রমজানে সুস্থ থাকার উপায়!

ইফতারের পর অল্প সময়ের মধ্যে অনেকেই যথেষ্ট পরিমাণে খাবার খেয়ে ফেলেন যার বেশিরভাগ হয়ে থাকে মাত্রাতিরিক্ত ক্যালরি সম্পূর্ণ ও তৈলাক্ত। অধিকন্তু রমজান মাসে আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হচ্ছে চর্বি, চিনি এবং কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারের মহা সমাহার। কিন্তু আসলেই কি আমাদের তাই করা উচিৎ! আসুন জেনে নেই রমজানে আমাদের কিভাবে খাবার খেতে হবে সে সম্পর্কে জরুরী কিছু প্রশ্নের উত্তর।

 

রমজান একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ মাসের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। এ মাসে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রোজা, নামাজ, সদকা, ফিতরা, জাকাত, দান খয়রাতের মাধ্যমে আরও বেশি ইবাদত বন্দেগিতে মনোনিবেশ করে থাকেন। হাটে ঘাটে, বাজারে, অফিস-আদালত ও অন্যান্য জনবহুল স্থানে প্রকাশ্যে পানাহার বন্ধ রাখাসহ মানুষের আচরণগত অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

রমজান মাসে খাদ্য গ্রহণের ব্যাপারে মুসলমানরা অনেক বেশি উদার বা উদাসীন মনোভাবের পরিচয় দিয়ে থাকেন। তবে স্বাস্থ্যকর খাবার সম্পর্কে আমরা একটু বেশিই উদাসীন। স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখতে তাই আমাদের প্রয়োজন, আমরা যা খাচ্ছি তার প্রতি সচেতনা। 

আর এর জন্য রমজানে সুস্থ থাকার উপায় জানার আগে আসুন নিচের উপকারী প্রশ্নের উত্তরগুলো জেনে নেই-

 

প্রশ্নঃ সারাদিন রোজা রাখার পর কি যত ইচ্ছা তত খাওয়া যাবে?

উত্তরঃ না। অনেকেই মনে করেন রমজানে আমরা যত খুশি খাওয়া দাওয়া করব, এতে দোষের কিছু নেই। এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। কারণ, খাদ্য এমন একটি বিষয় যা সব সময় একইভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাই রমজান মাসেও আপনি বেশি পরিমাণে খাদ্যগ্রহণ করলে মোটা বা স্থুলাকায় হবেন এটাই স্বাভাবিক। 

বেশি করে কার্বোহাইড্রেট বা চিনি-মিষ্টি খেলে অবশ্যই আমাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হবে এবং ওজন বাড়বে। অতিরিক্ত তেল-চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণেও আপনার ওজন বাড়বে এবং রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়বে এটাও অবধারিত। 

তাই রমজান মাসে সুস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে অত্যাধিক চিনিযুক্ত খাবার ও অতিমাত্রায় তেল-চর্বি জাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে। অবশ্যই অতিভোজন থেকে বিরত থাকবেন। তা না হলে আপনি একমাসে যে পরিমাণ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বেন, তা সারাতে অনেক মাস লেগে যাবে। 

 

প্রশ্নঃ রমজান মাসে সুষম খাদ্য কিভাবে বজায় রাখব?

উত্তরঃ রমজানেও সুষম খাদ্য (ব্যালান্সড ডায়েট) গ্রহণ করতে ভুলবেন না। সুষম খাদ্য বলতে এমন এক ধরণের খাদ্যকে বোঝায় যাতে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান সঠিক মাত্রায় বিদ্যমান থাকবে, যেমন কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন, ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার ও পানি।

কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে রমজান মাসে ভাত, মাছ, সবজি, ফলমূল ইত্যাদি বাদ দিয়ে, যদি পোলাও, বিরিয়ানি, তেহারি, কাচ্চি, ভাজ পোড়া খাবার, মিষ্টি, খিচুড়ি, ফিরনি, পায়েস ও মন্ডা মিঠাই, ফাস্ট ফুড ইত্যাদি খাদ্যের প্রতি বেশি ঝুঁকে যান, তবে শাক-সবজি, ফলমূল, ভাত-রুটি ও ফাইবার জাতীয় খাদ্য গ্রহণের মাত্রা কমে গিয়ে, সুষম খাদ্যগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে আপনার স্বাস্থ্য ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যাবে। 

তার মানে এই নয়, রমজানে আপনি ইফতারের মজাদার খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকবেন। তবে এসব মজাদার খাদ্য অবশ্যই স্বল্প মাত্রায় গ্রহণ করবেন এবং রাতের খাবার ও সাহরিতে প্রয়োজনীয় শাক-সবজি, ফলমূল, মাছ-ভাত অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে খাবেন।

 

 

প্রশ্নঃ সময়মত সেহরি ও ইফতার না করা কি স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর?

উত্তরঃ হ্যা। অনেক সময় অসাবধানতা ও উদাসীনতার কারণে অনেকেই সেহরি না খেয়েই রোজা পালন করে থাকেন; এটা উচিত নয়। কারণ, এতে একদিকে যেমন সেহরি সুন্নতের সওয়াব ও বরকত থেকে বঞ্চিত হতে হয়, অপরদিকে এটি স্বাস্থ্যহানিকর এবং কর্তব্য কর্ম আমল ও ইবাদত সম্পাদনে অন্তরায় হতে পারে। 

অনুরূপ কেউ কেউ যথাসময়ে ইফতার গ্রহণেও অলসতা করেন। এতেও ইফতারের সুন্নতের সওয়াব না পাওয়া এবং ইবাদতে বিঘ্ন ঘটাও অসুস্থতার কারণ ঘটতে পারে।

 

রমজানে সুস্থ থাকতে সেহরি ও ইফতারে যা খাবেন

 

প্রশ্নঃ কাজকর্ম ও ইবাদতের কথা চিন্তা করে কিভাবে খাওয়া উচিৎ?

উত্তরঃ সেহরিতে এমন খাবার গ্রহণ করা উচিত যাতে রোজা পালন সহজ হয় এবং ইবাদতের অসুবিধা না ঘটে। ইফতারেও এমন খাবার গ্রহণ করা উচিত যাতে স্বাস্থ্য রক্ষা হয় এবং রাতে তারাবির নামাজ, তাহাজ্জুদ নামাজ ও অন্যান্য ইবাদতের সহায়ক হয়। একসঙ্গে বেশি পরিমাণে খাবার গ্রহণ না করে রাতে বারবার অল্প অল্প পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে। ইফতারের পর থেকে সেহরি পর্যন্ত পানি ও তরল খাবার বেশি পরিমাণে গ্রহণ করা উচিত। 

 

প্রশ্নঃ রমজানে ঘুম ও ব্যায়াম কিরূপ হওয়া উচিৎ?

উত্তরঃ এ মাসে রোজা রাখার ফলে অনেকেই কাজ-কর্ম কমিয়ে, ঘুমের পরিমাণ বাড়িয়ে ফেলেন এবং অনেকেই নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেন। এটা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। রোজার সময় প্রত্যেক ব্যক্তি তার কর্মতৎপরতা বজায় রেখে রোজা পালন করবেন। তবে হাঁটা ও ব্যায়ামের সময়সূচি পরিবর্তন করে নিতে পারেন। তবে অতিরিক্ত কোন ব্যায়াম করা যাবে না। হাঁটাহাঁটি ও হালকা ব্যায়াম করার সময়, যদি মাথা হালকা বোধ করা বা মাথা ঘোরার উপক্রম হয়, তবে হাঁটাহাঁটি বা ব্যায়াম বন্ধ করে দিতে হবে।

 

 

রমজানে সুস্থ থাকার ১০ উপায়

১. খেজুর ও শরবত দিয়ে আপনার ইফতার শুরু করুন। এর সাথে ফল, সালাদ, ছোলা, ডিম সেদ্ধ, মুড়ি বা চিড়া খেতে পারেন।

২. তাড়াহুড়া না করে ধীরে ধীরে আপনার রোজা ভাঙ্গুন এবং সময় নিয়ে খাবার খান। দরকারে ইফতারের খাবার দুই ভাগে ভাগ করুন- আজানের পরে এবং মাগরিব নামাযের পরে।

৩. বেশি করে পানি পান করুন। সেহরি ও ইফতার মিলিয়ে কমপক্ষে ৮ থেকে ১২ গ্লাস পানি পান করাটা প্রত্যেকের জন্য জরুরী।

৪. ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত আপনার খাবারটাকে তিনবার ভাগ করুন। রাতের খাবারের মেন্যু হালকা হওয়া উচিত। এতে সঠিক পরিমাণের খাবার সেহরিতে গ্রহণ করা সম্ভব হয়। তাছাড়া রাতে একটু হালকা খাবার খেলে ঘুম ভালো হয় এবং ওজন বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে।

৫. সেহরিতে ভাত বা রুটি, বিভিন্ন রকমের সবজি, মাছ, ডিম বা মাংস খাওয়ার চেষ্টা করুন। এতে সারাদিনের ক্ষুধার্ত ভাবটাকে কমাবে এবং প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দিবে।

৬. কফি এবং চা এড়িয়ে চলুন বা পরমাণে কম পান করুন, কারন এতে দেহে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। দুধ চা না খেয়ে বরং এক কাপ রং চা খেতে পারেন।

৭. লবণযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন এবং আপনাকে অবশ্যই  অধিক ভাজা-পোড়া এবং চর্বিযুক্ত খাবার পরিহার করতে হবে। এছাড়া নিশ্চিত করুন যে আপনার খাবার মেন্যুতে পর্যাপ্ত ফল রয়েছে।

৮. হালকা ব্যায়াম করার চেষ্টা করুন। সারাদিনের যে কোনো সময়ে কমপক্ষে ৩০ মিনিট নিয়মিত হাঁটার চেষ্টা করুন।

৯. কম শারীরিক পরিশ্রম লাগে, কিন্তু উপকারী এমন ব্যায়াম করতে পারেন। আর তারাবির নামাজও কিন্তু পরিশ্রমসাধ্য ব্যপার। শরীরে পর্যাপ্ত শক্তির জোগান থাকলে আপনি তারাবি নামাজ পড়বেন। তারাবীহ নামাজের সময় পাশে পানি বা গ্লুকোজ রাখতে পারেন।

১০. পর্যাপ্ত ঘুম দিন, যা আপনাকে সারাদিন কাজ করতে সাহায্য করবে।

 

সবশেষ

রমজান ত্যাগের মাস, ভোগের মাস নয়। তবে আমরা অনেকে সেহরি ও ইফতারিতে এমন ভোজনরসিক হই, এতে অনেকের শরীরের ওজন অনেকবেড়ে যায়। আমরা আসলে রোজার আসল উদ্দেশ্যই ভুলে যাই। তাই আসুন রমজান মাসে সংযমী হই, স্বাস্থ্যের প্রতি সচেতন হই এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খাই।

 

আরও পড়ুনঃ

রোজায় ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য চিকিৎসকের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ

 

Default user image

সানজানা হাসান শামা, লেখক

আমি সানজানা হাসান শামা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুস্টিবিজ্ঞানবিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা এবং ক্লিনিক্যাল পুস্টিবিদ হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। পড়াশোনার পাশাপাশি মাঝে মাঝে লিখালিখি করতে ভালো লাগে। এছাড়াও বিভিন্ন বই পড়তে, নতুন কিছু শিখতে সবসময় খুবই আগ্রহী।ভালোবাসি ভ্রমণ করতে, গল্পের বই পড়তে, রান্নাবান্না করতে, পরিবারের সবার সাথে সময় কাটাতে।

Related Articles