ডায়াবেটিস রোগীদের ভাত খাওয়ার ৫টি স্বাস্থ্যকর উপায়
ভাত আমাদের দেশীয় সংস্কৃতিতে এত ওতপ্রত ভাবে জড়িয়ে আছে যে, কম করে দুবেলা ভাত না খেতে পেলে আমাদের শান্তি হয়না। কিন্তু বর্তমান ডায়াবেটিস এর প্রকোপ লক্ষ্য করলে, দৈনিক ভাত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর তা বোঝা যায়। কিন্তু সহসা ভাত খাওয়াও কি ছাড়া যায়! আসুন জেনে নেই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কতটুকু ও কিভাবে ভাত খাওয়া নিরাপদ?
২০১৮ সালে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ এর একদল গবেষকের রিসার্চে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের ৩১ ঊর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর ভেতর ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার প্রায় ৯.৫%। অর্থাৎ প্রতি দশজনের একজন মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হন। PLOS Global Public Health এর ১১,৫০০ মানুষের উপর করা আরেকটি গবেষণায় উঠে আসে, বাংলাদেশের প্রায় ২২% মানুষের ডায়াবেটিস ও প্রি-ডায়াবেটিস রয়েছে, যার ভেতর ৬১% মানুষ জানেন-ই না তাদের ডায়াবেটিস বা প্রি-ডায়াবেটিস রয়েছে। এই হচ্ছে আমাদের জনগোষ্ঠীতে ডায়াবেটিসের অবস্থা।
অবশ্য এই অবস্থা সব সময়ই এমন ছিলো না, ২০০১ এ ডায়াবেটিসের আক্রান্ত মানুষ ছিলো ৫% এর আশেপাশে, যা ২০১৭ তে ১৪% এ গিয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে এর প্রকোপ যে আরো বেড়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। ৪০ পেরনো একটা বড় অংশ মানুষই এখন ডায়াবেটিসে ভুগছেন।
ডায়াবেটিসের অনেক গুলো প্রভাবক থাকতে পারে, যেমন, স্থূলতা, বংশগতি, খারাপ কোলেস্টেরল গ্রহণ, যথেষ্ট শারীরিক পরিশ্রম না করা, কিন্তু এর মাঝে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, বিশেষ করে ভাত খাওয়ার একটা মুখ্য ভূমিকা আছে। চলুন ডায়াবেটিস ও ভাতের সম্পর্ক বিষয়ে জানা যাক।
ডায়াবেটিস ও ভাতের সম্পর্ক
ভাত বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেরই প্রধান খাবার। এতে প্রচুর পরিমাণে সহজ পাচ্য কার্বোহাইড্রেট থাকে, যা সহজে হজম করা যায় ও দ্রুত শক্তি প্রদান করে। তবে ভাতের সমস্যা তার কার্বোহাইড্রেটে নয়, বরং দ্রুত হজম হওয়ার বৈশিষ্টই ডায়াবেটিসের এর জন্য দায়ী।
কখনো খেয়াল করেছেন, যতই পেট ভরে খান না কেন, ভাত না খেলে যেন শান্তি নেই। এর কারণ হলো আপনি ভাত খেতে খেতেই তা ভাঙতে শুরু করে ও শরীরে শর্করা সরবরাহ করে শক্তি দেয়। এই দ্রুত ক্ষুধা নিবারণ আমাদের মস্তিষ্কে সুখি হরমোন নিঃসরণ করে যার কারণেই ভাত খাওয়া এতো সন্তোষ জনক। যদিও ঠিক এই কারণেই, ভাত এর থেকে পাওয়া শক্তি খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়।
ডায়াবেটিস ও ভাতের সম্পর্ক খুব সহজ। ভাত হঠাৎ করে প্রচুর পরিমাণ শর্করায় পরিণত হয়, আর অল্প সময়ে এতো বেশি পরিমাণ শর্করা সঠিক ভাবে শরীরে প্রবেশ করাতে প্রচুর পরিমাণ ইনসুলিন এর প্রয়োজন হয়। এতে চাপ পড়ে অগ্ন্যাশয়ের উপরে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মাত্রায় শর্করা প্রসেস করতে গিয়ে একসময় তা প্রয়োজনীয় ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না। ফলাফল ডায়াবেটিস।
তাহলে ডায়বেটিস রোগীরা ভাত কিভাবে খেলে স্বাস্থ্যের তেমন ক্ষতি হবে না?
ভাত খাওয়ার স্বাস্থ্যকর উপায়
প্রথমত নিয়মিত ভাত খাওয়ার অভ্যাস হুট করে বাদ দেওয়া বেশ কঠিন। আমাদের খাবার থেকে পাওয়া একটা বড় অংশ শক্তি আমরা পাই ভাত থেকে। কিন্তু ভাতের স্বাস্থ্য ঝুঁকিও ছোট করে দেখার নয়। ভাতে গ্লাইকেমিক ইনডেক্স (GI) অত্যন্ত বেশি। যে খবারের গ্লাইকোমিক ইনডেক্স বা GI বেশি সে খাবার থেকে তত দ্রুত শর্করা নির্গত করে।
নিন্ম GI: ১ থেকে ৫৫
মধ্য GI: ৫৬ থেকে ৬৯
উচ্চ GI: ৭০ থেকে বেশি
আমাদের দেশে প্রচলিত ভাতে সাধারণত GI ৭০ থেকে বেশি থাকে।
চলুন এখন স্বাস্থ্যকর ভাবে ভাত খাওয়া ও ভাতের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর উপায় নিয়ে আলোচনা করা যাক-
১. সকালে ও রাতে রুটি খাওয়া
সকাল ও রাতে দুই বেলা রুটি খেলে ইনসুলিন উৎপাদন এর উপর চাপ কম পড়বে। রুটি খাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো হলো লাল আঁটার রুটি, কারন এতে ফাইবার বেশি থাকার কারণে GI খুব কম।
২. লাল চালের ভাত খাওয়া
অতীতে দেশীয় চাল খাওয়ার প্রচলন বেশি ছিলো, যে চাল গুলোতে ফাইবার ও ভিটামিন বি এর পরিমাণ অর্থাৎ GI ও বেশ কম ছিলো। বর্তমানে প্রায় সবগুলো উচ্চফলনশীল ধানের চাল এ কম ফাইবার ও বেশি GI থাকে। সাদা চালের GI ৭০ এর বেশি, অন্যদিকে লাল চালে GI ৫০-৫৫ হয়ে থাকে।
৩. অল্প ভাতের সাথে প্রোটিন, ফাইবার ও ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়া
ভাতের GI যদিও অনেক বেশি, তবে অন্যান্য ধীরে হজম হওয়া খাবারের সাথে গ্রহণ করলে ভাতেরও GI কমে আসে। যেমন ভাতের সাথে প্রচুর শাক-সবজি ও ডাল খাওয়া, মাছ ও মাংস কিংবা দই দিয়ে ভাত খেলেও ভাতের হজম ধীরে হয়, অর্থাৎ রক্তে খুব তাড়াতাড়ি চিনির মাত্রা বাড়ে না।
৪. ফ্রিজে রেখে জমিয়ে ভাত খাওয়া
ভাত রাঁধার পরপর ঠাণ্ডা করে ১ দিনের জন্য ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখুন। পরদিন পুনরায় গরম করে খেতে পারেন। এতে ভাতের শর্করা ও ফাইবার গুলো দৃঢ় ভাবে একে অন্যের সাথে লেগে যায়, যার ফলে ভাতের গ্রহণযোগ্য শর্করার পরিমাণ কিছুটা কমে আর GI ও কিছুটা কমে আসে। প্রতি ১০০ গ্রাম ভাতে শর্করা থাকে ২৭ গ্রাম। একদিন ডীপ ফ্রিজিং এর পর তা হয়ে দাঁড়ায় ২৩ গ্রাম। অর্থাৎ গরম ভাতের চেয়ে একদিনের ঠাণ্ডা করা ভাত কিছুটা হলেও স্বাস্থ্যকর।
তবে, ভাত রান্নার পর দীর্ঘসময় সেটি সাধারণ তাপমাত্রায় রাখার পর সেই ভাত আবার গরম করা হলে তা স্বাস্থ্যকর হবে না।
৫. প্রতিদিন কতটুকু ভাত খাওয়া উচিত
