দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ
ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারন করছে করোনাভাইরাস। ভাইরাসটির বিস্তার রোধে স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত সব নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হচ্ছে, প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হতে মানা করা হচ্ছে, পরিস্কার পরিচ্ছনতার উপর গুরুত্ব দিতে বলা হচ্ছে, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় খাবার খেতে বলা হচ্ছে, নিয়মিত ব্যয়াম করতে বলা হচ্ছে। তাই আসুন জেনে নিই করোনাভাইরাসের আক্রমন রুখে দাড়াতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য করণীয় কাজগুলো কি কি।
যেহেতু করোনাভাইরাস মোকাবেলায় কোনও ভ্যাক্সিন বা ঔষধ এখনও আবিষ্কার হয়নি অতএব এ অবস্থায় আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার উপর অনেকটাই নির্ভর করা লাগছে। আসুন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার কিছু উপায় আমরা জেনে নেই।
১. কালোজিরা হচ্ছে সব রোগের মহৌষধ। প্রতিদিন সকালে ২০-২৫ দানা কালোজিরা খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অসংখ্য উপকারি উপাদান রয়েছে কালোজিরায়। নাইজেলোন, থাইমোকিনোন, লিনোলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিঙ্ক, ফসফেট, সেলেনিয়াম, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ফসফরাস- কি নেই কালোজিরায়। জ্বর, কাশি, কফ, ডায়াবেটিক, হাপানি, অরুচি, শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা, অ্যালার্জি, শ্বাসকষ্ট সহ আরও অনেক অনেক রোগের প্রতিষেধক হচ্ছে কালোজিরা।
২. সকালের নাস্তার সাথে এক কোয়া রসুন খেতে পারি আমরা। আস্ত রসুনে এলিন (alliin) নামক উপাদান থাকে। যখন রসুনকে চিবানো হয় তখন এলিন রুপান্তরিত হয় এলিসিন (allicin) নামক উপাদানে। এই এলিসিন হচ্ছে মূলত রসুনের প্রধান উপাদান। এলিসিনে সালফার থাকে যার কারনে রসুনের স্বাদ এবং গন্ধ এতটা তীব্র হয়ে থাকে। এলিসিন অস্থিতিশিল হবার কারণে সালফার ধারণকারী নতুন উপাদানে রুপান্তরিত হয়। এই নতুন উপাদান শ্বেত রক্তকনিকাকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। মূলত যেসব ভাইরাসের কারণে সাধারন ঠাণ্ডা এবং ফ্লু হয়ে থাকে তাদের বিরুদ্ধে এই উপাদান বেশি কার্যকরী।
৩. অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খেতে পারি আমরা। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। টমেটো, গাজর, কমলা, মাল্টা, লেবু, পালং শাক, পুদিনা পাতা, কাঁচামরিচ, ক্যাপসিকাম, গ্রিন টি ও বাদাম অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার।
ভাইরাসের আক্রমনে আমাদের শরীরের কোষসমূহ বিভিন্ন শারীরিক কাজ সম্পাদনের সময় মুক্ত মৌল বা ফ্রি রাডিক্যালস তৈরি করে। এই ফ্রি রাডিক্যালস অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। এগুলোকে যদি নিস্ক্রিয় বা নিউট্রালাইজ না করা হয় তবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহের মাধ্যমে মারাত্তক ক্ষতি হতে পারে। এ অবস্থায় যদি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া হয় তবে এ বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কেননা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অস্থিতিশীল ফ্রি রাডিক্যালস এর সাথে সংযুক্ত হয়ে তাদেরকে নিউট্রালাইজ করে। এভাবে করে শরীরে অতিমাত্রায় ইনফ্লামেশন হওয়া বন্ধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাকে সচল রাখে।
৪. ভিটামিন-সি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। লেবুর টুকরো গরম পানির সাথে প্রতিদিন খেলে ভাইরাসের বিস্তার রোধ হবার সম্ভাবনা থাকে।
ভাইরাস যখন শরীরের কোষকে আক্রমণ করে তখন কোষ থেকে ইনটারফেরন নামক একটি প্রোটিন উৎপন্ন হয় যেটা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে। ভিটামিন-সি এই ইনটারফেরন প্রোটিনের উৎপাদন বৃদ্ধি করার জন্য কোষকে সহায়তা করে।
এছাড়া ভিটামিন-সি শ্বেতকনিকার মাধ্যমে সাইটোকাইনের উৎপাদনও বৃদ্ধি করে। সাইটোকাইনকে যোগাযোগ সহায়ক প্রোটিন বলা হয় যেটা ভাইরাস আক্রমনের সময় এক কোষ থেকে অন্য কোষে তথ্য সরবারহ করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে টিকে থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ বযবস্থাপনাকে মজবুত করে।
৫. প্রিবায়োটিক যেসব খাবারে পাওয়া যায় যেমন পেঁয়াজ, রসুন, কলা, ওটস, আপেল, শতমূলী সেগুলো খাওয়া যেতে পারে। আমাদের অন্ত্রে প্রোবায়োটিক থাকে যেগুলো হচ্ছে জীবিত জীবাণু এবং এদের উপস্থিতি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। আর প্রিবায়োটিক মূলত প্রোবায়োটিক জীবাণুর খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রিবায়োটিক অন্ত্রের উপকারি জিবাণুর (প্রোবায়োটিক) বিস্তার ঘটায় যার ফলে অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি সাইটোকাইন উৎপন্ন হয় যেগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৬. স্ট্রিট ফুড, ফাস্ট ফুড, ফিজি ড্রিংক , তেলে ভাজা খাবার এবং যেকোনো অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করতে হবে। এগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে।
৭. পর্যাপ্ত ঘুম দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা হয়ত মনে করতে পারি যে ঘুমের সময় আমাদের শরীর এবং মস্তিষ্ক বন্ধ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে ঘুমের সময় আমাদের শরীর এবং মস্তিষ্ক অনেকাংশে দিনের তুলনায় আরও কঠোর পরিশ্রম করে, কোষ পুনরুদ্ধার করতে প্রক্রিয়াধীন থাকে, তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং স্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৮. ধূমপান, মদ্যপান, তামাকজাত দ্রব্য পরিহার করা। কেননা এগুলো শরীরে উপস্থিত অ্যান্টিবডি ধ্বংস করে। অ্যান্টিবডি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপন্ন প্রোটিন যেগুলো শরীরে প্রবেশক্রিত ভাইরাসকে ধ্বংস করে। এসব নেশাজাতীয় দ্রব্য অ্যান্টিবডি ধ্বংসের পাশাপাশি ফুসফুসের কার্যক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। সুতরাং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ঠিক রাখতে অবশ্যই ধূমপান, মদ্যপান, তামাকজাত দ্রব্য পরিহার করা লাগবে।
৯. স্ট্রেস বা প্যানিক হওয়া যাবে না। স্ট্রেস হরমোন করটিকোস্টেরয়েড, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সুতরাং প্যানিক না হয়ে সাবধানতা অবলম্বন করা এবং পরিবারের সাথে সুন্দর সময় ব্যয় করা উচিত।
১০. শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যয়াম ফুস্ফুস এবং শ্বাসনালী থেকে জীবাণু বের করতে সহায়তা করে। প্রতিদিন নিয়ম করে ব্যয়াম করা হলে কাশি, ফ্লু এবং অন্যান্য শারীরিক অসুস্থতা হবার সম্ভাবনা কমে যায়। ব্যয়াম শরীরের অ্যান্টিবডি এবং শ্বেতকনিকায় পরিবর্তন আনে যার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
পরিশেষে বলতে চাই সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যয়াম, পরিচ্ছনতা এবং স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন সবকিছুই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনাকে জোরদার করতে এবং ব্যকটেরিয়া ভাইরাসের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে।