শীতে করোনাভাইরাস—সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কি প্রস্তুত?
দরজায় কড়া নাড়ছে শীতকাল, আর আমাদের মধ্যেও বাড়ছে শীতকালীন রোগ বালাইয়ের সংক্রমণ। তবে এর সাথে কি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণও বৃদ্ধি পাবে? এই ব্যাপারে দেশ বিদেশের চিকিৎসাবিদ এবং বিজ্ঞানীরা কি ভাবছেন? অনেকেই মনে করছেন আসন্ন শীতে আসতে পারে কোভিড-১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকেও নেয়া হচ্ছে নানা প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ। আসুন তবে শীতকালীন এবং করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সম্পর্কে একটু বিস্তারিত জেনে নেয়া যাক।
“গুড়ি গুড়ি বয় হিমের কথা কয়
তারই কুয়াশায়—
পাতা ঝরা শীতের ছোঁয়া কাঁপিয়ে দিয়ে যায়”
শীতকালে শুধু যে হিমের ছোঁয়া আমাদের কাঁপিয়ে দেয় তা নয় বরং ঠাণ্ডা জনিত নানাবিধ রোগ বালাইয়ের সংক্রমণ বাড়তেও দেখা যায়। আর এবার সবকিছু ছাপিয়ে মাথার উপর খড়গের মত ঝুলে রয়েছে ভয়াবহ এক মহামারীর প্রকোপ বাড়ার আশংকা। এই শীতে শীতকালীন রোগ যেমন কাশি এবং সর্দি জনিত রোগ বেড়ে যেতে পারে, আর ঠিক তেমনই বিশেষজ্ঞদের মতে ভাইরাস জনিত রোগ কোভিড-১৯ এর সংক্রমণও প্রবল হারে বাড়তে পারে।
মরনঘাতি এই ভাইরাস ইতোমধ্যেই ইউরোপ এবং আমেরিকায় প্রচণ্ড তাণ্ডব চালিয়ে কিছুটা স্তিমিত হতে না হতেই পুনরায় ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা একে দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েভ নামে আখ্যায়িত করছেন। আর এর থেকে বাংলাদেশেও বাদ যাবে না বলে অনেকেই মনে করছেন।
শীতে করোনা সংক্রমণ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে বাড়তি সতর্ক থাকার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছে, কেননা ইতোমধ্যে উত্তর গোলার্ধের কিছু যায়গায় কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছুদিনের আগেই কোভিড-১৯ বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা জানিয়ে সবাইকে সতর্ক থাকতে বলেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট ডেভিড রিলম্যান এই সম্পর্কে বলেন, “শীতকালে করোনা ভাইরাস আরো প্রবল আকার ধারণ করতে পারে, ফলে আমরা আসন্ন শীতে কঠিন কিছু সময়ের সম্মুখীন হতে পারি”। আদতে এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া এবং করোনাভাইরাস সহ অন্যান্য বেশ কিছু শ্বাস প্রশ্বাস জনিত রোগ শীতকালে বেড়ে যায় এবং গ্রীষ্মে কিছুটা প্রশমিত হয়। ঠিক এই কারণেই যাদের শ্বাসকষ্ট এবং ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা রয়েছে তাদেরকে শীতকালে অনেক বেশি অসুস্থ থাকতে দেখা যায়।
তবে এই কোভিড-১৯ নামক মহামারী কি ইনফ্লুয়েঞ্জার মতই মৌসুমি ভাইরাসে পরিণত হবে কি না সেটাও এখনো পরিষ্কার ভাবে বুঝা যাচ্ছে না। কেননা করোনা ভাইরাস পৃথিবীতে এখনো মহামারী আকারেই রয়েছে এবং এখনো এই ধরণের কোন মন্তব্য করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পার হয়নি এবং একই সাথে তথ্য উপাত্তেরও ঘাটতি রয়েছে।
তবে যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীদের বক্তব্য হল ঠাণ্ডা অঞ্চল বিশেষ করে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মত তাপমাত্রা করোনা ভাইরাস সংক্রমণের জন্য বেশ অনুকূল। এছাড়াও শীতপ্রধান দেশগুলোতে সাধারণত সবাই দরজা জানালা বন্ধ করে রাখে এবং এতে করে ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো বাতাস ঢুকতে পারে না। এই ধরণের পরিস্থিতি করোনা ভাইরাসের জন্য অনুকূল। ব্রিটেন একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্স এর একটি গবেষণা বলছে, এই শীতকালে যুক্তরাজ্যের পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে এবং এতে আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ মৃত্যু বরণ করতে পারে।
আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা কি বলছেন?
অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিচালিত সাম্প্রতিক কিছু গবেষণার দাবি, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়ে শীতকালে এ ভাইরাসটির প্রভাব আরও বাড়তে পারে।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সাথে বাতাসের আর্দ্রতা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। শীতকালে বাতাসের আর্দ্রতা কমে যাওয়ার কারণেই মূলত করোনা ভাইরাসের সংক্রমণও বেড়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। তবে এর সাথে তাপমাত্রার কোন সম্পর্ক নেই।
ভারতের বিশেষজ্ঞদের মতে, মৌসুমি বৃষ্টিপাত, ঠান্ডা বায়ুমণ্ডল এবং শীতকাল ঘনিয়ে আসাসহ পরিবেশগতভাবেই ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়তে পারে।
যুক্তরাজ্যের মেডিক্যাল সায়েন্স একাডেমির এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ২০২১ সালের জুনের মধ্যেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়ে মৃতর সংখ্যা বেড়ে এক লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড স্কুল অব মেডিসিনের গবেষকরা বলছেন, ব্রিটেন, মধ্য এশিয়া, ককাস, পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ, উত্তর ও মধ্য-পশ্চিমা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়াতে শীতকালে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ঝুঁকি বেশি রয়েছে।
বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞদের মতামত
এদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞদের ক্ষেত্রে দুই ধরণের বক্তব্য লক্ষ করা গিয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়য়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এর বক্তব্যেও কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বাড়ার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। তার মতে শীতকালে এই ভাইরাসের প্রকোপ বৃদ্ধি হবে।
তিনি বলেন, শীতে তাপমাত্রা ও কম আর্দ্রতা করোনাভাইরাসকে আরও বেশি সময়ের জন্য বেঁচে থাকার সুযোগ করে দেবে। সেই সাথে ভিটামিন-ডি এর ঘাটতি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার ফলে করোনাভাইরাসটি মানুষের ওপর আরও বেশি প্রভাব ফেলবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক রোগ নিয়ন্ত্রক পরিচালক বি-নাজির বলেন, যেহেতু করোনা ভাইরাসের লক্ষণ অন্যান্য ঠাণ্ডা জনিত সমস্যাগুলোর মতই। তাই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শীতকালে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া যারা এমনিতেই বিভিন্ন ধরণের শ্বাস প্রশ্বাস জনিত সমস্যায় ভুগেন, তাদের জন্য করোনা ভাইরাস আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে।
তবে, অণুজীব বিজ্ঞানী ড. সমীর কুমার সাহা বলেন, অন্যান্য দেশে যে ভাবে করোনা বিস্তার লাভ করেছে সেদিক থেকে আমাদের অবস্থান এখনও ভাল। অন্যান্য দেশের মতো পরিস্থিতি আমাদের হবে না বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই অণুজীব বিজ্ঞানী।
আরেক অনুজীববিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল বলছেন, দেশে যে ভাবে এখনও ভাইরাস ছড়াচ্ছে তাতে করে শীতের আগেই সব মানুষের মধ্যে আন্টিবডি তৈরি হয়ে যাবে। ফলে করোনা শীতে খুব বেশি প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। এছাড়াও বাংলাদেশি মানুষদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় করোনা প্রতিরোধে সক্ষম হচ্ছে মানুষ।
তবে এই দুই বিজ্ঞানী বলছেন, করোনা নিয়ে সব ধরণের প্রস্তুতি সরকারকে রাখতে হবে। একইসঙ্গে জনসাধারণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
অশনি বিপদ মোকাবেলায় সরকারের পদক্ষেপ
দ্বিতীয় ঢেউ বা সেকেন্ড ওয়েব সামলানোর জন্য ইতোমধ্যেই সরকারের বিভিন্ন মহলে চলছে বিশেষ তোরজোড়। বিদেশ থেকে আগতদেরকে পুনরায় কোয়ারেন্টিনে প্রেরণ সহ সাড়া দেশ ব্যাপী মাস্ক পরিধান করা এবং করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নেয়া হচ্ছে নানা পদক্ষেপ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও মাস্ক পরিধান করার জন্য বিশেষ ভাবে জোর প্রদান করেছেন।
নো মাস্ক, নো সার্ভিস—নামক প্রচারণায় সরকারের বিভিন্ন অধিদপ্তরগুলোতে মাস্ক পরার প্রতি আলাদা ভাবে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এমনকি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাস পরার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুন টাঙ্গানো হচ্ছে।
এছাড়াও শীতকালীন সময়ে যেহেতু এমনিতেই মানুষের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ঠাণ্ডার সমস্যা বেড়ে যায় তাই সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে বিশেষ নির্দেশনা অনুযায়ী সারা দেশে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ ঠিক রাখার ব্যাপারে সচেষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। এই সম্পর্কে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আব্দুল মান্নান বলেন, “ঠাণ্ডাজনিত রোগ যেমন নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রকোপ যেহেতু এমনিতেই বৃদ্ধি পায়, তাই এই রোগগুলোর ভ্যাকসিনের সংকট যাতে না হয় সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নির্দেশ রয়েছে। সরকারের বিভিন্ন মহল এই অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালকে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা প্রদানের জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। এমনকি নন কোভিড চিকিৎসায় যে হাঁসপাতালগুলো ব্যবহৃত হত, প্রয়োজনের সেগুলোতেও কোভিড এর চিকিৎসা প্রদান করা হবে। এছাড়া মাস্ক পরিধান না করলে আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে সাড়া দেশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধরণের পদক্ষেপ সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিশেষ অবদান রাখতে পারে।
তবে অনেকেই মনে করছেন, প্রতিনিয়ত বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদেরকে আলাদা ভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখার মত জায়গা সংকট রয়েছে। কেননা প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার ব্যক্তির উপরে আগমন করছেন। এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সহ মানুষের সাধারণ জীবন যাপনের মধ্যেও বেশ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। আর তাই সবার মধ্যে সচেতনতায় শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে।
তবে সরকারি ওয়েবসাইট https://corona.gov.bd তে গেলেই আপনি করোনা ভাইরাস জনিত যাবতীয় তথ্য পেয়ে যাবেন। ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী বিগত সপ্তাহে করোনা ভাইরাসে সংক্রান্ত প্রায় পনের হাজারের মত এবং মৃত্যুর সংখ্যাও প্রায় ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছ, যা রীতিমত আশঙ্কাজনক বলে অনেকেই মনে করছেন