ফরমালিন যেভাবে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে

ফরমালিন প্রসঙ্গ এক সময় জনমনে বেশ ভীতির সঞ্চার করতো। কিন্তু বর্তমানে এ বিষয়ে খুব বেশি কথা হয় না। ফরমালিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের স্বল্পতার জন্য অনেক ভুল ধারণা জন্মায় অথচ ফরমালিন থেকে বেঁচে থাকার সতর্কতার ধাপ গুলো থেকে যায় অজানা। ফরমালিনের নাড়ি-নক্ষত্র ঘেটে সহজ ভাষায় এর প্রয়োজনীয় ইতিবৃত্ত জানানোর চেষ্টা করব। সাথেই থাকুন।

ফরমালিন কিভাবে কাজ করে, প্রতিরোধের উপায় কী?

 

আনিস সাহেব (ছদ্মনাম) স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ। নিয়মিত ব্যায়াম করেন, টাটাকা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রায়সই এই স্বাস্থ্য সচেতনতা যেন একটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। তার অবশ্য কিছু কারণও আছে। নতুন করে খাবারে ফরমালিন এর প্রয়োগের কথা শোনা যাচ্ছে। এতে নাকি ক্যান্সার সহ কত কত রোগ দেহে বাসা বাঁধে। তার এক বন্ধুরই তো সেদিন ক্যান্সার ধরা পড়লো।

তিনি বাজারে দাঁড়িয়ে এইসব ভাবছিলেন। হঠাৎ মনে হলো কিছুই তো কেনা হয়নি! সবজির বাজারে গেলেন সবজি কিনতে। খেয়াল করলেন সবজিতে পানি ছিটাচ্ছে বিক্রেতারা। তার মনে সন্দেহ বাসা বাঁধে, এতেই ফরমালিন নেই তো! তিনি চলে গেলেন মাছের বাজারে, সেখানেও বালতিতে ধুয়ে ধুয়ে মাছ তুলে রাখতে দেখলেন তার ভ্রু কুুঁচকে গেল। মাংসের দোকানের গন্ধটাও স্বাভাবিক মনে হলো না। তিনি বাজারে কিছুই কিনতে পারলেন না। অবশেষে উচ্চমূল্যে বড় গ্লোসারি স্টোর থেকে অর্গানিক শাক-সবজি কিনে বাড়ি গেলেন।

ঠিক এমনটাই হতে পারে যদি আপনি ফরমালিন সম্পর্কে না জেনে অযথা আতঙ্কিত হন। আশা করছি এই প্রবন্ধটি আপনাকে একটি পরিষ্কার ধারণা প্রদান করতে সহায়তা করবে।

ফরমালিন কি?

ফরমালিন হচ্ছে ফর্মালডিহাইড (জৈব রাসায়নিক দ্রব্য) এর ৩৭-৪০% জলীয় দ্রবণ। মূলত ফর্মালডিহাইড এক ধরণের তীব্র গন্ধ যুক্ত বর্ণহীন গ্যাস ও এর কার্যকারী মূলক হলো (CHO)। জলীয় দ্রবণে ফরমালিন রূপে এটি সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত প্লাইউড, পেইন্ট, কার্পেট, প্রসাক ও ধাতব শিল্পে ফর্মালডিহাইড এর বহুল ব্যাবহার আছে। 

১৮৫০ এর দিকে Butlerov নামক একজন কেমিস্ট অন্য একটি ক্যামিক্যাল বানাতে গিয়ে ভুল করে ফরমালডিহাইড তৈরি করে ফেলেন। সেই থেকে সারা বিশ্বে বিভিন্ন শিল্প খাতে ফরমালিনের বহূল ব্যাবহার শুরু হয়।

ফরমালিন কিভাবে কাজ করে?

ফরমালিন মাছ, মাংস, ফল ও সবজির পচন রোধ করে। কিন্তু ফরমালিন যুক্ত খাবার গ্রহণের ফলে মানবদেহে ক্যান্সার সহ অন্যান্য জটিল রোগ বাসা বাঁধতে পারে। আসুন জানা যাক, এটি কিভাবে পচন রোধ করে আর কেনই বা ক্ষতিকর।

ফরমালিন এর কার্যকরী মূলক CHO, যেখানে কার্বন অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন ধরে রাখে। কিন্তু এই যৌগের অক্সিজেন প্রান্তটি বেশ ভঙ্গুর আর কার্বন তুলনামূলক উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। যার ফলে ফরমালিন যখনি কোন জৈবিক পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তা ঐ পদার্থের প্রটিনের সাথে সংযুক্ত হয়ে যায়।

এখন চলুন জানা যাক কোন কিছুর পঁচন কিভাবে হয়। মূলত সকল জৈবিক বস্তু যেমন, মাছ, মাংস, কাঠ, উল, সবজিতে কার্বন, নাইট্রোজেনসহ অন্যান্য মৌল রয়েছে। আমাদের পরিবেশে আবার অসংখ্য ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক, প্রোটোজোয়াদের বসবাস। তারা সেই জৈব পদার্থ গুলো থেকে শক্তি সঞ্চয় করে এ বংশবৃদ্ধি করে। পৃথিবীর সকল পঁচন ঘটে ঠিক এদের কারণেই হয়ে থাকে। এখন লক্ষ্য করুন, ফরমালিন যেহেতু জৈব পদার্থের সাথে সংযুক্ত হয়, সেটা যেকোন জীবানু, ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাকের সাথেও সংযুক্ত হয়ে যায়। যদিও ফরমালিন এর সংযোগ কোন জৈব বস্তুর বাহ্যিক ও আকারের পরিবর্তন করে না, তবুও এটি জীবিত প্রাণির জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। আর যদি ব্যাক্টেরিয়া কোন কিছুতে আক্রমণ করতে না পারে, সেটা আজীবন মোটামুটি একই অবস্থায় থেকে যাবে। 

তাই মাছ বা সবজিতে ফরমালিন প্রয়োগে তা পঁচন প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন আমরা সেই ফরমালিন যুক্ত খাবার গ্রহণ করি। আমাদের শরীরের জীবিত কোষ এর সাথেও ফরমালিন যুক্ত হয়ে যায়। যার ফলে বিভিন্ন শারিরীক প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। আমাদের জীবিত কোষের কোন রূপ পরিবর্তন হলেই সেখানে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। সে কারণে বিভিন্ন আন্তর্জার্তিক খাদ্য নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠান গুলো এটিকে সম্ভাব্য ক্যান্সার উৎপন্নকারী পদার্থ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো আলোকপাত করা হয় নি। তা হলো, আমাদের শরীরেই স্বল্প পরিমানে ফরমালডিহাইড তৈরি হয়, এমনকি আমাদের প্রায় সব খাবারে সামান্য পরিমাণ ফরমালডিহাইড থাকে।

অল্প পরিমাণে ফরমালিন আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। মোটামুটি ৫০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত ফরমালিন দৈনিক গ্রহণ করা যায়। তার বেশি হলে বিপদের সম্ভাবনা থাকে। প্রতি কেজি মাংসে গড়ে ১০-১২ গ্রাম ফরমালিন থাকে। অর্থাৎ ফরমালিন গ্রহণের বিপদসীমা পার করতে হলে আপনাকে একদিনে কম করে ৫ কেজি মাংস খেতে হবে! তবে একথা অনস্বীকার্য যে, খাদ্যে ফরমালিনের যে কোন রূপ ব্যবহারই অত্যন্ত বিপদজ্জনক।

ফরমালিনের প্রভাবে যে উপসর্গগুলি দেখা দিতে পারে

  • অল্প মাত্রায় ফরমালিন এর সংষ্পর্শে আসলে নাক, মুখ জ্বলা, চোখে ও ঠোঁটে অস্বস্তি হওয়া ইত্যাদি।

  • খুব, বেশি মাত্রায় ফরমালিন শ্বাসের সাথে বা খাবারের সাথে গ্রহণ করলে, শরীরে রেশ হওয়া, শ্বাসকষ্ট, হাচি আর ফুসফুসের কার্যকারীতায় পরিবর্তন হওয়ার মত সমস্যা দেখা দিতে পারে।

  • শিশু বৃদ্ধ ও এজমা রোগীর জন্য ফরমালিন বিশেষ ভাবে ক্ষতিকর হতে পারে।

কোন খাবার গ্রহণের পর যদি উপরিক্ত উপসর্গ গুলো দেখা যায় তাহলে প্রচুর পরিমান পানি পান করতে হবে ও ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।

ফরমালিন এর দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য প্রভাব

মাত্র দুই চামচ পরিমাণ ফরমালিন গ্রহণ ঘটাতে পারে মৃত্যু। তাছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে ফরমালিন এর সংস্পর্শে লিউকোমিয়া, ক্যান্সার, ফুসফুসে জটিলতা সহ না না রোগ ব্যাধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। লক্ষ্য করুন, ফরমালিন যেকোন জৈব পদার্থের আকৃতি পরিবর্তন করে, মানব শরীরও জৈব পদার্থের তৈরি। আমাদের দেহ কোষের কোন রূপ পরিবর্তনই ডিএনএর অস্বাভাবিক কার্যকলাপ এর কারণ হতে পারে, যার ফলাফল টিউমার ও ক্যান্সার।

বর্তমানে ফরমালিন নিয়ে আলোচনা কতটা প্রাসঙ্গিক

ফরমালিন আবারো তত দিন আলোচনায় আসবে না, যতদিন কোন বড় ফরমালিন প্রয়োগের ঘটনা মানুষের চোখের সামনে আসবে না। তবে এখন কি ফরমালিন প্রয়োগ হচ্ছে না? সে প্রশ্নের উত্তরের জন্য আরো কিছু বিষয় বোঝা প্রয়োজন। ফরমালিন ব্যাবহার হচ্ছে কিনা তা জানার একমাত্র মাধ্যম হলো ফরমালিন পরীক্ষা করা। নিয়মিত বড় বড় বাজার গুলোয় তবে ফরমালিন পরীক্ষা করা হলেই কি আসল প্রেক্ষাপট জানা যাবে? সম্ভবত না, কারণ যে বাজারে ফরমালিন পরীক্ষা হয়, সে বাজারে ফরমালিন না ঢোকাটাই স্বাভাবিক। 

হয়ত ফর্মলিন ব্যাবহারের বর্তমান পরিস্থিতি আমরা কখনোই শতভাগ নিশ্চিৎ ভাবে জানতে পারব না। আসুন ফরমালিন একটু যৌক্তিক ভাবে চিন্তা করি। খাবারে ফরমালিন কেন ব্যবহার করা হয়? যেন তা অনেক দিন ধরে বিক্রি করা যায় ও টাটকা থাকে। সবজির বাজার খেয়াল করলে দেখবেন, দিনের সবজি দিনেই ফুরিয়ে যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সেই সাথে মাছ, মাংসও ক্রেতাদের চাহিদায় ফুরিয়ে যায়। মোটামুটি খুব বেশি পন্যে যে ফরমালিন ব্যবহার করে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন পড়ে না। সেই সাথে ফরমালিন ব্যাবহার করে লাভের চাইতে আইনী বিপদের সম্ভাবনা অনেকাংশেই বেশি। তাই গরীব বিক্রেতারা সাধারণত এইসব ঝামেলায় যেতে চাইবেন না। তবু সবাই যে সাধু তাও নয়। তবে কথায় আছে, "সাবধানতার মার নেই।" চলুন খাবার থেকে ফরমালিন দূর করার পদ্ধতি জেনে নেই।

খাবার থেকে ফরমালিন দূর করার উপায়

ফল, সবজি ও মাছ থেকে ফরমালিন দূর করার জন্য শুধু পানিতে ভিজিয়ে রাখাই যথেষ্ট নয়। কার্যকারী ভাবে ফরমালিন দূর করতে নিচের পদ্ধতিটি অনুস্বরণ করুন।

  • প্রথমে বাজার থেকে আনা ফল, সবজি বা মাছ ১০% লবণ পানিতে দেড় ঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। অর্থাৎ ৫০০ মিলি পানিতে ৫০ গ্রাম লবণ মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করতে হবে।

  • এরপর ১০:২ পানি ও ভিনেগারের দ্রবণে আরো একঘন্টা ভিজিয়ে রাখুন। 

  • এরপর পরিষ্কার টেপের পানি দিয়ে ফল, সবজি বা মাছ ধুয়ে ফেলুন। 

এই প্রক্রিয়া অনুস্বরণ করলে কাচা খাবার থেকে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ফরমালিন দূর করা যায়। 

পরিশেষ

বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্য আমাদের সবার অধিকার। কিন্তু ভ্যাজালের এই সাম্রাজ্যে নিজেদের ভালোটা নিজেদেরই নিশ্চিত করা ছাড়া আর গতি কি! আপনার সামগ্রিক সুস্বাস্থ্য কামনা করে ইতি টানছি।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles