এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হলে করণীয়!

অ্যান্টিবায়োটিক কি ও এর ইতিহাস, বিভিন্ন প্রকার অ্যান্টিবায়োটিকের রেজিস্ট্যান্স হওয়ার সম্ভাবনা। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে আমাদের অসচেতনা ও ভ্রান্ত ধারণা

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে আবিষ্কৃত যে জীবন রক্ষাকারী ঔষধগুলো মানব জাতিকে প্রতিনিয়ত রক্ষা করে চলেছে, তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হবে আ্যন্টিবায়োটিকের কথা। বিভিন্ন রকম ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের বিরুদ্ধে এই অ্যান্টিবায়োটিকই আমাদের প্রধান হাতিয়ার। কিন্তু জীবন রক্ষাকারী এই ঔষধের ক্ষমতা কমে যাবার একটি ঘটনার কথা আমরা প্রায়শই শুনতে পাচ্ছি, ডাক্তারি পরিভাষায় যার নাম দেওয়া হয়েছে  'অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স'। এই কথাটার মানে হল প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলো তাদের কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলছে এবং বিভিন্ন অণুজীব বা মাইক্রোঅর্গানিজমের বিরুদ্ধে আর আগের মতো কাজ করছে না। বিভিন্নভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার আর অকারণে ঔষধের প্রয়োগকে অনেক ক্ষেত্রেই এই রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টির জন্য দায়ী করা হয়। এখন প্রশ্ন হল, এই সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাগুলো কতখানি ঠিক? এর উত্তর পেতে হলে আমাদের একটু ইতিহাসের দিকে ঘুরে তাকাতে হবে। 

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রথম কিভাবে তৈরি হলো?

অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের কথা বলতে গেলে হয়তো অনেকের মনে পেনিসিলিনের নাম ভেসে উঠবে, যদিও প্রথম আবিষ্কৃত সফল ক্লিনিকাল অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল এজেন্ট-এর নাম ছিল প্রন্টোসিল রূবরাম, যেটা ১৯৩১ সালে আবিষ্কৃত একটা 'সালফা ড্রাগ'। কিন্তু ইতিহাসের প্রথম  অ্যান্টিবায়োটিক আর তার উদ্ভাবককে খুঁজে পেতে হলে আমাদের আরো বহু যুগ আগে ফিরে যেতে হবে এবং মজার ব্যাপার হল এই আবিষ্কর্তা কোন মানুষ ছিলেন না।

জীনগত বিশ্লেষণ আমাদের বলছে আনুমানিক দুইশত কোটি বছর আগে ব্যাকটেরিয়াদের মাধ্যমেই প্রথম 'অ্যান্টিবায়োটিক' এবং 'অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স', দুটো জিনিসই সৃষ্টি হয়। জৈবিক ভাবে সৃষ্ট এই অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে ব্যাকটেরিয়ারা ব্যবহার করতো একে অপরকে নিধনের জন্য, আর রেজিস্ট্যান্সকে তারা ব্যবহার করত এসব অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা কবচ হিসেবে।  অর্থাৎ মানুষ যত দিনে গবেষণাগারে কৃত্রিম অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেছে তার বহু লক্ষ বছর আগে থেকেই পৃথিবীর প্রাণী জগতে প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিকের অস্তিত্ব ছিল।

এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় ২০১১ সালের একটি সমীক্ষা থেকে যেটা পরিচালিত হয়েছিল আমেরিকার নিউ মেক্সিকো প্রদেশে। তখন মাটির গভীরের একটি গুহার নেটওয়ার্ক থেকে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া উত্তোলন করা হয় যেগুলো অন্তত চল্লিশ লাখ বছর ধরে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সংস্পর্শে আসেনি। এই ভূগর্ভস্থ গুহাগুলো এর আগে কখনোই মানুষের সংস্পর্শে আসেনি। যে বিজ্ঞানীরা এই অভিযানটির দায়িত্বে ছিলেন তারা গুহাগুলোর দেয়াল থেকে প্রাকৃতিক ভাবে সংরক্ষিত অবস্থায় বেশ কিছু ব্যাকটেরিয়ার নমুনা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন। তখন দেখা যায় এই আদিম ব্যাকটেরিয়াগুলোও অন্তত একটি এবং অনেক ক্ষেত্রে একাধিক আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে 'রেজিস্ট্যান্স' প্রদর্শন করছে। এবং দেখা যায় এই রেজিস্ট্যান্স প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এবং গবেষণাগারে তৈরি উভয় প্রকার অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধেই দেখা যাচ্ছে! এই প্রতিরোধ ব্যবস্থা এমন কিছু গবেষণাগারে তৈরি কৃত্রিম ঔষধের বিপক্ষেও পরিলক্ষিত হয় যেগুলো  আশির দশকের আগে আবিষ্কৃত হয়নি। এর মধ্যে লিনেজোলিড, ড্যাপ্টোমাইসিন এবং ফ্লুরোকুইনোলন এর মতো আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিকও অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর শতকোটি বছরের বিবর্তনের ফল স্বরূপ অণুজীবগুলো সব রকম অ্যান্টিবায়োটিক এর বিরুদ্ধেই প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, এমনকি এখন পর্যন্ত যে অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়নি তার ক্ষেত্রেও রেজিস্ট্যান্স অর্জন করা সম্ভব!

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স নিয়ে আমাদের সমাজের প্রচলিত ধারণাসমূহ

১.  অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারই কি শুধু দায়ী?

অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কিত একটা বহুল প্রচলিত ধারণা হল, যদি আমরা এর অপব্যবহার বন্ধ করতে পারি তাহলে সহজেই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধ করা সম্ভব। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক এবং ভুল দু'রকম প্রয়োগই রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। এর কারণ হলো যখনই কোন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয় সেটি অসংখ্য অণুজীব নিধনের মাধ্যমে প্রকৃতিতে বিদ্যমান সকল ব্যাকটেরিয়াকুলের উপরে 'সিলেক্টিভ প্রেসার' তৈরি করে। এবং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই অনুজীবদের জন্য অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়। সঠিক হোক বা অপ্রয়োজনীয়, সব রকম ঔষধ প্রয়োগের ক্ষেত্রেই কিন্তু এই সিলেকটিভ প্রেসার সৃষ্টি হয়। আসলে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়েই অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের বিপক্ষে প্রধান যুক্তি হলো এতে রোগ নিরাময়ে আমাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। আর অ্যান্টিবায়োটিক এর সঠিক ব্যবহার করতেই হবে কারণ অনেক মারাত্মক ব্যাধি সৃষ্টিকারী অণুজীবের বিরুদ্ধে এটাই আমাদের প্রধান অস্ত্র। অর্থাৎ স্বীকার করে নিতেই হবে যে অ্যান্টিবায়োটিক এর সঠিক প্রয়োগও রেজিস্ট্যান্স তৈরিতে ভূমিকা রাখে কিন্তু রোগ নিরাময়ের স্বার্থে সেটা গ্রহণ করা ব্যতীত আমাদের উপায় নেই।

এক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হল অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার আমাদের বন্ধ করতে হবে ঠিকই, কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা রেজিস্ট্যান্সতৈরি হওয়া সম্পূর্ণ প্রতিরোধ করতে পারবো না। তবে অপপ্রয়োগ বন্ধ হলে এতে রেজিস্ট্যান্স তৈরির প্রবণতা ধীর হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। অ্যান্টিবায়োটিক যখন আমরা সঠিক ভাবে ব্যাবহার করি তখন এতে রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা থাকলেও সেটা বিভিন্ন মারাত্মক রোগ ও মৃত্যু হার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় রাখতে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে অপ্রয়োজনীয় ঔষধের প্রয়োগ অণুজীব সমূহের মধ্যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সৃষ্টি করে আমাদের ক্ষতি সাধন করে কিন্তু এর বিনিময়ে কিছুই অর্জিত হয় না। সে জন্যেই বলতে হয়, সঠিক প্যাথলজিক্যাল টেস্ট এর মাধ্যমে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তবেই উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়।

২. রোগ সেরে গেলেও কি অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে যেতে হবে?

জনমনে প্রচলিত আরো একটা ধারণা হলো, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বন্ধ করার জন্য রোগীদের সবসময় ঔষধের সম্পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করতে হবে, এমনকি তারা সবগুলো ঔষধ খাবার আগে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেলেও। কিভাবে এই ধারণা এত জনপ্রিয় হলো সে সম্পর্কে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া না গেলেও অন্তত গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক থেকে এই তত্ত্বের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এই মতবাদ ব্যাপক ভাবে মানুষ বিশ্বাস করে যে সংক্রমণের সকল লক্ষণ কমে যাওয়া সত্ত্বেও অ্যান্টিবায়োটিক পূর্ণ মেয়াদে ব্যবহার করলে তা রেজিস্ট্যান্স তৈরির বিপক্ষে কাজ করবে। কিন্তু এর স্বপক্ষে তথ্য উপাত্ত পাওয়া দুষ্কর বরং বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত মেডিকেল স্টাডিগুলো থেকে এর বিপক্ষে একাধিক যুক্তি পরিলক্ষিত হয়েছে। অনেক গবেষক মনে করেন এই ধারণা প্রচলনের পেছনে যতটা না ঔষধের কার্যকারিতার বিষয়টি থাকে তার চেয়ে বেশি থাকে উৎপাদনকারীদের বেশি ঔষধ বিক্রয়ের চিন্তা।

যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি (সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল ) এবং যুক্তরাজ্যের পিএইচই (পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড) ইতোমধ্যেই "অ্যান্টিবায়োটিক এর কোর্স সম্পন্ন করতে হবে" এই স্লোগানটির পরিবর্তে "পুরোপুরি ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী" কথাটি প্রয়োগ করা শুরু করেছে।

প্রাকৃতিক বিবর্তনের সূত্র বলছে স্বল্প মেয়াদী ঔষধের প্রয়োগ যেহেতু অণুজীবগুলোকে ঔষধের সাথে পরিচিত হতে কম সময় দিচ্ছে এতে রেজিস্ট্যান্স তৈরির প্রবণতা হ্রাস পাওয়া উচিত। একাধিক রেনডমাইজড (এলোমেলোভাবে নিয়ন্ত্রিত) ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যখনই তীব্র ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণের জন্য স্বল্প মেয়াদি আর দীর্ঘ মেয়াদি অ্যান্টিবায়োটিক কোর্সের কার্যকারিতা নিয়ে তুলনা করা হয়েছে, দেখা গেছে স্বল্পমেয়াদি কোর্সগুলো সমভাবেই রোগ নিরাময়ে কার্যকরী হচ্ছে। এই একই ফলাফল একাধিক ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের ক্ষেত্রে (তীব্র ব্যাকটেরিয়া জনিত সাইনোসাইটিস, সেলুলাইটিস, কমিউনিটি অ্যাকোয়ার্ড নিউমোনিয়া, নসোকমিয়াল নিউমনিয়া, ভেন্টিলেটর জনিত নিউমোনিয়া,  ইউরিনারি ট্র্যাক্ট এর সংক্রমণ, পরিপাকতন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল সংক্রমণ) পাওয়া গেছে। অর্থাৎ রোগ অনুযায়ী উপযুক্ত স্বল্প মেয়াদী অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োগ রেজিস্ট্যান্স তৈরীর বিরুদ্ধে একটা অস্ত্র হতে পারে এবং রোগীরা যদি সাধারণ সংক্রমণ নিরাময়ের ক্ষেত্রে সুস্থ অনুভব করে তাহলে তারা আগে-ভাগেই অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স শেষ করার ব্যাপারটি চিকিৎসকের সাথে পরামর্শের জন্য বিবেচনা করতে পারে। তবে কিছু ক্রনিক ইনফেকশনের ক্ষেত্রে (যেমন অস্টিওমায়েলাইটিস, যক্ষা, অ্যাকটিনোমাইকোসিস) সবসময়ই অ্যান্টিবায়োটিকের পূর্ণ কোর্স শেষ করা উচিত। অর্থাৎ সংক্রমণ নিরাময় হবার পরেও অ্যান্টিবায়োটিকের দীর্ঘ ব্যবহার আমাদের কোন সুবিধা দেয় না বরং এটা রেজিস্ট্যান্স তৈরিতে সম্ভাব্য ভূমিকা রাখতে পারে।

৩. জীবাণু কিভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে?

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স প্রথম কিভাবে সৃষ্টি হলো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই মনে করা হয় সংক্রমনের মূল জায়গায় ('সাইট অফ ইনফেকশন') আক্রমণকারী ব্যাকটেরিয়া 'মিউটেশন' বা জেনেটিক শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে এই প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে। একথা সত্য যে যক্ষ্মা সৃষ্টিকারী অণুজীবগুলোর বেলায় আসলেই তা হয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ সাধারণ ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের সাথে যক্ষ্মার কিছু বিশেষ পার্থক্য আছে।

মানুষের চামড়ায়, অন্ত্রে এবং শরীরের অন্যান্য অংশে সাধারণত একশো ট্রিলিয়ন এর উপর অণুজীব বাস করে যেগুলো মানব দেহের জন্য উপকারীও হতে পারে আবার রোগ সৃষ্টিকারীও হতে পারে। এই অণুজীবদের বলা হয় 'ন্যাচেরাল ফ্লোরা'। কিন্তু যক্ষ্মার জীবাণুগুলো প্রকৃতি আর প্রাণীদেহে প্রাপ্ত সাধারণ ব্যাকটেরিয়াদের অন্তর্ভুক্ত নয়। এ কারণে যক্ষ্মার বেলায় রেজিস্ট্যান্স সাধারণত সংক্রমণের মূল জায়গাতেই তৈরি হয়। এসব সাইটে যক্ষ্মা অণুজীবের ঘনত্বও অন্যান্য সংক্রমনের তুলনায় খুব বেশি থাকে (কোন কোন ক্ষেত্রে  সংক্রমণের উৎসে প্রতি গ্রামে অণুজীবের সংখ্যা ১ লক্ষ কোটির বেশি হতে পারে)। এর ফল স্বরূপ যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণকারি অ্যান্টিবায়োটিকগুলো (যেমন আইসোনিয়াজিড এবং রিফাম্পিন) প্রয়োগের ক্ষেত্রে সংক্রমণ স্থলে রেজিস্ট্যান্স তৈরীর সম্ভাব্যতা বেড়ে যায়।

মনে রাখতে হবে, যে কোনো রকম মনোথেরাপির জন্য (যেখানে একটি মাত্র ঔষধের মাধ্যমে মাইক্রোঅরগানিজমগুলোকে প্রতিহত করা হচ্ছে) স্বতস্ফূর্ত মিউটেশনের বা জেনেটিক রূপান্তরের মাধ্যমে আক্রমণকারী অণুজীব প্রতিরোধ অর্জন করতে পারে। কিন্তু আইসোনিয়াজিড ছাড়া অন্যান্য সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির দেহে প্রাকৃতিক ভাবে বিদ্যমান এবং ন্যাচারাল ফ্লোরার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার ওপরেও 'সিলেক্টিভ প্রেশার' তৈরি হয়। এই ক্ষেত্রে কেবল মূল সংক্রমনের জায়গায় নয় বরং দেহের অন্যত্র (যেমন ত্বক এবং পরিপাকতন্ত্রে) জীনগত যোগাযোগের এর মাধ্যমে প্রতিরোধ তৈরি হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়।

লক্ষণীয় যে ব্যাকটেরিয়ার দেহে আগে থেকেই বিদ্যমান প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রবণতা বিভিন্ন জেনেটিক উপাদান (যেমন- ডিএনএ ফ্রাগমেন্ট, প্লাসমিড, ট্রানসপোসন, ফেইজ) এর মাধ্যমে এই শেয়ারিংয়ে ভূমিকা রাখতে পারে। আসল কথা হলো, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একজন রোগীর দেহে কখন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হবে তা আমাদের জানা সম্ভব নয়। একটি সংক্রমণের জন্য দীর্ঘদিন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে একজন রোগী সুস্থ হয়ে উঠলে আমরা মনে করতে পারি এক্ষেত্রে কোন রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়নি। কিন্তু এমন হতে পারে তার দেহের প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়াগুলোর একটা অংশ সুপ্ত ভাবে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করেছে যা ভবিষ্যতে নতুন করে রেজিস্ট্যান্স সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

৪. কোন অ্যান্টিবায়োটিকটির রেজিস্ট্যান্স তৈরীর সম্ভাবনা কম?

বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে সাধারণত দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়:

  •  স্ট্যাটিক অ্যান্টিবায়োটিক: স্ট্যাটিক (পূর্ণ নাম ব্যাকটেরিওস্ট্যাটিক) অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণকে বাধা দেয় তবে ব্যাকটেরিয়াগুলিকে মেরে ফেলতে পারে না। রোগীর নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা ব্যাকটেরিয়ার মৃত্যুর জন্য দায়ী। উদাহরণ: এজিথ্রোমাইসিন, ক্লোরামফেনিকল, ডক্সিসাইক্লিন, লিনেজোলিড, টিজেসাইক্লিন এবং

  •  সাইডাল অ্যান্টিবায়োটিক: সাইডাল (পূর্ণ নাম ব্যাকটেরিসাইডাল) অ্যান্টিবায়োটিক রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতা ব্যবস্থার উপরে নির্ভর না করেই ব্যাকটেরিয়াকে মেরে ফেলে। উদাহরণ: লিভোফ্লক্সাসিন, সেফিক্সিম, সেফালোস্পোরিন, রিফালাজিল, সেফট্রিয়াক্সোন, ভ্যানকোমাইসিন, রিফাম্পিন, জেন্টামাইসিন, ফ্লুরোকুইনোলোন, ইমিপেনেম। 

অনেকেই কোন প্রমাণ ছাড়াই মনে করেন সাইডাল অ্যান্টিবায়োটিকগুলো রোগ নিরাময়ের জন্য অধিক কার্যকরী এবং এতে রেজিস্ট্যান্স তৈরীর সম্ভাবনাও হ্রাস পায়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্ট্যাটিক অ্যান্টিবায়োটিকগুলোও ঠিকই ব্যাকটেরিয়া বিনাশ করতে পারে, কেবল তফাৎ হলো সাইডাল ঔষধের তুলনায় স্ট্যাটিক নমুনাগুলো অধিক ঘনত্বে প্রয়োগ করতে হয়। এক্ষেত্রে MBC (minimum bactericidal concentration) এবং MIC (minimum inhibitory concentration) নামের দুটি টেকনিক্যাল টার্ম ব্যবহার করা হয়। MBC  ঔষধের সেই ঘনত্ব নির্দেশ করে যা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ এক হাজার গুণ কমিয়ে আনতে পারে। আর MIC সেই ঘনত্বের পরিমাপক যা ব্যবহার করলে ২৪ ঘন্টা পর আর মাইক্রোঅরগানিজম সমূহের বৃদ্ধি পাওয়া দৃশ্যমান থাকে না। সাইডাল এবং স্ট্যাটিক দুরকম অ্যান্টিবায়োটিকই অণুজীব বিনাশে কার্যকরী কিন্তু সাইডাল অ্যান্টিবায়োটিকের বেলায় MBC-র মান MIC-র তুলনায় চারগুণ এর বেশি থাকে না। অন্যদিকে স্ট্যাটিক এন্টিবায়োটিকের জন্য MBC-র মান MIC-র তুলনায় আট গুণ বা তারও বেশি থাকতে পারে।

অনেক চিকিৎসক  সাইডাল অ্যান্টিবায়োটিক বেশি পছন্দ করে থাকলেও কার্যকারিতার দিক দিয়ে দুটির কোনটিকেই বেশি ভালো বলা উচিত হবে না এবং রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে স্ট্যাটিক বা সাইডাল গোত্রের বিভাজন না করে বরং সঠিকভাবে সনাক্তকরণ এবং সেই অনুযায়ী ঔষধ দেবার ওপর মনোযোগ দেওয়া উচিত।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি এড়ানো যাবেই না?

পরিশেষে বলতে হয়, ব্যাকটেরিয়াদের সাথে মানব জাতির যুদ্ধ কখনো শেষ হবার নয়। এই যুদ্ধে 'জয়ী' হওয়া খুব কঠিন এবং আমাদের সব রকম রেজিস্ট্যান্স থেকে রক্ষা করার জন্য কোন 'সুপার অ্যান্টিবায়োটিক' আবিষ্কারের চিন্তা করা কেবলই বাতুলতা হবে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স যে তৈরি হবেই সেটা আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। তাই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা যেন কখনো অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার না করি। ভাইরাস এবং ব্যাক্টেরিয়ার রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া যেহেতু সম্পূর্ণ আলাদা তাই ভাইরাল ডিজিজ যেমন ঠান্ডা অথবা ফ্লুতে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অনুচিত। যথাযথ ল্যাবরেটরি টেস্ট এর মাধ্যমে সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই কেবল উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়। সব সময় ব্রড স্পেক্ট্রাম (যেগুলো বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী) অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের চিন্তা না করে সম্ভব হলে ন্যারো স্পেকট্রাম (সিলেকটিভ ব্যাকটেরিয়ার ক্ষেত্রে কার্যকরী) ঔষধ স্বল্প মেয়াদী কোর্স এর অংশ হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। রোগী যদি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে তাহলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে পূর্ণ কোর্স শেষ হবার আগেই ঔষধ খাওয়া বন্ধ করার ব্যাপারটা বিবেচনা করা যেতে পারে। ঔষধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্ট্যাটিক আর সাইডাল অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে বিভাজন না করাই শ্রেয়। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স সম্পর্কে আমাদের সর্বদা সচেতন থাকতে হবে এবং মনে রাখা উচিত যত আমরা অ্যান্টিবায়োটিক বেশি ব্যবহার করব ততোই বিবর্তনের সূত্র অনুসারে রেজিস্ট্যান্স তৈরি হবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। তাই সব সময় ব্যাকটেরিয়াল সংক্রমণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েই কেবল রোগীকে উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হবে।


 

Default user image

প্রকৃতি চক্রবর্ত্তী, লেখক, আস্থা লাইফ

পেশাগত ভাবে একজন ফার্মাসিস্ট এবং মনোজগতে একজন স্বপ্নচারী।ফার্মেসীর উপর স্নাতকোত্তর করার পর পাঁচ বছরেরও বেশী সময় ধরে কাজ করছেন দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট বিভাগে।পাশাপাশি ভালবাসেন বই পড়তে ও লিখতে।প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন একদিন সব অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে সুশিক্ষার আলো আসবেই।স্বপ্ন দেখেন বিশ্বপর্যটক হবার আর মানুষের জন্য কিছু করার।

Related Articles