্টারনেটে সাইবার সেক্স বা ভার্চুয়াল সেক্স এর প্রভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের নানা রকম বদভ্যাস তৈরি হয়। এছাড়া নিয়মিত পর্ণসাইটে ভিজিট করার ফলে যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় ফলে টেস্টোসটোরেন হরমোন নিঃসৃত হয়। কেউ কেউ আবার হস্তমৈথুনের মতো বাজে অভ্যাস গড়ে তোলে ও যৌনজীবনে সমস্যায় পতিত হয়।

ক্ষুধামন্দাঃ ইন্টারনেটের নেশায় লম্বা সময় পার করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে অনেকে ঠিক সময়ে খাবার খেতে ভুলে যায় এবং কখনো কখনো না খেয়ে থাকে। ফলে খাদ্যাভাসের পরিবর্তনসহ বদহজম, আহারে অনিহা তৈরি হয়।

 

ইন্টারনেট আসক্তির দ্বারা সৃষ্ট মানসিক সমস্যা

ইন্টারনেট আসক্তি বিশ্বব্যাপী তরুণ প্রজন্মের জন্য নতুন একটি মানসিক সমস্যা। এটি তাদের স্নায়বিক জটিলতা, মনস্তাত্ত্বিক ব্যাঘাতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইন্টারনেট আসক্তির মধ্য দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা উদ্বীগ্ন ও হতাশা হচ্ছে, যার ফলে নানান মানসিক সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। মানসিক চাপ ও হতাশার ফলে সৃষ্ট জটিলতাসমূহ,

  • বিষণ্ণতা

  • নিরাশ হওয়া

  • আত্ম অনুতপ্ততা

  • অপরাধবোধ

  • নিজের প্রতি বিরক্তি ও নিজেকে অপছন্দ করা

  • অস্তিত্বের সংকট উপলোব্ধি করা

  • আত্মহত্যা করার ইচ্ছা জাগা

  • অনাগ্রহ জন্মানো

  • সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা

  • আত্মবিশ্বাসের অভাব

  • উদ্যমতা হারিয়ে ফেলা

  • বিস্বাদ বোধ

  • মনোযোগের ক্ষেত্রে সমস্যা

  • ক্লান্তি ও অবসাদ

 

ইন্টারনেট আসক্তিতে শিশুরা কতটা ঝুঁকিতে আছে?

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিশুরা ইন্টারনেট আসক্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। এই আসক্তি মূলত দুইভাবে প্রভাব ফেলতে পারে। তা হলো শিশুদের ব্যক্তিগত ইন্টারনেটে বিনোদন বা তথ্য অনুসন্ধানের অতি উৎসাহ থেকে প্রত্যক্ষভাবে আসক্ত হওয়া এবং  অপরদিকে বাবা-মায়ের আসক্তির ফলে শিশুর উপর পরোক্ষ প্রভাব। যেহেতু শিশুর বাবা-মা সর্বক্ষণ ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যস্ত থাকে, সে কারণে স্বভাবতই শিশুরা তা নজরে রাখে ও কৌতুহল মিটাতে লুকিয়ে লুকিয়ে বা বাবা-মা এর কাছে আবদার করে তা ব্যবহারের সুযোগ করে নেয়। এমন কি কোন কোন বাবা-মা নিজে থেকেই শিশুকে ইন্টারনেটের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় এবং ধীরে ধীরে তারা ব্রাউজিং করতে করতে ইন্টারনেটের নেশায় পড়ে যায়। একটা সময় তাড়া নিত্য নতুন সকল বিষয় পেয়ে সেই লোভ সামলাতে পারে না এবং আসক্তির দিকে ঢলে পড়ে। 

অনেক সময় বাবা-মা ব্যক্তিগত সময় কাটাতে ছোট শিশুদের এড়িয়ে চলার জন্য অনলাইন টিভি, স্মার্টফোন ও ট্যাবে ইউটিউব চালানোর জন্য এক্সেস দিয়ে থাকেন। এই ধরনের প্রবেশাধিকার বাচ্চাদের শুধু আসক্তই করেনা, বরং শিশুদের সাথে বাবা-মায়ের কম সময় ব্যয় করাকে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বহীনতা বোঝায়। কিছু গবেষণায় দেখা যায় পাঁচ থেকে দশ বছরের শিশুরা সাইবার বুলিং বা ইন্টারনেট হয়রানির শিকার হয়। কিছুক্ষেত্রে দেখা যায় মেয়ে শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হয়।

তবে শিশুদের কৌতুহলের কারণে ও বন্ধু-বান্ধবীর প্ররোচণায় অনেক শিশুরাই বাবা-মাকে অমান্য করে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমের মধ্যে ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউবের প্রভাব বেশি লক্ষ্য করা যায়। এসব বিনোদনের নেশায় তাদের ঘন্টার পর ঘন্টা ব্যয় হয় যা তাদের মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তাদের আচরণগত পরিবর্তন এবং বদ মেজাজি হয়। এমনকি বাবা-মা তাদের ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে বললে বা বাধা দিলে তারা খুব রেগে যায়, কান্নাকাটি ও বিষণ্ণ হয়। মাঝে মাঝে তারা রাগের মাথায় অনেক ভুল কাজ করে বসে।

 

ছাত্র-ছাত্রীদের ইন্টারনেটে আসক্তি এবং এর ফলে তাদের ভবিষ্যত জীবনে যে প্রভাব পড়তে পারে

স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেটকে হাতের নাগালে সবচেয়ে বড় সহায়ক হিসাবে দেখছে। তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে যেকোন ধরণের প্রয়োজন হলেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে সে প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি শিক্ষার্থীদের সহায়ক ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। 

কম্পিউটার ও স্মার্টফোন শিক্ষার্থীদের কাছে খুব আকর্ষণীয় বস্তু। ছাত্র-ছাত্রীর এসব ডিভাইস ব্যবহারের সুযোগে শিক্ষণীয় বিষয়ে আগ্রহী না হয়ে  বিনোদন, তথ্য অনুসন্ধান ও যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেছে। যা তাদের শিক্ষাক্ষেত্রে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ইন্টারনেট শুধু তথ্য অনুসন্ধানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা ইন্টারনেটে অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করা, ইমেইল পাঠানো, তাৎক্ষণিক কথোপকথন এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার করছে। 

স্কুল কলেজে শিক্ষার্থীরা ইন্টারনেট থেকে গান, সিনেমা ডাউনলোড করা এবং অনলাইন গেম খেলা ও বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ভিজিটের মাধ্যমে অভ্যস্ত হয়ে ধীরে ধীরে তাদের আসক্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে। যে কারণে তারা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে। কম্পিউটারে বা মোবাইলে গেম খেলার মধ্য দিয়ে তাদের পড়াশোনার গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যায়। এই আসক্তি যখন চরম আকার ধারণ করে তখন পড়াশোনার ক্ষতি নিয়ে তাদের আর তেমন অনুতাপ থাকে না। 

তথ্য প্রযুক্তির নির্ভরশীলতার কারণে ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে কি কি প্রভাব লক্ষ্য করা যায়? 

  • পাঠ্য বই পড়ার পরিবর্তে ইন্টারনেট ব্যবহারকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া।

  • স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কমে যায় এবং দূরত্ব তৈরী হয়। 

  • বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা, বিশ্লেষণ, অ্যাসাইনমেন্ট ও পরীক্ষা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে শিক্ষকের সরণাপন্য না হয়ে ও লাইব্রেরী ব্যবহার না করে ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যার ফলে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন সম্ভব হয় না।

  • অনবরত ইন্টারনেটে সোশ্যাল মিডিয়া, বিনোদন ও ভিডিও গেম খেলায় আসক্ত হওয়ার ফলে ক্লাসরুমে শিক্ষকের পাঠে মনোযোগ কমে যায়।

  • অনেক শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমেও ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এর ফলে সে নিজের যেমন ক্ষতি করছে, তেমনি আশপাশের অন্য শিক্ষার্থীদেরও পাঠে মনোযোগ দিতে সমস্যা হয়।

  • নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতা তৈরী হয় বলে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়ার রুটিন অনুসরণ করতে পারে না।

  • কিছু কিছু ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে যারা ইন্টারনেটে আসক্তির কারণে তাদের আচরণগত ও বাহ্যিক পরিবর্তন হয়। তাই তাদেরকে প্রায়শই দেখা যায় বাবা-মায়ের সাথে মিথ্যে বলছে, তাদের অবাধ্য হচ্ছে ও অসম্মান করছে। এমনকি ক্লাসরুমে সহপাঠীদের সাথে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং শিক্ষককে পর্যন্ত অমান্য ও অসম্মান করে। 

তথ্য, যোগাযোগ প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট আসক্তির ফলে ভবিষ্যতে কি প্রভাব পড়তে পারে?

  • পরীক্ষায় খারাপ ফলাফলের কারণে স্কুল-কলেজ থেকে অর্থাৎ লেখাপড়া থেকে ছিটকে যেতে পারে।

  • জীবনের লক্ষ্য পরিবর্তন সহ অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হবে।

  • প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।

  • শিক্ষা অসম্পন্ন থাকার কারণে বেকারত্ব বাড়তে পারে।

  • কিছু কিছু শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল মেনে না নিতে পেরে, নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে ও আরো বেশি ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়ে। 

 

ইন্টারনেট আসক্তিতে আর্থ-সামাজিক প্রভাব

যখন থেকে মানুষের জীবনযাপনে ইন্টারনেট কেন্দ্রবিন্দুতে স্থান করে নিয়েছে, তখন থেকেই সমস্যাপূর্ণ ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে তৈরি হচ্ছে সামাজিক সমস্যা। আর এ সমস্যা তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রবলভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলছে তাদের জীবন ভোগ ও জীবন ব্যস্ততার মধ্যদিয়ে।  ইন্টারনেট ব্যবহার তাদের জীবনে হয়ে ওঠেছে অপ্রতিরোধ্য এবং এর আসক্তি তাদের দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব কাজে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।

সামাজিক প্রতিকূল পরিস্থিতিরঃ ইন্টারনেট আসক্তির ফলে আমাদের সমাজে নানা রকমের ত্রুটি-বিচ্যুতি, অনাকাঙ্খিত ঘটনা, নিরাপত্তাহীনতা, সুষ্ঠু সুন্দর জীবনযাপনে বাধা-বিঘ্নতা, ব্যতিক্রমী তীক্ত অভিজ্ঞতা, অস্থিরতা, অরাজকতা, বিশৃংখলা, আইন অমান্য করা থেকে শুরু করে আইনের অপব্যবহার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

সাইবার অপরাধঃ ইন্টারনেটে আসক্ত অনেক ব্যক্তি সাইবার ক্রাইম, সাইবার হ্যাকিং ও সাইবার সেক্স এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নিজে বরবাদ হয়েছে এমনকি কেউ কেউ ব্যক্তিগত বা দলীয়ভাবে তৈরি করছে অনলাইন জুয়ার প্লাটফর্ম এবং অন্যান্যদের আকৃষ্ট করার মাধ্যমে ক্ষতি করছে। এর কারণে সমাজে দারুণ সংকট তৈরি যেমন হচ্ছে, তেমনি ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে অনেক ইন্টারনেট আসক্ত ব্যক্তি।

সামাজিক অপরাধ প্রবণতাঃ ইন্টারনেটে আসক্ত ব্যক্তিরা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণহীনতার কারণে বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের সাথে অনেক সময় সংঘর্ষে জড়িয়ে যায়, মারামারি করে। কখনো কখনো দেখা যায় সোশ্যাল মিডিয়ার ক্লোজ গ্রুপের মধ্যে অনেকে মিলে গ্যাং বা অপরাধী চক্র গড়ে তোলে এবং সমাজে বিভিন্নভাবে তারা প্রভাব বিস্তার করতে চায়।

সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাঃ ইন্টারনেট আসক্তির ফলে তরুণ সমাজে চরম বিপর্যয় নেমে আসে। তাদের মধ্যে নানা উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করা যায়। যেমন অপরিচিত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা, মেয়েদের অনলাইনে অথবা অফলাইনে উত্যাক্ত করা, অল্পবয়সী মেয়েদের ফুস়্লিয়ে বা জোর করে হ্যানস্ত করা, যেকোন ব্যক্তির ব্যক্তিগত মূহুর্ত গোপন ক্যামেরায় ধারণ করে সোশ্যাল ‍মিডিয়ায় প্রচার করে তাকে বিরম্বণায় ফেলা, কারো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হ্যাক করে তাকে ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক ভাবে ফাঁদে ফেলার মতো প্রতিদিন অসংখ্য সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হচ্ছে ইন্টারনেট এর অপব্যবহার ও আসক্তির কারণে।

পারিবারিক ও সাংসারিক কলহঃ প্রাপ্ত বয়স্ক ইন্টারনেট আসক্ত ব্যক্তিদের দীর্ঘ সময় ইন্টারনেটে ব্যয়ের মাধ্যমে অনেকেই নানা রকম সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, বিবাহিত জীবনে দ্বন্দ্ব ও কলহ তৈরি হয়। অনেকেই পরিবারে সময় কম দিয়ে অপরিচিত বা নতুন বন্ধু-বান্ধবের সাথে খোশগল্পে মজে থাকেন। যার ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সন্দেহ ও ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। যে কারণে সামাজিক মূল্যবোধের অবনতি হয়।

ছেলে-মেয়েদের অবাধ মেলামেশা ও অবাধ্যতাঃ সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে আজকাল শহর ও গ্রামাঞ্চলে সমানতালে ছড়িয়ে পড়ছে পশ্চিমা সংস্কৃতি ও উত্তরাধুনিকতা সমৃদ্ধ স্টাইল, ফ্যাশন এবং মানসিক ও বাহ্যিক বেশভূষায় এসেছে মারাত্মক আপত্তিকর পরিবর্তন। এছাড়া ওঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা ঘরে-বাইরে কারো কোন শাসন-বারন ও নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে স্বেচ্ছাচারিতায় মেতে উঠছে ও অবাধে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে গড়ে উঠছে অনিরাপদ সম্পর্ক।

এছাড়া বিশাল জনগোষ্ঠীর ইন্টারনেটে ঝাপিয়ে পড়ার ফলে  বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয় হচ্ছে। যেকোন মানুষের গড় ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট খাতে যে ব্যয় হয় তা সার্বিকভাবে বড় একটি পরিমাণ এবং অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যয় বিলাসীতার সামিল। অন্যদিকে অনলাইন জুয়ার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থের ক্ষতি হচ্ছে, যা অর্থনীতিতে নেতিবাচক দিক বলে বিবেচনা করা হয়। তাই অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত  ইন্টারনেট ব্যবহারের মধ্য দিয়ে আর্থসামাজিক অবস্থানে নেতিবাচক প্রভাব বাড়ছে।

 

ইন্টারনেট আসক্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে

ইন্টারনেটে আসক্তি জন্ম নেওয়াটা খুবই সহজ বিষয় হলেও এর থেকে সহজে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। কারণ ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বের হতে গেলে অসংখ্য বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে হয়। সেক্ষেত্রে কি কি চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হলো,

আত্মনিয়ন্ত্রণে অক্ষমতাঃ ইন্টারনেট আসক্তি হতে রক্ষা পাবার ক্ষেত্রে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো আসক্ত ব্যক্তির গতিবিধির উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। ইন্টারনেটে আসক্ত হচ্ছে জেনেও সে এর প্রতিকার সম্পর্কে ভাবতে পারেনা।

নেতিবাচক মানসিকতা ও খামখেয়ালি হওয়াঃ কেউ ইন্টারনেটে আসক্ত হয়ে পড়লে সব ব্যাপারেই সে নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে। ইন্টারনেট ব্যবহারে তেমন কিছু হবে না, এমন ভেবে পুনরায় ইন্টারনেট ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ হয়, যা ইন্টারনেট আসক্তি হতে মুক্ত হবার ক্ষেত্রে অন্যতম অন্তরায়। তাই প্রবল চেষ্টার পরেও মানসিক নির্ভরশীলতা কাটে না।

সঠিক ‍চিকিৎসা ও নির্দেশনার অভাবঃ ইন্টারনেট আসক্তি প্রতিরোধ করার জন্য অনেক দেশেই এখনো তেমন বিশেষ কোন চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় না। এছাড়া যেহেতু এটিতে শারীরিক সমস্যা থেকে মানসিক সমস্যাই বেশি তাই অনেক আসক্ত ব্যক্তিকেই বুঝানো যায় না সে ইন্টারনেটে আসক্ত। অনেক আসক্ত ব্যক্তিরা সঠিক নির্দেশনা না পাচ্ছেনা বলে আসক্তি থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

সঠিক সঙ্গের অভাবঃ আজকাল ইন্টারনেট ব্যবহার করেনা এমন মানুষ খোঁজে পাওয়া কঠিন। তাই কেউ আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চাইলেই তার বন্ধু-বান্ধব, আপনজন ও চারিপাশের সকল মানুষকে ইন্টারনেট ব্যবহারে প্রতিনিয়ত দেখার পর ও ইন্টারনেটে সেসব মানুষের আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে, নিজের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। ফলে আসক্তি ছাড়াতে সমস্যা হয়।

কর্মজীবনে ইন্টারনেট ব্যবহারের সম্পৃক্ততাঃ কোন ব্যক্তি ইতোমধ্যে ইন্টারনেটে আসক্ত হয়েছে জেনে যখন আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করে, তখন তার বর্তমান কর্মজীবনে কার্য সম্পাদন করতে গেলে তা ইন্টারনেটের সাথে সম্পৃক্ত বলে ইন্টারনেট ব্যতিত তার কাজ সম্পন্ন হয় না। ফলে ইন্টারনেটে সম্পৃক্ত হতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নতুন নির্ভরশীলতা তৈরি হয়।

সময়ের সাথে আপডেট থাকতে গিয়ে ও যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রেঃ বর্তমান সময়ে যেকোন মানুষের সাথে যোগাযোগ করার সবচেয়ে সহজ ও সাশ্রয়ী মাধ্যম হলো ইন্টারনেটে মেসেঞ্জার বা সোশ্যাল মিডিয়া। কেউ নিজে থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্যদের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু সোশ্যাল মিডিয়া বা মেসেঞ্জার হওয়ায় ইন্টারনেট এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে না। আর তাই একবার ইন্টারনেটে প্রবেশ করলেই তৈরি হয় নতুন নতুন ব্যবহারের উৎস। যেকারণে ইন্টারনেট আসক্তি ছাড়ানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।

 

ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়

ইন্টারনেট আসক্তির ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর শারীরিক ও মানসিক এক ভয়ানক ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে ইন্টারনেট আসক্তিকে এমন এক ব্যাধি হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যা মানসিক সমস্যা হিসাবে বিবেচনা করা হয় এবং ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তি পাবার জন্যে প্রচুর পরিমাণে গবেষণা প্রয়োজন। ইন্টারনেট আসক্তির ব্যাপারে যদিও এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো উন্নতমানের চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি, তবুও অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম মেনে চললে ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। নিম্নে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো,

সমস্যা চিহ্নিতকরণ ও প্রতিরোধ করার প্রবল ইচ্ছাঃ ইন্টারনেট আসক্তির ক্ষেত্রে প্রথমেই চিহ্নিত করতে হবে এ জাতীয় সমস্যা বা আসক্তি বিদ্যমান আছে কিনা। কেউ যদি মনে করে তার ইন্টারনেট আসক্তির মতো সমস্যা নেই, তাহলে সে প্রকৃতপক্ষে ইন্টারনেট আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চায় না।

আত্মসচেতনতা ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাঃ অনেকেই বিশ্বাস করনে আত্মসচেতনতা ও নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রেখে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারলে তা আসক্তিতে পরিণত হবেনা। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারের পূর্বে নিজের সাথে একধরনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে যে, তার একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে।

আচরণগত পরিবর্তনঃ ইন্টারনেট ব্যবহারের উপর তীব্র নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে এবং দৈনন্দিন কার্যসূচীর প্রতি মনোযোগী হওয়ার মধ্য দিয়ে আচরণগত পরিবর্তন সম্ভব।

ডায়ালেক্টিক্যাল বিহ্যাবিউরাল থেরাপিঃ ডায়ালেক্টিক্যাল বিহ্যাবিউরাল থেরাপি হচ্ছে এমন একটি  সক্রিয় থেরাপি পদ্ধতি, যার ফলে সঠিকভাবে নেতিবাচক ভাবনা-চিন্তার সমূলে চিহ্নিত করে তাকে ইতিবাচক ভাবনা-চিন্তায় রূপান্তর করা। অর্থাৎ কোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সুপ্ত সদিচ্ছাকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে দীর্ঘদিনের বদভ্যাসকে ছাড়ানোর একটি কার্যকর পদ্ধতি হলো এই থেরাপী।

বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট বহিঃর্ভূত মাধ্যম তৈরি করাঃ আজকাল সকল বিনোদন যেন তৈরিই করা হয় ইন্টারনেটে আপলোড করার জন্য। কিন্তু প্রচুর পরিমাণে সাংস্কৃতি কার্যক্রম, ইনডোর এবং আউটডোর গেমস এর পরিমাণ বাড়ানো, বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পালনের মধ্য দিয়ে ইন্টারনেটের বিকল্প বিনোদন মাধ্যম তৈরি করলে মানুষ ইন্টারনেটের ব্যবহার কমিয়ে দিবে।

বই পড়ার মধ্য দিয়েঃ নিয়মিত বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে ইন্টারনেটের ব্যবহার কমিয়ে আনা সম্ভব। তাহলে মানুষ ইন্টারনেটে কম আসক্ত হবে।

পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং পরিবারের সদস্যদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণঃ প্রত্যেকের বিচ্ছিন্ন মনোভাবকে পরিহার করে একে অপরের সাথে সকল ক্ষেত্রে যোগাযোগ বাড়াতে হবে এবং বাবা-মা বা অভিবাবকদের ছেলে-মেয়েদের প্রতি নজর রাখতে হবে, যেন তারা ইন্টারনেটে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে না পারে।

শিশুদের ক্ষেত্রে ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার নজরদারিঃ শিশু-কিশোরদের যতটা সম্ভব সম্ভব স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট ব্যবহারে বিরত রাখা। আর ব্যবহার করলেও তাদেরকে খুশি রেখে সকল সাইটের পাসওয়ার্ড নজরদারিতে রাখা এবং ক্ষতিকর সাইট ব্লক করে রাখতে হবে। যাতে তারা আপত্তিকর সাইটগুলো ব্যবহার করতে না পারে।

ছেলে-মেয়েদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়াঃ সম্ভব হলে প্রতিসপ্তাহে বাচ্চাদের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরতে নিয়ে যেতে পারলে, তাদের পড়াশোনার একঘেয়েমী কেটে যাবে। আর সে ক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের আগ্রহ কম হবে।

ছেলে-মেয়েদের সৃজনশীল কাজে নিযুক্ত করা এবং অনুপ্রেরণা দেওয়াঃ প্রত্যেক পরিবারে এবং বিদ্যালয়ে ছেলে-মেয়েদেরকে বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল কর্মকান্ডে নিয়োজিত করা এবং তাদেরকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে উৎসাহ প্রদান করলে, পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের প্রতিভা বিকাশের মাধ্যমে সময় কেটে যাবে। ফলে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজন কম হবে।

নেশাদ্রব্য বা অন্যান্য আসক্তি পরিহারঃ যারা পূর্বেই অন্যান্য নেশায় আসক্ত বা হতাশ। তাদেরকে সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ তাদের পূর্ববর্তী নেশা কাটাতে এবং হতাশা দূর করতে ইন্টারনেটকে বেছে নিতে পারে। 

 

ইন্টারনেট এ আমরা কতটা উপকার পাচ্ছি সেটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তা আমাদের কোন কোন দিক থেকে ক্ষতি করতে পারে সেসব ব্যাপার জানা দরকার। কেননা অবাধে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। সেকারণে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সকল স্তরের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগের পাশাপাশি প্রশাসনিক উদ্যোগ, গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পাঠ্যপুস্তকসহ প্রতিটি মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা ও ক্ষতিকর দিকসমূহ প্রচার করে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে সাবধানতা ও সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এছাড়া প্রতিটি পরিবারের অভিবাবককে তাদের সন্তানের ইন্টারনেট ব্যবহার সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইন্টারনেট আসক্তির মতো সংকট মুক্ত হওয়া সম্ভব।

Default user image

মোঃ অলিউল্লাহ, লেখক, আস্থা লাইফ

সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর এর পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের একজন লেখক। বিডিজবস.কম এ কনটেন্ট ডেভেলপার হিসাবে দায়িত্বরত আছি। সবধরনের লেখালেখি, গবেষণা ও বিশ্লেষণ করতে আমার ভাললাগে। মেডিকেল সাইন্স ও মেডিসিনের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ ও দূর্বলতা থেকেই “আস্থা লাইফ” এর নাম শুনামাত্র কাজ করার জন্যে রাজি হয়ে যাই। একজন সচেতন মানুষ হিসাবে আমার দায়িত্ব মানুষকে শারীরিকভাবে সচেতন হতে সহায়তা করা। আর সেজন্যে “আস্থা লাইফ” এ কাজ করার থেকে ভাল প্লাটফর্ম আর হতে পারেনা।

Related Articles