পরীক্ষার আগে মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধির ৯ টি উপায়

মানব মস্তিষ্ক সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে জটিল ও নিখুঁত জৈবিক যন্ত্রগুলোর একটা। সঠিকভাবে কাজে লাগালে এটির ক্ষমতা শত শত গুন বেড়ে উঠতে পারে। তবে কোন কিছুই বিনামূল্য নয়। ক্ষমতা শতগুন বৃদ্ধির জন্য পরিশ্রমও শতগুণই করতে হবে। আসুন জেনে নেই, কম সময়ের মধ্যে আসন্ন পরীক্ষার জন্য কিভাবে মস্তিষ্কের ক্ষমতা সর্বাধিক বাড়িয়ে তোলা যায়?

পরীক্ষা না থাকলে ছাত্রজীবন সুখের হতো কিনা সে বিতর্কে শিক্ষক, ছাত্র ও অভিভাবক সমাজে ভিন্ন ভিন্ন মতামত পাওয়া যাবে। তবে পরীক্ষা যে আপামর ছাত্রসমাজের কেউই পছন্দ করে না, সে কথা যেকেউই নির্দিধায় স্বীকার করবেন। 

সে কি এক গাধার খাঁটুনি! লাইনের পর লাইন পড়ে যাও তো পড়েই যাও, লিখে যাও তো লিখেই যাও, আবার পরীক্ষার হলে, কি পড়লাম আর কি শিখলাম সে হিসাব মিলানো ভার!

তবে এভাবে আর কতদিন চালিয়ে যাওয়া যায়। কতবার মনে হয় পড়ালেখা আরেকটু সহজ হলে কতই না ভালো হতো!

না, পড়ালেখা কেউ সহজ করে দেবে না। ক্লাস এইটে কেউ ABCD পড়তে দেবে না। কিন্তু আপনি চাইলে আপনার পড়ালেখা প্রক্রিয়া করার যন্ত্রটি অর্থাৎ মস্তিষ্ককে আপডেট করতে পারেন। পরীক্ষার হলে মস্তিষ্কের ঈর্ষনীয় ক্ষমতা নিয়ে ঢুকতে পারেন, ও সেরা শিক্ষার্থির মত পরীক্ষাটি নিমিষেই সম্পন্ন করতে পারেন। এটি শুধুই গল্প নয়, যথেষ্ট প্রচেষ্টার মাধ্যমে আপনি খুব সহজেই তা অর্জন করতে পারেন। আসুন তবে জানা যাক কিভাবে মস্তিষ্কের ক্ষমতাবৃদ্ধি করা যায়।

১. স্ট্রেস বা চাপ না নেওয়া

পরীক্ষার আগে স্ট্রেস বা চাপ চলে আসা যেন সূর্যের পূর্ব দিকে ওঠার মত স্বাভাবিক। আর পড়ালেখা একটু অগোছালো থাকলে তো কথাই নেই। তবে স্ট্রেস মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা প্রচন্ডভাবে কমিয়ে দেয়।

আমাদের ব্রেইনের হাইপোথ্যালামাস অংশটি শেখা, মনে রাখা ও স্মৃতি সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করে। ব্রেইনের কার্যকারিতার উপর নির্ভর করে প্রতিদিনই হাইপোথ্যালামাসে নতুন নিউরন সেল জন্ম নেয়। চাপ নেওয়া, দুশ্চিন্তা করা  ব্রেইনের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট করে, ক্ষমতা বৃদ্ধি তো বহুদূর। তাই চাপ না নেওয়া হবে আপনার প্রথম পদক্ষেপ।

এখন প্রশ্ন হলো চাপ কিভাবে কমাবেন। এর উত্তর হলো যে জন্য চাপ সেটি ঠিক করা শুরু করুন। পড়া বাকী থাকলে দ্রুত শুরু করুন, ভাইভাতে আটকে যাবেন ভেবে চাপ লাগলে, কথা বলা প্রাক্টিস করুন। প্রস্তুতি যত ফেলে রাখবেন তত চাপ বাড়বে ও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা কমবে। চাপমুক্ত থাকা পরবর্তি টিপস গুলোর জন্য জরুরী।

২. ঘুমকে প্রয়োজনে ব্যবহার করুন

দৈনিক অন্তত ৭ ঘন্টা ঘুম প্রয়োজন সে তো পুরোনো খবর। পুরোনো হলেও গুরুত্বপূর্ণ তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের মস্তিষ্কের ক্ষয় পূরণ ও বৃদ্ধি সাধনের মূল কাজটি হয়ে থাকে আমদের ঘুমানোর সময়। তাই পরীক্ষার আগে কিছুতেই ঘুমের সাথে কোন আপস নয়।

পুরোনো খবর রিভিশন হলো। চলুন ঘুম নিয়ে নতুন কিছু জানা যাক। আমাদের ঘুমের বিভিন্ন পর্যায় থাকে। ঘুমের প্রথম ৩০ মিনিট সারাদিন আমরা যা নতুন তথ্য এলোমেলো ভাবে আমাদের ব্রেইনে সংগ্রহ করি তা মোটামুটি একটু গুছিয়ে আমাদের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়। ঘুমের পরবর্তি অংশ গুলোতে ব্রেইনের ক্ষয় পূরণ ও বৃদ্ধিসাধনের কাজ চলে। ঠিক এই ব্যাপারটিকে আমরা আমাদের প্রয়োজন মত ব্যাবহার করতে পারি। বলছি কিভাবে।

পরীক্ষার সময় সাধারণত লম্বা সময় এমনকি সারাদিনই পড়ালেখা করার প্রয়োজন পড়ে। খেয়াল করে থাকবেন, সকালে ওঠার প্রথম দুই ঘন্টা আমাদের মস্তিষ্ক সবচেয়ে সচল থাকে, কঠিন বিষয় সহজে আয়ত্বে আনা যায়। কেমন হতো যদি তেমন সক্রিয়তা সারাদিন থাকতো? এটি কিন্তু আসলেই সম্ভব।

আমাদের মস্তিষ্কের ক্লান্তি দূর করতে প্রয়োজন হয় সর্বচ্চ ৩০ মিনিটের ঘুম। ৩০ মিনিটের মাঝে মস্তিষ্ক সকল তথ্য গুছিয়ে লম্বা ঘুমের প্রস্তুতি নেয়। ঠিক এখানেই আমরা আমাদের ব্রেইনেরর সাথে ট্রিক করতে পারি।

দীর্ঘক্ষন পড়ার পর যখন মাথা ব্যাথা শুরু হয়ে যায়, ও আর কোন তথ্য মাথায় ঢুকতে চায় না, তখন ফোনটা হাতে নেওয়ার চাইতে ঠিক ২০ মিনিটের একটা ন্যাপ বা ছোট ঘুম দিন। এই সময় ১০ ও ১৫ মিনিটও করতে পারেন, আপনার ক্লান্তির পরিমান ও রিফ্রেশমেন্টে  প্রয়োজন ভেদে। কিন্তু ২০-২৫ মিনিটের উপরে গেলে শরীর দীর্ঘ ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলবে, তখন ক্লান্তি বোধ হতে পারে। এতে করে আপনার মস্তিষ্ক পুনরায় প্রায় ৮০-৯০% কর্মদক্ষতার সাথে কাজ করতে সক্ষম হবে। এর মাঝে যা পড়েছিলেন তাও মনে রাখতে সাহায্য হবে।

৩. ব্রেইনের জন্য পুষ্টিকর খাবার

কথায় আছে তুমি যা খাও তুমি তাই হবে। আমরা যা খাই তার দ্বারা আমাদের মস্তিষ্কের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রিত হয়। কিছু খাবার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। যেমন ধরুন হলুদ। হলুদে থাকা সারকিউমিন ব্রেইণের ডোপামিন ও সেরাটোনিন হরমোন রিলিজ বাড়িয়ে তোলে যা মুড ভালো রাখতে সাহায্য করে।

ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্কের শেখা ও মনে রাখার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এটি তেল সমৃদ্ধ মাছে প্রচুর পরিমানে থাকে। তাই পরীক্ষার আগে মাছ খাওয়া বাড়িয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হতে পারে।

তাছাড়া কুমড়ার বীজ, বাদাম, মটরশুটি, ডার্ক চকলেট, গ্রিন টি ও কফিতে মস্তিষ্ককে সুস্থ্য রাখা ও কার্যক্ষমতা বাড়ানোতে ভূমিকা রাখে।

৪. খাবার দিয়ে নিজ মস্তিষ্ক হ্যাক করুন

অনুচ্ছেদের শিরনামটি একটু অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু কিছু খাবার দিয়ে আসলেই ব্রেইনের কর্মক্ষমতা বাড়ানো যায়। শরীরের যেকোন পেশির মত মস্তিষ্কও ব্যবহারে ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়ে, কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। আসুন দেখা যাক এই সমস্যাটি পরীক্ষার হলে কিভাবে সমাধান করা যায়।

আমাদের ব্রেইনে যখন ডোপামিন এর প্রভাবে সুখানুভূতি পায়, সে অবসাদ ভুলে নতুন উদ্যোমে কাজ করতে পারে। যেমন ধরুন একটি প্রশ্নের উত্তর খুব সুন্দর ভাবে লিখতে পারলে আপনার মস্তিষ্কে সুখানুভূতি হবে ও পরের প্রশ্নটাও মন দিয়ে লিখবেন। 

এটি অনুকরণ করা যায় মিষ্টি স্বাদ দিয়ে। মিষ্টি জিনিস আমাদের মস্তিষ্কে সুখানুভূতি দেয় যা পরবর্তিতে মনোযোগ ধরে রাখার জন্য সহায়ক হতে পারে। তাই পরীক্ষার হলে শুধু পানির বদলে ফলের জুস বা গ্লুকোজ জাতীয় তরল রাখুন। মাথা ক্লান্ত হয়ে গেলে মিষ্টি জাতীয় পানীয় গ্রহণ মস্তিষ্ককে আরাম দেবে। যদিও এটি সবসময় করার ঠিক নয়, কারণ অতিরিক্ত চিনি মস্তিষ্ককে অলস করে দিতে পারে।

পরীক্ষার হলে খাওয়া দাওয়া করার নিয়ম যদিও নেই। তবু স্যারের চোখ বাঁচিয়ে একটা ডার্ক চকলেট খেয়ে নিলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়বে। 

পরীক্ষার হলে দেখা যায় শুরুতে আমাদের সম্পুর্ণ সক্রিয় হতে অনেক সময় লেগে যায়। সামান্য কটা প্রশ্ন লিখতেই এক ঘন্টা চলে যায়। এটি দূর করার জন্য, হলে ঢোকার আগে আগে কফি খাওয়া বেশ উপকারী হতে পারে। কফি আমাদের মস্তিষ্কের সক্রিয়তা অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে। আজকাল সবজায়গায় ইন্সট্যান্ট কফি পাওয়া যায়। আর হ্যাঁ সকালে পেটভরে পুষ্টিকর খাবার খেয়ে আসতে ভুলবেন না!

৫. গান শুনুন

বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে গান বা বাজনা শোনা আমাদের ম্যামরি বাড়াতে সাহায্য করে। তাই পড়া শুরু করার আগে দুটো গান শুনতে পারেন।

৬. প্রিয়জনের সাথে আনন্দময় সময় কাটান

ভালোবাসা ও স্নেহের সম্পর্ক গুলো আমাদের ব্রেইনে কিছু অতি প্রয়োজনীয় ক্যামিকেল রিলিজ করে যা ব্রেইনের সুস্বাস্থ্যে দরকারি। কিছুটা সময় মা-বাবা-ভাই-বোন কিংবা বন্ধু-প্রিয়জনকে দিন। পরীক্ষায় শুধু সারাদিন পড়তে হবে সে বহু সেকেলে কথা!

৭. ব্যায়াম করুন

সুস্থ্য সবল মন একটি সবল কর্মক্ষম দেহ ছাড়া সম্ভব নয়। ব্যায়াম মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই পরীক্ষার সময় অন্তত ১০-১৫ মিনিট ব্যায়াম করুন। পরীক্ষার দিনও সকালে ব্যায়াম করতে ভুলবেন না।

৮. বিনাকারণে হলেও ওয়াশরুমে যান

আমাদের মস্তিষ্ক একটানা কাজ করার ক্ষেত্রে খুব বেশি ভালো নয়। সামান্য হলেও বিরতি প্রয়োজন, আর বিরতির সময় বাইরের হাওয়া-বাতাস খেয়ে আসা গেলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। শিক্ষক সমাজ আমার এই উপদেশ ইতিবাচক ভাবে নেবেন সে আশা অবশ্য রাখছি না!

৯. পর্যাপ্ত পানি পান করুন

আমাদের মস্তিষ্কের শতকরা নব্বই ভাগ পানি। মস্তিষ্কের পানির পরিমান যদি মাত্র দু-ভাগও কমে তাহলেও মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। তাই পরীক্ষা ও পড়ালেখার সময় (সবসময়) পর্যাপ্ত পানি পান করুন।

শেষ কথা

পরীক্ষার আগে মস্তিষ্কের কার্মদক্ষতা বাড়ানোর বেশ কিছু টিপস জানা হলো, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টিপসটি এখনো উল্লেখই করা হয়নি। আর তা হলো, নিয়মিত পড়ালোখা করা। ঠিকভাবে না পড়ে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা যেন চাকা ছাড়া গাড়ি চালোনোর প্রচেষ্টার মতো। নিয়মিত পড়ালেখার সাথে সাথে উপরের টিপসগুলো মেনে চলুন, নিজের মস্তিষ্কের সর্বচ্চ দক্ষতা পরীক্ষায় কাজে লাগাতে পারবেন। কিছু অপ্রথাগত টিপসও দিয়েছি, আশা করি শিক্ষা অধিদপ্তর কিছু মনে করবেন না।

আরো পড়ুনঃ

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles