রমজানে যেসব চিকিৎসা করালে রোজার কোন ক্ষতি হবে না
রমজান মাসে অসুস্থ রোজাদার ব্যক্তিরা চিকিৎসা ও ঔষুধ ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। এই সময়ে বেশীরভাগ রোগীদের কি চিকিৎসা করা যাবে আরা কি করা যাবে না তা নিয়ে জ্ঞান ও সচেতনার কমতি থাকে। আবার অনেক চিকিৎসক এবং ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি ও সংশয় লক্ষ করা যায়। তাই আজকে আমরা সেসব বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা করব এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করব।
পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখা এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন বিভ্রান্তি দূর করতে ডাক্তার, ইসলামিক স্কলার এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। আসুন আমরা সেগুলি জানার চেষ্টা করি।
১) ডায়াবেটিস থাকলে কি আপনার রোজা রাখা উচিৎ?
টাইপ-১ ডায়াবেটিস এ আক্রান্তদের সাধারনত রোজা রাখা উচিত না, তবে যাদের টাইপ-২ ডায়াবেটিস তারা চাইলে রোজা রাখতে পারে। হয় তাদের ডাক্তার তাদের ইনসুলিন এর ডোজ পরিবর্তন করতে বলবে অথবা তাদের ইনসুলিন এর ধরন পরিবর্তন করতে বলবে।
২) আমি যখন না খেয়ে থাকি তখন আমার তীব্র মাইগ্রেনের ব্যাথা হয়, এবং যখন আমি রোজা রাখি তা আরও তীব্র হয়, এমতাবস্থায় আমার কি রোজা রাখা উচিৎ হবে?
যে সব মানুষের অনিয়ন্ত্রিত মাইগ্রেনের ব্যাথা আছে, তাদের রোজা রাখা উচিৎ না। কিন্তু সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনমানের পরিবর্তন করে মাইগ্রেনের ব্যাথা নিরাময় যোগ্য করা যায়। কিভাবে মাইগ্রেনের ব্যাথা নিয়ন্ত্রন করা যায় সে বিষয় আপনার ডাক্তার সাথে কথা বলুন।
৩) হাই ব্লাড প্রেসার বা লো ব্লাড প্রেসার থাকলে কি আপনার রোজা রাখা উচিৎ হবে?
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রিত হলে রোজা রাখা যাবে। এক্ষেত্রে আপনার ডাক্তার আপনাকে ঔষধ পরিবর্তন করার পরামর্শ দিতে পারে যা আপনাকে রোজার সময় ঔষধ খাওয়া থেকে বিরত রাখবে।
আবার কারও যদি স্বাস্থ্য ভালো থাকে তার লো ব্লাড প্রেসার থাকলেও রোজা রাখা সম্ভব। তবে নিশ্চিত করতে হবে যে রোগী পর্যাপ্ত লবন ও তরল খাবার খাচ্ছে কিনা।
৪) রক্ত গ্রহীতা কি রোজা রাখতে পারবেন?
না। একজন রক্ত গ্রহীতাকে রোজা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয় না। রক্ত গ্রহনের তারিখ ব্যতীত অন্য দিন গুলোতে তারা রোজা রাখবে।
৫) আমি তো নিয়মিত ঔষধ খাই। আমি কি রোজা রাখব?
নির্দিষ্ট ঔষধ গুলোর ব্যপারে আপনার চিকিৎসক এর পরামর্শ নিন।
৬) রোজা অবস্থায় কি ঔষধ, ইনজেকশন, প্লাস্টার নিতে পারবো?
ঔষধ খেলে রোজা ভেঙে যাবে। কিন্তু ইনজেকশন,প্লাস্টার, নাক, কান বা চোখের ড্রপ ব্যবহার করলে রোজা ভাঙে না যদি সেগুলোর মাধ্যমে কোনো খাবার গ্রহন না হয়। তবে এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন ইসলামিক স্কলার বিভিন্ন মত দিয়েছেন। আর ইসলামি শরীয়াহ মতে অসুস্থ ব্যক্তির জন্য রোজা না।
আরও পড়ুনঃ রমজানে রোগীদের যেভাবে ঔষুধ খেতে হবে
৭) রমজান কি ধূমপান ত্যাগের উত্তম সময়?
হ্যাঁ, ধূমপানের মত ক্ষতিকর বদ অভ্যাস গুলো পরিত্যাগ করার উপযুক্ত সময় হল রমজান।
৮) কত বয়স থেকে শিশুরা নিরাপদে রোজা রাখতে পারবে?
শিশুর বয়ঃসন্ধি হলে তাদের রোজা রাখা উচিত। এতে ক্ষতির কিছু নেই। আবার ৭-৮ বছরের নিচের বয়সীদের রোজা রাখতে না করা হয়। তবে বাচ্চাদের এক-দুই ঘন্টা করে রোজা রাখানো যেতে পারে তাদের রোজার মৌলিক জ্ঞান সম্পর্কে শেখানোর জন্য।
৯) আমি কি রমজানে অ্যাজমার ইনহেলার ব্যবহার করতে পারব?
এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন ইসলামিক স্কলার বিভিন্ন মত দিয়ে থাকেন। কোনো কোনো স্ক্লার এর মতে অ্যাজমা ইনহেলার খাওয়া বা পান করার মত কোনো ক্ষতিকর বিষয় না। তাদের মতে অ্যাজমা আক্রান্ত রোগী রোজা রেখে যেকোনো সময় ইনহেলার ব্যবহার করতে পারে, এতে তার রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। এ বিষয় আরও জানার জন্য আপনার চিকিৎসক এর পরামর্শ নিন।
১০। আমি কি রোজা রেখে সাতার কাটতে পারব?
