মুঠোফোনে টাচস্ক্রিনের ব্যবহার কি স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ?

টাচস্ক্রিন ব্যবহারের ঝুঁকিসমূহ কি কি? টাচস্ক্রিন কিভাবে ব্যবহার করব? ঝুঁকিসমূহ আমরা কিভাবে কমাতে পারি?

বহুল ব্যবহৃত বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, টাচস্ক্রিন ল্যাপটপ বা কম্পিউটার এগুলো সবই আমাদের কব্জি, বাহু, ঘাড়, পিঠ, কোমর এবং চোখের স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা তৈরি করতে পারে, যদি না আমরা এগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করি।

মুঠোফোনে বা মোবাইল ফোনে টাচস্ক্রিন এর বিচরণ আজ সর্বত্র। মোবাইল ফোন বা ল্যাপটপের স্ক্রিন বা আমাদের গাড়ির কনসোল, অত্যাধুনিক শপিংমল বা বিভিন্ন সার্ভিস সেন্টারের প্রবেশদ্বার, সর্বত্রই এখন টাচস্ক্রীন কিবোর্ড তথা বাটনযুক্ত কিপ্যাডকে ক্রমশ প্রতিস্থাপিত করছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো প্রযুক্তির এই এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে কি? ইনফোওয়ার্ল্ড (তথ্য বিষয়ক ম্যাগাজিন) ও অন্যান্য উৎস আমাদের জানাচ্ছে এ সম্পর্কে।

যেকোনো ব্যস্ত রাস্তায় অল্প সময় কাটালেই আমরা খেয়াল করব মানুষ বিভিন্ন টাচস্ক্রিন ডিভাইস যেমন স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট বিপজ্জনকভাবে ব্যবহার করছে। এর সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হল কানে ফোন ধরে রাস্তা পার হওয়া, গাড়ি বা বাইক চালাতে চালাতে ফোন ব্যবহার করা, ফুটপাতে চলার সময় ফোন ব্যবহারে মগ্ন থাকায় আশেপাশে খেয়াল না করা। কিন্তু টাচস্ক্রিন ব্যবহার করার ফলে চারপাশে খেয়াল না করা এর একমাত্র ঝুঁকি নয়। এর সাথে প্রাসঙ্গিক আরও বেশ কিছু লুকিয়ে থাকা স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে যেগুলো সম্পর্কে মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই সচেতন নয়। আর দিনকে দিন গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে টাচস্ক্রিনের ব্যবহার যতই বাড়ছে, মুঠোফোন ব্যবহারের ফলে মানুষের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা ততই বেড়ে চলেছে। 

 

টাচস্ক্রিন ব্যবহারের ঝুঁকিসমূহ

টাচস্ক্রিন ব্যবহারের ফলে মানুষের যেসব সমস্যা হতে পারে বিজ্ঞানের পরিভাষায় এগুলোকে বলা হয় 'আরগোনোমিক রিস্ক'। এবং এই সমস্যাগুলো নতুন কিছু নয়, কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হবার ফলে আশির দশক থেকেই এগুলো পরিলক্ষিত হচ্ছে। কিন্তু এখন ল্যাপটপ কম্পিউটার ডেস্কটপ কম্পিউটারের তুলনায় বেশি বিক্রি হওয়ায় এবং টাচ স্ক্রিন স্মার্ট ডিভাইসকে সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে দেওয়ায় সমস্যাগুলো ক্রমেই বেড়ে চলছে। মেশিন হিউম্যান ইন্টারঅ্যাকশন সম্পর্কে কত কয়েক দশকের গবেষণা মূলত তিন ধরণের টাচ স্ক্রিন জনিত স্বাস্থ্য ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে।

১) রিপিটেড স্ট্রেস ইনজুরি (RSI)

এই সমস্যাগুলো সাধারণত একই মাংসপেশি বারবার ব্যবহার করার ফলে হয়ে থাকে এবং এগুলো বিভিন্ন অস্থিসন্ধি, ছোট বা বড় মাংসপেশির সাথে সংযুক্ত লিগামেন্ট এবং বিভিন্ন স্নায়ু তন্তুগুলোকে প্রভাবিত করে। যেমন মানুষ ক্ষুদে বার্তা বা মেসেজ আদান প্রদান করতে তার বুড়োআঙ্গুল ক্রমাগত ব্যবহার করলে এক ধরণের ব্যথা জনিত সমস্যা হতে পারে যাকে বলা হয় কুইভেইন সিনড্রোম। এর ফলে বুড়ো আঙুলের সাথে সংযুক্ত টেন্ডনের হালকা বা তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে পারে যা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। একই সমস্যা ডেস্কটপ কিবোর্ড দীর্ঘ সময় ব্যবহারের ফলেও হতে পারে।

২) অস্বাভাবিক ভঙ্গিমায় বসে থাকা জনিত সমস্যা

এই কন্ডিশনগুলো ইতিপূর্বে বর্ণিত রিপিটেড স্ট্রেস ইনজুরির সাথে সম্পর্কিত। এগুলো ঘটে যখন মানুষ এমন ভঙ্গিমায় দীর্ঘ সময় বসে থাকে যে তা ফিজিক্যাল স্ট্রেসের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা ঘটতে পারে টাচ স্ক্রিনে কাজ করার সময় হাতের অস্বাভাবিক পজিশন থেকে বা টাইপ রাইটারে টাইপ করার সময় কব্জির অবস্থানের কারণে। এর একটি বহুল পরিলক্ষিত উদাহরণ হল কারপাল টানেল সিনড্রোম, যেটি কব্জির মিডিয়ান স্নায়ুর ওপর চাপ পড়ার কারণে হয়ে থাকে।

৩) আই স্ট্রেইন বা চোখের সমস্যা

আমরা সকলেই টাচস্ক্রিন বা কোন পর্দায় কিছু পড়ার সময় মানুষকে চোখ কুঁচকে থাকতে দেখেছি। এটি চোখের উপর যথেষ্ট চাপ তৈরি করতে পারে যখন পর্দার ছবি বা লেখা গুলো স্পষ্ট থাকে না বা রোদের প্রতিফলন এবং তীব্র আলোর কারণে পর্দার লেখাগুলোর পাঠোদ্ধার করা অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে কম্পিউটার ভিশন সিনড্রোম এর কথা বলে থাকেন যার উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো চোখ লাল হওয়া, চোখে ব্যথাজনিত সমস্যা, চোখে ঝাপসা দেখা এবং হালকা বা তীব্র মাথা ব্যথা অনুভূত হওয়া।

এ পর্যন্ত বর্নিত সমস্যাগুলো একসময় ডেস্কটপ কম্পিউটারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে ব্যবহারের অভিজ্ঞতা হবার ফলে এখন ডেস্কটপ কম্পিউটার ডিজাইন করার সময় আরগোনোমিক ফ্যাক্টরগুলোও বিবেচনা করা হয়। এজন্যে কম্পিউটার সামগ্রীর নির্মাতারাই এখন মনিটরের স্ট্যান্ড এর উচ্চতা কত হবে, চোখের সাথে কত ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে মনিটরটা ব্যবহার করতে হবে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখেন। দুর্ভাগ্যবশত ল্যাপটপ বা টাচস্ক্রিন ডিভাইসগুলোর ক্ষেত্রে এই সচেতনতা এখনো বহুলভাবে গড়ে ওঠেনি।

 

ল্যাপটপ ব্যবহারের যত অসুবিধা

একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার ডিজাইন করার সময় যেভাবে আরগোনোমিক ফ্যাক্টরগুলো বিবেচনায় আনা যায়, একটা ল্যাপটপের জন্য তা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। যেমন একটা ল্যাপটপের ডিসপ্লে আর কিবোর্ড একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে, ফলে দুটোকেই একসাথে দেহের জন্য সুবিধাজনক অবস্থানে রাখা সম্ভব নয়। এর একটা সমাধান হতে পারে একটা উঁচু আসনের উপর ল্যাপটপটা রাখা যাতে এর স্ক্রিনটা চোখের সম উচ্চতায় থাকে, এবং একটা আলাদা ওয়ারলেস কিবোর্ড ব্যবহার করা যেটা টেবিলের ওপর হাতের লেভেলে থাকবে। ল্যাপটপের আরো বড় অসুবিধা হলো এটা অফিস এবং বাড়ি দু'জায়গাতেই সমানভাবে ব্যবহৃত হয়, ফলে অনেক ক্ষেত্রে অফিসের কাজও আমাদের বাড়িতে চলে আসে। বিছানায় বসে কেউ যখন ল্যাপটপে অফিসের কাজ করেন অনেক সময় তার শরীরের পজিশন ঠিকভাবে রাখার কথা মনে থাকে না, যার ফলশ্রুতিতে ঘাড়ে ও কোমরে ব্যথা দেখা দেয়। এ কারণে বাড়িতে বসে কাজ করলেও আমাদের সম্ভব হলে বিছানা ব্যবহার না করে একটা ডেস্ক অথবা টেবিলে ল্যাপটপ ব্যবহার করা উচিত।

 

টাচস্ক্রিনের ক্ষেত্রে কি করা উচিত?

টাচস্ক্রিন ডিভাইস ব্যবহারের ক্ষেত্রে ল্যাপটপ ব্যবহারের চ্যালেঞ্জগুলো আরো বড় হয়ে দেখা দেয়। কারণ একটা টাচ স্ক্রিন হরাইজন্টাল অথবা ভার্টিক্যাল প্লেসমেন্টসহ যে কোন পজিশনে ব্যবহার করা সম্ভব। এবং এটা যদি এমন পজিশনে থাকে যে আমাদের ঘাড় বাঁকা করে স্ক্রিনটা ব্যবহার করতে হয়, তাহলে তা ব্যথার সৃষ্টি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা এবং আইফোনের জন্য জগদ্বিখ্যাত উদ্ভাবক স্টিভ জবস ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে একটা সম্মেলনে বলেছিলেন, টাচ সারফেসগুলো কখনো ভার্টিক্যাল পজিশনে থাকতে চায়না। কারণ স্ক্রীন গুলো যত খাড়া হয়ে থাকবে ততই আমাদের এটা ব্যবহার করতে কব্জি বেশি বাঁকাতে হবে। এর ফলে যে ভঙ্গিমাটা তৈরি হয় সেটাকে ডাক্তাররা বলে থাকেন ডরসিফ্লেক্সন (dorsiflexion), যা কব্জির কারপাল টানেল অবস্থানে মিডিয়ান স্নায়ুর ওপর চাপ তৈরি করে। 

তাহলে টাচ স্ক্রিন এর জন্য সবচেয়ে সঠিক অবস্থানটা কোনটা? বলা হয়ে থাকে ডিভাইসটা এমনভাবে রাখতে হবে যেন পুরো স্ক্রিনটা স্পষ্ট দেখা যায়। তার মানে হলো দেখার বেলায় চোখের লাইন অফ সাইট এর সাথে স্ক্রিনটা ৯০ ডিগ্রী অবস্থানে থাকতে হবে। আর টাইপ বা টাচ করার মাধ্যমে লিখতে হলে স্ক্রিনটা লাইন অফ সাইট এর সাথে ৩০ ডিগ্রী অবস্থানে থাকা ভালো।

 

দেহকে আমরা কিভাবে বাঁচাবো?

স্বাভাবিক জ্ঞান বলে স্ক্রিনে কিছু পড়তে গিয়ে চোখগুলোকে যত বেশি কাজ করতে হবে, আই স্ট্রেইন তৈরির সম্ভাবনা তত বৃদ্ধি পাবে।  বাস্তব জীবনে এর উদাহরণ হল খুব অল্প আলোয় দীর্ঘক্ষন বই পড়লে চোখে ব্যথা হয়ে থাকে। টাচস্ক্রিনের ক্ষেত্রে এই ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করে কয়েকটা ফ্যাক্টর, রিজলিউশন (ছবিগুলো কতটা স্পষ্ট দেখাবে), কনট্রাস্ট (ব্যাকগ্রাউন্ড এর তুলনায় ক্যারেক্টারগুলো কতটুকু সাদা বা কালো দেখায়) আর ব্রাইটনেস (স্ক্রিন কি পরিমাণ আলো তৈরি করছে)। আধুনিক টাচস্ক্রিন গুলোতে এই প্যারামিটারগুলো অনেক উন্নত হয়েছে, কিন্তু তার ফোনে আবার একটা নতুন সমস্যা দেখা দেয়। 

স্ক্রিন গুলো যেহেতু প্রতি বর্গইঞ্চিতে আরো বেশি পিক্সেল প্রদর্শন করছে, তার ফলে বর্ণ অক্ষর গুলো খুবই ছোট করে দেখানো সম্ভব। এতে একই জায়গায় অনেক বেশি লেখা এঁটে গেলেও তা চোখের জন্য চাপের কারণ হতে পারে। তাই টাচস্ক্রিনের জন্য ফন্ট সাইজ নির্বাচনের সময় তার চোখের জন্য স্বস্তিদায়ক আকারে রাখাই ভালো। স্ক্রিন গুলো এমনভাবে আমাদের বসাতে হবে যেন তা দেহ থেকে অন্তত এক হাত দূরে থাকে। খেয়াল রাখতে হবে চোখ যেন স্ক্রিনের দিকে সোজা তাকাতে পারে এবং ঘাড় যেন সোজা অবস্থানে থাকে। কোমর বাঁকা করে বসে থাকা বা কুঁজো হয়ে থাকা পরিহার করতে হবে পিঠ সোজা রাখার মাধ্যমে। বাহু আর কব্জির ওপর চাপ কমাতে ল্যাপটপ এবং টাচ ডিভাইসের ক্ষেত্রে সম্ভব হলে আলাদা কিবোর্ড ও মাউস ব্যবহার করতে হবে। টানা আধা ঘন্টা কাজ করে কিছুক্ষণ দেহ ও চোখকে বিশ্রাম দিয়ে একটু হেঁটে নেওয়া ভালো যেন ফিজিকাল স্ট্রেসের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত না হতে পারে।

 

পরিশেষে আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা ডেস্কটপ কম্পিউটার অনেক বেশি বছর ধরে ব্যবহার করছি। নব্বইয়ের দশকে উত্তর আমেরিকায় কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা বেশ আলোড়ন তুলেছিল, এর ফলে নির্মাতারাও ডিজাইনের ক্ষেত্রে বিষয়টি মাথায় রেখেছেন। টাচস্ক্রিনের ক্ষেত্রে এ জনিত স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আমাদের ধারণা এখনো খুব স্পষ্ট নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ঘাড়ে বা পিঠে ব্যথার জন্য আমরা মুঠোফোনকে দায়ী না করে অন্য কারণের কথা হয়তো ভাবি। যতদিন পর্যন্ত এ সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞানসম্মত ধারণা আরও স্পষ্ট না হচ্ছে, আমাদের নিজেদেরই টাচস্ক্রিনের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা মাথায় রেখে সচেতন হতে হবে।

Default user image

প্রকৃতি চক্রবর্ত্তী, লেখক, আস্থা লাইফ

পেশাগত ভাবে একজন ফার্মাসিস্ট এবং মনোজগতে একজন স্বপ্নচারী।ফার্মেসীর উপর স্নাতকোত্তর করার পর পাঁচ বছরেরও বেশী সময় ধরে কাজ করছেন দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য ঔষধ শিল্প প্রতিষ্ঠানের রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট বিভাগে।পাশাপাশি ভালবাসেন বই পড়তে ও লিখতে।প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন একদিন সব অন্ধবিশ্বাস আর কুসংস্কারের বেড়াজাল ভেঙে সুশিক্ষার আলো আসবেই।স্বপ্ন দেখেন বিশ্বপর্যটক হবার আর মানুষের জন্য কিছু করার।

Related Articles