খাবারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ কমানোর ৮ টি উপায়

এই ফাস্ট ফুড, ইন্সট্যান্ট ডেলিভারী আর ফুড ব্লগের যুগে ভোজন রসিক মানুষেরা ফুড ক্রেভিং বা খাবারের প্রতি তীব্র আকর্ষণ এর সমস্যায় প্রায়ই ভুগে থাকেন। এতে যেমন মানসিক শান্তি নষ্ট হয়, তেমনি স্বাস্থ্যও যায় রসাতলে। আসুন এই কনটেন্টে জানি কিভাবে ফুড ক্রেভিং এর যুদ্ধ ছেড়ে খাবারের সাথে শান্তিচুক্তি করবেন।

মাঝে মাঝে মনে হয় না, ঠিক এই জিনিসটা না খাওয়া পর্যন্ত ভালোই লাগবে না। মনের ভেতর অস্বস্তি বাড়তে থাকে। ইচ্ছা পূরণ করার পরে তবেই এই অস্বস্তি কমে। এটা সব মানুষেরই হয়ে থাকে। অস্বাস্থ্যকর বিবেচনায় স্বাভাবিক মানুষ এই অনুভূতিটা চাপিয়েও যেতে পারেন। কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এটা ঘন ঘন হয় আর নিয়ন্ত্রণও কঠিন হয়ে থাকে। ফুড ক্রেভিং নিয়ন্ত্রণ এর বাইরে গেলে ওজন বেড়ে যাওয়া সহ নানা ধরণের সমস্যা তৈরি হয়। আসুন জেনে নেই কিভাবে ফুড ক্রেভিং নিয়ন্ত্রণ করবেন।

 

ফুড ক্রেভিং বা খাবারের তীব্র আকাঙ্ক্ষা কী?

ফুড ক্রেভিং হল ক্ষুধা না থাকা সত্ত্বেও নির্দিষ্ট কোন খাবারের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা। এটি সাধারণ খিদের চেয়ে ভিন্ন। বিভিন্ন প্রকার খাবারের প্রতি ক্রেভিং হতে পারে। তবে মিষ্টি জাতীয় খাবার কিংবা চর্বিযুক্ত এবং জাঙ্ক ফুড এর প্রতি ক্রেভিং বেশি  হয়ে থাকে। ফুড ক্রেভিং এর কারণে  ওজন বাড়তে পারে।

 

ফুড ক্রেভিং কেন হয়?

ফুড ক্রেভিং হবার কারণ গুলো হলো-

হরমোনের ভারসাম্যহীনতা

লেপটিন ও সেরোটোনিনের মতো হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে ফুড ক্রেভিং হতে পারে।

গর্ভাবস্থা 

গর্ভকালে প্রসূতি মায়েদের ফুড ক্রেভিং হতে পারে। কারণ এ সময় দেহে নানা রকম হরমোনের পরিবর্তন হয় এটি ফুড ক্রেভিং এর কারণ হতে পারে। 

কম ঘুমের প্রভাব

আমাদের অবশ্যই সর্বনিম্ন ৬ ঘন্টা ঘুমাতে হয়। কিন্তু ঘুমের ঘাটতির কারণে গ্রিলান নামক হরমোনের নিঃসরণ বেড়ে যায় আর এই হরমোন আমাদেরকে খিদের বার্তা পাঠায়। তাছাড়া কম ঘুমের কারণে ইনসুলিনের মাত্রাও বেড়ে যায়  ফলে সুগার বা কার্বোহাইড্রেট এর চাহিদাও বাড়ে। 

ইমব্যালেন্সড ডায়েট

যে খাদ্য তালিকায় প্রোটিন এবং ফাইবারের অভাব থাকে তা আমাদের দেহে পর্যাপ্ত পুষ্টি যোগাতে পারে না। তাই কিছু সময় পর আবার ক্ষুধা অনুভব হয়। এটিও ফুট ক্রেভিং এর কারণ। 

ডিহাইড্রেশন

দেহে পানির অভাব লিভারের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে, যা সবসময় ক্ষুধাভাব এর সমস্যা তৈরি করে।

দৈহিক পরিশ্রমের অভাব

দৈহিক পরিশ্রম দেহের হরমোনের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। বিপরীত পক্ষে শরীরচর্চা বা দৈহিক পরিশ্রমের অভাবের কারণে ফুড ক্রেভিং হতে পারে। 

প্রক্রিয়াজাত খাবার

প্রক্রিয়াজাত খাবার নিয়মিত খেলে একসময় ওই খাবারের প্রতি এক ধরনের আসক্তি জন্মায়। ফলে প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি ফুড ক্রেভিং হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

মানসিক চাপ

মানসিক চাপের কারণে কর্টিসেল হরমোন এর মাত্রা বৃদ্ধি পায়। এ কর্টিসেল হরমোন খাই খাই স্বভাব বাড়ায়। তাছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি মানসিক চাপ চর্বিযুক্ত খাদ্যের চাহিদাকে বাড়াতে পারে। 

মনোযোগের অভাব 

খাবার সময় অন্যদিকে মনোযোগ থাকলে ফুড ক্রেভিং হতে পারে। আমরা অনেক সময় নাটক বা সিনেমা কিংবা খেলা দেখতে দেখতে খাবার খাই। তখন চোখ মস্তিষ্ককে তৃপ্তির সংকেত পাঠায় না তাই খাবার খেয়ে আমাদের তৃপ্তি হয় না আরো খাওয়ার ইচ্ছা জাগে। 

মুড সুইং

সাধারণত মুড সুইং এর সময় আমরা  খাবার ব্যাপারে অবহেলা করি তখনও ফুড ক্রেভিং হতে পারে।

নির্দিষ্ট কোন খাদ্য উপাদানের অভাব

দীর্ঘদিন যাবত নির্দিষ্ট কোন খাদ্য উপাদানের অভাব থাকলে ওই খাদ্য উপাদানের প্রতিও ফুড ক্রেভিং  হতে পারে। যেমন দীর্ঘদিন প্রোটিন স্বল্পতায় ভুগলে মাংস জাতীয় খাবারের চাহিদা বাড়ে।

অতি নিয়ন্ত্রণ

আমরা অনেক সময় ডায়েট করতে যেয়ে ক্যালোরি দ্রুত-হ্রাস করার জন্য খাদ্যাভ্যাসের অতি নিয়ন্ত্রণ করে থাকি। কিন্তু এই অতি নিয়ন্ত্রণের ফলে ফুড ক্রেভিং হওয়ার সম্ভাবনা বহুগুণে বেড়ে যায়। 

২০১২ সালে ১২৯ জন নারীর ফুড ক্রেভিং এর গবেষণায় দেখা গেছে যে যারা ওজন কমানোর জন্য ডায়েট করেছেন তারা ডায়েট করেননি এমন নারীদের তুলনায় অতিরিক্ত ফুড ক্রেভিং অনুভব করেছেন।

 

খাবারের লোভ কমানোর কৌশল

 

১. অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত থাকবেন না

অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লে আমরা আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তাই খুদা চেপে না রেখে দেহকে পর্যাপ্ত খাবার দিন। অতিরিক্ত ক্ষুধার্ত থাকলে আপনার ব্লাড সুগার কমে যেতে পারে। এর ফলে ব্লাড সুগারের মাত্রা ঠিক না রাখলে আপনার দেহে উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত খাদ্য গ্রহণের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।

 

২. পর্যাপ্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে

পর্যাপ্ত প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেলে আপনার ঘনঘন ক্ষুধা ভাব হবে না।

 

আমিষের অভাবে কি রোগ হয়? প্রতিদিনের খাবারে আমিষ রাখছেন তো?

 

৩. আপনার পছন্দের খাবার খান

আপনার পছন্দের খাবারটি যদি ক্ষতিকর মনে করে একেবারে বাদ দিয়ে দেন তাহলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। তাই পছন্দের খাবার অল্প হলেও খান। ক্ষতিকর মনে হলে ধীরে ধীরে বাদ দিন। 

 

৪. মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন

অতিরিক্ত মানসিক চাপের কারণে আমাদের ফুড ক্রেভিং হয়। তাই মনকে প্রফুল্ল রাখতে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন। ২০১৫ সালে ৬১৯ জন মানুষের উপর করা একটি জরিপে দেখা গেছে যে, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ প্রত্যক্ষভাবে ফুড ক্র্যাভিং এর কারণ।

 

মানসিক রোগ থেকে দ্রুত মুক্তির ৯ টি উপায়!

 

৫. পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমান

যেহেতু পর্যাপ্ত ঘুমের অভাব ব্রেইনের ফ্রন্টাল কর্টেক্স এবং এমিগডালায় প্রভাব ফেলে। তাই রাতে অবশ্যই ৭ ঘণ্টা ঘুমানোর অভ্যাস করুন। 

 

স্বাস্থ্যকর ঘুমের অভ্যাস তৈরি করবেন যেভাবে

 

৬. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন

আপনি হয়তো অবাক হবেন, দেহের ওজন ফুড ক্রেভিং এর কারণ হতে পারে। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ২০১৪ সালের ৬০০৪৬ জন মানুষের উপরে করা একটি গবেষণা দেখা গেছে যে, স্থূলকায় মানুষেরা অধিক ফুড ক্রেভিং অনুভব করে থাকেন সাধারণ মানুষের তুলনায়।

 

বাড়তি ওজন কমানোর প্রমাণিত ৮ টি উপায়!

 

৭. হরমোনের ভারসাম্যহীনতা পরীক্ষা করুন

যদি বারবার ফুড ক্রেভিং হয় তাহলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। কেননা অনেক সময় হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণেও এটি হতে পারে। ডায়াবেটিস থাকলে হেলদি লাইফ স্টাইল অনুসরণ করুন।

 

৮. পর্যাপ্ত পানি পান করুন

পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির অভাবে ক্ষুধা-ভাব তৈরি হয়। কিন্তু আমরা না বুঝেই বারবার খাবার খেয়ে থাকি।  এজন্য খাবার গ্রহণের ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি পান করুন।

 

সুস্থ থাকতে প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করবেন?

 

সুষম খাদ্যের গুরুত্ব 

সুষম খাদ্য বলতে সে খাদ্য কে বোঝায় যেখানে খাদ্যের সকল প্রকার উপাদানের উপস্থিতি থাকে। সুষম খাদ্য গ্রহণের সাথে সাথে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে। সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে ফুড ক্রেভিং থেকে বাঁচা অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে আপনার জন্য। 

 

সুস্থ থাকতে যে ৫ টি খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলবেন!

 

ফুড ক্রেভিং  এর মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো

  • ডিপ্রেশনের কারণে মিষ্টি জাতীয় খাবারের প্রবণতা বাড়তে পারে। 

  • মানসিক চাপের কারণে সল্ট ক্র্যাভিং হতে পারে।

  • রাগের কারণে অতিরিক্ত আমিষের ক্রেভিং হতে পারে ৷ 

 

কিছু নির্দিষ্ট খাদ্যের ক্রেভিং থেকে বাঁচার উপায় 

  • চকলেট ক্র্যাভিং মানে হল ম্যাগনেসিয়াম এর অভাব তাই খাদ্যে বাদাম, সিম, সবুজ পাতাযুক্ত সবজি রাখুন। 

  • চর্বিযুক্ত খাদ্যের ক্রেভিং পরিহার করতে পালং শাক, ব্রকলি, দুধ ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রাখুন।

  • জাঙ্ক ফুডের ক্রেভিং থেকে  বাঁচতে অবশ্যই সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন।

  •  সুগার ক্রেভিং থেকে বাঁচতে ফল, দারুচিনি, কিসমিস খেতে পারেন 

 

পরিশেষে 

ফুডক্রেভিং খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। এটি নিয়ে ভয়ের কোন কারণ নেই। তবে ওজন ঠিক রাখতে ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে ফুড ক্রেভিং প্রতিরোধ এবং প্রতিকার করা আমাদের কর্তব্য।

Default user image

রায়হান ফেরদৌস রুদ্র, লেখক, আস্থা লাইফ

আসসালামু আলাইকুম। আমি রায়হান ফেরদৌস রুদ্র। স্বাস্থ শিক্ষা বিষয়ে আমার যতটুকু জ্ঞান ততটুক আপনাদের সাথে শেয়ার করতে আগ্রহী।

Related Articles