বর্ষার রোগসমূহ প্রতিরোধ করবেন যেভাবে

যদিও কয়েকটি গরম এবং আর্দ্র মাসের পরে বৃষ্টি সবার কাছেই একটি স্নিগ্ধতার বার্তা নিয়ে আসে তবে এই সত্য আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে বৃষ্টির কারণেই বর্ষাকালে বেশ কিছু রোগের প্রকোপ দেখা দেয়। বর্ষাকালে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়, এর ফলে অনেক পানিবাহিত রোগ সহ বিভিন্ন রোগ হয়। যাইহোক, আমাদের সকলের সচেতন হওয়া উচিত বর্ষাকালের বিভিন্ন রোগ ও তাদের লক্ষণ সম্পর্কে এবং কীভাবে আমরা নিরাপদ এবং সুরক্ষিত থাকতে পারি।

গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদের পর বর্ষা সবসময়ই নিয়ে আসে সীমাহীন আনন্দ ও স্বস্তি। প্রচন্ড গরমে মন্থর হয়ে যাওয়া জনজীবনে নিয়ে আসে গতি, শুকিয়ে যাওয়া প্রকৃতিকে করে তোলে জীবন্ত। তবে সব কিছুরই কিছু খারাপ দিক থাকে। একদিকে বর্ষা যেমন ক্ষরা দূর করে, অন্যদিকে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে বন্যা হয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। আর এমন অতিরিক্ত বৃষ্টি, বিশুদ্ধ পানির অভাব, কাদামাটির ছড়াছড়িতে জন্ম নেয় ডায়রিয়া, কলেরিয়া, টাইফয়েডের মতো মারাত্মক সব রোগ। এসব রোগ থেকে বাঁচতে সাবধানতার বিকল্প নেই। তাই আজকের আর্টিকেলে  আমরা আলোচনা করবো বর্ষাকালের কি কি রোগ হয় এবং এগুলো থেকে মুক্ত থাকার উপায় সম্পর্কে। 

বর্ষাকালের রোগসমূহ

বর্ষাকালে মশা ও অন্যান্য পোকামাকড়ের উপদ্রব বেড়ে যায়, যার কারণে ভাইরাস জ্বর, ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া হতে পারে। আবার, বন্যা কবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং ঠান্ডার কারণে হতে পারে ডায়রিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ অন্যান্য রোগ। এছাড়া বৃষ্টির কাদাপানি শরীরে লাগলে অনেকের ত্বকে র‍্যাশ, ঘামাচিসহ নানা ধরনের চর্মরোগও দেখা যায়। 

বর্ষাকালে সাধারণত যেসব রোগ বেশি হয়ে থাকে সেগুলো হলো–

  • ডেঙ্গু

  • চিকুনগুনিয়া

  • ম্যালেরিয়া

  • ডায়রিয়া 

  • কলেরা

  • টাইফয়েড

  • পাকস্থলীর ইনফেকশন 

  • ভাইরাস জ্বর

  • ইনফ্লুয়েঞ্জা 

  • টাইফয়েড ইত্যাদি। 

বর্ষাকালের রোগসমূহের সাধারণ লক্ষণ এবং এগুলো থেকে মুক্ত থাকার উপায়

বর্ষায় কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সব ধরণের রোগই অনেকাংশে কমানো সম্ভব। যদিও বন্যাকবলিত অঞ্চলে সাবধানতা অবলম্বনের খুব একটা উপায় থাকেনা, তবু নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার কিছুটা চেষ্টা করা যেতে পারে।

ক) মশার কামড়ে সৃষ্ট রোগ: ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়া

বর্ষাকালে এডিস মশার উৎপাত বেড়ে যায়, যার ফলে ডেঙ্গু জ্বরে অনেক মানুষ আক্রান্ত হয়। চিকুনগুনিয়াও অনেকটা ডেঙ্গুর মতোই, যা এক প্রজাতির এডিস মশার কামড়েই হয়ে থাকে। আবার, প্লাজমোডিয়ামের কতগুলো প্রজাতির মশা ম্যালেরিয়ার জন্য দায়ী। 

ডেঙ্গু রোগের সাধারণ লক্ষণগুলো

  • জ্বর

  • মাথাব্যথা 

  • র‍্যাশ

  • পিঠে এবং শরীরের অন্যান্য জায়গায় তীব্র ব্যাথা

  • লিম্ফ নোড ফুলে যাওয়া

  • রক্তে অণুচক্রিকা কমে যাওয়া 

চিকুনগুনিয়া রোগের সাধারণ লক্ষণগুলো

  • জয়েন্টে ব্যাথা

  • জ্বর

  • ঠান্ডা শরীর

  • ক্লান্তি 

ম্যালেরিয়া রোগের সাধারণ লক্ষণ্গুলো

  • জ্বর

  • শরীরে ব্যাথা

  • রক্তশূন্যতা 

  • ঘাম হওয়া

  • শরীর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া 

বর্ষাকালে বাড়ির আশেপাশে, ফুলের টবে, ডোবায় পরিষ্কার বৃষ্টির পানি জমে থাকে যেখানে এসব মশা ডিম পাড়ে। এজন্য খেয়াল রাখতে হবে কোথাও যেন পানি জমে না থাকে।

এমন মশাবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে হলে মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। আবার, এডিস বা অন্যান্য ক্ষতিকর মশাগুলো বেশিরভাগই দিনে কামড়ায়। এজন্য দিনের বেলা মসকিউটো রিপেলেন্ট ক্রিম ব্যাবহার করা যেতে পারে। ঘরের মধ্যে থাকলে মশার কয়েল, স্প্রে, মশারি ইত্যাদি ব্যাবহার করতে পারেন। 

খ) দূষিত খাবার ও পানিবাহিত রোগ: কলেরা, টাইফয়েড ও ডায়রিয়া 

জীবাণুমিশ্রিত খাবার ও পানি পান করার মাধ্যমে কলেরা রোগের জীবাণু দেহে প্রবেশ করে। এছাড়া টয়লেটে হাইজিনের অভাব থাকলেও নোংরা পরিবেশে এসব জীবাণু ছড়ায়। কলেরায় আক্রান্ত হলে মানুষ কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মারা যেতে পারে, সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব এর চিকিৎসা শুরু করতে হয়। এই রোগ থেকে বাঁচতে হলে বাসি পঁচা খাবার খাওয়া যাবেনা। বিশুদ্ধ পানি করতে হবে এবং টয়লেট পরিষ্কার রাখতে হবে। পায়খানার পর প্রতিবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

কলেরা রোগের সাধারণ লক্ষণগুলো

  • নিম্ন রক্তচাপ 

  • হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাওয়া 

  • মিউকাস মেমব্রেন শুকিয়ে যাওয়া

  • মাংসপেশিতে ব্যাথা

  • তৃষ্ণা বেড়ে যাওয়া 

টাইফয়েড রোগের জীবাণুও দূষিত খাবার ও পানীয়র মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করে। এজন্য এই রোগ থেকে মুক্ত থাকার জন্য বিশুদ্ধ পানি ও ভালো খাবার খেতে হবে।

টাইফয়েড রোগের লক্ষণগুলো

  • দীর্ঘদিন ধরে জ্বর থাকা

  • দুর্বলতা

  • কোষ্ঠকাঠিন্য 

  • পেটে ব্যাথা

  • বমি করা

  • মাথাব্যাথা

বাংলাদেশে বর্ষাকালের সবচেয়ে কমন রোগ বলা যেতে পারে ডায়রিয়াকে। এই রোগ স্বল্প সময়ের জন্যও থাকতে পারে, আবার দীর্ষদিন থেকে মৃত্যুঝুঁকিও সৃষ্টি করতে পারে। খাবার ও পানি পানে সতর্ক থাকতে হবে এ রোগ এড়ানোর জন্য। আর ডায়রিয়া হলে শুরু থেকেই যথেষ্ট পরিমাণে খাবার স্যালাইন সঠিক নিয়মে খেতে হবে।

ডায়রিয়া রোগের সাধারণ লক্ষণগুলো

  • পাতলা পায়খানা

  • পেটে ব্যাথা

  • পেট ফেঁপে উঠা

  • বমিভাব

  • জ্বর

  • মাঝে মাঝে পায়খানার সাথে রক্ত যেতে পারে।

গ) ঠান্ডাজ্বর: ইনফ্লুয়েঞ্জা, ভাইরাস জ্বর ও সর্দি-কাশি

শীত ও বর্ষাকালে সর্দি-কাশিসহ সাধারণ জ্বর ও ভাইরাস জ্বর হয়ে থাকে। বর্ষাকালে তাপমাত্রার অতিরিক্ত তারতম্যের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকেরই কমে যায়, ফলে সহজেই ঠান্ডা লাগে, সর্দি কাশি শুরু হয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা হলে সেটা একজনের থেকে অন্যজনের মাঝেও ছড়াতে পারে। অনেকের বৃষ্টিতে ভিজার ফলেও ঠান্ডা লাগে। তাই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, যাতে করে শরীরে এসব জীবাণুর বিরূদ্ধে লড়াই করার জন্য অ্যান্টিবডি তৈরী হয়।

ইনফ্লুয়েঞ্জা ও ভাইরাস জ্বরের সাধারণ লক্ষণগুলো

  • জ্বর

  • মাংসপেশিতে ব্যাথা

  • মাথাব্যথা 

  • ঘাম হওয়া

  • শুকনো কাশি

  • গলা ভেঙে যাওয়া

  • দুর্বলতা

  • ক্লান্তি

  • জয়েন্টি ব্যাথা

  • শ্বাসনালীতে ইনফেকশন 

  • সর্দি ইত্যাদি। 

ঘ) পাকস্থলীর সংক্রমণ

বিশেষ করে বাইরের ভাজাপোড়া খাবার ও দূষিত পানি পান করলে পাকস্থলীতে সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। বর্ষাকালে গ্যাস্ট্রোএন্টেরাইটিস নামক সংক্রমণ বেশি দেখা যায়। ফুটানো বিশুদ্ধ পানি পান করলে ও বাসার তৈরী খাবার খেলে এসম সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।

পাকস্থলীর সংক্রমণের সাধারণ লক্ষণগুলো

  • বমিভাব ও বমি করা

  • পেটে ব্যাথা

  • ডায়রিয়া

  • হাল্কা জ্বর ইত্যাদি। 

ঙ) চর্মরোগ

বর্ষায় কাদাপানিতে অনেক ধরনের জীবাণু ও ক্ষতিকর পোকামাকড় থাকে, যা শরীরের সংস্পর্শে আসলে ত্বকে জ্বালাপোড়া ও চুলকানি হয়। বাইরে বের হওয়ার আগে শরীরে অলিভ অয়েল বা নারকেল তেল মাখলে তা বৃষ্টি পানি ও ত্বকের মাঝে একটি পাতলা আস্তরণ তৈরী করে, ফলে পানিতে থাকা জীবাণু সরাসরি ত্বকের সংস্পর্শে আসতে পারেনা। এভাবে সংক্রমণ অনেকটাই কমানো যায়।  তারপরেও ত্বকে সমস্যা হলে পায়ে পলিথিন বেঁধে পানির মধ্যে হাঁটতে হবে।

চর্মরোগের সাধারণ লক্ষণগুলো

  • ত্বক লাল হয়ে যাওয়া 

  • ফুলে যাওয়া

  • চুলকানি

  • র‍্যাশ

  • ত্বকে ফুসকুড়ি উঠা ইত্যাদি। 

 

বর্ষাকালে যেমন মানুষ অতিরিক্ত গরম থেকে মুক্তি পায় তেমনি অনেক ধরনের রোগবালাইও মোকাবিলাও করতে হয়। তবে সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায়। আবার, কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যাবস্থা করলে এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই বর্ষাকালের বেশিরভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।  

Default user image

মেঘলা, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি মেঘলা। রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা শেষ করেছি। ভালো লাগে পাহাড় আর ঝর্ণায় ঘুরতে। পছন্দের কাজ বাগান করা আর বিভিন্ন রেয়ার গোলাপ সংগ্রহ করা। বই পড়ার শখ থেকেই লেখালেখির শুরু। আস্থা লাইফের হেলথ ব্লগগুলো লিখতে ভালো লাগে, পাঠকদের সচেতন করার পাশাপশি নিজেও অনেক নতুন কিছু জানতে পারি।

Related Articles