বন্ধ্যাত্বের দায় নারী-পুরুষ উভয়ের! কীভাবে?

বন্ধ্যাত্ব কোন অভিশাপ নয়। সঠিক কারন নির্ধারণ ও উপযুক্ত চিকিৎসা্র মাধ্যমে বেশীরভাগ দম্পতি সন্তানলাভে সক্ষম হন। সামাজিক কুসংস্কার, অজ্ঞতা এবং পুরুষ শাসিত সমাজ বন্ধ্যাত্বের দায় কেবল নারীর ঘাড়ে চাপিয়ে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান করে।

বন্ধ্যাত্ব একজন নারীর জন্য অভিশাপের চেয়ে কিছু কম নয়। শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলের নারীরা বেশী নিগৃহীত হয় সন্তান না হওয়ার কারনে। গ্রামের স্বাস্ত্য কেন্দ্রগুলোতে দেখা যায়, সন্তান না হওয়া জটিলতা নিয়ে শুধু নারীরাই আসেন, তাদের স্বামীরা আসতে অনাগ্রহী। কারণ আমাদের মত অনগ্রসর এবং অসচেতন সমাজ এই সমস্যার জন্য নারীদের দোষারোপ করে থাকেন। 

সন্তান না হওয়াতে সামাজিকভাবে হেয় হতে হয় অহরহ। আধুনিক চিকিৎসা থাকা স্বত্বেও মানূষ জানার অভাবে, সঠিক তথ্যের অভাবে চিকিৎসা নেয় না। আজও তারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন। নারীকে করে হয় প্রতিপন্ন। চিকিৎসা করলেও তা ঝাড় ফুক বা কবরাজি অপচিকিতসা। আমরা চেষ্টা করেছি এখানে সঠিক এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক তথ্য প্রদানের যা চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা।  

সন্তান না হওয়ার কারণ কি? 

স্বামী এবং স্ত্রীর মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময় পর সন্তান সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। তাই শুধু স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক থেকে পিতামাতা হওয়ার আকাংক্ষায় নয়, দাম্পত্যকে সাবলীল করা এবং সামাজিকভাবে নানাবিধ অপ্রীতিকর প্রশ্নের সম্মুখীন না হওয়ার জন্যেও সন্তান লাভে দম্পতিরা মরিয়া হয়ে পারেন। তবে অনেকেই সন্তান না হওয়ার সঠিক কারন নির্নয় না করেই কবিরাজ বা গ্রাম্য অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা গ্রহন করে থাকে। ফলে সন্তান লাভের চেষ্টায় নানাবিধ শারীরিক সমস্যার সম্মুক্ষীন হন। গবেষণা মতে দেখা যায়-

  • প্রতি ৩ জন বন্ধ্যা নারীর মধ্যে ১ জনের প্রজনন সিস্টেমে সমস্যা থাকে।

  • প্রতি ৩ জন বন্ধ্যা পুরুষের মধ্যে ১ জনের প্রজনন সিস্টেমে সমস্যা থাকে।

  • প্রতি ৩ টি বন্ধ্যা দম্পতির মধ্যে ১ টি দম্পতি কোন কারন ছাড়াই সন্তান ধারন করতে ব্যার্থ হন।  

যে সকল কারনে নারীদের সন্তান না হতে পারে 

দীর্ঘদিন যাবত স্ত্রীরোগ ও বন্ধ্যাত্ব সম্পর্কিত চিকিৎসা প্রদান করছেন চট্টগ্রাম ইমপেরিয়াল হসপিটালের এসোসিয়েট কনসাল্টেন্ট ডাঃ নুসরাত জাহান। তিনি বলেন,যে এক বছরের বেশী সময় ধরে জন্মবিরতিকরন কোন পদ্ধিতি গ্রহন ছাড়া গর্ভ ধারন করতে ব্যর্থ হলে তখন সেটাকে বন্ধাত্ব হিসেবে ধরা হয়। বন্ধ্যাত্বের হার আমাদের দেশে নারী পুরুষ উভয়ের সমান। চলুন দেখি কেন নারীদের সন্তান হয় না বা হতে সমস্যা হতে পারে।

  • পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম নারীদের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম প্রধান কারন। এর কারনে ডিম্বাণু বড় হতে পারে না। 

  • আবার  এন্ড্রোমেট্রোসিস্টের কারনেও ডিম্বানু বড় হতে পারে না।   

  • থাইরয়েড এর সমস্যা থাকলে অথবা শরীরে প্রোল্যাক্টিন হরমোনের পরিমান বেড়ে গেলে ডিম্বস্ফোটন হয় না বা ডিম্বাণু বড় হয় না।

  • ক্ল্যামাইডিয়া বা গনোরিয়া ইত্যাদি যৌনবাহিত রোগ থাকলে গর্ভধারনে সমস্যা হতে পারে।

  • মহিলাদের ফ্যালোপিয়ান টিউবগুলি কোন কারনে ব্লক হয়ে গেলে শুক্রাণু ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌঁছাতে যেতে পারে না।

  • ডিম্বানুর গুণগতমান ভালো না হলে

  • ডিম্বাশয় বা টিউবে কোন ইনফেকশন হলে বা টিউমার, সিস্ট জাতীয় কোন রোগের কারনে অস্ত্রপাচারের প্রয়োজন হলে পরবর্তীতে গর্ভধারনে সমস্যা দেখা দিতে পারে।

  • জরায়ুতে কোন সমস্যা যেমন, টিউমার হলে বা জরায়ুর প্রাচীর যদি খুব বেশী পাতলা হয় তাহলে তাহলে ভ্রুন সেখানে প্রতিস্থাপন হতে পারে না। এই সমস্ত ক্ষেত্রে সন্তান ধারন করা সম্ভব হয় না।

  • এছাড়াও জরায়ু মুখে যদি কোন ইনফেকশন হয় অথবা সংকীর্ণ হওয়ার কারনে যদি বীর্য জরায়ু পর্যন্ত পৌছাতে না পারে তাহলেও সন্তান লাভ সম্ভব হয় না। 

যে সকল কারনে পুরুষদের সন্তান না হতে পারে

আগেই বলেছি সন্তান জন্মদানে শুধু নারীরা নন, পুরুষরাও অক্ষম হতে পারেন। এখানে দেখবো যে কোন কোন কারনে পুরুষরা সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হতে পারেন।

  • সিফিলিস বা গনোরিয়া জাতীয় কোনো যৌন রোগ হলে পুরুষদের শুক্রাণু নষ্ট হতে পারে।

  • পুরুষদের সবচেয়ে সাধারন যে বন্ধ্যাত্বের কারন তা হল বীর্যে পর্যাপ্ত শুক্রাণুর অভাব থাকা।

  • আবার অনেক সময় শুক্রাণুর সংখ্যা পর্যাপ্ত থাকলেও সেগুলোর গুণগত মান ভালো না হওয়ার জন্য অথবা দুর্বল হওয়ার কারনে ডিম্বাণু পর্যন্ত পৌছাতে না পারার কারনে সন্তান হয় না। 

  • বিভিন্ন কারনে পুরুষের শুক্রাণু নষ্ট হয়ে যেতে পারে, যেমন যারা অনেক বেশী গরমে কাজ করেন বা নিয়মিত গরম পানিতে গোসল করেন বা নাইলনের অন্তর্বাস পড়েন তাদের শুক্রাণু নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

  • পুরুষের শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা  অর্থাৎ অনেক বেশী অথবা পরিমানের তুলনায় অনেক কম থাকার কারনেও শুক্রাণুতে সমস্যা হতে পারে যেটা অনেক সময় বন্ধ্যাত্বের দিকে ঠেলে দিতে পারে। 

  • ছোট বেলায় যদি শিশুদের লিঙ্গ ও অণ্ডকোষে বা তার আশেপাশে কোন রোগ হয় বা অস্ত্রপাচার করা হয় তাহলে সেকারনেও শুক্রাণু ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। 

নারীদের সন্তান না হলে করনীয় কি? 

আমরা জানি যে, যদি কোন মহিলা লাগাতার এক বছর কোন জন্মনিয়ন্ত্রন পদ্ধতি ব্যাবহার না করার পরেও যদি গর্ভধারন করতে না পারেন তাহলে সেটাকে বন্ধ্যাত্ব বলে ধরা হয়। এই ক্ষেত্রে দ্রুততার সাথে কোন অভিজ্ঞ গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। ডাক্তার আপনার আপনার উপসর্গ এবং লক্ষন বিচার করে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যা খুঁজে বের করবেন। এবং সমাধানযোগ্য সমস্যা হলে তার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ বলে দিবেন। 

  • ডাক্তার প্রথমেই আপনাকে রক্তের পরীক্ষা দিবেন। এর মাধ্যমে থাইরয়েড, প্রোল্যাক্টিং ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের হরমোনের অবস্থা পরীক্ষা করা হবে।

  • প্রস্রাব পরীক্ষা করবে।

  • বিভিন্ন ধরনের ইমেজিং পরীক্ষা যেমন ট্রান্সভ্যাজাইনাল আল্ট্রাসাউন্ড, হিস্টেরোস্কোপি, স্যালাইন সোনোহিস্টেরোগ্রাম, হিস্টেরোসালপিঙ্গগ্রাফি ইত্যাদি করাবেন।

  • পেলভিক টেস্ট ও করাতে পারেন। 

এই সবগুলো টেস্টই যে আপনার করানো হবে এমন নয়। প্রকৃতপক্ষে আপনার লক্ষন এবং উপসর্গগুলো বিবেচনা সাপেক্ষে ডাক্তার যে সমস্যা বা সমস্যাগুলোকে সন্দেহ করবেন সেগুলোর বিচারেই পরীক্ষা করতে দিবেন। আনন্দের বিষয় হল, এখন আমাদের দেশেও বন্ধ্যাত্বের অনেক উন্নতমানের চিকিৎসা রয়েছে। এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহন করে অনেকেই মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছেন।

পুরুষদের সন্তান না হলে করনীয় কি? 

বন্ধ্যাত্বের হার মূলত পুরুষ এবং নারী উভয়েরই সমান। তাই নারীর মত পুরুষের ক্ষেত্রেও ১ বছর কোন প্রকার জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি গ্রহন না করেও যদি স্ত্রী গর্ভবতী না হন তাহলে স্বামী-স্ত্রী উভয়কেই ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। এক্ষত্রে ডাক্তার লক্ষন ও উপসর্গ বিবেচনায় পুরুষকেও কিছু পরীক্ষা করাতে বলবেন। চলুন দেখি পুরুষদের ক্ষেত্রে কি ধরনের পরীক্ষার প্রয়োজন হত পারে। 

  • সিমেন বা বীর্য পরীক্ষা। এই পরীক্ষার মাধ্যমে পুরুষের শুক্রাণুর গুণগত মান, সক্রিয়তা এবং ভুমিকা নির্ণয় করা হয়।

  • রক্ত পরীক্ষা। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে টেস্টোস্টেরন, থাইরয়েড এবং অন্যান্য হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করতে পারে। এমনকি রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে জেনেটিক কোন অস্বাভাবিকতা আছে কিনা সেটাও দেখা হয়। 

  • স্ক্রোটাল আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা। এটি অণ্ডকোষের একটি আল্ট্রাসাউন্ড যেটা দিয়ে  ভেরিকোসেলস বা অন্যান্য টেস্টিকুলার সমস্যা সনাক্ত করা যায়। 

কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?

আমরা পূর্বেই বলেছি যে, কোন প্রকার জন্ম নিয়ন্ত্রন পদ্ধতি ছাড়ায় ১ বছরের মধ্যে গর্ভধারন করতে না পারলে অবশ্যই ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হবে। 

  • তবে নারীর বয়স যদি ৩৫ বছর বা তার অধিক হয় তাহলে ছয় মাস পরেই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। কারন নারীদের বয়স যত বাড়ে তত উর্বরতা কমতে থাকে। 

  • এছাড়াও কারো যদি অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম বা PCOS থাকে, অথবা থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে ১ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করা ঠিক নয়।

  • এছড়াও নারী পুরুষ নির্বিশেষে আপনার যদি এমন কোন রোগ থেকে থাকে যেটা আপনার উর্বরতাকে নষ্ট করে ফেলতে পারে যেমন গনোরিয়া তাহলে দেরি না করে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া আবশ্যক। 

  • এছাড়াও নারীদের ব্লক করা ফ্যালোপিয়ান টিউব, পলিপ, অপসারণের জন্য অস্ত্রপাচারের প্রয়োজন হতে পারে। 

  • একইভাবে পুরুষের ক্ষেত্রেও যদি হরমোন সংক্রান্ত সমস্যা থাকে তাহলে তা ঔষধের মাধ্যমে অনেকাংশে দূর করা সম্ভব আর যদি শুক্রাণু বহনকারী টিউবগুলোতে ব্লক থাকলে তার জন্য অস্ত্রপাচারের প্রয়োজন হতে পারেন।

  • এছাড়াও শুক্রাণুর সংখ্যা কম হলে বা ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হবার মত যথেষ্ট শক্তিশালী না হলে ঔষধের মাধ্যমে তা অনেকটায় নিরাময় করা সম্ভব। 

শেষকথা

যে কোন দম্পতির জন্যেই বন্ধ্যাত্ব মোকাবেলা করা অনেক বেশী কঠিন। কারন এটি কেবল আপনার শারীরিক নয় মানুষিক এবং সামাজিক অবস্থানকেও ক্ষতিগ্রস্থ করে তুলতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল হতে পারে যা আপনার অর্থনৈতিক অবস্থার উপরেও চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে সময় নষ্ট না করে দ্রুত অভিজ্ঞ কোন গাইনি ডাক্তারের পরামর্শ নিলে অনেক সমস্যারই সহজে সমাধান হয়ে যায়। আর বর্তমানে আমাদের দেশেই বন্ধ্যাত্বের অনেক ভালো চিকিৎসাসেবা পাওয়া যাচ্ছে। তবে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা গ্রহনের জন্য স্বামী-স্ত্রীর একে অপরকে সাপোর্ট করা সর্বোপরি পরিবারের সহযোগিতা অনেক বেশী জরুরি। তাই আসুন, সামাজিক কুসংস্কার এবং গোঁড়ামিকে দূরে ঠেলে দিয়ে সন্তানহীন দম্পতিকে সন্তান সুখ লাভে সর্বোচ্চ সহযোগীতা করি।

Default user image

সানজিদা আলম, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি একজন ফ্রিল্যান্স কন্টেন্ট রাইটার। বাংলা এবং ইংরেজী উভয় ভাষাতেই লেখি। টেকনোলজি, স্বাস্থ্য, প্রোডাক্ট রিভিউ এবং ইনফরমেটিভ কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করি। লেখালেখির পাশাপাশি ভালোবাসি পড়তে।

Related Articles