বেঁচে থাকতে আমাদের ব্যথা ও আনন্দের অনুভূতি কেন দরকার?
কি কারণে আমাদের জ্বর হলে দুর্বল বা অসুস্থ্য লাগে, কেন হাত কেটে গেলে ব্যথা পাই, বিভিন্ন অসুখের উপসর্গ কি কারণে হয় এবং তা কি বার্তা বহন করে? আর আনন্দ বা সুখানুভূতির বিশেষ কোন কারণ আছে কি? উত্তর জানতে আমাদের প্রাণের গভীর রহস্যময়তায় ডুব দিতে হবে। আসুন তাহলে একসাথে রহস্যভেদ করি।
ধরুন রান্নাঘর যেতে যেতে টেবিলের কোনার সাথে আপনার পায়ের আঙ্গুল ধাক্কা খেল। ব্যথার চোটে চোখ মুখ কুচকে সহ্য করলেন। কিংবা হঠাৎ জ্বরে ভুগে কষ্ট পাচ্ছেন, কখনো কাশিতে কষ্ট পেলেন। শুধু দৈহিক কষ্টই নয়, মানসিক কষ্টও যে একই রকম পীড়াদায়ক। আর শুধু তো কষ্টই নয়, আনন্দও আছে, ভালো কিছু খেলে, সুন্দর কিছু দেখলে, কিছু অর্জন করলে আমাদের আনন্দ হয়। কিন্তু এই অনুভূতিগুলোর কি দরকার ছিলো?
উত্তরটা জানলে নিজের শরীর সম্পর্কে এমন এক জ্ঞান লাভ করবেন যা জীবনকে আরো সূক্ষ ও সত্য দৃষ্টিকোণে দেখতে সাহায্য করবে। দুঃখ, কষ্ট ও অসুখের কারণ উপলব্ধি করবেন, শক্তি পাবেন, এবং ক্ষতিকর ভাবে আনন্দে বয়ে যাওয়াও এড়ানো সম্ভব হবে।
আমরা কেন ব্যথা ও আনন্দ পাই এর সোজাসাপ্টা উত্তরটা আমরা সবাই আধ-একটু জানি। বিজ্ঞানের ছাত্র হলে বেশ ভালোভাবেই তা জানার কথা। ছোট করে বললে, আমাদের মস্তিস্কই সব আনন্দ ও ব্যথার অনুভূতি জাগায়, আর কোথায় ব্যথা বা সুখানুভূতি হচ্ছে তা আমরা জানতে পারি আমাদের শরীর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্নায়ুর মাধ্যমে। এটুকুতে বোঝা গেলো অনুভূতি কিভাবে হয়। কিন্তু এসব অনুভূতির প্রয়োজন কোথায়?
আমাদের ব্যথা ও আনন্দের মূল কারণটি জানতে কিছু ধারাবাহিক বিষয় সম্পর্কে জানা থাকা দরকার। একে একে বিষয়গুলো জানলে উত্তরটি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে থাকবে। আসুন শুরু করা যাক।
জীবনের উদ্দেশ্য
মানুষ সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে জটিল জীবের অন্তর্গত হলেও তার অস্তিত্বের মূল ভিত্তি অন্য সব প্রাণির চেয়ে আলাদা নয়। জীবনের উদ্দেশ্য বুঝতে চলুন জীবনের এককে অর্থাৎ কোষে ফিরে যাই।
আমাদের শরীর অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত। কোষের বিভিন্ন ধরণ ও কাজ থাকলেও তার মূল কাজ হলো নতুন কোষ তৈরি করা, অর্থাৎ বিভাজন করা। আমাদের কোষের ভেতরে থাকে ডিএনএ, যা আমাদের বৈশিষ্ট ও জীবনের সকল তথ্য বহন করে। একটি কোষ বিভাজিত হলে প্রতিটি বিভাজিত কোষেই একই ডিএনএ থাকে। অর্থাৎ কোষের মূল কাজ হলো পরবর্তি প্রজন্মের কোষে জেনেটিক্যাল তথ্য বা ডিএনএ সরবরহ করা।
ক্ষুদ্র অ্যামিবা, ব্যাক্টেরিয়া ও সকল এককোষি প্রাণিরও বিভাজনের কারণটা একই। তা হলো সংখ্যা বৃদ্ধি করে নিজের ডিএনএ এর কপি তৈরি করা।
এবার একটু বড় প্রাণির দিকে আসি। ইদুর। প্রত্যেক প্রাণির মত ইদুরের শরীরের কোষও প্রতিনিয়ত বিভাজিত হচ্ছে। দেহের কোষের বিভাজনের কারণ হলো, আমাদের শরীরে বেড়ে ওঠায় সাহায্য করা ও প্রতিনিয়ত যে কোষ গুলো মারা যাচ্ছে সেগুলো পূরণ করা। তার শরীরের সব কোষ তার ডিএনএ বহন করছে। এখন ছোট ইদুরের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য কি হতে পারে?
তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য হলো, সে তার শরীরে যে সব জেনেটিক তথ্য বহন করছে তা যেন বৃথা না যায় সেই বন্দবস্ত করা। অর্থাৎ প্রজনন করে নিজের ডিএনএ এর অনেক গুলো কপি তৈরি করে যাওয়া।
পৃথিবীতে এমন কোন প্রাণি নেই যে কিনা জীববৈজ্ঞানিক তত্বে এই উদ্দ্যেশ্যের বাইরে অবস্থান করে। প্রত্যেক প্রাণিরই সবচেয়ে বেসিক লক্ষ হলো তার জিন বা ডিএনএর অস্তুত্ব টিকিয়ে রাখা।
শুনতে একটু অবাক লাগলেও মানুষও তার ব্যতিক্রম নয়। যদিও মানুষ জ্ঞান বিজ্ঞানে এ সভ্যতার পথে অনেক দূর পেরিয়ে এসেছে, তবু তাদের জীবনের আদিম উদ্দেশ্য হলো বংশবৃদ্ধি। কিন্তু বংশবৃদ্ধিই যদি উদ্দেশ্য হবে তবে এতো জটিল জীব হবার দরকার কি ছিলো? উত্তরটা হলো টিকে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি। একটি প্রাণি যদি উন্নত হয়, তবে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা ও বংশ বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেড়ে যায়। টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ানো প্রয়োজন এটা নিশ্চিত করতে যেন আমাদের জেনেটিক ইনফরমেশন ঠিক ভাবে পরবর্তি প্রজন্মে যেতে পারে। এই টিকে থাকার ব্যপারটা থেকে আমাদের পরবর্তি প্রশ্ন গুলোর উত্তর মিলবে।
আমাদের শরীর আসলে কি?
শরীর হলো টিকে থাকার সম্ভাবনা বাড়ানোর একটি বায়োলোজিক্যাল যন্ত্র। এটি এমন সুচারুভাবে সৃষ্টি বা বিবর্তিত হয়েছে যে টিকে থাকার বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অভূতপূর্ব ও জটিল কলাকৈশল রপ্ত করেছে। শরীরের মূল উদ্দেশ্য হলো বংশ বৃদ্ধি করা ও বংশ বৃদ্ধি করার জন্য যত বেশি সময় সম্ভব টিকে থাকা। মানুষ ও অন্যান্য উন্নত প্রাণি এও নিশ্চিত করতে চায় যে, তাদের সন্তান যেন তার জিন ঠিকমত পরবর্তি প্রজন্মে পৌঁছাতে পারে। ঠিক এ কারণেই সন্তান লালন-পালনের চল শুরু হয়।
ব্যথার উদ্দেশ্য কি?
আমাদের শরীরে এমন ভাবে সৃষ্টি যাতে বিশেষ কিছু কর্মকান্ডে শরীরর আমাদের শাস্তি ও সতর্কতা মূলক বার্তা দেয়। কর্মকান্ড গুলো সেগুলোই যা আমাদের শরীরের টিকে থাকা ও বংশবৃদ্ধিতে কোনরূপ বাঁধা সৃষ্টি করে। এবার একটু চিন্তা করা যাক।
দরজার কোনায় পায়ে বাড়ি খেলে আপনার ব্যথা হয়। কারণ সে ব্যাথাটুকু না পেলে আপনি পা কে সাবধানে রাখার চেষ্টা করতেন না। আপনার পা আপনার টিকে থাকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই ব্যথার দিয়ে সেই অঙ্গের সুরক্ষা আপনার শরীর নিজেই বুঝে নিচ্ছে। আমাদের সকল অঙ্গপ্রত্যঙ্গই তাই।
হাত-পা-মাথা বলতে গেলে টিকে থাকার ক্ষেত্রে কোন অঙ্গই অপ্রয়োজনীয় নয়। শুধু তো ধাক্কা খেয়ে ব্যথা পাওয়াটাই তো ব্যথা নয়। তাহলে আপনি বাঁকা হয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকলে আপনার কোমর ব্যথা করে কেন? নিশ্চিতভাবে বাঁকা হয়ে বসা মেরুদন্ডের জন্য খারাপ যা আপনার শরীরের সব স্নায়ু বহন করে। মেরুদন্ডে ক্ষতি হওয়া মানে শরীর নিষ্ক্রিয় হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা। তাই শরীর ব্যথাকে একটি ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করে যেন আপনি এই ক্ষতিকর কাজটি আর না করেন।
ধরুন আপনার শরীরে কোন এক ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমন হয়েছে। এমন অবস্থায় শরীর রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে চালু করে ব্যাক্টেরিয়া ধ্বংসের চেষ্টা করে। ব্যাক্টেরিয়াকে সম্পুর্ণ অকেজো করে তুলতে, শরীরের সব শক্তি প্রতিরক্ষায় ব্যাবহার হয়। যে কারণে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে শরীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে দেয় যেন ব্যাক্টেরিয়া বংশবৃদ্ধি ব্যহত হয়। এই ব্যাপারটাই হলো জ্বর। উল্লেখ্য জ্বর আসার আরো অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সবক্ষেত্রেই তা শরীরের প্রতিরক্ষার জন্য হয় এবং শরীর বিশ্রাম নেওয়ার বার্তা দেয়।
কোথাও কেটে গেলে তা সংক্রমণ, রক্তপাত আরও অনেক ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই শরীর ব্যাথার অনুভূতি সৃষ্টি করে যেন আমরা কেটে যাওয়া যায়গার যত্নে মনোযোগ দেই। আপনি যদি একটু খেয়াল করেন তবে সব রকমের শারিরীক ব্যথারই একই ধরণের যোগসূত্র খুঁজে পাবেন। এই বিষয়টা জানা থাকলে ব্যথা ও রোগ সংক্রান্ত উপসর্গের কারণ অনুমান করতে পারবেন এবং অযথা কোন উপসর্গ নিয়ে দুশ্চিন্তা এড়িয়ে যাওয়া যাবে।
আরেকটি মজার ব্যপার খেয়াল করুন, ধরুন ক্রিকেট খেলছেন। একটা বল আপনার সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত করলো। ঠিক একই আঘাত অন্যকোথাও লাগালে যে ব্যথা হতো তার অনেক অনেক গুন বেশি ব্যথা পাবেন। এর কারণটা কি? কারণটা হলো এইযে, যে অঙ্গগুলোর গুরুত্ব টিকে থাকা ও পরবর্তি প্রজন্মে জিন ট্রান্সফার এর জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা আমাদের শরীর বিশেষ ভাবে প্রতিরক্ষা করতে চায়।
শারিরীক ব্যথা না হয় গেল। তবে মানসিক ব্যথার কি কারণ? চলুন একটু বিস্তারিত জানা যাক।
মানসিক কষ্টের নেপথ্যে
মানুষ ও মানব মস্তিস্কের গঠন ও কার্যাবলি এতো জটিল যে তার সবকিছু খুব সহজে বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। তবুও মৌলিক মানসিক কষ্টগুলোর সাথে আমাদের বেঁচে থাকার যোগসূত্র খুব সহজেই পাওযা যায়।
যেমন ধরুন, একা থাকা আমাদের জন্য কষ্টকর। এই কষ্টের উৎস কোথায়? মানুষ সমাজ ছাড়া একা থাকলে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা কমে যাবে। সমাজ সকল মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। তাই সামাজিক হতে আমাদের ভালো লাগে। একা থাকতে কষ্ট হয়।
আবার প্রিয় মানুষ হারালে আমাদের কষ্ট হয় কারণ, কারণ কাছের মানুষই আমাদের সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা দেয়, মনোযোগ দেয়। যা টিকে থাকাকে আরো সহজ করে।
প্রেমে ব্যর্থ হলে আমরা প্রচন্ড কষ্ট পাই, কারণ সেক্ষেত্রে আমাদের অস্তিত্বের সবচেয়ে আদিম দিকটা অর্থাৎ বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনায় টান পড়ে। মানুষের ক্ষেত্রে মানসিক ব্যপার গুলো এতো সহজে ব্যখ্যা করা সহজ নয়। প্রত্যেকটা মানসিক অবস্থার কারণের আরো অনেকগুলো যোগসূত্র থাকে। এবং সেই যোগসূত্রেরও থাকে শাখা প্রশাখা। তবে একটু ভাবলে সবকিছুরই যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
সুখ বা আনন্দের ব্যখ্যা
সুখ আনন্দ দুঃখ এমনকি সব অনুভূতির উৎস আমাদের মস্তিস্কে। ভালো লাগলে আমাদের মস্তিস্কে এমন কিছু হরমোন (Serotonin, Dopamine, Endorphins, Oxytocin) ক্ষরণ হয় যা সুখের অনুভূতি দেয়। দুঃখের জন্যও রয়েছে আলাদা আলাদা হরমোন। তাহলে সুখ বা আনন্দ পাওয়ার প্রয়োজনীয়তা কি?
সুখ বা আনন্দ হচ্ছে আমাদের মস্তিস্কের পুরষ্কৃত করার একটা উপায়। মস্তিস্ক সেই সব কাজকেই সুখ বা আনন্দ অনুভূতি দেয় যা আমাদের টিকে থাকতে, পরবর্তি প্রজন্মর জিন ট্রান্সফার করার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সহায়তা করে।
যেমন ধরুন গোসল করলে আমাদের ভালোলাগে কারণ গোসলের ফলে মস্তিস্কে সুখি হরমোন নিঃসৃত হয়। গোসল না করলে নানাবিধ চর্মরোগে ভোগার সম্ভাবনা থাকে, ও ভালো সঙ্গি পাওয়াও কঠিন হয়ে যায়। তাই আমাদের শরীর এমনভাবে প্রোগ্রাম করা যেন গোসলে আমাদের ভালোলাগা কাজ করে।
মানুষের সাথে মিশতে পারলে আমাদের আনন্দ হয় কারণ তা আমাদের সামাজিক নিরাপত্তার ইঙ্গিত দেয়। যে খাবার শরীরের জন্য বেশি পুষ্টি বহন করে, সেই সব খাবারেই আমাদের বেশি স্বাদ লাগে ও আমরা তাতে আনন্দ পাই।
আমাদের মস্তিস্ক এতো উন্নত যে আমরা এই মৌলিক জিনিসগুলোর বাইরেও আমাদের আনন্দ ও সুখের পরিধি বিস্তৃত করতে পেরেছি। ভালো একটা বই পড়লে আমরা আনন্দ লাভ করি কারণ তা আমাদের নিজেদের জ্ঞানী বোধ করতে সাহায্য করে, যা টিকে থাকাকে আরো সহজ করে দেয়।
এই সুখা ও আনন্দ অনুভূতি গুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে উৎসাহী থাকতে সাহায্য করে। জীবনকে স্বাভাবিক রাখে। কিন্তু কোন উপায়ে যদি এই আনন্দ ভালোলাগার অনুভূতিগুলোকে হ্যাক করে ভিন্ন উপায়ে তা জাগ্রত করা হয় তা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। ঠিক এই কারণেই মাদক মানসিক ও শারিরীক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই বিষয়টি অনুধাবন করলে আপনি বুঝতে পারবেন যেকোন সুখানুভূতি ও আনন্দে বয়ে যাওয়ার আগে তার ভালোমন্দ যাচাই করে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
শেষকথা
মানব শরীর নিঃসন্দেহে এই মহাবিশ্বের সবচাইতে জটিল বায়োলোজিক্যাল যন্ত্র। আমরা নিজে থেকে এর কাজ উপলব্ধি করি আর না করি, সে বিভিন্ন উপায়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখার কাজ করে চলে। তবে শরীরের এই প্রবণতা বুঝতে পারলে আমাদের জীবনের অনেক রহস্য আরো সহজ হয়ে ওঠে। রোগ, শোক, ব্যথায় শক্ত হওয়া যায়। এই আর্টিকেলটি একটি শুধু মূল বিষয় নিয়ে কথা বলা হয়েছে। বাকি ভাবনা ও পড়ালেখার দায়িত্ব পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া হলো।