স্টেরয়েড ব্যবহার কি নিরাপদ? এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলি কি কি?

স্টেরয়েড এমন ধরণের ঔষধ যা পেশি তৈরি ও অন্যান্য চিকিৎসায় খুব কার্যকরী হলেও, এর কিছু মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আপনি যদি ওজন, শক্তি ও পেশি তৈরি করার জন্য স্টেরয়েড ব্যবহার করার কথা ভেবে থাকেন, তাহলে এই প্রবন্ধ টি আপনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সারা বিশ্বেই বডি বিল্ডার ও অ্যাথলেটরা স্টেরয়েড বৈধ ও অবৈধ ভাবে ব্যবহার করে থাকেন এবং এতে প্রাণহাণি হবার ঘটনাও কম না।

সাধারণত মানুষের শারীরিক বৃদ্ধির কিংবা ওজন কমানো একটা সীমা আছে। যে কিনা জিন গত ভাবেই একটু শুকনো পাতলা, সে হঠাৎ করে বডি বিল্ডারদের মত মাসল পেতে পারবেন না। কিংবা কেউ খুব মোটা হলে, খুব দ্রুত ওজন কমাতে পারবেন না। সে জন্য অনেকটা সময় ও পরিশ্রমের দরকার হবে।

কিন্তু স্টেরয়েড এমন একটি ঔষধ যা কিনা শারীরিক সীমার বাইরেও আপনাকে পেশিবহুল, মেদহীন ও শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু এর মূল্যটা হতে পারে চড়া। আসুন জেনে নেই বিস্তারিত।

স্টেরয়েড কি?

স্টেরয়েড হলো কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা টেস্টস্টেরন হরমোন দিয়ে বানানো ঔষধ। মূলত, স্টেরয়েড ব্যবহার হয় চিকিৎসা ক্ষেত্রে। অ্যাজমা, ব্যাথা, অ্যালার্জি, পরিপাক তন্ত্রের কিছু রোগের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর সবচেয়ে বহুল ব্যবহার হলো ওজন বাড়ানো, ফ্যাট লস ও খেলাধুলার সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনে। যদিও অনেক দেশে ও অনেক খেলায় স্টেরয়েড নিষিদ্ধ, তবুও দ্রুত শারীরিক সক্ষমতা ও পেশি বাড়িয়ে তোলার জন্য গোপনে ও সঠিক নিয়ম নীতি না মেনেই স্টেরয়েড ব্যবহার হয়ে থাকে।

স্টেরয়েডের মূল উপাদান হলো টেস্টেস্টেরন, যা হলো পুরুষের সেক্স হরমোন। শরীরে যত পুরুষালি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, তার সবকিছুই হয় এই হরমোন এর কারণে। যেমন শক্ত ও মোটা পেশি, বিভিন্ন স্থানের লোম, গলার স্বর মোটা হওয়া ইত্যাদি। পুরুষ ও নারী উভয়েই এই হরমোনটি শরীরে স্বাভাবিক ভাবেই উৎপন্ন করে। পুরুষের চেয়ে নারীরা ৮০-৯০ শতাংশ কম টেস্টস্টেরন হরমোন উৎপন্ন করে। যে নারীরা তার বেশি টেস্টস্টেরন উৎপন্ন করেন তাদের পুরুষালি ভাব সামান্য বেশি দেখা যায়।

স্টেরয়েড খেলে কি হয়?

সাধারণ টেস্টোস্টেরনের মাত্রা পুরুষদের জন্য ৩০০-১০০০ ন্যানোগ্রাম/ডেসিলিটার এবং মহিলাদের জন্য ১৫-৭০ ন্যানোগ্রাম/ডেসিলিটার। স্টেরয়েড গ্রহণ করলে এই হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়, যা পেশী ভর এবং শক্তি বৃদ্ধিতে প্রভাব সৃষ্টি করে।

চিকিৎসায় যে পরিমাণ স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়, পেশি বাড়ানো কিংবা ঐ ধরণের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয় তার চেয়ে ১০-১০০ গুন বেশি ডোজ। স্বাভাবিক ভাবেই এতো বেশি পরিমাণ হরমোন আমাদের লিভার বা যকৃত সহজে প্রসেস করতে পারে না। এতে কিডনী ও হার্টের উপর মারাত্মক চাপ পড়ে। যার ফলাফল হঠাৎ হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া, যকৃত নষ্ট হয়ে যাওয়া, কিডনী ফেইলিওর সহ আরো অসংখ্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।

তবে, ডাক্তারের পরামর্শ ও বিভিন্ন চেকাপের মধ্যে থেকে তুলনামূলক নিরাপদে স্টেরয়েড গ্রহণ করা যেতে পারে। বিভিন্ন দেশে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া স্টেরয়েড বেচা-কেনা ও ব্যবহার বেআইনী। 

উল্লেখ্য: বেশিরভাগ পেশি বৃদ্ধির স্টেরয়েড পুরুষদের জন্য হয়ে থাকে। নারীদের জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার (স্তন সংকোচন, ভারী কণ্ঠ, মুখমণ্ডলে লোম গজানো) ঝুঁকি বেশি থাকায়, এটির ব্যবহার খুব সীমিত।

ষ্টেরয়েড এর প্রকারভেদ

স্টেরয়েড এর প্রকারভেদ করা হয় তাদের কাজের উপর ভিত্তি করে। এগুলিকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়-

১) কর্টিকোস্টেরয়েড (গ্লুকোকোর্টিকয়েড এবং মিনারলোকোর্টিকয়েডস)

এই স্টেরয়েডগুলি শরীরের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত, যার মধ্যে রয়েছে স্ট্রেস রেসপন্স, ইমিউন রেসপন্স, এবং প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ, কার্বোহাইড্রেট বিপাক, প্রোটিন বিপাক, রক্তের ইলেক্ট্রোলাইটের মাত্রা এবং বিহেভিওর বা আচরণ।

২) সেক্স স্টেরয়েড (প্রজেস্টেরন, অ্যান্ড্রোজেন এবং ইস্ট্রোজেন)

এই ধরণের স্টেরয়েডগুলি যৌন-সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আবার গ্রহণের ধরণ অনুযায়ী স্টেরয়েডকে ২ ভাগে ভাগ করা যায়-

১) ওরাল স্টেরয়েড

২) ইনজেক্টেবল স্টেরয়েড

ওরাল স্টেরয়েড মুখ দিয়ে গ্রহণ করতে হয়। অন্যদিকে ইনজেক্টেবল স্টেরয়েড পেশিতে ইনজেকশন আকারে গ্রহণ করতে হয়।

দুই ধরণের স্টেরয়েড এরই নিজস্ব বিপদ আছে। ওরাল স্টেরয়েড যকৃতকে দুর্বল করে দেয় ও নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। অন্যদিকে ইনজেক্টেবল স্টেরয়েড পেশিতে প্রবেশ করাতে গিয়ে যদি কোন ধমনীতে চলে যায় তাহলে কোমা এমনকি মৃত্যু ও হতে পারে। চলুন স্টেরয়েডের স্বাস্থ্য ঝুঁকি গুলো বিস্তারিত জেনে আসি।

স্টেরয়েডের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

স্টেরয়েড যদি আপনি প্রফেশনাল ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ীও গ্রহণ করেন, তাহলেও নিম্নোক্ত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে-

  • শরীরে পানি জমে যাওয়া

  • ব্রন হওয়া‌

  • মূত্র ত্যাগে যন্ত্রণা ও অসুবিধা হওয়া

  • ছেলেদের স্তন বৃদ্ধি পাওয়া

  • লোহিত রক্ত কণিকা অস্বাস্থ্যকর ভাবে বৃদ্ধি পাওয়া

  • চুল পড়া

  • বীর্য হ্রাস ও অনুর্বরতা

  • শরীরে খারাপ ক্লোরেস্টেরল বৃদ্ধি পাওয়া।

স্টেরয়েডের স্বাস্থ্য ঝুঁকি

স্টেরয়েড মাত্রারিক্ত ব্যবহার নিম্নোক্ত স্বাস্থঝুঁকি তৈরি করে থাকে-

  • হৃদযন্ত্রের সমস্যা

  • হঠাৎ হৃদযন্ত্র অচল হয়ে যাওয়া

  • কিডনী ফেইলর

  • লিভার ড্যামেজ

  • টিউমার

  • অস্টিওপেরেসিস ও

  • বিভিন্ন হাড়ের রোগ।

তাছাড়াও বয়সন্ধিকালে স্টেরয়েড নানাবিধ জটিলতা তৈরি করতে পারে। যেমন,

  • ছেলেদের অণ্ডকোষ ছোট হয়ে যাওয়া

  • স্তন বৃদ্ধি পাওয়া

এই সবই শরীরে টেস্টস্টেরন উৎপন্ন হওয়ার প্রক্রিয়ায় গোলযোগের কারণে হয়ে থাকে।

অন্যদিকে নারীদের ক্ষেত্রে,

  • ঋতুচক্রে গোলযোগ

  • কণ্ঠ ভারী হয়ে যাওয়া

  • স্তন সংকোচন ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।

স্টেরয়েড নানাভাবে মানসিক অবস্থার পরিবর্তনও ঘটাতে পারে। যেমন,

  • মুড সুইং

  • বিচার বুদ্ধি হ্রাস পাওয়া 

  • ডিপ্রেশন

  • উত্তেজনা ও রাগ বৃদ্ধি।

স্টেরয়েড গ্রহণ করা বন্ধ করলেও নানা রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। যেমন,

  • ঘুমহীনতা

  • ডিপ্রেশন

  • আসক্তি

  • দুর্বলতা

  • মেজাজ খিচিয়ে থাকা ইত্যাদি।

স্টেরয়েড ব্যবহারের কি কোন নিরাপদ উপায় আছে?

ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী, বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষার মধ্যে থেকে সঠিক উপায়ে স্টেরয়েড গ্রহণ করলে অনেকটাই নিরাপদে স্টেরয়েড গ্রহণ করা যায়। কিন্তু তারপরও কিছু পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই এড়ানো সম্ভব নয়। স্টেরয়েড ব্যবহার অনেক দেশ ও খেলাধুলাতে নিষিদ্ধ, সেই সাথে ওজন কমানোর জন্য কিংবা যৌন ক্ষমতা বাড়ানোর স্টেরয়েড অনেক সময়ই হিতে বিপরীত করে থাকে। যদিও  বাংলাদেশে চিকিৎসকের তত্বাবধায়নে স্টেরয়েড ব্যবহার কতটুকু বাস্তবিক সেটাও ভাববার বিষয়। 

বাংলাদেশে স্টেরয়েড সে‌ভাবে বহূল ব্যবহার না হলেও, ফুড সাপ্লিমেন্ট জাতীয় ঔষধ বেশ জনপ্রিয়। এসব অনিয়ন্ত্রিত ঔষধ মানব স্বাস্থ্যের জন্য হতে পারে ভয়াবহ ক্ষতিকর। চলুন এ সম্পর্কে আলোচনা করা যাক।

ফুড সাপ্লিমেন্টের বিপদ

যে কোন ফার্মেসীতে গেলেই, কিছু সাধারণ প্যাকেট সামনেই রাখা থাকে। এর ভেতর ফলমূলের ছবি সহ ফুড সাপ্লিমেন্ট সিরাপ অন্যতম। এসব ওষুধের বেশিরভাগেরই নেই কোন অনুমোদন ও উপাদানের নিশ্চয়তা। অথচ এই ফুড সাপ্লিমেন্ট গুলো কাজ করে ম্যাজিকের মত। মাত্র কয়েক দিনেই খাবারের রুচি বাড়ে আর শরীর মোটা দেখাতে থাকে। কিন্তু এসব ঔষধ কিডনী ও লিভারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। দেশের বিভিন্ন স্থানে সংবাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মোটা হবার ঔষধের ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি, ও এতে আক্রান্ত মানুষের গল্প। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় আক্রান্ত ব্যক্তি কিডনী ফেইল করে মৃত্যুবরণ করছেন। এসব ওষুধে স্টেরয়েড থাকে কিনা বা কি কি উপাদান থাকে তা বলা কঠিন কারণ, দেশের বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ছোট ছোট ঔষধ কোম্পনী মুনাফার জন্য এসব ক্ষতিকর ওষুধ তৈরি করে। 

মোটা, চিকন কিংবা লম্বা হোন সম্পর্কিত যে কোন চমকপ্রদ ওষুধই এক প্রকার বিপদ সংকেতের মত দেখা উচিত, ও না জেনে কোন প্রকার ভিটামিন, সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিৎ।

পরিশেষ

স্টেরয়েড হোক কিংবা যে কোন ঔষুধ যা দ্রুত  শারীরিক পরিবর্তন আনে, প্রায় সময়ই খুব বিপদজনক হতে পারে। তাই খুব প্রয়োজন হলে কোন রেজিস্টার্ড ডাক্তারের পরামর্শ ও তত্বাবধায়নে এসব ওষুধ ব্যবহার করতে হবে, আর তা সম্ভব না হলে এসব থেকে শত হাত দূরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles