ভয়ঙ্কর বিপদ মাইক্রোপ্লাস্টিক যেভাবে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে

মাইক্রোপ্লাস্টিক পলিউশন একটি বৈশ্বিক সমস্যা, যার জন্য ব্যাহত হচ্ছে প্রকৃতি, জলজ ও স্থলজ সকল প্রকার জীব-জন্তু এমনকি মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যও মাইক্রোপ্লাস্টিকের বিরূপ প্রভাব থাকার প্রবল সম্ভাবনা আছে। যদিও মানব স্বাস্থ্যের উপর মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব এখনো গবেষণাধীন এবং এখন পর্যন্ত খুব বেশি তথ্য জানা যায় নি, তবে আমাদের স্বাস্থ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ফলাফল যে ভালো হবে না তা সহজেকই অনুমেয়।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্রাশ করা থেকে রাতে সিনথেটিক তুলোর বালিশে শুয়ে ঘুমানো পর্যন্ত আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িয়ে গেছে প্লাস্টিক। এমন ব্যবহার্য জিনিস খুব কমই আছে যাতে প্লাস্টিকের ব্যবহার নেই। প্লাস্টিকের এই বহুল ব্যবহার কি ক্ষতিকর? কেনই বা প্লাস্টিক দূষণকে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্রের উপর হুমকি স্বরূপ? আর মানুষের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাবটাই বা কেমন? আসুন একদম মূল বিষয়টি থেকে শুরু করে একে একে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা যাক।

মাইক্রোপ্লাস্টিক কি?

মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো মূলত প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা, যা পচনশীল নয়। মাইক্রোপ্লাস্টিকের মূলত আসে প্লাস্টিক থেকে। প্লাস্টিক যখন পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান যেমন রোদ, বাতাস, মাটি বা পানির সংস্পর্শে এসে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায় তখন মাইক্রোপ্লাস্টিক উৎপন্ন হয়। মাইক্রোপ্লাস্টিককে ঠিকভাবে বুঝতে আগে প্লাস্টিক সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাটুকু নেওয়া যাক।

প্লাস্টিক হলো মূলত কার্বন ও অন্যান্য পদার্থের মৌলের লম্বা শিকল, যা শুধুমাত্র কৃত্তিমভাবে তৈরি করা সম্ভব। বিভিন্ন ধরণের প্লাস্টিকের রয়েছে যাদের ভিন্ন তাপমাত্রায় ভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি করা হয়। এসব প্লাস্টিক যখন কোন ভাবে ক্ষয় হয়ে ক্ষুদ্রতম অংশে ভেঙে যায় তাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলে। একটি তিলের সমান প্লাস্টিকের টুকরা থেকে খালি চোখে দেখা যায় না এমন প্লাস্টিকের টুকরোকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। আকারভেদে একটি মাইক্রোপ্লাস্টিক ১-১০০০ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হতে পারে।

মাইক্রোপ্লাস্টিকের সমস্যা কি?

পৃথিবীতে যা কিছু নতুন করে তৈরি হয় তার একটা ধ্বংস আছে। এই যেমন গাছ থেকে একটা পাতা পড়লে সেটা পঁচে যেতে সময় লাগে সপ্তাহ খানিক। একট প্রাণি মারা গেলে কয়েক মাসের ভেতরেই তার দেহ মাটতে মিশে যায়। কিন্তু প্লাস্টিকের সমস্যাটা হলো প্লাস্টিক নষ্ট হয় না। 

মাটি, পাথর, কাঠ সবকিছুই রূপ পরিবর্তন হয় এবং সেই রূপ পরিবর্তনের অন্তরালে থাকে ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাকের মত অনুজীব। এসব অনুজীব জৈব ও অজৈব বস্তু থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে যার ফলে পঁচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এই ডিকম্পোজিশন ব্যাপারটি প্রকৃতির একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার উপর দাঁড়িয়ে আছে সম্পুর্ণ প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

প্লাস্টিক কৃত্তিমভাবে তৈরি একটি বস্তু যা ১৯৬৫ এর দিকে প্রথম ব্যবহার শুরু হয়। অর্থাৎ মাত্র ৫০-৬০ বছর আগেও এত পরিমাণ প্লাস্টিক প্রকৃতিতে ছিলো না। প্লাস্টিকের ধরণ হচ্ছে এটি তৈরি করতে ও ভাঙতে বিপুল পরিমাণ তাপ শক্তির প্রযোজন হয়, আর যেহেতু পদার্থটি নতুন এমন কোন অনুজীব নেই যা প্লাস্টিকের পদার্থকে কার্যকরী ভাবে ভেঙে ফেলতে পারে।  

