কোরবানির ঈদে সুস্থ থাকতে যে ১০টি উপায় মেনে চলবেন
পশু কোরবানির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন আর গরীব দুঃখীদের মাংস বিলিয়ে সবার মাঝে আনন্দ ভাগাভাগি করার দিনই হচ্ছে ঈদ-উল আযহা বা কোরবানির ঈদ। তবে এই খুশির ঈদ যাতে আমাদের একটু অসচেতনতায় মাটি হয়ে না যায় তার জন্য বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। সেজন্য মেনে চলতে হবে স্বাস্থ্য সচেতনতার বেশ কয়েকটি উপায়।
আর একদিন বাদেই মুসলমানদের সবচেয়ে আনন্দের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ। মাংস ভুনা, গরুর ভুড়ি, খাসির গোস্ত, কাবাব, কালাভুনাসহ হরেক নামের হরেক পদের মাংস রান্না হয়, এবং বলতে গেলে খাবারের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় এই ঈদে। তবে যেহেতু অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না, তাই প্রতিবারই এমন অতিরিক্ত খাওয়াদাওয়ার ফলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন, এমনকি মাঝে মাঝে হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয়। তাই কোরবানিতে স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং কিভাবে খাওয়াদাওয়া করেও এসময় সুস্থ থাকা যায় তা নিয়েই আমাদের এবারের আয়োজন। চলুন তাহলে জেনে নিই কোরবানি ঈদে সুস্থ থাকার কিছু কার্যকরী উপায়।
১) কোরবানির কাজ করুন সতর্কতার সাথে
দেশে এখন আর আগের মত করোনা অতটাও ভয়ংকর না হলেও ঠাণ্ডা-সর্দি, হাঁচি-কাশি, ফ্লু সহ বিভিন্ন ধরণের সংক্রামক রোগ বেড়েই চলছে। এজন্য কোরবানির সময় সাবধান থাকতে হবে সবাইকে। বেশি লোকসমাগম না করা, মাস্ক পরে থাকা, হাতের কাছে স্যানিটাইজার রাখা এমন কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে এসব সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব। কোরবানির পর ভালোমতো হাত পরিষ্কার করে মাংস কাটতে বসা উচিত। কসাই কেও বলে দিতে হবে যেন তারা পরিষ্কার হাতে সব কাজ করেন। পশুর রক্ত ও অন্যান্য বর্জ্য ভালোমতো পরিষ্কার করা উচিত এবং ব্লিচিং পাউডার দিয়ে মাংস কাটার পর জায়গাটি পরিষ্কার করা উচিত।
২) সঠিকভাবে মাংস সংরক্ষণ করুন
মাংস ঠিকমতো সংরক্ষণ না করলে তাতে টিনিয়া সোলিয়াম, সালমোনেলা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জীবাণু সংক্রমণ হয়ে থাকে। তাছাড়া ভালোমতো সিদ্ধ না করলেও অনেক জীবাণু মাংসে থেকে যায়, যা থেকে পেটের সংক্রমণসহ বিভিন্ন রোগ হতে পারে। একারণে মাংস কাটা, প্যাকেট করা এবং সংরক্ষণ করার সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, অথবা দক্ষ কাউকে দিয়ে কাজগুলো করিয়ে নিতে হবে।
৩) চেষ্টা করতে পারেন বারবিকিউ
বারবিকিউয়ে তেলের পরিমাণ অনেক কম থাকে, তাই তেল ছাড়া রান্নার কথা ভাবলে এটি একটি ভালো উপায় হতে পারে। তবে বারবিকিউ করতে দক্ষতা প্রয়োজন। যদি অভ্যাস থাকে রান্না করার তাহলে এটা আসলেই একটা ইউনিক ডিশ হতে পারে, দেখবেন মেহমানরা সবাই অনেক খুশি হবে।
তবে বারবিকিউ করতে মাংস অনেক উচ্চতাপে রান্না করতে হয়, যারফলে মাংসের সাধারণ প্রোটিন স্ট্রাকচার চেঞ্জ হয়ে যায় এবং এমন কিছু উপাদান তৈরী করে, যা ক্যান্সার সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে। এসব উপাদান তৈরী যেন না হয়, সেজন্য ভিনেগার ও লেবু দিতে পারেন বারবিকিউতে।
৪) মেটাবলিজম বাড়াতে গ্রিন টি
গ্রিন টি এর বহু গুণাগুণ বিভিন্ন রিসার্চে প্রমাণিত হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মেটাবলিজম বাড়িয়ে খাবার হজমে সহায়তা করা, দেহে ইনসুলিনের পরিমাণ ঠিক রাখা, ওজন কমাতে সাহায্য করা ইত্যাদি। যদি দাওয়াতে যেয়ে আত্মীয় বা পাশের বাসার প্রতিবেশীর চাপে পড়ে অনেক বেশি খেয়ে ফেলেন কখনো, এটা আপনাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারে এমন সময়।
প্রথমত, খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নিন। এবার আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করুন। আধাঘন্টা পর এক কাপ গ্রিন টি পান করুন। দেখবেন অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে যে অস্বস্তি ছিলো, তা ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। আর প্রতিদিন যদি এমন গ্রিন টি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন, সেটা আরও ভালো।
৫) হাঁটাহাঁটির অভ্যাস করতে পারেন
গরু, খাসি ও অন্যান্য লাল মাংসে কোলেস্টেরলের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে। একারণে যাদের স্থুলতা আছে, বা হার্টে চর্বি জমেছে, তাদের এসব মাংস কম খাওয়া উচিত। এছাড়া খাওয়ার পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে, তারপর অন্তত বিশ মিনিট হাঁটাহাঁটি করা উচিত। চাইলে খাওয়ার আগেও কিছুটা সময় হেঁটে নিতে পারেন, এতে খাবার ভালোমতো হজম হওয়ার সুযোগ পাবে। তাছাড়া ভারি খাবার খাওয়ার ৩ ঘন্টা পর ব্যায়াম বা হালকা শরীরচর্চা করতে পারলে অতিরিক্ত অনেক ক্যালরিও বার্ন হবে।
৬) সঠিক সময়ে খাবার খেয়ে নিন
অন্যান্য কাজ যেমন সঠিক সময়ে করতে হয়, তেমনি খাবারটাও খেতে হয় সঠিক সময়ে। ঈদের পর বেশিরভাগ মানুষের খাবারের রুটিনে পরিবর্তন আসে যা বদহজমসহ নানাবিধ পাকস্থলীর সমস্যা সৃষ্টি করে। তাছাড়া দুইবেলা খাবারের মাঝে যথেষ্ট সময় থাকা প্রয়োজন। একবেলা খাওয়ার ন্যুনতম ৬ ঘন্টা পর পরের বেলার খাবার খাওয়া উচিত, এতে আগের খাবার হজম হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় নিশ্চিত হবে।
৭) খাবার তালিকা থেকে যেন সবজি বাদ না পড়ে যায়
দুই ঈদেই, বিশেষ করে কোরবানির ঈদে দেখা যায় বেশিরভাগ খাবারের আইটেম মাংসের হয়ে থাকে। একটানা সাত থেকে দশদিন সবাই বিভিন্ন পদের মাংস, কাবাব, হালিম ও অন্যান্য ভারি খাবার খেয়ে থাকেন, ফলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হতে পারে। তাই প্রতি বেলায় চেষ্টা করুন অন্তত এক থেকে দুই পদের সবজি খাবারের টেবিলে রাখতে। এতে করে আপনার খাবারে কিছুটা ফাইবার যোগ হবে।
৮) খাবারের পরিমাণের উপর নজর দিন
ঈদের সময় বছরের সবচেয়ে সুস্বাদু ও লোভনীয় খাবারগুলো রান্না করা হয়। অবশ্যই সেগুলো খাবেন, তবে পরিমিত পরিমাণে। মনে রাখবেন কোরবানি ঈদের প্রায় সবধরনের খাবারই অতিরিক্ত তেলচর্বিতে ভরপুর। এসব খাবার পেটপুরে খেলে কিছু না কিছু সমস্যা হবেই। তারচেয়ে সবধরনের খাবার অল্প পরিমাণে খেয়ে সুস্থ থাকাটাই ভালো নয় কি?
৯) খেতে পারেন গ্রিলড মাংস
ডিপ ফ্রাইড খাবার সবসময়ই ক্ষতিকর। তবু মাঝেমধ্যে এসব খাবার সবাই খেয়ে থাকে। কিন্তু ঈদে এধরনের খাবার বেশি খাওয়া হয় বলে পেটের সমস্যা বেশি দেখা যায়। এসব সমস্যা এড়াতে খেতে পারেন গ্রিল করা গরু, খাসি ও অন্যান্য মাংস। এতে তেল অনেক কম পরিমাণে লাগে কিন্তু স্বাদটা অসাধারণ।
তবে এখানে আরো একটু ক্ষতি কমাতে রেগুলার রান্নার তেলের বদলে অলিভ অয়েল ব্যাবহার করতে পারেন। এছাড়া সয়াবিন তেলের বদলে রান্নায় সরিষার তেল ব্যবহার করে অনেকে উপকার পেয়ে থাকেন। সাথে কিছু সবজিও গ্রিল করে নিতে পারেন, এতে আপনার খাদ্যতালিকা আরো একটু সমৃদ্ধ হবে।
১০) নানাবিধ রোগে আক্রান্তদের জন্য বিশেষ নিয়ম
পাকস্থলীর আলসার, কিডনি ফেইলিওর, ডায়াবেটিস, পাইলস বা কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগী, হার্টে ব্লক আছে, হাই ব্লাড প্রেশার, লিভারের রোগ আছে বা যাদের কোনো অপারেশন হয়েছে এমন রোগীদের যেকোনো খাবার খুবই সাবধানতার সাথে খাওয়া উচিত।
বিশেষ করে ঈদের সময় অস্বাস্থ্যকর খাবারের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, ফলে চাইলেও মাঝে মাঝে রোগীদের উপযুক্ত খাবার পাওয়া যায়না। এমন অবস্থায় অবশ্যই তাদের জন্য আলাদা খাবারের ব্যাবস্থা করতে হবে। তারা গরুর মাংস খেলে সাথে প্রচুর পরিমানে সবজি, সালাদ ও পানি খেতে হবে। আর সুস্থ মানুষ হলেও তাদের দিনে ৮৫-৯০ গ্রামের বেশি মাংস খাওয়া উচিত নয়।
মুসলমানদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হলো ঈদ। এই দিনে সবাই সবার সাথে কোলাকুলি করবে, আনন্দ ভাগাভাগি করবে, খাবার ভাগাভাগি করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অতিরিক্ত ও অনিয়ম করে খাওয়াদাওয়ার কারণে ঈদের আনন্দ মাটি হয়ে যায় অনেকের। পেটে গ্যাসের সমস্যা, বদহজম, পাকস্থলীতে ইনফেকশন, ফ্যাটি লিভারসহ নানা ধরনের রোগ হতে পারে এই কয়দিনের অতিরিক্ত খাওয়ার কারণে। কোরবানিতে স্বাস্থ্য সচেতন থেকে এই নিয়মগুলো মেনে চললে এসব সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখে ঈদের আনন্দ উদযাপন করা সম্ভব।