কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে কার্যকরী উপায়!
কোলেস্টেরলের কথা বলতে আমরা সবাই বুঝি এটি খারাপ। কিন্তু শুনতে অবাক হলেও সত্যি আমাদের শরীরে ভাল এবং মন্দ দুই ধরণের কোলেস্টেরল পাওয়া যায়। আজকে আমরা জানব দুইটি খারাপ কোলেস্টেরল ভিএলডিএল এবং এলডিএল এর পার্থক্য এবং আমাদের জীবনে এদের প্রভাব।
একটু লক্ষ্য করলে খেয়াল করবেন, আপনি যখন কোলেস্টেরলের নাম শুনেন সাথে সাথে আপনার মনে একটা আতঙ্ক চলে আসে। কিন্তু সত্যি কি কোলেস্টেরল আতঙ্কের নাম! না। কোলেস্টেরল আমাদের দেহের একটি অত্যাবশ্যক উপাদান। তবে স্বাভাবিকের তুলনায় কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি হলেই বিপদ।
সাধারণত আমাদের শরীরে ভালো ও খারাপ দুই ধরণেরই কোলেস্টেরল পাওয়া যায়। ভালো কোলেস্টেরল হচ্ছে এইচডিএল এবং খারাপ বা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হচ্ছে ভিএলডিএল এবং এলডিএল। এই লেখাতে আমরা জানব শুধু ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এবং তাদের নিয়ন্ত্রণের উপায়।
ভিএলডিএল এবং এলডিএল কী?
কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা এলডিএল) এবং খুব কম ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন (ভেরি লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন বা ভিএলডিএল) হচ্ছে আপনার রক্তে পাওয়া দুটি ভিন্ন ধরণের লাইপোপ্রোটিন। ভিএলডিএল এবং এলডিএল এর মধ্যে প্রধান পার্থক্য হল তাদের মধ্যে বিদ্যমান কোলেস্টেরল, প্রোটিন এবং ট্রাইগ্লিসারাইডগুলির পরিমাণ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। ভিএলডিএলে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেশি থাকে, আর এলডিএলে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি থাকে।
মূল লেখাতে যাওয়ার আগে আসুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জেনে নেই-
লাইপোপ্রোটিন, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইড কী?
লাইপোপ্রোটিন হল প্রোটিন এবং বিভিন্ন ধরণের ফ্যাটের সংমিশ্রণ। এগুলো আপনার রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডকে শরীরের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বহন করে নিয়ে যায়।
কোলেস্টেরল একটি চর্বিযুক্ত উপাদান যা আমাদের দেহের কোষ তৈরির জন্য বিশেষভাবে দরকার। এটি একটি জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লিভারে তৈরি হয়, যা আমাদের হজমে সাহায্য করে এবং ভিটামিন ডি ও হরমোন তৈরি করতেও সহায়তা করে।
ট্রাইগ্লিসারাইড হচ্ছে আমাদের দেহে পাওয়া সবচেয়ে সাধারণ বা পরিচিত ফ্যাট। এগুলি আপনার খাদ্য থেকে পাওয়া অতিরিক্ত শক্তিকে সঞ্চয় করে রাখে।
ভিএলডিএল এবং এলডিএল - খারাপ নাকি ভালো?