হ্যাঁ, তবে খেয়াল রাখতে হবে যাতে পানি পেটে না যায়। সাতার কাটা বা গোসল করলে রোজার কোনো ক্ষতি হয় না। কারণ, এসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে কোনো ধরনের পানি গ্রহন করা হয় না, যাতে রোজা ভেঙে যাবে।
১১। ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা কি এমন খারাপ পর্যায় যেতে পারে যে রোজা ভাঙা লাগতে পারে?
হ্যাঁ, আপনি যদি রোজা রাখার পূর্বে যথেষ্ট তরল খাবার না খান, তাতে এমনটা হতে পারে। যদি আপনার প্রসাব একদমই কমে যায়, অস্থির বোধ করেন বা অজ্ঞান হয়ে পড়তে পারেন তবে দেরী না করে কিছু পান করুন এবং রোজা ভেঙে ফেলুন। অসুস্থ হয়ে রোজা রাখা ইসলাম সমর্থন করে না। আর রোজা ভেঙে ফেললে, পরবর্তি সময়ে তা আবার রাখতে হবে।
আরও পড়ুনঃ সুস্বাস্থ্যের সাথে সিয়াম পালন করতে যে যে খাবারগুলো জরুরী
১২) ডায়ালাসিস চলা কালীন কি আমি রোজা রাখতে পারব?
না। ডায়ালাসিস এর রোগী রোজা রাখবে না এবং কাফফারা আদায় করবে।
রুগীদের জন্য রমজানের নির্দেশিকা
-
যাদের দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ আছে রমজানে তাদের ডাক্তার দেখানো ও চেকাপ করানো জরুরী। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে এমন কোনো রুগীর খাদ্যাভ্যাস বা চিকিৎসায় পরিবর্তন আনতে হলে অবশ্যই তাদের অভিজ্ঞ চিকিৎসক এর পরামর্শ নিতে হবে।
-
ঔষধের ডোজ পরিবর্তনের আগে একজন রুগীকে অবশ্যই তার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে হবে, ঔষধের ডোজের পরিবর্তন হলে এর কার্যক্ষমতা এবং পার্শ প্রতিক্রিয়ায়ও প্রভাব পরে। যেমন- যদি চিকিৎসা পত্রে দেওয়া থাকে দিনে এক বা দুই বার খেতে হবে, তা আপনি সহজেই ইফতার এবং সেহেরীতে খেতে পারবেন। কিন্তু যদি এমন হয় যে ৬ বা ৮ ঘন্টা পর পর খেতে হবে কোনো বিশেষ কারনে, তখন তা আপনার ডাক্তার ছাড়া কেউ পরামর্শ দিতে পারবে না।
-
টাইপ-২ ডায়াবেটিস এর রুগী, যারা অনেক কষ্টে রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রন করেন বা যারা বয়ষ্ক টাইপ-২ ডায়াবেটিস এর রুগী বা ঐ সব প্রেগন্যান্ট নারী যিনি ইনসুলিন নেন বা স্তন্য দানকারী তাদের সাধারনত রোজা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয় না। যারা দীর্ঘ দিন ধরে ডায়াবেটিস সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিলতা বা কিডনি ফেইলিউর বা হৃদরোগে আক্রান্ত তাদেরকেও রোজা রাখার পরামর্শ দেওয়া হয় না।
-
একজন ডায়াবেটিস এর রোগীর তার ডাক্তার এর কাছ থেকে জানা এবং শেখা উচিত যে কখন এবং কয়বার তার রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করবে। সাধারন নিয়ম হলো, যদি খাওয়ার পর গ্লুকোজ এর রিডিং ৮০-১৮০ মিঃগ্রা/ ডেসিঃলিঃ এর মধ্যে থাকে তবে তা স্বাভাবিক এবং এক্ষেত্রে যতটা সম্ভব দেরি করে সেহেরী খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। এ ধরনের রোগীদের উচিত রমজানে কঠোর পরিশ্রম থেকে বিরত থাকা, বিশেষ করে ইফতারের পূর্বে, তখন তারা লো ব্লাড সুগার এ ভুগতে পারে। অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমের কাজ, বিভিন্ন ইবাদত পালন এই সময়ে দৈনিক কার্য তালিকায় রাখা যেতে পারে।
-
যখন গবেষনা বলে যে রোজা রাখা হার্ট এর রোগীদের জন্য ভালো, তখনও কিছু কিছু হার্ট এর রোগী যাদের সমসাময়িক সময়ে হার্ট এটাক হয়েছে বা হার্ট এর অপারেশন হয়েছে তাদের জন্য রোজা রাখার পরামর্শ দেওয়া না।
-
অল্প কিছু সংখ্যক ডায়াবেটিকস ও হার্টের রোগীদের জন্য রোজা বিপদজনক হলেও ব্যাক্তির রক্তের উপকারী কোলেস্টরেল প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ বৃদ্ধিতে রোজা উপকারী ভুমিকা পালন করে। তারপরও একজন রোগীর রোজা রাখার পূর্বে অবশ্যই তার চিকিৎসক এর পরামর্শ নেওয়া উচিত কিভাবে রোজা রাখবে, ঔষধের ডোজ কি হবে, কিভাবে তার চিকিৎসা চলবে।
-
অনেক গর্ভবতী নারী রয়েছেন যারা নিরাপদে নিশ্চিন্তে রোজা রাখতে পারেন কিন্তু এটি ব্যতিক্রম। যেসব গর্ভবতি নারীদের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্ত চাপের মত সমস্যা রয়েছে তাদের রোজা রাখা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় নিষেধ।