রাতের খাবার বিলম্বে খাচ্ছেন? ভয়ানক বিপদের মধ্যে আছেন!
আপনি জানেন কি—রাতের খাবার একটু আগে খেয়ে নিলে শরীর অনেক ভালো থাকে? এমনকি এটা শরীরের ওজন কমাতেও সাহায্য করে এবং রক্তের গ্লুকোজের মাত্রাও সীমিত রাখে। আজকে আমরা ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করব, আমরা জানব যে রাতে দ্রুত খাওয়া দাওয়া করে নিলে সেটা কীভাবে আমাদের বাড়তি মেদ কমাতে সাহায্য করতে পারে।
“Early to bed and early to rise makes a man healthy, wealthy and wise”
“রাতে দ্রুত ঘুমানো ও সকালে দ্রুত উঠা মানুষকে স্বাস্থ্যকর, ধনী ও জ্ঞানী করে তোলে”- ছোটবেলায় এই নীতিবাক্যটি পড়া হয়নি এমন কাউকে মনে হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে মজার বিষয় হল আমরা এই বাক্যটি পড়লেও কখনো সেই ভাবে অনুধাবন করা হয়ে উঠেনি। দ্রুত ঘুমিয়ে যাওয়া মানেই হল একটু দ্রুত খাওয়া দাওয়া করে নেয়া। আর কিছুটা আগেই রাতের খাবার সেরে ফেলার মধ্যে স্বাস্থ্যগত অনেক উপকারিতা রয়েছে, যা আপনাকে দীর্ঘদিন সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।
সাধারণত আমরা মনে করি যে, ক্যালোরি গ্রহণ করলেই শরীরে মেদ জমবে, তবে বর্তমান পুষ্টিবিদদের আধুনিক ধ্যান ধারণা বদলে দিচ্ছে সেই পুরানো ভাবনাগুলো। কেননা ক্যালোরি গ্রহণের পাশাপাশি ক্যালোরি বার্ন করার বিষয়টিও শরীরের ওজনের সাথে সম্পৃক্ত।
রাতে দেরি করে খাবার খেলে বাড়তি মেদ কেন জমবে?
‘ক্লিনিক্যাল এনডকরিনোলোজি এন্ড মেটাবলিজম’ নামক বিখ্যাত একটি জার্নালে প্রকাশিত হওয়া একটি গবেষণার রিপোর্ট অনুযায়ী, আপনি যদি রাতে দেরি করে খাদ্য গ্রহণ করেন তাহলে সেটার প্রভাব আপনার শরীরে মেদ জমার কারণ হয়ে উঠবে এবং সরাসরি উচ্চ রক্ত চাপের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ঠিক একই খাবার যদি আপনি দ্রুত খেয়ে ফেলেন, তাহলে তুলনামূলক ভাবে এই প্রভাব কিছুটা কম হবে।
এখানে একটি বিষয় বুঝে নেয়া প্রয়োজন, পুরো বিষয়টি যদিও আপনার খাদ্য তালিকার সাথে অর্থাৎ আপনি ঠিক কি খাচ্ছেন তার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত তবুও রাতে খাবার গ্রহনের সময়টা এখানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
উল্যেখ্য যে উক্ত গবেষণাটি করেছিলেন, জন হপকিংস বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মেডিসন বিভাগের সহকারী প্রফেসর ‘ডাঃ জোনাথন’। তিনি এই সম্পর্কে বলেন, “আমরা বেশ কিছু তথ্য থেকে জানতে পারছিলাম যে রাতে দেরি করে খাবার গ্রহণ করার সাথে শারীরিক স্থুলতার সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। তবে এই গবেষণার মাধ্যমে জানতে চাচ্ছিলাম যে আদৌ কি রাতের বেলায় দেরি করে খাওয়া দাওয়া করলে শরীরের মেটাবলিজমে এমন কোন পরিবর্তন আসে কি না, যার ফলে স্থুলতা বৃদ্ধি পায়।”
ঠিক যেভাবে এই গবেষণাটি করা হয়েছে
সুস্থ স্বাভাবিক দশজন নারী এবং দশজন পুরুষের উপরেই মূলত এই গবেষণাটি করা হয়েছিল। এই বিশজনের খাদ্যাভ্যাস এবং ঘুমের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের ভিন্নতা নিয়ে এসে তাদের উপর অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমেই এই গবেষণাটি করা হয়েছে।
প্রাথমিক অবস্থায় সবাইকে রাতের দশটার দিকে খাবার খেতে দেয়া হয়েছিল এবং তারা সবাই রাত এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে তাদের শরীরের রক্তচাপ বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং একই সাথে শরীরে ফ্যাট বার্ন হওয়াও কমে গিয়েছিল। পুনরায় যখন তাদেরকে আবার দ্রুত খাবার দেয়া হয়েছিল তখন দেখা গেছে তাদের শারীরিক রক্ত চাপ কমে যাওয়ার পাশাপাশি ফ্যাট বার্নও বেড়ে গিয়েছিল।
এই সম্পর্কে ‘ডাঃ জোনাথন’ বলেন তিনি এই ফলাফলে মোটেও আশ্চর্য হন নি। কেননা এই গবেষণার মাধ্যমে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলেও, আগে থেকেই বিষয়টি আন্দাজ করা যাচ্ছিল।
তবে একটি মজার বিষয় হল, সবার মধ্যে শারীরিক ভাবে একই রকম প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তবে এটা খুবই স্বাভাবিক, কেননা প্রত্যেকটা মানুষের শারীরিক অবস্থা একে অপর থেকে একদমই আলাদা হয়ে থাকে।
ঠিক কি কারনে রাতে দ্রুত খেলে শরীরের বাড়তি মেদ কমতে থাকে?
আদতে আমরা সারাদিন অনেক ধরনের কাজের মধ্যে থাকি, আর তাই আমাদের শারীরিক ক্যালোরি বার্নও অনেক বেশী হয়ে থাকে। অপরদিকে রাতের দিকে আমরা স্বভাব বশতই আরাম করি। রাতের বেলায় বাসায় থাকা হয় এবং পারিবারিক গল্প গুজবের মধ্য দিয়ে একটা আরামদায়ক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আর তাই শারীরিক চলাফেরা কম হওয়ার কারনে রাতের দিকে আমাদের শরীরের ক্যালোরি বার্ন হওয়ার পরিমাণও অনেক খানি কমে আসে।
একে তো শারীরিক চলাফেরা কম হওয়ার কারনে ক্যালোরি কম বার্ন হচ্ছে, অপরদিকে ঠিক একই সময়ে দেরি করে খাবার খেলে আমাদের গ্রহণ করা খাদ্যের পুরো ফ্যাটটাই শরীর গ্রহণ করে ফেলে। এছাড়াও খাদ্য ছাড়া থাকার সময় অর্থাৎ উপোষ থাকার সময়টাও বেশ কমে আসে। রাতে দ্রুত খেয়ে নিলে, সকালে উঠে নাস্তা করার আগ পর্যন্ত আমরা দীর্ঘ একটি খাদ্য বিরতি পেয়ে যাই। আর এই কারণে আমাদের রাতে গ্রহণ করা ক্যালোরিগুলো শরীর পুরোপুরি ব্যবহার করে ফেলতে পারে।
এই সম্পর্কে ডাঃ রুপালী দত্ত নামক একজন পুষ্টিবিদ বলেন, “দ্রুত খাবার খাওয়া হজমের জন্যও বেশ উপকারী। আর যেহেতু দ্রুত খাবার গ্রহনের কারণে সব ক্যালোরি শরীর ব্যবহার করতে পারে, তাই শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরিও থেকে যায় না। আর তাই শরীরের বাড়তি মেদ জমে না তেমন একটা, কেননা শরীরের অব্যবহৃত ক্যালোরিগুলোই মূলত পরবর্তীতে ফ্যাট হিসেবে জমা হয়ে যায়।
আমাদের দৈনন্দিন সাধারণ খাদ্যাভ্যাস ও স্থুলতা
আমাদের প্রতিনিয়ত খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে ‘ডাঃ জোনাথন’ বলেন, সাধারণত যেটা দেখা যায়, সকাল বেলায় মানুষ অফিস ও অন্যান্য কাজের ব্যস্ততায় পর্যাপ্ত পরিমাণে খাওয়া দাওয়া হয়ে উঠে না। আর দুপুরেও ঠিক একই ভাবে ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যায়। ফলাফল স্বরূপ রাতের বেলায় খাবারের প্রতি একটু বাড়তি প্রেশার পরে যায়।
আর এই গবেষণায় দেখ গেছে রাতের বেলায় এমন দেরি করে বাড়তি খাবার গ্রহণ করলে শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং বাড়তি মেদ জমে স্থুলতার দিকে রূপ নেয়। এমনকি খাদ্যাভ্যাসের কারণে মরণঘাতি রোগ যেমন ডায়াবেটিক, হৃদযন্ত্র জনিত রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
রাতের বেলায় খাবার গ্রহনের ব্যাপারে আমাদের করণীয় কি?
অফিসের বাড়তি কাজের প্রেশারে আপনার যদি মনে হয় যে, বাসায় ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। তাহলে বিকেলের দিকে বাদাম, দই জাতীয় হালকা নাশতা করে নিতে পারেন। যাতে করে রাতের বেলায় খাবার গ্রহনের প্রতি প্রেশারটা তুলনামূলক ভাবে কিঞ্চিৎ কম থাকে।
এছাড়া সকালে এবং দুপুরে তুলনামূলক ভাবে একটু বেশী খাবার গ্রহন করলে সেটাতে ঝুঁকি কম থাকে। কেননা সারাদিন শারীরিক ভাবে অনেক পরিশ্রম হয়ে যায়। আর সেক্ষেত্রে রাতের বেলায় একদম হালকা স্ন্যাকস গ্রহন করলে শারীরিক ভাবে অনেক বেশী সুস্থ থাকা যায়।
পরিশেষে এটাই বলা যায় যে, আমরা কি খাচ্ছি আর কখন খাচ্ছি এই দুটো বিষয়ের উপরেও আমাদের শারীরিক সুস্থতা নির্ভর করে। একটি সঠিক অভ্যাস আমাদের অনেক বড় ধরণের প্রাণঘাতী রোগের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে। আবার রাতে দেরি করে খাওয়ার মত একটি বদ অভ্যাস আমাদের দীর্ঘ অসুস্থতার কারণ হয়ে যেতে পারে। আর তাই সঠিক অভ্যাসটি মেনে চলা আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আপনি কি রাতে দেরি করে খাচ্ছেন? তাহলে এখনই সঠিক সময় সেই অভ্যাসটিকে পরিবর্তন করে দ্রুত খাবার গ্রহন করার। একটি সুস্থ শরীর আপনাকে একটি সুস্থ জীবন উপহার দিতে পারে।