শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণে ৯ ঝুঁকি

মেসে বা হলে থেকে যে শিক্ষার্থিরা পড়ালেখা করেন তারা নিজেদের গাফিলতির সাথে রান্নার খালার অনুপস্থিতি, বেশি ঘুমিয়ে ফেলা, পছন্দসই রান্না না হওয়া ইত্যাদি কারণে খাবারে প্রচন্ড অনিয়ম করে ফেলেন। কিন্তু এর পরিণতি হিসেবে পরবর্তি বয়সে গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং জটিল সব রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক গুন বেড়ে যায়। আসুন সমস্যা গুলো চিহ্নিত করি এবং করণীয় সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।

ছাত্র অবস্থায় প্রায় অধিকাংশ মানুষকেই জীবনের কোন না কোন সময় মেস বা হেস্টেলে থাকতে হয়। সে এক অদ্ভুৎ জীবন। সম্পুর্ণ স্বাধীনতা মেলে, তবে বাড়ির মত যত্ন-আত্মি মেলে না। 

প্রথম প্রথম স্বাধীনভাবে বন্ধুদের সাথে থাকতে পারা খুব আনন্দময় কিছু সময় ও স্মৃতি তৈরি করে। সেই সঙ্গে এই সম্ভাবনাও থাকে যে প্রাণোচ্ছল জীবণে বয়ে গিয়ে অনেকে নিজের উপর অযত্ন করে ফেলেন।

এটি আবার অনেকক্ষেত্রে ভিন্নও হয়ে যায়। অনেক জায়গায় নিরুপায় হয়েও স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে পারেন না। যার ফলে পরবর্তি জীবনে জটিল রোগের সম্ভাবনাও বেড়ে যায় অনেকাংশে।

এই প্রবন্ধটিতে বাস্তবিক রূপটা তুলে ধরার চেষ্টা করব যেন, সাধারণ মানুষ ও অভিভাবকেরা হোস্টেল ও মেসের অবস্থা বুঝতে পারেন, শিক্ষার্থিরা সচেতন হতে পারেন। সেই সাথে অনিয়মিত খাবার গ্রহণের সমস্যা ও তা সমাধানের উপায় নিয়ে আলেচনা করব।

হোস্টেল ও মেসে কেন শিক্ষার্থিরা খাবারের প্রতি অনিয়ম করেন?

বাংলাদেশের বাস্তবতা এইযে একজন মধ্যবিত্ত ছাত্র দূরে পড়তে গেলে যে অবস্থায় থাকে, তা  পৃথিবীর যে কোন দেশের সাথে মেলানো কঠিন। এমনকি, অনেকক্ষেত্রে দিন আনে দিন খায় এমন মানুষের চেয়েও অস্বাস্থ্যকর জীবনের মধ্যে দিয়ে পার হতে হয়ে একটি বড় সংখ্যক শিক্ষার্থিদের।

অস্বাস্থ্যকর বলতে, শুধু যে ময়লা-অপরিষ্কার বোঝায় তা কিন্তু নয়। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাই অস্বাস্থ্যকর। 

তাহলে এর পেছনে কারণ গুলো কি? আসুন একটু গোড়া থেকে আসা যাক। 

  • একটা বড় অংশের ছেলেমেয়েরা কলেজে ভর্তি হবার সময় ঢাকা, বা বড় শহরগুলোতে চলে আসে। সেখানে মেসে বা হোস্টেলে থাকার প্রয়োজন হয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় উঠতি বয়সী শিক্ষার্থিদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে যেতে হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে। স্বাভাবিক ভাবেই, বাড়িতে নিয়মিত খাবার আর পরিবেশ কোন কিছুর সাথেই হোস্টেল জীবনের মিল থাকবে না। কিন্তু বিভিন্ন হোস্টেল গুলোতে ছাত্রদের খাবারের মান যে হতাশা জনক রকম খারাপ তা নিশ্চই যে কেউই মানতে বাধ্য হবে।

  • পুষ্টিকর খাবারের অভাব তো আছেই, সেই সঙ্গে খাবার রান্নার ধরণেও প্রায় অযত্ন অবহেলা যেন খুব সাধারণ বিষয়। পানির মত স্বচ্ছ ডাল, একপিস মুরগি বা ডিমই যেন হোস্টেল, মেস, বা বিভিন্ন হল গুলোর প্রত্যহিক রুটিন। পুষ্টির অভাব তো আছেই, সেই সাথে খাবার গুলো চলনসইও নয় বেশিভাগ ক্ষেত্রে। ফলাফল খাবারে অনীহা।

  • এই অনীহার কারণেই শিক্ষার্থিরা প্রায়ই খাবার খাবার না খেয়েই সকাল বা রাতটা কাটিয়ে দেন। অনেক ছাত্রকে দেখা যায়, একবারে দুপুরবেলা লাঞ্চ করছে। সে সকালে ক্লাসের কারণেই হোক বা অতিরিক্ত ঘুম। এ ধরণের সমস্যার  বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবারের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। 

  • মেসে যারা থাকে তাদের সমস্যা আরো বহুমুখি। রান্নার খালা অনুপস্থিত মানে সেই দিন উপস থাকা ছাড়া গতি নেই। 

  • আরেক ধরণের ছাত্ররা নিজের দোষে স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখেন না। রাত জেগে তাস খেলা, মাদক ও নানাবিধ প্ররোচনায় বয়ে গিয়ে সময়ানুবর্তিতার কোন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। তবে চলুন জেনে আসা যাক অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণ কি কারণে ক্ষতিকর।

অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণ অথবা একবেলা না খাওয়ার ঝুঁকি গুলো কি কি?

অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে গেল। এখন আসুন দেখে আসি কেন এই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা প্রয়োজন।

১. টাইপ-২ ডায়বেটিস এর ঝুঁকি বাড়ায়

সাধারণত মানুষ ধারণা করেন শুধু বেশি খাদ্য গ্রহণ করলেই ডায়বেটিস হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। কিন্তু আদৌতে অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণ রক্তে শর্করার পরিমানে অসমাঞ্জস্যতা তৈরি করে। দীর্ঘদিন এই অভ্যাস চালিয়ে গেলে পরবর্তি জীবনে টাইপ-২ ডায়বেটিস হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

২. পেশি কমে যাওয়া

আমাদের শারিরিক ওজন ও পেশি বজায় রাখার জন্য নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের কোন বিকল্প নেই। শরীর তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি না পেলে, পেশি মেরামত ও অন্যান্য কাজ বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ গুলোতে পুষ্টি খরচ করে। ফলাফল পেশি হারানো, শুকিয়ে যাওয়া যাকে বলে।

৩. ওজন বেড়ে যাওয়া

অনিয়মিত খাবার গ্রহণ বাড়িয়ে তুলতে পারে ওজন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও। শুনতে আশ্চর্য মনে হলেও এটি সত্যিকারেই হয়ে থাকে। যখন আপনি কিছুদিন নিজে অনিয়মিত খাবার গ্রহণ করেন, শরীর সংকেত পায় যে আপনি বিপদকালীন পরিস্থিতিতে আছেন। এর পরে যখন স্বাভাবিক খাবার গ্রহণ করেন, শরীর সেই খাবারের পুষ্টি জমিয়ে রাখে, যাতে পরবর্তিতে বিপদকালীন পরিস্থিতে কাজে লাগতে পারে। ফলাফল ওজন বৃদ্ধি। শরীর বেচারা যদি জানতো, আপনি কেবল অবহেলা করে না খেয়ে রয়েছেন, বিপদ আপদ কিছু নয়!

৪. চিন্তাক্ষমতা হ্রাস পাওয়া

নিয়মিত খাবার গ্রহণ না করলে, বা একবেলা না খেয়ে থাকলে চিন্তাক্ষমতা হ্রাস পায়। আমাদের শরীরের বেশিরভাগ ক্যালোরি আমাদের মস্তিষ্ক খরচ করে। কিন্তু যখন আপনি ঠিকভাবে খাদ্য গ্রহণ করবেন না, পর্যাপ্ত শক্তি না পাওয়ার কারণে মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না।

অথচ সুস্থ্য মস্তিষ্ক শিক্ষার্থি ছাড়া কারো জন্য বেশি প্রয়োজনীয়তা রাখে না।

৫. সহজে বিরক্তি চলে আসা

খাবারের সাথে মেজাজের যে সম্পর্ক রয়েছে তা তো সবারই জানা। ঠিকমতো খাদ্য গ্রহণ না করলে মেজাজ ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়ে, যেকোন কাজে সহজে বিরক্তি চলে আসে।

৬. এসিডিটির সমস্যা

খাবার দেরীতে গ্রহণ করলে পাকস্থলির এসিড নির্গমনে অসামাঞ্জস্যতা তৈরি হয়। ফলাফল এসিডিটি। প্রায়সই হজমে গোলযোগ তৈরি হয় ও দীর্ঘদিন এ অভ্যাস চালয়ে গেলে বড় ধরণের পরিপাকতন্ত্রের অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। 

৭. আলসার

অনিয়মিত খাদ্যগ্রহণ ও দির্ঘদিন এসিডিটির সমস্যা থেকে পরিপাক তন্ত্রে ঘা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, অনেকসময় যা জটিল দিকে রূপ নেয়।

৮. হরমোনাল ইমব্যালেন্স

ক্ষুধা শুধু শরীরের খাবার চাহিদার বহিপ্রকাশ নয়। এটি আমাদের খাবার গ্রহণের রুটিনের সাথেও সম্পর্কিত। প্রতিদিন যে যে সময় আপনি খাবার গ্রহণ করেন, সে সময়ই আপনার বেশি ক্ষুধা লাগবে। সে সময় না খেয়ে পার করে দিলে দেখা যাবে আসলে তেমন ক্ষুধা নেই। এটি হয় আমাদের শরীরের বায়োলোজিক্যাল ক্লকের জন্য। 

কিন্তু বেশিদিন এরূপ অনিয়ম চালিয়ে গেলে আপনার ক্ষুধা লাগার হরমোনের অসামাঞ্জস্যতা তৈরি হবে। যা আপনার স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণের প্রক্রিয়াতেও সমস্যা তৈরি করতে পারে।

৯. পুষ্টিহীনতা

একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক প্রয়োজন হয় ২০০০-২৫০০ ক্যালরি। অর্থাৎ আপনার প্রতি বেলায় ৭০০-৮০০ ক্যালরির খাবার গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু আপনি একবেলা কম খেলে আপনার পরের দুই বেলায় কম করে ১০০০ ক্যালরি করে খেতে হবে যা বাস্তবে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলাফল পুষ্টিহীনতা।

অর্থাৎ দেখতেই পারছেন, অনিয়মিত খাবার গ্রহণকে যতটা হালকা ভাবে দেখা হয়, আসলে বাস্তবতা সম্পুর্ণ বিপরীত। তাহলে এই সমস্যা থেকে কিভাবে পরিত্রাণ পেতে পারেন?

অনিয়মিত খাদ্য গ্রহণের সমস্যা গুলো থেকে সাবধান থাকার উপায়।

আসলে ব্যক্তিগত পর্যায় থেকেই খাবার গ্রহণের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করলেই ঝুঁকি অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব। 

  • যতই গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকুক না কেন, যথা সময়ে খাবার গ্রহণ করে ফেলা উচিৎ। বিকালে ও সকাল ১১-১২ টায় হালকা নাস্তা করা ভালো অভ্যাস। 

  • সেই সাথে শুকনো খাবার যেমন বিস্কুট, ড্রাই ফ্রুটস, বাদাম ইত্যাদি রাখা উচিৎ যেন, ক্ষুধা লাগলে খেতে পারেন। 

  • বাইরের ভাজাপোড়া অস্বাস্থ্যকর খাবারের চেয়ে কলা, পেয়ারা ও অন্যান্য পুষ্টিকর ফলমুল গ্রহণ করুন।

  • রাত জাগার অভ্যাস ত্যাগ করলে খাবার সময়সূচি অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপেক্ষিতে রাত জাগা যেন খুব স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এটি অত্যন্ত  অস্বাস্থ্যকর বিশেষ করে আপনি যখন এমন জায়গায় আছেন যেখানে কেউ ডেকে খেতে বলবে না। 

  • ধরুন রাত দশটায় খেয়ে আপনি তিনটা পর্যন্ত জাগছেন, এতে করে আপনি ঘুমাচ্ছেনও ক্ষুধার্ত অবস্থায়। সেই সাথে ঘুম থেকে উঠছেনও দশটার দিকে। অর্থাৎ মাঝে বিশাল একটা সময় না খেয়ে কাটিয়ে দিতে হচ্ছে যা শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

ছাত্রাবস্থায় পড়ালেখা, উদ্দীপনা ও অসংখ্য কাজের ভেতর শরীরের যত্ন নেওয়া সময় সময় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু শরীরের দিকে সবসময় সামান্য মনোযোগই কিন্তু আপনার ভবিষ্যত জীবনের সুস্বাস্থ্যের চাবিকাঠি হতে পারে।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles