বায়ু দূষণের প্রভাবে আমাদের যেসব রোগ হতে পারে

উচ্চ মাত্রার বায়ু দূষণের প্রভাবে হৃদরোগ, হাড়ের রোগ, প্রজনন স্বাস্থ, ফুসফুসের ক্যান্সার, মানসিক স্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। আর আসুস্থ ব্যক্তি, শিশু, বয়স্ক এবং দরিদ্র মানুষের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব সবচেয়ে বেশি হয়। তাহলে এই থেকে বাঁচবার উপায় কি? বায়ু দূষণ কমানোর উপায় কি হবে?

আজকের পৃথিবী বড্ড বেশিই শহরকেন্দ্রিক। আর বেশি মানুষ এক জায়গায় বসবাস করলে অন্যান্য দূষন যত যাই ঠেকানো যাক, বায়ু দূষণ ঠেকানো প্রায় দুঃসাধ্য। বাংলাদেশের শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতি পূর্ণ শহরগুলোর ভেতর একটা। এমন ঘনবসতি আর ভৈগলিক ও জলবায়ুর বৈশিষ্টের কারণেই শহর এলাকায় বায়ু দূষণ স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় সবসময়ই বেশি থাকে। কিন্তু লম্বা সময়ে এর স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটুকু? 

এই লেখাটি যখন লিখতে বসেছি সেই মুহুর্তে এন্ড্রয়েড ফোনে দেখাচ্ছে বাতাসের মান ১৩০ এর এর কাছাকাছি যা কিনা সংবেদনশীল মানুষের জন্য ক্ষতিকর ও স্বাধারণ মানুষেরও দীর্ঘমেয়াদে জটিল রোগ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অথচ আজ শুক্রবার, সপ্তাহের সবচেয়ে কম কর্মব্যাস্ত দিন, উপর্যপরি গতকাল রাতে বৃষ্টিও হয়েছিলো।

এখন নিশ্চই ভাবছেন, বাতাসের মানের সাথে শুক্রবার আর বৃষ্টির কি সম্পর্ক? আসুন প্রথমেই বাতাসের মান সম্পর্কে জানা যাক, পরবর্তি অংশ গুলোতে এর প্রভাব আর বাঁচার উপায় গুলো জানব।

এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স কি?

Air Quality Index (AQI) হচ্ছে এমন একটি মাধ্যম যার মাধ্যমে আপনি কোন স্থানের বাতাস কতটা পরিষ্কার বা অস্বাস্থ্যকর জানতে পারবেন। বাতাসের উপস্থিত ১২ রকমের দূষণ কারী পদার্থের একরকম ভারসাম্য করেই এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স বের করা হয়। 

যদি এই মুহুর্তে আপনার এলাকার এয়ার কোয়ালিটি জানতে চান, প্রথমে আপনার এন্ড্রয়েড ফোনের আবহাওয়া বিষয়ক অ্যাপ টি তে যান। একটু নিচের দিকে Air Quality এর সাথে যে সংখ্যাটি দেওয়া থাকবে সেটাই আপনার এলকার AQI. 

আরেকটু ভেঙে ব্যখ্যা করা যাক। Air Quality এর উপর ক্লিক করলে PM10, Co2 এমন কিছু কোড দেখতে পারবেন। আসুন বাতাসের মূল দূষণ গুলো, ও এর প্রকৃতি একে একে জানা যাক।

PM10

PM10 হলো বাতাসের ধুলি কণাগুলো যার আকৃতি ১০ মাইক্রোমিটার এর সমান। তুলনা করে বোঝাতে গেলে, এই ধুলিকণা গুলো চুলের পুরত্বের চেয়ে প্রায় সাত গুন ছোট। এই ধুলো গুলো আসে যানবাহনের ধোয়া, কলকারখানার ধোয়া, কিছু পোড়ালে অথবা যানবাহন ও মানুষের চলাচলে যে ক্ষুদ্র ধুলো উড়ে তা থেকে। মানুষের নাকের ভেতরে লোমস ছাঁকনির মত অংশ এগুলো অনেকটাই দূর করতে পারে। অবশ্য সেক্ষেত্রে নাকের ভেতর অস্বস্তি হয়ে থাকে। যাদের এলার্জি জনিত সমস্যা তাদের ক্ষেত্রে এটি ভয়াবহ হতে পারে। বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানির সাথে এই কণা গুলো মাটিতে নেমে আসে। পরিবেশ শুকিয়ে আসার পর মানুষের চলাচলে আবার বাতাসে স্থান পায়। 

এই ধরণের কণা সৃষ্টির আরেকটি মূল কারণ হলো অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ, যেখানে সেখানে নির্মান সামগ্রী ফেলে রাখা ইত্যাদি। মানুষের কথা বাদই দিচ্ছি, সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রজেক্টগুলি ঢাকাবাসীদের যেভাবে ভোগাচ্ছে তা বর্ণনাতীত।

PM2.5

বাতাসের যে কণাগুলো ২.৫ ন্যানোমিটার বা ছোট, সেগুলোকে PM2.5 বলা হয়। এটি চুলের চেয়েও ৩০ গুন ছোট। এগুলো মানুষের ফুসফুসে খুব সহজে পৌঁছায় ও ক্ষতিও বেশি করে। 

এই কণাগুলো উৎপন্ন হয় একই পদ্ধতিতে। যানবাহন, কলকারখানার ধোঁয়া থেকে এ ধরণের ক্ষতিকর কণা নির্গত হয়। মানুষ ও যানবাহনের চলাচলের ফলেও এটি বাতাসে নির্গত হয়। এই কণা গুলো এতো ছোট যে সহজে বাতাস থেকে চলে যেতে চায় না। এমনকি বৃষ্টির পরও কিছু পরিমানে PM2.5 বাতাসে থেকে যায়। 

অক্সাইডস

শহর মানে সেখানে গাড়ি চলবে, মিল-কলকারখানা চলবে। আর এসব চলতে প্রয়োজন জ্বীবাস্ম জ্বালানী। জীবাস্ম জ্বালানী ও বজ্র পদার্থ পুড়িয়ে ফেলার ফলে বাতাসে নির্গত হয় কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রজেন ট্রাই অক্সাইড ইত্যাদি গ্যাস, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আশার বিষয় হলো, খুব ব্যস্ত বা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এলাকা ছাড়া এই গ্যাস গুলো আমাদের দেশে ক্ষতিকর মাত্রায় অবস্থান করে না।

Air Quality Index বোঝার উপায় টি লক্ষ্য করুন,

  • ০-৫০: শুন্য থেকে পঞ্চাশের ভেতর বাতাসের মান থাকলে তাকে সম্পুর্ণ স্বাস্থ্যকর বাতাস বলা যায়।

  • ৫১-১০০: বাতাসের মান ৫১-১০০ থাকার অর্থ হলো বাতাসের মান স্বাভাবিক রয়েছে।

  • ১০১-২০০: বাতাসের মান একশ থেকে দুশোর ভেতর থাকার অর্থ বাতাসে মাঝারি ধরণের দূষণ রয়েছে যা স্পর্শকাতর জনগোষ্ঠির জন্য ক্ষতিকর।

  • ২০১-৩০০: বাতাসের মান দুশো থেকে তিনশো থাকার অর্থ বাতাসে বেশি পরিমাণে দূষণ উপস্থিত যা সাধারণ মানুষের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।

  • ৩০১-৫০০: বাতাসের মান তিনশো থেকে পাঁচশ হওয়ার অর্থ বাতাসে দূষণ ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে বেড়ে গেছে। এমন দূষিত বাতাসে সব মানুষের স্বাস্থ্যহানি হবার সম্ভাবনা থাকে।

বায়ু দূষণের ফলে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি

খুব বেশি দেরী হয়ে যাবার আগে বায়ুদূষণ সম্পর্কিত স্বাস্থ্যঝুঁকি কি পরিমাণ বিপদজ্জনক হতে পারে তা টের পাওয়া যায় না। বিশ্বে প্রতিবছর ৩৩ লক্ষ মানুষ মৃত্যুবরণ করছেন বায়ুদূষণে সৃষ্ট রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে। আমাদের দেশেও সেই সংখ্যাটাও যে বিরাট হবে তা বক্ষব্যাধি হাসপাতাল গুলোতে গেলে টের পাওয়া যায়।

বায়ুদূষণ জনিত রোগের ভেতর হার্ট এটাক করে মারা যান ৭৫ শতাংশ মানুষ, অন্যদিকে ফুসফুসের রেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৫ শতাংশ মানুষ। আসুন জেনে নেই বায়ুদূষনের ফলে যে রোগ গুলোতে আক্রান্ত হতে পারেন।

হার্টের রোগ

আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন এর তথ্য মতে হার্টের রোগের একটি অন্যতম প্রধান কারণ হলো দীর্ঘ সময় দূষিত বাতাসের ভেতর বসবাস করা। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য মতে শুধু মাত্র বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিলে আপনার আয়ু গড়ে ২-৪ বছর পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদিও হার্টের রোগের অন্যান্য কারণ রয়েছে, তবুও প্রায় ১০ শতাংশ হার্ট এটাকের জন্য বায়ুদূষণকে দায়ী করেন বিশেষজ্ঞরা।

ফুসফুসে প্রদাহ ও অন্যান্য রোগ

এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে বায়ু দূষনের কারণেই ফুসফুসের বেশিরভাগ রোগ হয়ে থাকে। এর ভেতর হাঁপানি, ফুসফুসে প্রদাহ সহ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

একটি বিষয় বেশ হাস্যকর বোধ হয়, মানুষের ক্যান্সার, করোনা সহ অন্যান্য রোগ নিয়ে ভীতির শেষ নেই। অথচ বাংলাদেশের পুরুষদের ভেতর প্রায় ৪৪ শতাংশ সরাসরি ধূমপান করে থাকেন যা ফুসফুসের রোগের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত।

প্রজনন স্বাস্থ্য

তাইওয়ানে বসবাসরত ৬৫০০ মানুষের উপর করা একটি গবেষণায় দেখা যায় বায়ুদূষণ পুরুষের শুক্রানুর সংখ্যা ও আকৃতির সরাসরি ক্ষতি করে থাকে। অন্যদিকে আমেরিকার একটি গবেষণায় উঠে আসে নারীদের অপরিপক্ক ডিম্বাণু ও ভ্রুণ মৃত্যুর একটি অন্যতম কারণ হলো বায়ুদূষণ।

স্ট্রোকের ঝুঁকি

বায়ুদূষণ কবলিত উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর একটি গবেষণায় দেখা যায়, পূর্বের তুলনায় এ অঞ্চল গুলোতে স্ট্রেক হওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক গুন বেশি। স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা স্ট্রোকের অন্যান্য কারণের সাথে বায়ুদূষণকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রতি বছর প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুবরণ করেন।

হাড়ের রোগ

বায়ু দূষণের কারণে হাড়ের পুরুত্ব কমে যাওয়া সহ অন্যান্য হাড়ের রোগ দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে বৃদ্ধ মানুষেরা এ ধরণের রোগের ঝুঁকিতে বেশি থাকেন। বায়দূষণ কবলিত এলাকায় বৃদ্ধদের অস্টিয়পেরেসিস বা হাড়ে ফাঁটল জনিত রোগে বেশি ভুগতে দেখা যায়।

মানসিক স্বাস্থ্য

কখনো কি খেয়াল করেছেন, শহরের থেকে মফস্যলে বা গ্রামের দিকে মন বেশি প্রফুল্ল থাকে? এর অন্যান্য কারণ থাকলেও নির্মল বায়ুর একটা প্রভাব অবশ্যই আছে। সাহিত্যে বায়ু পরিবর্তন নিয়ে যে কথাটা প্রচলিত আছে তা সত্যি সত্যিই বিজ্ঞানলব্ধ। তাই মানসিক অবস্থায় গোলযোগ দেখা দিলে শুদ্ধ বাতাসের ভেতর কোথাও কিছুদিন থেকে আসতে পারেন।

বায়ুদূষণ থেকে বাঁচার উপায় কি?

হতাশাজনক হলেও এটাই সত্যি যে, সমস্ত জনগোষ্ঠির সচেতনতা, সরকারী প্রকল্প ও নীতিমালা ছাড়া বায়ুদূষণ কমানোর কোন উপয় নেই। অবশ্য শহরের বেশিরভাগ নির্মাণ কাজ গুলো শেষ হলে বায়ুদূষণ কমবার এটু সম্ভাবনা রয়েছে। 

ব্যাক্তিগত ভাবেও স্থান না বদলে বায়ুদূষণ থেকে শতভাগ মুক্ত থাকা সম্ভব নয়। তবু কিছু পরামর্শ মেনে চললে বায়ুদূষণ থেকে অনেকাংশেই বেঁচে থাকা যায়।

  • বাইরে বের হলেই মাস্ক ব্যাবহার করুন। ধুলোবালি ও বৃষ্টিহীন মৌসুমে কার্বন ফিল্টার যুক্ত মাস্ক ব্যাবহার করতে পারেন।

  • বাসায় এয়ার ফিল্টার ব্যাবহার করতে পারেন। তা সম্ভব না হলে, বেশিরভাগ সময় দরজা জানালা বন্ধ রাখতে পারেন।

  • বাসায় লাকড়ি ও কেরোসিনের চুলা ব্যাবহার বর্জন করুন।

  • মশার কয়েলের পরিবর্তে মশাড়ি ব্যাবহার করুন।

  • বাইরে শরীরচর্চা পরিহার করুন। সেক্ষেত্রে একদম ভোরবেলায় করা যেতে পারে যখন বায়ুটা কিছুটা হলেও নির্মল থাকে।

  • প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ধুমপান থেকে দূরে থাকুন।

সামগ্রিক ভাবে বায়ু দূষণ কমানোর উপায়

জনসাধারণে সচেতনতা ও সরকারী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে বায়ু দূষণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমিয়ে আনা সম্ভব। যেমন,

  • নির্মাণ সামগ্রি ঢেকে রেখে।

  • ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন চালানো থেকে বিরত থেকে।

  • রাস্তায় গণপরিবহণের সংখ্যা বাড়িয়ে, ও ব্যাক্তিগত গাড়ি ব্যাবহারে নিরুৎসাহিত করে।

  • কলকারখানা, ইটভাঁটায় কার্বন ফিল্টার লাগানো বাধ্যতামূলক করে।

  • নিউক্লিয়ার পাওয়ারপ্লান্ট স্থাপন।

শেষ কথা

বায়ু দূষণ বিশ্বব্যাপি একটি ক্রমবর্ধমান আতঙ্কের নাম। প্রকৃতি এর ফলাফল হাতেনাতে ধরিয়ে দিলেও আমাদের দেশের মানুষের ভেতর সচেতনতা নেই বললেই চলে। দেশের একটি বিরাট জনগোষ্ঠি যেখানে ক্ষুধা নিবারনেই ব্যাস্ত, সেখানে পরিবেশ দূষণ তাদের কাছে স্থুল হওয়াই স্বাভাবিক। তবু আশা রাখি এই অবস্থা একদিন বদলাবে।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles