ফুড পয়জনিং এর লক্ষণ কি? এ সম্পর্কে আপনার যা জানা উচিত!
ফুড পয়জনিং রোগটি সাধারণ হলেও এই সম্পর্কে জ্ঞান রাখা অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রবীণ ও শিশুদের জন্য সমস্যাটি প্রাণঘাতী হতে পারে। বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর প্রায় ১৮ শতাংশ হয়ে থাকে খাবারে বিষক্রিয়া জনিত কারণে। তাই আসুন জেনে নেই ফুড পয়জনিং রোগের কারণ, উপসর্গ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধে করনীয়।
বাইরে থেকে খেয়ে আসার পর হঠাৎ পেট ব্যথা, কয়েক ঘন্টার ভেতর বমি, ডায়রিয়া ও দুর্বল হয়ে পড়ার মত ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। মূলত এটাই খাবারে বিষক্রিয়া বা ফুড পয়জনিং।
কখনো ফুড পয়জনিং হয়নি এমন লোক যেমন খুঁজে পাওয়া কঠিন তেমনই ফুড পয়জনিং সম্মন্ধে মোটামুটি জ্ঞান রাখেন তেমন মানুষও খুবই কম। সাধারণত ফুড পয়জনিং ডায়েরিয়া বা পেট খারাপ বলে আমাদের দেশে অধিক পরিচিত।
খাবার তৈরি ও গ্রহণে সাধারণ পরিচ্ছন্নতা মেনে চললে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফুড পয়জনিং থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অন্যদিকে ফুড পয়জনিং হয়ে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়া ইলেক্ট্রলাইট সমৃদ্ধ তরলের ভারসাম্য রক্ষা করা। চলুন, এটি নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।
ফুড পয়জনিং কি?
ফুড পয়জনিং বা খাদ্যে বিষক্রিয়া হলো খাবারের সাথে এমন কিছু খাওয়া যা শরীরে বিষাক্ত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। প্রশ্ন আসতে পারে, খাবারের সাথে বিষাক্ত কি এবং কিভাবে আসবে?
উত্তরটার গোড়া থেকে আসা যাক। খাবার পঁচনশীল দ্রব্য এবং খুব সহজেই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। খাবার নষ্ট হওয়ার মূল কারণ হলো আমাদের আমাদের চারপাশে থাকা ব্যাক্টেরিয়া। যেকোন খাদ্যগুণ সম্পন্ন বস্তু থেকে তারা পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করে ও খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।
কত দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে তার একটা ধারণা একটু পর দিচ্ছি। তো, এই ব্যাক্টেরিয়ায় কোন খাবারে প্রচুর পরিমানে বংশ বৃদ্ধি করলে আমরা ধরে নেই খাবারটি নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যাক্টেরিয়া উৎপন্ন ক্ষতিকর উপাদান খাদ্যের সাথে গ্রহণের ফলে ফুড পয়জনিং হতে পারে কিংবা, ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া আমাদের পরিপাক তন্ত্রে প্রবেশ করে ফুড পয়জনিং ঘটাতে পারে।
আমাদের চারপাশ ধুলো ও বাতাসে পরিপূর্ণ এবং সবকিছুর সাথেই ব্যাক্টেরিয়া বসবাস করে। তাই খাবার খোলা রাখলে খুব দ্রুত ব্যাক্টেরিয়ার সংস্পর্শ লাভ করে। এজন্য খোলা ও বাসি খাবার সবসময় এড়িয়ে চলা উচিৎ। যদিও বেশিরভাগ ব্যাক্টেরিয়া তেমন কোন ক্ষতি সৃষ্টি করে না। তবুও সবসময় খাবারের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা উচিৎ।
ব্যাক্টেরিয়ার বংশ বৃদ্ধির একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, E. coli নামক একটি ব্যাক্টেরিয়ার কিছু স্ট্রেইন ফুড পয়জনিং এর জন্য দায়ী হতে পারে। E. coli প্রতি ২০ মিনিটে বংশবৃদ্ধি করে প্রায় দ্বীগুন হয়ে যায়। তাহলে চিন্তা করুন, মাত্র একটি ইকোলাই এর সংষ্পর্শে আসা খাবার ৮ ঘন্টা পরে কি পরিমাণ বংশ বৃদ্ধি করতে পারে! মাত্র কয়েক হাজার ব্যাক্টেরিয়া শরীরে প্রবেশ করলেই তা ফুড পয়জনিং সৃষ্টি করে।
অনেক ক্ষেত্রে কিছু ভাইরাস ও প্যারাসাইটও ফুড পয়জনিং এর জন্য দায়ী হতে পারে।
ফুড পয়জনিং এর লক্ষণ!
প্রায় ২৫০ রকম অনুজীব দ্বারা ফুড পয়জনিং হতে পারে এরং ফুড পয়জনিং এর প্রকারভেদ ও উৎসের উপর ভিন্ন ভিন্ন উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে নিন্মক্ত উপসর্গ গুলো প্রায় সব ধরণের বিষক্রিয়াতেই কম বেশি দেখা যায়।
-
পেটে অস্বস্তি
-
ডায়রিয়া
-
খাবারে অরূচি
-
বমি বমি ভাব
-
বমি হওয়া
-
দুর্বলতা
-
মাথা ব্যথা
-
হালকা জ্বর
এই উপসর্গের সাথে সাথেই কিছু বিপদের লক্ষন জেনে রাখা উচিৎ। নিন্মক্ত লক্ষন গুলো দেখা গেলে খুব দ্রুত হাসপাতালে স্থানন্তর প্রয়োজন।
-
১০২ ডিগ্রির বেশি জ্বর
-
হঠাৎ পেশি শক্ত হয়ে যাওয়া
-
কথা বলতে কষ্ট হওয়া
-
প্রস্রাব না হওয়া ও ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা
-
প্রস্রাবে রক্ত আসা।
ফুড পয়জনিং বেশরভাগ ক্ষেত্রে নিজে নিজেই সেরে যায়। ছোট খাটো পয়জনিং মাত্র ঘন্টাখানিকের ভেতরে সরে ওঠে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ফুড পয়জনিং এর উপসর্গ গুলো প্রায় দুইমাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
ফুড পয়জনিং এর চিকিৎসা
আশার কথা হলো ফুড পয়জনিং এর চিকিৎসা জটিল নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শরীরে পানির ও ইলেক্ট্রলাইটের ভারসাম্য ঠিক রাখলেই আমারদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিজেই সব অনুজীব ও বিষাক্ত পদার্থ নিষ্ক্রিয় করে ফেলে। যদিও কিছু ক্ষেত্রে জটিলতা ও দীর্ঘকালীন অসুস্থতা দেখা দিতে পারে। আসুন খাদ্যে বিষক্রিয়ার চিকিৎসা ও করনীয় সম্পর্কে একটি লিস্ট করা যাক।
পানি ও ইলেক্ট্রলাইট প্রতিস্থাপন
ফুড পয়জনিং হলে আমাদের পরিপাক তন্ত্রের পুষ্টি গ্রহণকারী অংশ থেকে ইলেক্ট্রলাইট ও পানি বেরিয়ে যেতে থাকে। এ সময় শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও বিভিন্ন লবনের ঘাটতি হয় যা শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপ এর জন্য অতি প্রয়োজনীয়।
তাই ফুড পয়জনিং এর সাথে ডায়রিয়া ও বমি হলে প্রচুর পরিমাণ ইলেক্ট্রলাইট সমৃদ্ধ তরল ও স্যালাইন পান করতে হবে। যদি ফুড পয়জনিং গুরুতর হয়ে যায় ও একবার অনেকটুকু তরল শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, তবে পানির ঘাঢ়তি দ্রুত পূরণে শিরায় স্যালাইন দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
ডায়রিয়া প্রতিরোধী ঔষধ গ্রহণ
একজন ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়রিয়া প্রতিরোধি ঔষধ গ্রহণ করা যেতে পারে। যদিও এটি শুধু প্রয়োজনেই করা উচিৎ কারণ ডায়রিয়া হলো শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়ার একটি পদ্ধতি। তাই সবসময় ডায়রিয়া বন্ধ করাই ফুড পয়জনিং এর সমাধান নয়।
এন্টিবায়োটিক
অনেক সময় ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ এমন পর্যায়ে চলে যায় যে এন্টিবায়োটিক ছাড়া দমন করা কঠিন হয়ে যায়। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী একটি এন্টিবায়োটিক কোর্স এর প্রয়োজন পড়তে পারে।
মনে রাখবেন, এন্টিবায়োটিক এর পরিপূর্ণ কোর্স পূর্ন না করা আপনার এমনকি সমগ্র মানবজাতির জন্য ঝুঁকিপূর্ন হতে পারে। তাই এন্টিবায়োটিক গ্রহণে সঠিক নিয়ম মানা অতি গুরুত্বপূর্ণ।
এন্টিটক্সিন
সংক্রামিত ব্যাক্টেরিয়া অনেক সময় এমন টক্সিন উৎপন্ন করে যা সহজে শরীর থেকে দূর করা কঠিন। এমন অবস্থায় ডাক্তার এন্টিটক্সিন ঔষধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন যা বিষক্রিয়াকে নিষ্ক্রিয় করবে।
বিশ্রাম
খাদ্যে বিষক্রিয়ার সময় আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেক সক্রিয় হয়ে ওঠে আর সেজন্যই বিশ্রাম খুবই উপকারী। ফুড পয়জনিং এর সময় নিয়ম মত খাওয়া ও বিশ্রাম দ্রুত সেরে ওঠার জন্য সহায়ক।
খাদ্যে বিষক্রিয়ার সময় যা যা খাবেন
নিন্মক্ত খাবার গুলো ফুড পয়জনিং দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করবে,
-
সাদা ভাত
-
কলা
-
তেল ছাড়া শাকসবজি
-
সালাদ
-
মুরগীর স্যুপ
-
ফলমূল
-
ফ্যাট ছাড়া মাছ
খাদ্য বিষক্রিয়ার সময় যা যা থেকে বিরত থাকা উচিৎ
খাদ্যে বিষক্রিয়ার সময় পরিপাক তন্ত্রে সাধারণ ভাবেই অতিরিক্ত চাপ পড়ে। এসময় সহজে হজম হয় না এমন খাবার থেকে বিরত থাকা অতি প্রয়োজন। যেমন:
-
দুধ জাতীয় খাবার
-
চর্বিযুক্ত খাবান
-
উচ্চ চিনি যুক্ত খাবার
-
অতিরিক্ত ঝাল ও মশলা জাতীয় খাবার
-
ভাজা-পোড়া তৈলাক্ত খাবার
-
ক্যাফেইন
-
নিকোটিন ও
-
এলকোহল
ফুড পয়জনিং প্রতিরোধের উপায়
কিছু সাধারণ সতর্কতা মেনে চললে ফুড পয়জনিং সহ অসংখ্য সংক্রমক রোগ থেকে নিরাপদ থাকা যায়। চলুন একটা তালিকা করা যাক,
হাত ধোয়া
জীবানু ঘটিত রোগ ব্যাধি থেকে নিরাপদ থাকার জন্য হাত ধোয়ার অভ্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাইরে থেকে ফিরে, খাবার খাওয়া, তৈরি ও টয়লেট ব্যাবহারের পরে অতি অবশ্যই হাত ধুতে হবে।
বাসি খাবার এড়িয়ে চলুন
একটু খেয়ে বুঝলেন খাবার একটু নষ্ট হয়ে গেছে? ফেলে দিন, খাবার যেটা বাসি হয়ে গেছে সেটা খেয়ে অযথা রোগ বাঁধানোর প্রয়োজন নেই।
খাবার ঢেকে রাখুন
খাবার ঢেকে না রাখলে ধুলো ও মাছির থেকে ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়া ঐ খাবারে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। খাবার সবসময় ঢেকে রাখলে তাতে ব্যাক্টেরিয়ার কালচার হলেও ক্ষতিকর হওয়ার সম্ভাবনা কম।
খাবার প্রস্তুতের সময় সতর্ক থাকুন
বেশিরভাগ খাদ্যে বিষক্রিয়া ঘটে খাবার প্রস্তুতের সময় সঠিক পরিচ্ছন্নতা মেনে না চলার কারণে। ঠিক এই কারণেই বাইরের নিন্মমানের খাবার থেকে খাদ্যে বিষক্রিয়া বেশি হতে দেখা যায়।
নিন্ম মানের মদ বিপদজ্জনক
নিন্ম মানের মদ খেয়ে প্রায়ই অনেক মানুষ মারা যান। মদ তৈরি হয় গাজন প্রক্রিয়ায়, এবং সঠিক ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতিতে। নিন্ম মানের মদে ব্যাক্টেরিয়ার উপস্থিতি নিয়ন্ত্রন অনেকটা লটারির মত। ক্ষতিকর ব্যাক্টেরিয়ার উৎপন্ন টক্সিন খুব দ্রুত মৃত্যু ঘটাতে পারে।
শেষ কথা
অতীতে ফুড পয়জনিং এর সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে অসংখ্য প্রাণহানির ঘটনা ঘটতো। ঘরোয়া পদ্ধতিতে স্যালাইন তৈরির পদ্ধতি প্রচার ও ব্যপক জনসচেতনতা তৈরির ফলে মৃত্যুহার অনেকটাই কমে এসেছে। সর্বপরী স্বাস্থ্যকর ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনের মাধ্যমে ফুড পয়জনিং থেকে নিরাপদ থাকা যায়।