এর ফলাফল হলো মারাত্বক, যখন স্বয়ং প্রকৃতির কাছেই একটি বস্তুকে ভেঙে ফেলার কোন উপায় নেই, তখন তা ক্রমান্বয়ে প্রকৃতিতে জমা হতে থাকে ও একই রূপে শত বছর পর্যন্ত টিকে যায়। উদাহারণ স্বরূপ, একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ বা পলিথিন ভাঙতে সময় লাগে প্রায় ২০-৩০ বছর, আর একটি পানির বোতল প্রকৃতিতে ভাঙতে সময় নেবে ৪০০ বছর পর্যন্ত। তবুও কি নিস্তার আছে? প্লাস্টিক যেহেতু লং চেইন কার্বন দিয়ে তৈরি, লং চেইন ভেঙে হবে শর্ট চেইন কার্বন মলিকিউলস যাও আদৌতে প্লাস্টিকই, অর্থাৎ মাইক্রোপ্লাস্টিক।

একবার ভেবে দেখুন ঊনিশশো ষাঁটের দশকে যে প্লাস্টিক তৈরি হযেছিলো তা প্রকৃতি থেকে ভেঙে যেতে সময় লাগবে এখনো ৩৫০ বছর! আর সেখানে আমরা প্রতি বছর ৪০০ মিলিয়ন ম্যাট্রিক টন নতুন উৎপন্ন করছি!

মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে পৃথিবীর এমন একটি অবস্থায় পৌঁছিয়েছে যে, পৃথীবীর এমন কোন প্রত্যন্ত অঞ্চল নেই যেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ নেই। প্রতি মুহুর্তে আমরা আমাদের শ্বাসের, ও খাবারের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করছি। খাবারের মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো সেইসব মাইক্রোপ্লাস্টিক যা মাটি ও পানি থেকে আমাদের খাদ্যশৃঙ্খলে ঢুকে পড়েছে। প্লাস্টিকের প্যকেজিং থেকেও একটি বড় অংশ মাইক্রোপ্লাস্টিক আমরা খাদ্যের সাথে গ্রহণ করি। আমরা যখন প্লাস্টিক মাটিতে বা পানিতে ফেলি তা ধীরে ধীরে ভেঙে মাটি ও পানিতে মিশে যায়। উদ্ভিদ ও মাছেরা মেই মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে ও তাদের দেহে সেইসব মাইক্রোপ্লাস্টিক জমা থাকে। অর্থাৎ আমরা ইতিমধ্যে পৃথিবীর এমন অবস্থা করে ফেলেছি যে আমরা যে  খাবারই খাই না কেন, এবং পৃথিবীর যে প্রান্তেই শ্বাস নেই না কেন, কিছু না কিছু মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের দেহে গ্রহণ করতেই হবে।

শ্বাসের সাথে যে মাইক্রোপ্লাস্টিক আমরা গ্রহণ করি তা মূলত সিনথেটিক কাপড়ের সূক্ষ তন্তু বা রোম। বাতাসে ভাসমান মাইক্রোপ্লাস্টিকের ৮০ ভাগই এ ধরণের মাইক্রোপ্লাস্টিক হয়ে থাকে। 

অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে,  মাইক্রোপ্লাস্টিক এর জন্য গার্মেন্টস সেক্টর বেশ ভালোরকম দায়ী।  শ্বাসের সাথে গ্রহণ করা বেশিরভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক কাশির সাথে বেরিয়ে আসে কিন্তু খুব সূক্ষ মাইক্রোপ্লাস্টিক ফুসফুসে থেকে যায় এমনকি টিস্যুর ভেতরও চলে যেতে পারে।

মাইক্রোপ্লাস্টিক এ যে যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি

মাইক্রোপ্লাস্টিক যেহেতু মানব সভ্যতার কাছে একটি নতুন সমস্যা, এ সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য এখনো পর্যন্ত জানা যায় না। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানব শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রতিক্রিয়া জানতে গবেষণা চালয়ে যাচ্ছেন। তবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের আচরণ ও অন্যান্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা নিন্মোক্ত সমস্যার হাইপোথিসিস দিয়েছেন।

১. ডিএরএ ড্যামেজ: অর্থাৎ বিভিন্ন প্রকার মিউটেশন ও ক্যান্সারের ঝুঁকি।

২. অক্সিডেটিভ স্ট্রেস: শরীরের টিস্যুতে ঠিকমতো অক্সিজের না পৌঁছানো জনিত সমস্যা।

৩. বিভিন্ন অঙ্গে প্রদাহ।

মাইক্রোপ্লাস্টিক এর সম্পুর্ণ জ্ঞান আহরণে প্রয়োজন উন্নতমানের গবেষণা। অবশ্য, মাইক্রোপ্লাস্টিকের সমস্যাটি বড় বড় প্লাস্টিক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, ফ্যাশন ব্রান্ড ও নানাবিধ শিল্প প্রতিষ্ঠানের দিকে আঙ্গুল তোলে যারা পৃথিবীর অর্থনীতির চালিকাশক্তিই বলা যায়। মাইক্রোপ্লাস্টিক সমস্যার সচেতনতা বৃদ্ধি ও গবেষণায় পিছিয়ে থাকার পেছনে তাদের হাত থাকতে পারে কিনা তাও একদম ফেলে দেবার মত সম্ভাবনা নয়। 

মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ কমাবেন কিভাবে?

যেমন পরিবেশে আমরা বাস করি, সেখানে একেবারে মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে গ্রহণ না করারর কোন উপায় নেই। কিন্তু কিছু কাজ করলে মাইক্রেপ্লাস্টিক গ্রহণ প্রায় নব্বই শতাংশ কমিয়ে আনতে পারেন। সেগুলো হলো-

মাস্ক ব্যবহার

এই সময়ে দেশের এমন খুব অল্প জায়গাই আছে যেখানে বাতাসে দূষণের মাত্রা স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে আছে। বাতাসের দূষণের একটা বড় অংশই মাইক্রোপ্লাস্টিক, বিশেষ করে সিন্থেটিক কাপড়ের ক্ষুদ্রাংশ। রাস্তাঘাটে মাস্ক ব্যবহার করে মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা শ্বাসের সাথে গ্রহণ করা কমানো যায়।

অর্গানিক খাবার

বর্তমানে অর্গানিক পদ্ধতিতে কোন খাবারই উৎপাদন করা হয় না, বিশেষ করে শহরে তো নাই। তবু যদি অর্গানিক খাবার খেতে পারেন তাহলে তা বেশি স্বাস্থ্যকর মাইক্রোপ্লাস্টিক বিহীন হয়ে থাকে। ফার্মের মুরগি, মাছ ও বিভিন্ন দ্রব্যেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব থাকে। এমনকি প্রকৃতিতেও মাছের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিরল প্রজাতির মাছেদের দেহেও মিলছে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক। যা প্রকৃতি সচেতন মানুষের জন্য হতাশাজনকই বটে।

প্লাস্টিকের ব্যাগ ও বোতল পরিহার

খাবারের সাথে প্লাস্টিকের পলিথিন, বোতল ইত্যাদি আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। যদিও এই সময়ে খাবারের সাথে প্লাস্টিকের মোড়ক একক ভাবে বর্জন অত্যন্ত কঠিন হতে পারে।

পরিবেশ আন্দোলন

আপনি নিজে যতই সচেতন হলেও সমস্যাটি থেকেই যাবে ও প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাইক্রোপ্লাস্টিক প্রকৃতি ও মানুষের জন্য অভিশাপ হয়ে রয়ে যাবে। তাই বৃহত্তর পরিবেশ আন্দোলন, প্লাস্টিক বর্জন ও সরকারী ও বেসরকারী ইৎপাদন প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণই এই সমস্যাটি সমাধান হওয়ার আশা দেখাতে পারে।

শেষ কথা

এ কথা সত্য যে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব খুব তাড়াতাড়ি বোঝা যায় না। বিভিন্ন রোগের সাথে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সম্পর্কও এখনো গবেষনাধীন। তবে এই কথা অনস্বীকার্য যে উদ্ভিদ, প্রাণি, ও জলজ জীবনের জন্য মাইক্রোপ্লাস্টিক বিশাল ঝুঁকি বহন করে, এবং থাবা থেকে মানুষও মুক্ত নয়। বৃহত্তর ও কার্যকর গণসচেতনতা ছাড়া এই সমস্যার সভ্যতাকে শত শত বছর ভোগাবে।

আরও পড়ুনঃ

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles