রমজানে দাঁতের যত্ন না নিলে যে ৫টি রোগ হতে পারে

রমজান মাসে আমাদের শরীরের যে অংশটি সবচেয়ে অবহেলিত হয়ে থাকে তা হলো আমাদের মুখগহ্বর, অর্থাৎ দাঁত, জিহ্বা, মাড়ি এবং আশেপাশের টিস্যু। মূলত এই বিষয়ে সচেতনতার অভাব থেকেই দেখা দেয় বিভিন্ন সমস্যা। অথচ অল্প কিছু নিয়ম মেনে মুখগহ্বর পরিষ্কার রাখলে বেশিরভাগ দাঁতের রোগ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব, তা রোজায় হোক বা অন্য কোনো সময়।

কিডনি ডিজিজ, হাই/লো ব্লাড প্রেশার, বা অন্যান্য রোগের ক্ষেত্রে রমজানে যেমন সাবধানতা অবলম্বন করা হয়, মুখগহ্বরের রোগব্যাধি গুলোর ক্ষেত্রে মানুষ তার তুলনায় অনেক বেশি উদাসীন। ফলে রমজানে অথবা ঈদের পরপরই অনেকের দাঁতের সমস্যা বেড়ে যায়। আজকে তাই আলোচনা করবো রমজানে দাঁতের যত্নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এবং জেনে নিবো কিভাবে রোজা রেখে দাঁতের যত্ন নিতে হবে। 

রমজানে দাঁতের যত্ন নেওয়ার গুরুত্ব

রমজানে যেহেতু একটা লম্বা সময় আমরা খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকি তাই অনেকেই ভাবেন, দাঁতের তো বেশি কাজ নেই আপাতত, ঈদের পরে ভালোমতো যত্ন নিলেই হবে। কিন্তু একটা বিষয় বোঝা দরকার যে, রমজানে দাঁতের কাজ কম হলেও, মুখগহ্বরের ব্যাকটেরিয়াগুলোর কাজ কিন্তু থেমে থাকেনা! তারা ঠিকই সুযোগ বুঝে নিজেদের মাল্টিপ্লিকেশন করে এবং তৈরী করে ল্যাকটিক এসিড। আর এসিডের কারণে শুরু হয় দাঁতক্ষয়।

এছাড়াও একটানা ১৪-১৬ ঘন্টা পানি পান না করার কারণে আমাদের মুখের ভেতরটা শুকিয়ে থাকে, মুখের লালা নিঃসরণও কমে যায়। মুখের লালার একটি প্রধান কাজ হলো জীবাণুগুলোকে পরিষ্কার করে মুখগহ্বরকে সুস্থ রাখা। কিন্তু রোজার সময় এই মেকানিজম খুবএকটা কাজ করে না। পানিও খাই না আমরা যে পানির মাধ্যমে মুখগহ্বর পরিষ্কার হবে। এই সুযোগে ব্যাকটেরিয়াগুলোর সংখ্যাবৃদ্ধি হতে থাকে। 

এছাড়া ইফতারে আমাদের প্লেটে যে অস্বাস্থ্যকর, ভাজাপোড়া খাবার এবং অতিরিক্ত চিনি দেওয়া সরবত থাকে, সেগুলোও কিন্তু দাঁতের সর্বনাশের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে। 

সারাদিন শুষ্ক মুখে থাকার পর, ইফতারে হাবিজাবি খাওয়ার পর নিয়মিত ব্রাশ এবং ফ্লস ব্যাবহার করেন এমন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। এমনকি সেহরির পরেও কারো কারো মনে থাকেনা দাঁতের যত্ন নেওয়ার কথা। এসব কারণে রমজান মাসে বেশিরভাগ মানুষের মুখগহ্বর এবং দাঁতের মারাত্মক ক্ষতি হয়, যার ফলে ঈদের পরপরই হাসপাতাল বা চেম্বারে দেখা যায় রোগীর উপচে পড়া ভিড়।

রোজা রেখে দাঁতের যত্ন না নিলে যেসব সমস্যা হতে পারে

রমজানে দাঁতের যত্ন নিয়মিত এবং সঠিকভাবে না নিলে বিভিন্ন ধরনের দাঁতের রোগ হতে পারে, রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে, অথবা আগে থেকে যেসব রোগ ছিলো তা আরো খারাপ পর্যায়ে যেতে পারে। এই সময় যেসব কমন রোগ দেখা যায় তা হলো-

১. হ্যালিটোসিস 

হ্যালিটোসিস বা মুখে দূর্গন্ধ হওয়া রোজাদারদের সবচেয়ে বেশি পরিচিত একটি সমস্যা। নিয়মিত ব্রাশ এবং ফ্লস ব্যাবহার না করলে প্রায়ই এই অস্বস্তিকর সমস্যা দেখা দেয়। 

২. ড্রাই মাউথ 

মুখ শুকনো হয়ে যাওয়া। অর্থাৎ লালা নিঃসরণ কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া। ডায়াবেটিস রোগীদের এই সমস্যা বেশি হয়ে থাকে।

৩. দাঁতক্ষয় 

ইফতারে অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার খাওয়া এবং হজমে সমস্যার কারনে দাঁতক্ষয় হয়ে থাকে।

৪. প্লাক বিল্ডআপ 

খাওয়ার পর ব্রাশ না করলে দাঁতের বাইরের স্তরে ব্যাকটেরিয়া, খাবারের ক্ষুদ্র কণাসহ অন্যান্য উপাদানের একটি পাতলা প্রলেপ আঠার মতো স্টিকি হয়ে লেগে থাকে, এটি প্লাক নামে পরিচিত। 

৫. ক্যালকুলাস 

প্লাক জমতে জমতে একটা সময় তা শক্ত হয়ে দাঁতের উপরের স্তরে আটকে যায়, যা ব্রাশের মাধ্যমে দূর করা যায়না। একে ক্যালকুলাস বলে।

এসব রোগ প্রতিরোধ করতে চাইলে রমজানেও দাঁতের যত্ন সঠিকভাবে নেওয়ার বিকল্প নেই। তবে এর সাথে দূর করতে হবে ডিহাইড্রেশন। কারণ ডিহাইড্রেশন পরোক্ষভাবে ব্যাকটেরিয়ার মাল্টিপ্লিকেশন বাড়িয়ে দেয়। সুতরাং সুস্থ দাঁত এবং মুখগহ্বর পেতে হলে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহন, বেশি পানি পান করার পাশাপাশি দাঁতের যত্নের প্রয়োজনীয়তা অনেক।

রমজানে কিভাবে দাঁতের যত্ন নিতে হবে

  • প্রথমত, খাবার এবং পানীয় এই দুটো বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং পানীয় যেমন শরীরের অন্যান্য অংশের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি দাঁতের জন্যেও ক্ষতিকর। তাই ইফতার ও সেহরিতে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে হবে। বেশি করে ফলমূল রাখার চেষ্টা করুন ইফতারে, এবং সবজি ও প্রোটিন জাতীয় খাবার (মাছ, মাংস, ডিম, দুধ) রাখার চেষ্টা করুন সেহরিতে। ইফতারে অনেকের শরবত না হলে চলেই না। কিন্তু চিনি মেশানো শরবত খেলে তা শুধু আপনার দাঁতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়, আপনার সার্বিক সুস্থতার পথেও বাঁধা সৃষ্টি করবে। বেশি করে পানি, অথবা চিনি ছাড়া ফলের রস পান করার মাধ্যমে শরীরের পানিশূন্যতা দূর করা সবচেয়ে ভালো উপায়। 

  • দাঁতের যত্নের দ্বিতীয় ধাপটি হলো মুখগহ্বর পরিষ্কার রাখা। অনেকেই প্রশ্ন করেন রোজা রেখে ব্রাশ করা যাবে কিনা? এক্ষেত্রে বিষয়টি হলো, যদি আপনি সাবধান থাকতে পারেন ব্রাশ করার সময়, যেন কুলকুচি করতে যেয়ে পেস্ট বা পানি না খেয়ে ফেলেন, তাহলে রোজা ভাঙার কোনো কারণ নেই। আর আপনার যদি সন্দেহ থাকে রোজা ভাঙার বিষয়ে, তাহলে সেহরির সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই ব্রাশ করে ফেলতে হবে। অর্থাৎ ব্রাশিং কোনোভাবেই বাদ দেওয়া উচিত নয়। যদি ব্রাশ যথেষ্ট মনে না হয় তাহলে ফ্লস করে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার বের করতে হবে। অতিরিক্ত সাবধানতা হিসাবে ব্যাবহার করতে পারেন মাউথ ওয়াশ। তবে মাউথ ওয়াশ বেশিক্ষণ মুখে নিয়ে রাখলে অনেকের মুখের মধ্যে জ্বালাপোড়া হতে পারে তাই মাউথ ওয়াশের টেস্ট যতই ভালো লাগুক না কেন, তা বেশিক্ষণ মুখে রাখা যাবেনা। 

  • যাদের অলরেডি দাঁতে সমস্যা আছে, সময়মতো চিকিৎসা নেওয়াটাও তাদের জন্য দাঁতের যত্নের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। অনেকে মনে করেন রোজা রেখে দাঁতের চিকিৎসা করলে রোজা ভেঙে যাবে। বিষয়টা আসলে নির্ভর করে আপনাকে কি ধরনের ট্রিটমেন্ট দেওয়া হবে তার উপর। যদি এমন ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয় যাতে আপনার একটু বেশি ব্লিডিং হওয়ার সম্ভাবনা আছে, অথবা পানি গিলে ফেলার সম্ভাবনা আছে, তাহলে আপনার রোজা ভেঙে যাবে। সেক্ষেত্রে আপনি ইফতারের পর ট্রিটমেন্ট নিতে পারেন। 

  • তবে অন্যান্য বেশিরভাগ ট্রিটমেন্ট, যেমন স্কেলিং, পলিশিং, অ্যাক্সেস ক্যাভিটি প্রিপারেশন, ফিলিং ইত্যাদি করতে আপনার ব্লিডিং হওয়ার সম্ভাবনা নেই, এবং সাকার ব্যাবহার করার কারণে পানিও গিলে ফেলার সম্ভাবনা নেই। তারপরেও যদি সন্দেহ মুক্ত থাকতে চান তাহলে সন্ধ্যার পরেই যেতে পারেন ডাক্তারের কাছে। কিন্তু ট্রিটমেন্ট না করে পুরো মাসটা পার করে দেওয়া যাবেনা।

শুধু দাঁতের সমস্যা না, শরীরে যেকোনো সমস্যা হলে যদি দ্রুত চিকিৎসার ব্যাবস্থা করা হয় তাহলে রোগীর সমস্যাগুলো আর বাড়ে না, সহজেই রোগী সুস্থ হতে পারে এবং অল্প খরচেই ট্রিটমেন্ট শেষ করা যায়। চিকিৎসা নিতে যতোই দেরি হয়, ততোই রোগের জটিলতা বাড়ে, কমে যায় রিকোভারি রেট, বাড়ে চিকিৎসা খরচ এবং ভোগান্তি। 

শেষ কথা

দাঁতের সমস্যাগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে ওরাল হাইজিন মেনে না চলার কারণে। তবে অন্যান্য কিছু প্রভাবকও রয়েছে, যেমন— বয়স, আশেপাশের পরিবেশ, পেশা, অন্যান্য রোগ, প্রেগন্যান্সি, জেনেটিক্স ইত্যাদি। কারণ যা-ই হোক, সমস্যা দেখা দিলে সাথে সাথে চিকিৎসা নিলে দাঁত হারানোর সম্ভাবনা অনেক কমে আসে। অনেকেই ভাবেন, দাঁত তুলে ফেললে কি হবে? এখন তো অনেক অপশন রয়েছে। কিন্তু অপশন যতই থাকুক, ন্যাচারাল দাঁতের সমকক্ষ কোনোটিই নয়। নকল দাঁত ব্যাবহার করে কখনোই খাবার খেয়ে বা কথা বলে তৃপ্তি পাওয়া যায়না। তাই সময় থাকতে সচেতন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।

Default user image

নিশাত বিনতে সাইফ, লেখক, আস্থা লাইফ

আসসালামু আলাইকুম। আমি বাংলাদেশ ডেন্টাল কলেজে পড়াশোনা করছি। প্রতিদিন কলেজে অনেক রোগী দাঁতের সমস্যা নিয়ে আসেন যেগুলোর প্রধান কারণ দাঁতের স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতনতা এবং সঠিকভাবে দাঁতের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতা। আস্থা ব্লগের নিয়মিত লেখক হয়ে সবাইকে এই বিষয়ে সচেতন করে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে। উদ্দেশ্য একটাই—সুস্থ দাঁত, সুন্দর হাসি যেন ছড়িয়ে দিতে পারি সাধারণ মানুষের মধ্যে।

Related Articles