সুস্থ থাকতে প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করবেন?
পানি নিয়ে ভাবার অবকাশ হয়ত আমাদের নেই—কিন্তু আপনি কি জানেন, পানি পান করার পরিমাণের উপর আমাদের শারীরিক সুস্থতা অনেকাংশে নির্ভর করে? পানি কম খাচ্ছেন অথবা বেশী খাচ্ছেন? আসুন তবে, পানির প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি পানির ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো সম্পর্কেও জেনে নেই।
‘পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল’ তবুও দেখা যায় অনেক জায়গা আছে যেখানে সুপেয় পানির অনেক অভাব! ঠিক একই ভাবে পানির অপর নাম যেমন জীবন, তেমনই পানি বাহিত রোগের কারণে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। পানি বিহীন যেমন এই পৃথিবীর কথা কল্পনা করা যায় না ঠিক তেমনই পানি ছাড়া আমাদের শরীর টিকতেও পারবে না। কেননা আমাদের শরীরের ৬০ ভাগই হচ্ছে পানি!
প্রাথমিক ভাবে প্রস্রাব এবং ঘামের সাথে আমাদের শরীর থেকে পানি কমতে থাকে। আর এই পানির ঘাটতি পূরণ করার জন্য আমাদের পরিমিত পানি পান করতে হবে। তবে এই পরিমিত শব্দটির পরিমাণ নির্ণয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। আজকে আমরা পানির সাথে আমাদের শারীরিক সুস্থতার যে সম্পৃক্ততা রয়েছে সেগুলো নিয়ে আলোচনা করব। আমরা আরো জানব যে—সুস্থ থাকার জন্য আমাদের প্রতিদিন কতটুকু পানি খাওয়া প্রয়োজন!
পানির স্বাস্থ্যগত উপকারিতা
আমাদের শরীরের ওজনের ৬০ শতাংশই পানি জাতীয় পদার্থ—আর তাই বেঁচে থাকার জন্য আমরা পানির উপর অনেক বেশী নির্ভরশীল। পানি ছাড়া আমাদের শরীরের কোষ, অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ কোন কিছুই স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারবে না।
-
মূলত প্রস্রাব এবং ঘামের মাধ্যমে, পানি আমাদের শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে দেয়
-
আমাদের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখে
-
শরীরের জয়েন্টগুলো চলাচল করার উপযুক্ত রাখে
-
শরীরের অনেক সংবেদনশীল কোষগুলোকে রক্ষা করে
পরিমিত পানি পান না করলে আমাদের শরীর পানি শুন্যতায় ভুগতে পারে। আর পানি শূন্যতা একটি স্বাভাবিক শব্দ মনে হলেও, পানির অভাবে শরীরের অনেক স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই ব্যাহত হয়। ফলে এই বিষয়টি অনেক বড় ধরণের মরণঘাতী সমস্যাতেও রূপান্তরিত হতে পারে।
প্রতিদিন আপনার কতটুকু পানির প্রয়োজন?
বিভিন্ন ভাবে আমাদের শরীর থেকে প্রতিদিন পানি বের হয়ে যাচ্ছে, আর তাই সম্পূরক ভাবেই একটি প্রশ্ন উঠে আসে—সেই ঘাটতি পূরণে আমাদের প্রতিদিন কতটুকু পানি পান করা উচিৎ?
আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমিক ও সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড মেডিসিন কর্তৃপক্ষের মতে-
-
পুরুষের জন্য দৈনিক ১৫.৫ কাপ অথবা ৩.৭ লিটার পানি
-
নারীদের জন্য ১১.৫ কাপ অথবা ২.৭ লিটার পানি পান করতে হবে
পানির সাথে কি শরীরের এনার্জি এবং মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার সম্পর্ক রয়েছে?
বিভিন্ন গবেষণায় এটা উঠে এসেছে যে আপনার মধ্যে যদি পানিশূন্যতা দেখা যায় তাহলে আপনার শরীরের এবং মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতার উপরেও তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পরবে।
আর তাই আপনার শরীর থেকে যদি পানি বেশী বের হতে থাকে, তাহলে আপনার পানি গ্রহণের পরিমাণও সেই অনুপাতে বৃদ্ধি করতে হবে। ঠিক কি কি কারণে আপনার শরীর থেকে বেশী পরিমাণে পানি বের হয়ে যেতে পারে, সেটা জেনে রাখাটাও বেশ প্রয়োজন।
যে সকল কারণে আপনাকে অনেক বেশী পানি পান করতে হবে
উপরোক্ত পানি পানের নির্দেশনাটি কিন্তু একটি স্বাভাবিক পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে দেয়া হয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থা যদি ব্যাহত হয় তাহলে আপনার পানি পানের পরিমাণও বাড়াতে হতে পারে।
শরীরচর্চা
আপনি যদি প্রতিনিয়ত ব্যায়াম করেন তাহলে আপনার শরীর থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশী পানি বের হয়ে যাবে। তাই আপনাকে সেই অনুপাতে পানির ঘাটতি পূরণ করার জন্য বেশী করে পানি পান করতে হবে।
বৈরি আবহাওয়া
প্রচুর গরম ও আদ্র আবহাওয়ার কারণে শরীরে বেশী পরিমাণ ঘাম হয়ে থাকে। আর তাই আবহাওয়ার উপরেও আপনার পানি পানের পরিমাণ নির্ভর করে থাকে।
শারীরিক অবস্থা
আপনার শরীরের বর্তমান অবস্থার উপরেও পানি গ্রহণের পরিমাণ নির্ভরশীল। যেমন ধরুন আপনার জ্বর এসেছে, আপনি প্রচুর বমি করছেন অথবা আপনার ডায়রিয়া হয়েছে। তখন কিন্তু ডাক্তাররাই আপনাকে বলে দিবে বেশী বেশী পানি পান করার জন্য। লেবুর শরবত, স্যালাইন সহ বিভিন্ন ধরণের ফলের জুস এই সময়ে শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য বেশ উপকারী ভূমিকা পালন করে।
গর্ভকালীন সময়ে কতটুকু পানি পান করবেন?
আপনি যদি গর্ভধারণ করে থাকেন অথবা শিশুকে বুকের দুধ পান করান তাহলে শরীরে পানির ঘাটতি পূরণ করার জন্য আপনাকে একটু বেশী পরিমাণ পানি পান করতে হবে। আমেরিকার নারী স্বাস্থ্য বিষয়ক অধিদপ্তরের মতে, আপনি যদি--
-
গর্ভবতী হয়ে থাকেন তাহলে প্রতিদিন ২.৪ লিটার পানি পান করুন
-
শিশুকে বুকের দুধ পান করান, তাহলে ৩.১ লিটার পানি পান করুন
"ট্রাস্ট ইয়োর থার্স্ট"—অর্থাৎ তৃষ্ণা লাগলে পানি পান করুন
সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য আপনার শারীরিক লক্ষণগুলোকে প্রাধান্য দিতেই হবে। যেমন ধরুন আপনার ঠাণ্ডা লাগবে আপনাকে গায়ে শীতের জামা পড়তে হবে আবার গরম লাগলে পাতলা জামা গায়ে দিতে হবে। অর্থাৎ আপনার শরীর আপনাকে যে নির্দেশনা দিচ্ছে সেগুলো মেনে চলা খুবই প্রয়োজন। ঠিক একই ভাবে আপনার শরীর যখন আপনার পানি শুন্যতার কথা জানান দিবে তখন আপনার তৃষ্ণা লাগবে।
কেননা সবসময় পানির পরিমাণ গণনা করেও আমাদের পানি পান করা হয়ে উঠে না। আবার কখনো ঘাম বেশী হচ্ছে আবার কখনো কম হচ্ছে, এতকিছুর দিকে খেয়াল রাখাটা আসলেই বেশ কঠিন।
আবার তৃষ্ণা না লাগলে যে পানি পান করা বন্ধ করে দিবেন ব্যাপারটি তেমনও নয়। স্বাভাবিক ভাবেই পরিমাণ অনুযায়ী পানি পান করুন এবং এর মধ্যে যদি তৃষ্ণা লাগে তাহলে সেই তৃষ্ণা নিবারণ করে নিন।
পরিমাণ মেপে পানি পান করা কি আদৌ সম্ভব?
উপরে যে নির্ধারিত পানির পরিমাণ দেয়া হয়েছে সেটা কিন্তু একটা গড় পরিমাপ। তার মানে এই নয় যে আপনাকে ঠিক সেই পরিমাণ পানি মেপে মেপে খেতে হবে। আর দৈনন্দিন হাজারো ব্যস্ততার আড়ালে মেপে মেপে পানি পান করাটা কিন্তু একটু কঠিনই বলা চলে।
আর তাই বেশীরভাগ সময়ে নিচের নির্দেশনা অনুসরণ করতে পারেনঃ
-
তৃষ্ণা লাগবে পানি পান করুন
-
তৃষ্ণা মিটে গেলে পানি পান করা বন্ধ করুন
-
শারীরিক কসরত অর্থাৎ ব্যায়াম করলে বেশী করে পানি পান করুন
-
গরম আবহাওয়ায় ঘাম বেশী হলে পানির ঘাটতি পূরণ করুন
পানির অভাব কি পানি দিয়েই পূরণ করতে হবে?
প্রশ্নটি একটু মজার! তবে এর মানে হল আপনাকে কি প্রতিদিন পানি দিয়েই পানি শূন্যতা পূরণ করতে হবে কি না! এর উত্তর হল, না! আপনাকে যে পানিই পান করতে হবে ব্যাপারটি এমন নয় বরং অন্যান্য আরো পানি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করার মাধ্যমেও পানির চাহিদা পূরণ করা যেতে পারে।
যেমন—ফলের রস, দুধ, চা, শরবত ইত্যাদি ধরণের পানীয় পানের মাধ্যমেও শারীরিক পানির ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। এমনকি মাংস, মাছ, ডিম, শাক সবজী ইত্যাদি ধরণের খাবারের মধ্যেও কিন্তু যথেষ্ট পরিমাণে পানি রয়েছে।
অতিরিক্ত পানি পানের ক্ষতিকর প্রভাব
অতিরিক্ত পানি পান করলেও কিন্তু আবার শরীরের উপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে। যেমন শরীরের সোডিয়াম লেভেল কমে যায় যার ফলে মাথাব্যথা, বমি ও অবসাদের মত সমস্যা হতে পারে।
এছাড়াও প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি যদি পান করেন সেটা কিডনির উপর প্রভাব ফেলবে। কেননা আপনার শরীরের পানির ব্যালেন্স রক্ষা করার প্রধান দায়িত্বটি হল কিডনির। আর অতিরিক্ত পানি পান করা মানে কিডনির উপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করা। এতে কিডনির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
পরিশেষে, আপনি হয়ত ইতোমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন, অন্যান্য খাবারের মতই পরিমাণ অনুযায়ী পানি পান করতে হবে। খাবার যেমন বেশী খেলেও সমস্যা আবার কম খেলেও সমস্যা—ঠিক একই ভাবে পানি গ্রহণের পরিমাণও খুব কম অথবা বেশী হলে শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। আর তাই প্রতিদিন সঠিক পরিমাণে পানি পান করুন ও সুস্থ থাকুন।