ভিএলডিএল এবং এলডিএল উভয়ই "খারাপ" কোলেস্টেরল হিসাবে বিবেচিত। আপনার দেহের সঠিকভাবে কার্যকলাপের জন্য কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড উভয়ের প্রয়োজন থাকলেও এই দুইটির অধিক উপস্থিতি আপনার ধমনীতে প্লাক তৈরি করতে পারে, যা ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে ধমনীকে সংকুচিত করে ফেলে এবং আপনার শরীরে অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্তের প্রবাহকে সীমাবদ্ধ করে। এটি করোনারি আর্টারি রোগসহ অন্যান্য হৃদরোগের কারণ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়।
ভিএলডিএল এর উপাদানসমূহ এবং কার্যকারিতা
আপনার সারা দেহে ট্রাইগ্লিসারাইড বহন করার জন্য আপনার লিভারেই ভিএলডিএল তৈরি হয়। ওজনের ভিত্তিতে ভিএলডিএলের এর প্রধান উপাদানগুলি হল -
-
ট্রাইগ্লিসারাইডস - ৭০%
-
কোলেস্টেরল - ১০%
-
প্রোটিন - ১০%
-
অন্যান্য চর্বি - ১০%
সাধারণত দেহের বিভিন্ন কোষ ভিএলডিএল বাহিত ট্রাইগ্লিসারাইডগুলিকে শক্তির জন্য ব্যবহার করে। আপনার দেহ যতটুকু ফ্যাট বা চর্বি পোড়ানোর ক্ষমতা রাখে তার চেয়ে অধিক পরিমাণে শর্করা বা গ্লুকোজ গ্রহণের ফলে আপনার রক্তে অতিরিক্ত পরিমাণে ট্রাইগ্লিসারাইড এবং ভিএলডিএল দেখা দিতে পারে। অতিরিক্ত ট্রাইগ্লিসারাইডগুলি চর্বিযুক্ত কোষগুলিতে সঞ্চিত হয় এবং শক্তির প্রয়োজনে পরবর্তীতে ব্যবহৃত হয়।
উচ্চ মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইডগুলি নিজেদের মধ্যে সংযুক্ত হয়ে মূলত আপনার ধমনীতে কঠিন বস্তুতে সঞ্চিত থাকে যাকে বলা হয় প্লাক। রক্তে এইসব প্লাক যত তৈরি হবে আপনার হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি তত বেড়ে যাবে।
বিশেষজ্ঞরা এই প্লাক তৈরির পিছনে কতগুলি কারণ উল্লেখ করেছেন-
-
অতিরিক্ত প্রদাহ (ইনফ্লামেশন)
-
উচ্চ রক্তচাপ
-
রক্তনালীগুলির আস্তরণের পরিবর্তন (সরু হয়ে যাওয়া)
-
রক্তে উচ্চ ঘনত্বের লাইপোপ্রোটিন বা এইচডিএল (ভালো কোলেস্টেরল) কমে যাওয়া
রক্তে উচ্চ মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইডগুলি মেটাবলিক সিনড্রোম এবং নন অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজের সাথেও যুক্ত।
ভিএলডিএলের স্বাভাবিক মান
একজন সুস্থ মানুষের দেহে ভিএলডিএলের স্বাভাবিক মান হচ্ছে ২-৩০ মিলিগ্রাম/ডিএল (মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার)। অর্থাৎ, ৩০ মিলিগ্রাম/ডিএল এর চেয়ে কম হওয়া উচিৎ। এর থেকে বেশি হলে তা আপনাকে বিভিন্ন হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকিতে ফেলতে সক্ষম।
ভিএলডিএলের লেভেল ঠিক রাখতে করণীয়
-
ভিএলডিএল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড দুইটি যেহেতু একটি অপরটির সাথে সম্পর্কযুক্ত, তাই সহজেই আপনি আপনার ট্রাইগ্লিসারাইড লেভেলকে কমিয়ে ভিএলডিএল লেভেলকে কমিয়ে রাখতে পারেন।
-
ওজন হ্রাস, স্বাস্থ্যকর ডায়েট এবং ব্যায়াম এগুলির সংমিশ্রণ করতে পারলেই আপনি ভিএলডিএল এর লেভেল ঠিক রাখতে সক্ষম হবেন।
-
স্বাস্থ্যকর চর্বি গ্রহণ করা এবং চিনি ও অ্যালকোহলকে সম্পূর্নরূপে বর্জন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
-
তবে কারো কারো ক্ষেত্রে ঔষধ সেবনের প্রয়োজনও দেখা দিতে পারে।
হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর ১৫টি কার্যকরী উপায়
প্রেসক্রিপশন ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ আর নয়
এলডিএল এর উপাদানসমূহ এবং কার্যকারিতা
লিভারে উৎপাদিত কিছু ভিএলডিএল রক্ত প্রবাহের মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। আর বাকিগুলি রক্তে এনজাইম দ্বারা এলডিএলে রূপান্তরিত হয়।
এলডিএলে ভিএলডিএলের তুলনায় কম মাত্রায় ট্রাইগ্লিসারাইড এবং উচ্চ মাত্রায় কোলেস্টেরল ও প্রোটিন রয়েছে। ওজনের ভিত্তিতে এলডিএল এর প্রধান উপাদানগুলি হল -
-
কোলেস্টেরল - ২৬%
-
প্রোটিন - ২৫%
-
ট্রাইগ্লিসারাইডস - ১০%
-
অন্যান্য চর্বি - ১৫%
এলডিএল আপনার সারা শরীরে কোলেস্টেরল বহন করে। আপনার দেহে অত্যধিক কোলেস্টেরল রক্তে এলডিএলের স্তরকে বাড়িয়ে দেয়। আর তা আপনার ধমনীতে প্লাক তৈরি হওয়ার সাথেও জড়িত।
রক্তে এলডিএলের অধিক মজুদ অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস এর দিকে ধাবিত করে। অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস তখনই সৃষ্টি হয় যখন প্লাকগুলি শক্ত হতে থাকে এবং যা ধমনীকে সংকুচিত করে দেয়। ফলে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়।
যেহেতু আপনার রক্ত আপনার হার্টে অক্সিজেন বহন করে থাকে, তাই যদি এই অবস্থা দেখা দেয় তবে আপনার হার্ট পর্যাপ্ত অক্সিজেন পেতে অক্ষম হয়। এর কারণে বিভিন্ন ধরণের হার্টের সমস্যা দেখা দেয়, যেমন এনজাইনা (বুকে ব্যথা) হতে পারে, বা রক্ত প্রবাহ পুরোপুরি অবরুদ্ধ থাকলে হার্ট অ্যাটাক কিংবা স্ট্রোকও হতে পারে।
এলডিএলের স্বাভাবিক মান
এলডিএলের পরিমাণ যত কম হবে আমাদের শরীরের জন্য তত ভাল।
সাধারণত এলডিএলের লেভেল ১০০ মিলিগ্রাম/ডিএল এর নিচে হলে উত্তম, তবে তা নির্ভর করে আপনার হৃদরোগের ঝুঁকি কতটুকু।
আর এলডিএলের লেভেল ১০০ মিলিগ্রাম/ডিএল এর উপর চলে যাওয়া মাত্রই আপনাকে সতর্ক হতে হবে।
এলডিএল এর লেভেল ঠিক রাখতে করণীয়
এলডিএলের লেভেল ঠিক রাখতে থেরাপিউটিক লাইফস্টাইল পরিবর্তন (টিএলসি) এর জুড়ি নেই। টিএলসির তিনটি অংশ রয়েছে-
হার্টের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার সেবন- এই ব্যবস্থাপনায় মূলত একটি হার্ট-হেলথি খাওয়ার পরিকল্পনা গড়ে তুলতে হয়। পরিপূর্ণ ও ট্রান্স ফ্যাটগুলি সীমিত আকরে গ্রহণ করতে হয়।
এর জন্য বাদাম, অ্যাভোকাডো, ওটসমিল এবং ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ মাছ খেতে পারেন।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার এড়িয়ে চলুন, যেমন গরুর মাংস, মাখন এবং পনির।
ওজন ব্যবস্থাপনা- যদি আপনার ওজন বেশি হয়ে থাকে তবে ওজন হ্রাস করার মাধ্যমে আপনার এলডিএল হ্রাস করতে পারেন।
শারীরিক কার্যকলাপ- প্রত্যেকেরই নিয়মিত শারীরিক ক্রিয়াকলাপ (কমপক্ষে ৩০ মিনিট) করা উচিত।
এছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ওষুধের সেবনের মাধ্যমে এলডিএলের লেভেল কমানোর ব্যবস্থা। হেলথি জীবনযাত্রার পরিবর্তনগুলি যদি আপনার কোলেস্টেরলকে যথেষ্ট পরিমাণে হ্রাস করতে না পারে তবে আপনার ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
বাজারে বর্তমানে স্ট্যাটিন সহ বেশ কয়েকটি ধরণের কোলেস্টেরল হ্রাসকারী ওষুধ পাওয়া যায়। ওষুধগুলি বিভিন্ন উপায়ে কাজ করে থাকে তবে এদের বিভিন্ন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ব্যতিত এইসব ওষুধ সেবন করা একদমই ঠিক নয়। কোন ওষুধটি আপনার জন্য উপযুক্ত তা সম্পর্কে আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলেই নির্বাচন করা উচিত। এইসব ওষুধ সেবনের সাথে সাথে আপনাকে তখন আপনার জীবনযাত্রার অন্যান্য পরিবর্তনগুলিও চালিয়ে যাওয়া উচিত।
যেহেতু এলডিএল এবং ভিএলডিএল উভয়ই খারাপ কোলেস্টেরোল নামে পরিচিত তাই আমাদের সকলের এদের ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। সকলের উচিত শারীরিক অনুশীলন বাড়ানো এবং স্বাস্থ্যকর বিভিন্ন খাবার গ্রহণ করা। ধূমপান ত্যাগ এবং অ্যালকোহল বর্জন করতে হবে।
আপনার কোলেস্টেরল সম্পর্কে এবং আপনার ডায়েট, ব্যায়াম, জীবনযাত্রার পরিবর্তন এবং ওষুধের সাহায্যে কীভাবে হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারেন সে সম্পর্কে আপনার ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।