স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে ভাত খেতে চাইলে সাধারণ মানুষের দৈনিক ১৭০ গ্রামের বেশি ভাত খাওয়া ঠিক নয়। স্বভাবতই আমরা এরচেয়ে অনেকটা বেশি ভাত খেয়ে থাকি। ডায়েবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির ভাত খাবার পরিমাণ তার ডায়েবেটিসের অবস্থা ও ডাক্তারের পরামর্শের উপর নির্ভর করবে।
অতএব দেখা যাচ্ছে, ভাত খাওয়া সীমিত না করলে ডায়াবেটিসের জটিলতা বাড়বে।
ডায়াবেটিস এর জটিলতা
ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা নিয়ন্ত্রণে রেখে সুস্থ জীবনযাপন করা যায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রণে গুরুত্ব না দিলে কিংবা যথেষ্ট সতর্ক না থাকলে সহজেই ডায়াবেটিস নানারকম জটিল রোগ এর কারণ হতে পারে। ডায়াবেটিস এর সাথে সম্পর্কিত রোগ গুলো হলো,
কিডনী রোগ
গড়ে তিনজন কিডনী রোগীর এক জন ডায়াবেটিস এর কারণে কিডনী রোগ এ আক্রান্ত হয়ে থাকেন। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর ফলে কিডনী আংশিক থেকে সম্পুর্ণ বিকল হয়ে যেতে পারে। যার কারণে পরবর্তীতে ডায়ালাইসিস ও কিডনী ট্রন্সপ্লান্ট এর মত জটিল চিকিৎসা গ্রহণ করার প্রয়োজন হতে পারে।
হৃদ রোগ ও স্ট্রোক
ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি সাধারণ মানুষের চেয়ে দ্বিগুণ।
চোখে সমস্যা ও অন্ধত্ব
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস চোখের বিভিন্ন রকমের সমস্যা তৈরি করে।
নার্ভে সমস্যা
ডায়াবেটিস এর কারণে আমাদের শরীরের নার্ভ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যার ফলে বিভিন্ন অঙ্গে অসারতা ও চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
অন্যান্য
এছাড়াও ডায়াবেটিসের কারণে Amputations (অঙ্গচ্ছেদ), ডিপ্রেশন, মাড়ির রোগ সহ আরো আনেক ধরণের সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অর্থাৎ দেখতেই পারছেন, সুস্থ জীবনের জন্য ডায়াবেটিস থেকে নিরাপদ থাকা, আর একবার ডায়াবেটিস হয়ে গেলে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও অন্যান্য কারণে স্বাভাবিক ভাবেই আমরা ঝুঁকির ভেতর রয়েছি।
সবশেষে
ভাত খাওয়া কমানো কোন কঠিন কাজ নয়, অসংখ্য বাংলাদেশী ভাত খাওয়া কমাচ্ছেন, সকালে শরীর চর্চা করছেন, কিন্তু তা শুধু ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পরে। ডায়াবেটিস হবার পর মানুষ যতটা স্বাস্থ্য রক্ষায় সচেতন হন, তর এক চতুর্থাংশ যদি আগে থেকে হতে পারতেন, তাহলে ডায়াবেটিস এর সমস্যা বেশিরভাগেরই হতো না। তাই দেরী নয়, ধীরে হলেও খাদ্যাভাসে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করুন।