মরণোত্তর অঙ্গ দান কেন করবেন?

আপনি যদি ইতিমধ্যে একজন অঙ্গ দাতা না হন, তাহলে একজন হয়ে উঠার কথা বিবেচনা করতে পারেন। আপনার মৃত্যুর পরে আপনার শরীরের কী হবে তা নিয়ে চিন্তা করা একটু কঠিন বৈকি, তবে আপনার অঙ্গ বা টিস্যু দান করার সিদ্ধান্ত নেওয়া কিন্তু একটি নিঃস্বার্থ এবং সার্থক সিদ্ধান্ত যা কারও জীবন বাঁচাতে পারে। তাই আসুন মরণোত্তর অঙ্গ দান সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই।

সেই গানটার কথা কি আপনাদের মনে আছে? 'তোমায় ছেড়ে বহুদূরে যাব কোথায়'। ২০১৩ সালে ভাইরাল হওয়া এই মিউজিক ভিডিওটি দেখেন নি কিংবা গানটি একবারও শোনেন নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার। কণ্ঠশিল্পী শহীদ এবং শুভমিতার গাওয়া এই মিউজিক ভিডিওতে ছেলেটি তার অন্ধ বান্ধবীকে নিজের চোখ দান করে সুস্থ করে তোলে। কিন্তু সত্যিই কি বিষয়টা এত সহজ? চাইলেই কি নিজের মৃত্যু পথযাত্রী প্রিয়জনকে নিজের শরীরের একটা অংশ দিয়ে সুস্থ করে তোলা যায়?

নাটক সিনেমার কারণে কাউকে চোখ, কাউকে কিডনি কিংবা কাউকে হৃৎপিণ্ড দিয়ে সুস্থ করে তোলাটা অনেকটা রোমান্টিসিজমের মত করেই আমাদের মনে গেঁথে গেছে। যদিও পুরো বিষয়টা যথেষ্টই জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। পাশাপাশি রয়েছে আইনি নিয়ম কানুন। আজকের ব্লগে আমরা অর্গান ডোনেশন এবং ট্রান্সপ্লান্ট অর্থাৎ  অঙ্গ প্রতিস্থাপন ও অঙ্গ দান বিষয়ে প্রাথমিক কিছু বিষয় জেনে নেব। 

অঙ্গ প্রতিস্থাপন আসলে কি? 

সহজ বাংলায় এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে অসুস্থ রোগীর অকেজো অচল অঙ্গ সার্জারির মাধ্যমে অপসারণ করা হয়। এরপর অন্য কোনো জীবিত বা মৃত মানুষের সুস্থ অঙ্গ বা টিস্যু সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়। এই পুরো বিষয়টাকে বলা হয় অঙ্গ প্রতিস্থাপন। আর জীবিত অবস্থায় বা মৃত্যুর পর কেউ অঙ্গ দিলে কিংবা মৃত্যুর পর অঙ্গ দেবেন সে বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ হলে তাকে অঙ্গ দাতা বলা হয়ে থাকে। 

অঙ্গ প্রতিস্থাপন দুই ভাবে হতে পারে। দাতা নিজের পুরো শরীর কোনো মেডিকেল কলেজ বা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী কোনো প্রতিষ্ঠানে দিয়ে যেতে পারেন। আবার শরীরের নির্দিষ্ট কোনো অংশও দিয়ে যেতে পারেন। যেমন হৃৎপিণ্ড কিংবা কর্ণিয়া কিংবা কিডনি। 

আবার একটি কিডনি, অস্থিমজ্জা কিংবা যকৃতের মত অঙ্গ চাইলে জীবিত ডোনারের কাছ থেকে সংগ্রহ করা যায়। একে Living Donor Transplant বলা হয়। তবে চোখ কিংবা হৃৎপিণ্ড শুধুমাত্র মৃত ডোনারের কাছে থেকেই নেয়া যেতে পারে। একে বলে Cadaveric Transplant. 

অঙ্গ প্রতিস্থাপন বিষয়ক সাম্প্রতিক ঘটনা 

সম্প্রতি এই বছরের শুরুতে বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞান এক ধাপ সামনে এগিয়ে যাবার সুযোগ পেল। আর তা সম্ভব হল সারাহ ইসলাম নামের এক অসাধারণ তরুণী এবং তার মায়ের সাহসী পদক্ষেপের দরুন। সারাহ ইসলাম ছোট বেলা থেকেই দুরারোগ্য টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস নামক একটি জটিল ও বিরল জেনেটিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলেন। দীর্ঘ ২০ বছর তিনি ও তার পরিবার এই রোগের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। অবশেষে এই বিরল রোগের কাছে হার মেনে সারাহ পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মৃত্যুর আগে তিনি নিজের অঙ্গ দান করে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এবং মৃত্যুর পর সারাহর মা তার এই ইচ্ছা কার্যকর করেন। এই প্রথম বাংলাদেশে একজন ব্রেন ডেড মানুষের শরীর থেকে অঙ্গ নিয়ে তা সফল ভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। তার দুটি কিডনি এবং দুটি কর্ণিয়া চারজন মানুষের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়।

২০১৫ সালে বিশ্ববিখ্যাত সংগীতশিল্পী সেলেনা গোমেজ লুপাস নামক একটি অটোইমিউন ডিজিজে আক্রান্ত হন। লুপাসকে বলা হয় 'ইনভিজিবল ইলনেস'। ধীরে ধীরে এ থেকে লুপাস নেফ্রাইটিস তৈরি হয়৷ এক সময় কিডনিসহ অন্যান্য ভাইটাল অর্গান অকেজো হয়ে পড়ে। তখন নিয়মিত ডায়ালাইসিস এমনকি কিডনি প্রতিস্থাপনের দরকার হতে পারে। এরকম একটি অবস্থায় ২০১৭ সালে সেলেনার শরীরে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। কিডনি দাতা সেলেনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ফ্রানসিয়া রাইসা। বিনোদন জগতের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে এই ঘটনা ফলাও করে প্রচার করা হয়। 

কোন কোন অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যায় 

আগেই বলেছি চাইলে কেউ নিজের পুরো শরীরটাই দান করতে পারেন। আবার নির্দিষ্ট দুই একটি অঙ্গও দান করতে পারেন। পুরোটাই নির্ভর করছে ডোনার এবং তার পরিবারের সদিচ্ছার উপর। এখন আসা যাক শরীরের কোন কোন অংশ আমরা দান করতে পারি। 

  • শরীরের ত্বক থেকে শুরু করে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত - সব অংশই প্রতিস্থাপন যোগ্য।

  • বাংলাদেশে আমরা সচরাচর কিডনি প্রতিস্থাপনের কথাই শুনে থাকি।

  • আসলে ফুসফুস, হৃৎপিন্ড, যকৃত, অন্ত্র, কিডনি, পাকস্থলী, পুরুষ ও স্ত্রী জননাঙ্গ, ত্বক, কর্ণিয়া, অস্থিমজ্জা বা বোনম্যারো এমনকি শরীরের হাড় পর্যন্ত প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে। 

মরণোত্তর অঙ্গ দান: কখন ও কীভাবে? 

ব্রেইন ডেথ বা লিগ্যাল ডেথ 

এক্ষেত্রে রোগীর মস্তিষ্ক সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। রোগী ভেন্টিলেশনে থাকার দরুন তার শ্বাস প্রশ্বাস চলতে থাকে তবে কৃত্রিম এই ব্যবস্থা সরিয়ে নিলেই রোগীর শ্বাস নেয়া চির দিনের মত বন্ধ হয়ে যাবে। রোগীকে ব্রেইন ডেড ঘোষণা করার অর্থ রোগী আর কখনোই জ্ঞান ফিরে পাবে না এবং ভেন্টিলেশনের সাহায্য ছাড়া শ্বাস নিতে পারবে না। এই ধরনের মৃত্যুকে লিগ্যাল ডেথ বলা হয়। রোগী মৃত জেনেও ভেন্টিলেশন সরিয়ে নিলেই শ্বাস নেয়া বন্ধ হয়ে যাবে ভেবে অনেক পরিবারই রোগীকে আইসিউতে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। আবার যেহেতু লাইফ সাপোর্টের সাহায্যে হলেও শ্বাস প্রশ্বাস চলছে, তাই অনেক রোগীর স্বজন ব্রেইন ডেড রোগীকে মৃত বলে মেনে নিতে চান না। সব মিলিয়ে রোগীর পরিবারের জন্য বিষয়টি খুবই হৃদয় বিদারক সেই সাথে অস্বস্তিকর।

কার্ডিয়াক ডেথ বা Circulatory Death 

এক্ষেত্রে রক্ত সঞ্চালন বা Circulation বন্ধ হয়ে যায়। হৃৎপিণ্ড থেমে যায়। শ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। একে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধজনিত মৃত্যু বলা হয়। 

উন্নত দেশগুলোতে সাধারণত ব্রেইন ডেড রোগীর কাছ থেকেই বেশির ভাগ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের জন্য নেওয়া হয়। তবে কিছু কিছু অঙ্গ কার্ডিয়াক ডেড রোগীর কাছ থেকেও নেয়া যায়। যেমন কর্ণিয়া। 

বাংলাদেশে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ইতিহাস ও এ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন কানুন 

দেশে ১৯৮২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (BSMMU) সর্বপ্রথম অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে দেশে অবৈধ অঙ্গ কেনা বেচা রোধ করার জন্য এ সংক্রান্ত একটি আইন প্রণয়ন করা হয়। আইন অনুযায়ী নিকট আত্মীয় ছাড়া অন্য কেউ জীবিত অবস্থায় অন্য আরেকজনকে নিজের কোনো অঙ্গ দান করতে পারবেন না। তবে ২০১৯ সালের এক সংশোধনী অনুযায়ী আত্মীয় নন এমন ব্যক্তিও মানবিক দিক বিবেচনায় অঙ্গ দান করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে দাতা যে শুধুমাত্র মানবিক দিক বিবেচনা করেই অঙ্গ দান করতে চাচ্ছেন সেই সংক্রান্ত কিছু প্রমাণ উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করতে হয়। 

সামাজিক ও ধর্মীয় বিধি নিষেধ 

উন্নত দেশে বেশির ভাগ অঙ্গ প্রতিস্থাপন সম্ভব হয় ব্রেন ডেড রোগীদের অঙ্গ দিয়ে। বাংলাদেশে ধর্মীয় ও সামাজিক বিভিন্ন ট্যাবুর কারণে এ প্রক্রিয়া এখনো ততটা পরিচিতি পায় নি। মৃত্যুর পরে শরীরে কাটাছেঁড়া করা হবে, শরীরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সরিয়ে ফেলা হবে কিংবা দাফন বা সৎকার না করে ফরমালিনের সাহায্যে ক্যাডাভার হিসেবে মেডিকেলে সংরক্ষণ করা হবে - এ ধরনের ব্যবস্থা অনেক পরিবারই মেনে নিতে পারে না। সমাজে মরণোত্তর অঙ্গ দান এবং মৃত ব্যক্তির অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে সে ভ্রান্ত ধারণাগুলি প্রচলিত আছে তা ভেঙ্গে ফেলার দায়িত্ব সবাইকে নিতে হবে। অনেক সময় জীবিত অবস্থায় ব্যক্তি নিজে অঙ্গ দানে আগ্রহী হলেও তার মৃত্যুর পর পরিবার দেহ বা অঙ্গ দান করতে অস্বীকৃতি জানায়। 

আমাদের ছোটবেলায় একা বাইরে কোথাও যাবার কথা উঠলেই মায়েরা ছেলে ধরার ভয় দেখাতেন। ছেলে ধরা এসে তুলে নিয়ে গেলে আর রক্ষা নেই! ছেলে ধরারা নাকি বাচ্চা পেলেই তুলে নিয়ে যায়। আর ছোট ছোট বাচ্চার কিডনি খুলে বিক্রি করে দেয়! রূপক অর্থে হলেও এই কথার সত্যতা রয়েছে। বর্তমানে দেশে যে পরিমাণ কিডনি প্রতিস্থাপন হচ্ছে তার বেশির ভাগই আসে হয় রোগীর নিকট আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে, নয়ত কিডনি বেচা কেনার কোনো চক্রের কাছ থেকে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকার গরিব অসহায় মানুষ অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে নিজের শরীরের একটি অংশ এভাবে বিক্রি করেন।

শুধুমাত্র আইন প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান করা যাবেনা। অঙ্গ দান এবং অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংক্রান্ত যেসব মিথ প্রচলিত আছে সেগুলো ভেঙ্গে দিতে সবার এগিয়ে আসতে হবে৷ এখন পর্যন্ত খুব কম সংখ্যক মানুষই আছেন যারা স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে এধরনের কাজে উৎসাহী হয়েছেন। অল্প যে কিছু ডোনার প্রতি বছর পাওয়া যায়, তাদের বেশির ভাগই সমাজের উচ্চ মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতি কর্মী অথবা সুশীল সমাজের অন্তর্ভুক্ত। সবার মধ্যে সচেতনতা ও আগ্রহ তৈরি করা গেলে দেশে কিডনি সহ অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনে নতুন সম্ভাবনা দেখা দেবে বলে আমার বিশ্বাস।

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles