প্যানিক অ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিক যে ৪ টি কাজ করবেন!

প্যানিক অ্যাটাক সাধারণত প্রাণঘাতী না হলেও, অসুস্থ ব্যক্তি অমানবিক কষ্টের ভেতর পতিত হন। যা তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেলতে পারে মারাত্মক প্রভাব। যদিও প্যানিক অ্যাটাক খুবই সাধারণ একটি সমস্যা হলেও আমাদের সমাজে এ সম্পর্কে ধারনা নেই বললেই চলে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা রাখলে, নিজের অথবা নিকটজনের সাহায্যে আসতে পারবেন।

  • বিশ্বে প্রায় ১ শতাংশ মানুষ কখনো প্যানিক ডিসঅর্ডারে ভুগছেন। 

  • প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ তার জীবনকালে দু-একবার প্যানিক অ্যাটাকের মধ্যে দিয়ে গেছেন।

তাহলে বুঝতেই পারছেন রোগটি খুব বিরল নয়। আপনি আপনার জীবনকালে যেকোনো সময় প্যানিক অ্যাটাকে ভুগতে পারেন, বিশেষ করে নারীদের এই সমস্যাটি হবার প্রবণতা বেশি। আপনাকে অভিনন্দন, কারণ প্যানিক অ্যাটাক সম্পর্কে জানতে পারাটাই জটিলতা অর্ধেক পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে! কিভাবে? আসুন আগে সাধারণ ধারণা নিয়ে আসা যাক।

প্যানিক অ্যাটাক ও প্যানিক ডিসঅর্ডার কি?

প্যানিক অ্যাটাক হলো আকর্ষিক তীব্র ভয় ও অস্বস্তিতে নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া। এই সমস্যাটি তুলনামূলক কম তীব্র ভাবে শুরু হয় ও ধীরে ধীরে সমস্ত শরীর ও মনকে গ্রাস করতে থাকে। অল্প কিছু সময় যা ভয়াবহ আকার ধারণ করে ও সর্বচ্চ ১০ মিনিট স্থায়ি হয়। এর উপসর্গ এত বিশ্রী রকম তীব্র যে, মনেহয় আপনি মারা যেতে চলেছেন! হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, ঘেমে যাওয়া, দম আটকে আসা, সারা শরীর কাঁপা, বুকে ব্যাথা, নিয়ন্ত্রন হারানোর মত উপসর্গ প্যানিক অ্যাটাক রোগীকে নারকীয় অনুভূতি প্রদান করে।

প্যানিক ডিসঅর্ডার হলো বারবার প্যানিক অ্যাটাক হবার রোগ। কারো এক দুবার প্যানিক অ্যাটাক হলে তাকে প্যানিক ডিসঅর্ডার বলা যায় না বরং যারা প্রত্যহ প্যানিক অ্যাটাক এর সম্মুখীন হয় তাদেরই প্যানিক ডইসঅর্ডার আছে। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একেবারে কোন পূর্বাভাস ছাড়াই প্যানিক অ্যাটাক হয়ে থাকে। যাদের রোগটি থাকে, কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ বিশেষ কোন পরিস্থিতি প্যানিক অ্যাটাক হতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কোন ধরনের ফোবিয়া, বিব্রতকর পরিস্থিতি, দুশ্চিন্তা থেকে প্যানিক অ্যাটাক শুরু হতে পারে।  তাই অনেক প্যানিক ডিসঅর্ডার রোগীদের এ ধরনের পরিস্থিতি এড়িয়ে চলতে দেখা যায়।

প্যানিক অ্যাটাক এর অনুভূতি কেমন?

প্যানিক ডিসঅর্ডার রোগীদের মতে বেশিরভাগ সময়ই অ্যাটাকের সময় হঠাৎ বুকে ড্রামের মত বুকের ভেতর হৃদস্পন্দন হতে থাকে। তখনই আতঙ্ক এসে ভর করে। প্রায় সাথে সাথেই গরম লাগতে শুরু করে, অনবরত ঘাম হতে থাকে। পরিপূর্ণ দম নেওয়া যায় না, বুকের কাছে কোথায় আটকে আসে, শ্বাসকষ্ট ও বুকে ব্যাথা হতে থাকে। শরীরে কাঁপুনি আসে আর নিয়ন্ত্রণ রাখা কষ্টকর হয়ে আসে। স্বাভাবিক ভাবেই এ সম্পর্কে ধারণা না রাখা রোগী মনে করে তার হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক জাতীয় কিছু হয়েছে। সে মারা যেতে চলেছে। কিন্তু কিছুক্ষন (সর্বোচ্চ ৩০ মিনিট) পর দ্রুত-ই সব সেরে যেতে থাকে। শুধু পড়ে থাকে দুঃসহ স্মৃতিটুকু। 

গবেষকদের মতে, মৃত্যুভয় ও আতঙ্কই অবস্থা আরও শোচনীয় করে তোলে। কিন্তু যখন আপনি জানবেন, এটি একটি প্যানিক অ্যাটাক, হার্ট অ্যাটাক জাতীয় কিছু নয়, ও আপনার কিছু হবে না। তখনি আপনি মনে জোর নিয়ে উপসর্গ প্রশমনের জন্য যা যা করনীয় তাই করার চেষ্টা করতে পারবেন। এ কারণে বলা, শুধু জ্ঞান রাখা-ই জটিলতা অনেক টুকু হ্রাস করতে পারে।

প্যানিক অ্যাটাকের উপসর্গ সমূহ

প্যানিক অ্যাটাকের উপসর্গ নানা রকম হতে পারে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ৪ বা ততোধিক করে উপসর্গ দেখা দেয়। 

শারীরিক

  • বুক ধড়ফড় করা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া।

  • ঘেমে যাওয়া।

  • সারা শরীর কাঁপতে থাকা।

  • শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।

  • দম আটকে আসা।

  • বুকে ব্যথা হওয়া।

  • মাথা ঘোরা, আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া, বোধশক্তি লোভ পাওয়া।

  • শরীর অসার হয়ে যাওয়া।

  • মাথা ব্যাথা

মানসিক

  • মুত্যুভয়

  • আতঙ্ক

  • তীব্র হতাশা

  • পাগল হয়ে যাচ্ছি এমন ভয় হওয়া

  • নিজের শরীর থেকে আলাদা হয়ে নিজেকে দেখতে পাচ্ছেন এমন একটি অনুভূতি হওয়া।

প্যানিক অ্যাটাক কতক্ষন স্থায়ি হয়?

প্যানিক অ্যাটাক এর সময় মানুষ ভেদে বিভিন্ন হতে পারে, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই  এটি ২০-৩০ মিনিট স্থায়ী হয় ও ৭-১০ মিনিট তীব্র পর্যায়টি চলে।

প্যানিক অ্যাটাক থেকে কি মৃত্যু হতে পারে? বিপদ গুলো কি কি?

প্যানিক অ্যাটাক থেকে মৃত্যু হবার সম্ভাবনা নেই। যদিও রোগীর মনেহয় সে মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে এসেছে। একটি গবেষণা মতে প্যানিক ডিসঅর্ডার রোগীর পরবর্তী জীবনে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। যদিও গবেষণার ভিত্তি কতটা শক্তিশালী তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তবে প্যানিক অ্যাটাক হলে, মনের দ্বিধা দূর করতে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া মনোবল বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। দীর্ঘদিন প্যানিক ডিসঅর্ডারে ভোগা মানুষের ভেতর আত্মহত্যা প্রবণতা দেখা দেওয়া অস্বাভাবিক নয়। এক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের সচেতন থাকা উচিত। তাছাড়া প্যানিক অ্যাটাক

  • কোন বিশেষ পরিস্থিতি বা জিনিসে ফোবিয়া তৈরি করতে পারে।

  • স্বাস্থ্য সম্পর্কে দুশ্চিন্তায় ভোগা।

  • সামাজিক যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি

  • ড্রাগ এডিকশন

  • শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে সমস্যা হওয়ার মত সমস্যা তৈরি করতে পারে।

যে যে কারণে প্যানিক অ্যাটাক/ ডিসঅর্ডার হতে পারে

প্যানিক ডিসঅর্ডার এর নির্দিষ্ট কোন কারণ নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। তবে বিশেষজ্ঞরা কিছু কারণকে দায়ী করে থাকেন। খুব বেশি সময় হতাশা বা খারাপ সময় পার করলে প্যানিক ডিসঅর্ডার হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অতীতের কোন যৌন হয়রানী, শারিরীক নির্যাতন, অতিরিক্ত ধুমপান বা মাদকাসক্তির ঘটনা প্যানিক ডিসঅর্ডার হবার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। কিছু জিনগত কারনেও প্যানিক ডিসঅর্ডার হতে পারে, তবে নির্দিষ্ট কোন জিন প্যানিক ডিসঅর্ডার এর জন্য দায়ি তা জানা যায় না। তবে পিতা-মাতার ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিসঅর্ডার থাকলে সন্তানের প্যানিক ডিসঅর্ডার হবার সম্ভাবনা থাকে।

প্যানিক অ্যাটাক হলে করনীয়

প্যানিক অ্যাটাক যেহেতু বেশি সময় স্থায়ী হয় না, মনে জোর নিয়ে ধৈর্য ধারণই প্রথমিক সমাধান। তাছাড়াও কিছু কাজ প্যানিক অ্যাটাকের তীব্রতা ও সময় দুটিই কমিয়ে আনতে পারে। যেমন:

১) মানসিক প্রস্তুতি

একবার প্যানিক অ্যাটাক দেখা দিলে পরবর্তী অ্যাটাকের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। অনেক সময় প্যানিক অ্যাটাক একই অবস্থায় থাকলে তীব্র আকার ধারণ করে। ঘর থেকে বারান্দায় গিয়ে বসাও অবস্থার উন্নতি করতে যথেষ্ট। কোথায় যাবেন, কাকে ফোন দেবেন আগে থেকে ঠিক করে রাখুন।

২) লম্বা শ্বাস নিন

প্যানিক অ্যাটাক শুরু হলে লম্বা লম্বা শ্বাস নিন। আস্তে আস্তে ছেড়ে দিন। শুরুতেই মস্তিষ্কে যথেষ্ট অক্সিজেন পৌঁছালে অ্যাটাকের তীব্রতা কমে আসবে। মনে মনে বলুন শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়াটা স্থায়ী নয়। শ্বাস নিয়ে চার পর্যন্ত গুনুন তারপর ছেড়ে দিন, আবার একই কাজ পুনরাবৃত্তি করুন, এতে একদিকে মনোযোগ থাকলে অ্যাটাকের তীব্রতা সেভাবে অনুভূত হবে না।

৩) মাসল রিল্যাক্সেশন পদ্ধতি

প্যানিক অ্যাটাকে মনে হয় আপনি শরীরের নিয়ন্ত্রন হারাতে চলেছেন, মাসল রিলেক্সেশন পদ্ধতি শরীরের নিয়ন্ত্রন রাখতে সাহায্য করবে। দুই হাত শক্ত করুন, তারপর ১০ পর্যন্ত গুনে হাত ছেড়ে দিন, আবার শক্ত করুন। এবার একই কাজ কাঁধ, ঘাড়, পেট, আর পা এও করুন। 

৪) মনোযোগ ঘোরানো চেষ্টা করুন

মনোযোগ অন্য দিকে ঘুরানোর চেষ্টা করুন, মনে মনে কোন অনুপ্রেরনা মূলক গান গান, ছোটবেলার একটা ছড়া মনে করার চেষ্টা করুন, পাশে কেউ থাকলে তার সাথে জোরে জোরে কথা বলুন। সময়টা দ্রুত কাটিয়ে দেওয়া গেলেই হলো। আশেপাশের জিনিস গুলো লক্ষ্য করুন, ফ্লোর এর টাইলস গুনুন, যেকোনো কিছুই কাজে লাগবে যদি একটু মনযোগ সরানো যায়।

প্যানিক অ্যাটাকের চিকিৎসা

কিছু ঔষধ ও মানসিক থেরাপি প্যানিক ডিসঅর্ডার নিরাময়ে বেশ কার্যকর। তার ভেতর CBT অর্থাৎ cognitive behavioral therapy সবচেয়ে কার্যকর বলে প্রমানিত।  এই থেরাপিতে থেরাপিস্ট শান্ত হওয়ার ট্রেনিং দেন, চিন্তা নিয়ন্ত্রন  ও মনের শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করেন। দেখা যায় বেশিরভাগ রোগীরই পরবর্তিতে প্যানিক অ্যাটাকের তীব্রতা ও সংখ্যা কমে আসে। এবং আস্তে আস্তে একেবারে নিরাময় হয়ে যায়। তাই, প্যানিক অ্যাটাক ডিসঅর্ডারে রূপ নেওয়ার আগেই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিৎ।

প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত কাউকে কিভাবে সাহায্য করবেন?

বন্ধু বা আপনজন কেউ প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্ত হলে তাকে আশ্বস্ত করুন, এটি শুধুমাত্র একটি প্যানিক অ্যাটাক ও কিছুক্ষনের মধ্যে এটা সেরে যাবে। তার পাশে থাকুন, জোরে জোরে শ্বাস নিতে বলুন। আশেপাশে অন্য কোথাও যেতে বলুন। আন্তরিকতা ও যত্নের সুরে কথা বলুন। প্যানিক অ্যাটাক সেরে গেলে কোন বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে উদ্বুদ্ধ করুন।

প্যানিক অ্যাটাক ও অ্যাংজাইটি (উদ্বেগ) অ্যাটাকের পার্থক্য

অনেক ক্ষেত্রে এরকম হলেও অ্যাংজাইটি অ্যাটাক ও প্যানিক অ্যাটাক আলাদা। অ্যাংজাইটি অ্যাটাকে মনে বিষন্নতা ও উদ্বেগ  ভর করে। যা প্যানিক অ্যাটাক এর থেকে অনেকাংশে কম তীব্র কিন্তু, অনেক বেশি সময় ধরে চলে। শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, দম আটকে আসা, বুক ধড়ফড় করা  অ্যাংজাইটি অ্যাটাকের উপসর্গ যা কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত চলতে পারে।

 

একটু সচেতনতা ও আশেপাশের মানুষদের একটু সহযোগিতা প্যানিক অ্যাটাক এর তীব্রতা কমাতে ও ডিসঅর্ডার থেকে নিরাময় পেতে সাহায্য করতে পারে। প্রবন্ধটি আপনার পরিবার ও বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন, যাতে এরকম সমস্যায় তারা করনীয় গুলো জানতে পারেন।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles