বিয়ের আগে ৬টি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পরীক্ষা

একটি সুখী এবং স্বাস্থ্যকর বৈবাহিক সম্পর্কের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক রয়েছে যা আমরা প্রায়শই উপেক্ষা করে থাকি; আর তা হচ্ছে দম্পতির স্বাস্থ্য। আপনার জীবনের বাকি সময়টি কারও সাথে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আপনার নিজের এবং আপনার সঙ্গীর মেডিকেল অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। মেডিকেল চেক-আপগুলি কেবলমাত্র পরামর্শই দেওয়া হয় না, তবে একটি সুখী এবং স্বাস্থ্যকর বিবাহিত জীবনের জন্য অবশ্যই করণীয়।

আনিকার সাথে রাহাতের পরিচয় ভার্সিটিতে। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব, প্রেম এবং সবশেষে বিয়ে। ভালোই যাচ্ছিল সবকিছু। বিয়ের তিন বছর পর মেয়ে রাখীর জন্ম হয়। বছর পেরোয়নি, এমন সময় রাখীর থ্যালাসেমিয়া ধরা পড়ে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায়, আনিকা ও রাহাত দুজনেই এ রোগের বাহক ছিল। 

ঘটনাটি কাল্পনিক হলেও এধরণের ঘটনা আজকাল প্রায়শই ঘটছে। আমাদের আশেপাশে খোঁজ করলেই আমরা অনেক দম্পতি পাব যারা এই ধরণের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন। 

বিয়ে একটি সামাজিক রীতি। বিয়ের মাধ্যমে দুজন মানুষ, দুটি পরিবার একে অপরের কাছাকাছি আসে। কথায় আছে, লাখ কথা না হলে বিয়ে হয় না। বিয়ের আগে দুই পরিবার কিংবা দুই এলাকার রীতি রেওয়াজ, দেনা পাওনা, আদান প্রদান এসব নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক হতে থাকে। এত অজস্র কথার ফাঁকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হয়ত না বলাই থেকে যায়। 

সুস্থ সুন্দর বৈবাহিক জীবনের পূর্বশর্ত হচ্ছে স্বামী স্ত্রী উভয়ের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। বিয়ের আগে অন্যান্য আলোচনার পাশাপাশি উভয়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিষয় নিয়েও আলোচনা হওয়া উচিত। থ্যালাসেমিয়ার মত রোগ যা পরবর্তীতে সন্তানের হবার সম্ভাবনা থাকে অথবা যেসব রোগ স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যেকোন একজনের থাকলে অপরজনের হবার ঝুঁকি থাকে এসব রোগ বিয়ের আগেই পরীক্ষা করে নির্ণয় করতে হবে। 

আসুন তাহলে বিয়ের আগে অবশ্যই করতে হবে এমন কিছু মেডিকেল টেস্ট সম্পর্কে জেনে নেয়া যাক - 

থ্যালাসেমিয়া

আনিকা এবং রাহাতের মত হাজারো দম্পতি আছেন যারা নিজের সন্তানের অসুস্থতা থেকে নিজেদের থ্যালাসেমিয়া স্ট্যাটাস সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। 

থ্যালাসেমিয়া বিশ্বের অন্যতম প্রধান কনজেনিটাল রোগ হলেও এ সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষের ধারণা খুবই ভাসা ভাসা। সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ থ্যালাসেমিয়া বাহক। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর রক্তের লোহিত রক্তকণিকা উৎপাদন কমে যায়, ফলে হিমোগ্লোবিন কমে এনিমিয়া বা রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। নির্দিষ্ট সময় পর পর ব্লাড ট্রান্সফিউশন করে এনিমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এছাড়াও বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশন করা যায় কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা খুবই ব্যয়বহুল এবং কষ্টসাধ্য একটি প্রক্রিয়া। 

স্বামী এবং স্ত্রী উভয়েই যদি থ্যালাসেমিয়া বাহক হয়, তাহলে তাদের সন্তানের 'থ্যালাসেমিয়া মেজর' হবার ঝুঁকি ২৫ শতাংশ। যদি স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে যেকোন একজন বাহক হয়,  তবে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। 'Prevention is better than cure' - তাই বিবাহ পূর্ববতী রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সতর্ক হওয়াই সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি। 

দুইজন বাহকের মধ্যে বিয়ে হলে তাদের সন্তানদের এ রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকবে। তাই বিয়ের আগে বর ও কনে উভয়ের CBC বা Complete Blood Count করে তাদের হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ দেখে নিতে হবে। ডেফিনিটিভ পরীক্ষা করতে চাইলে হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রফোরেসিস করা যায়। ভবিষ্যতের অনাগত সন্তানের কথা ভেবে দুইজন থ্যালাসেমিয়া বাহকের মধ্যে বিয়ে নিরুৎসাহিত করা উচিত। 

STD বা সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ ( যৌনব্যাধি)  

১৬ বছর বয়সী আকলিমার বাবা পেশায় ভ্যানচালক। পাঁচ ভাইবোন আর মা বাবার অভাব অনটনের সংসার। পাশের গ্রামের প্রবাসী মিজানের সাথে তাই অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায় আকলিমার। বিয়ের ৬ মাস পর ধরা পড়ে মিজান এইচাআইভি (HIV) পজিটিভ, সাথে আকলিমাও। 

আনিকা রাহাতের মত আকলিমা মিজানও কাল্পনিক চরিত্র। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ আমাদের সমাজের রোজকার ঘটনা। বাংলাদেশের বিয়ের বাজারে বিদেশে থাকাটাকে একটা যোগ্যতা বলে বিবেচনা করা হয় এবং কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। ফলে এ ধরণের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শুধু যে দরিদ্র পরিবারে বা প্রবাসী স্বামীর ক্ষেত্রে এ ধরণের ঘটনা ঘটে তা নয়। অনেক মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারেও দেখা যায়, স্বামী বা স্ত্রী বিয়ের আগে থেকেই HIV অথবা হেপাটাইটিস বি পজিটিভ, বিয়ের পর এ নিয়ে পারিবারিক অশান্তি, ঝগড়া কলহ এমনকি ডিভোর্সের ঘটনাও অহরহ। 

শারীরিক সম্পর্কের মাধ্যমে ছড়ায় এমন রোগ নিয়ে কথা বলতে সবার মধ্যেই প্রচণ্ড অনীহা। অথচ এই রোগগুলি নিয়েই সবচেয়ে বেশি কথা বলা উচিত আমাদের। যেহেতু HIV পজিটিভ মানেই এইডস নয় এবং হেপাটাইটিস বি ও সি নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ আছে, তাই বিয়ের আগেই এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বলা উচিত। 

অন্যান্য সেক্সুয়ালি ট্রান্সমিটেড ডিজিজ যেমন সিফিলিস, গনোরিয়া, জেনিটাল ওয়ার্টস - ঠিকমতো চিকিৎসা করলে এসব রোগ নিরাময় করা সম্ভব। তাই বিয়ের আগেই সঙ্গীর যৌনব্যাধি সম্পর্কিত তথ্য জেনে নিতে হবে। যাতে পরবর্তী সময়ে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস বজায় থাকে এবং পরবর্তী প্রজন্মের সুস্থতা নিশ্চিত থাকে। 

ফার্টিলিটি টেস্ট

বছরের পর বছর চেষ্টা করার পরও অনেক দম্পতি মা বাবা হতে ব্যর্থ হন। এ পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য বিয়ের আগেই ফার্টিলিটি টেস্ট করা দরকার। 

নারীদের ক্ষেত্রে Ovulation Test বা ডিম্বপাত সংক্রান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে সিমেন এনালাইসিস করে এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এর মাধ্যমে মহিলাদের Ovary বা ডিম্বাশয়ের অবস্থা এবং পুরুষদের স্পার্ম কাউন্ট বা শুক্রাণুর সংখ্যা জানা যায়। বিয়ের পর নিঃসন্তান দম্পতিদের একে অপরকে দোষারোপ করার চেয়ে বিয়ের আগেই এ বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। শুধুমাত্র সন্তান ধারণের জন্যই নয়, পাশাপাশি স্বাভাবিক যৌন জীবন অব্যাহত রাখার জন্যও যৌনাঙ্গ এবং এ সম্পর্কিত টেস্ট করা দরকার। 

ব্লাড গ্রুপ কম্প্যাটিবিলিটি টেস্ট

আমরা সবাই জানি আমাদের রক্তের গ্রুপ বেশ কয়েক ধরণের হতে পারে, যেমন - A, B, O এবং AB। এইগুলি আবার পজিটিভ এবং নেগেটিভ হতে পারে। এই পজিটিভ এবং নেগেটিভ ব্যপারটা নির্ভর করে Rh ফ্যাক্টর এর উপর যাএকটি ইনহেরিটেড প্রোটিন। 

আপনার ব্লাড গ্রুপ পজিটিভ হোক বা নেগেটিভ তাতে আপনার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। অর্থাৎ যে কোনো গ্রুপের রক্তের যে কেউ, অন্য যেকোন গ্রুপের ব্যক্তিকে বিয়ে করে সংসার বাঁধতে পারেন।  কিন্তু সন্তান ধারনের ক্ষেত্রে Rh ফ্যাক্টর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ পজেটিভ-নেগেটিভের মিলনে ঘটতে পারে বিপদ।

বিশেষ করে স্ত্রী যদি Rh নেগেটিভ হয় ও স্বামী  Rh পজিটিভ হয়এবং গর্ভের সন্তান যদি পজিটিভ হয়, তখন সন্তানের পজিটিভ ব্লাড সেল মায়ের শরীরে ইমিউন রেসপন্স তৈরি করে। ফলে মায়ের শরীরে এন্টিবডি তৈরি হয়। এই এন্টিবডি মায়ের শরীরে জমা থাকে এবং পরবর্তী প্রেগনেন্সির সময় সন্তানের রক্ত কণিকাকে আক্রমণ করে। এতে করে গর্ভস্থ শিশু গর্ভেই মারা যেতে পারে বা জন্মের পর মারাত্মক জন্ডিস দেখা দিতে পারে, মস্তিষ্কের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে যাতে না পরতে হয়, তার জন্য বিয়ের আগেই দুজনের ব্লাড গ্রুপিং ও Rh টাইপিং করতে হবে। নেগেটিভ ব্লাড গ্রুপ আছে এমন মহিলাদের Rh পজিটিভ কাউকে বিয়ে না করাই নিরাপদ। 

তাই এক্ষেত্রে আপনাকে অনেক সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। 

মানসিক সুস্থতাজনিত পরীক্ষা

শারীরিক বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভাবতে গিয়ে আমরা মানসিক সুস্থতার গুরুত্ব ভুলে যাই। অথচ শুধুমাত্র দুজন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের পক্ষেই সুখী সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব। বিয়ের আগে সঙ্গীর শারীরিক পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশাপাশি মানসিক কোনো সমস্যা আছে কিনা, অবসাদে ভুগছে কিনা এসব জানাও সমান জরুরি। 

ক্রনিক মেডিকেল ডিজিজ সংক্রান্ত টেস্ট

ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন, এপিলেপ্সি, বিভিন্ন ধরণের ম্যালিগন্যান্সি - এইসব নন কমিউনিকেবল রোগের ক্ষেত্রে ফ্যামিলি হিস্ট্রি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিয়ের আগে অন্যান্য কথাবার্তার সাথে সাথে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের ক্রনিক রোগব্যাধি সম্পর্কে খোঁজ নেয়া উচিত। যদিও আজকাল বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের মতামতই প্রধান ভূমিকা পালন করে, তবুও ভবিষ্যতে বাচ্চার সুস্থতা এবং সন্তান ধারনের সম্ভাবনার কথা ভেবে এসব ক্রনিক ডিজিজ সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত। 

 

বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এখন ছেলে মেয়ের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠছে। এখন আমাদের দেশেও বিয়ের আগে নিজেদের পছন্দ অপছন্দ, বিশ্বাস, সংস্কৃতি, পারিবারিক মূল্যবোধ, বিধি নিষেধ, রীতি নীতি এসব নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে একে অপরের রোগ ব্যাধি নিয়েও খোলামেলা আলোচনা হওয়া উচিত।

বিয়ের পর ঝগড়া অশান্তি কিংবা মনোমালিন্য হবার চেয়ে বিয়ের আগেই এসব বিষয় নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। তাই বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবার আগে ছেলে মেয়ে উভয়েরই প্রয়োজনীয় মেডিকেল টেস্টগুলি করা উচিত যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত রোগে আক্রান্ত না হয়।

Default user image

ডাঃ ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি ঐশ্বি তৃষা সৃষ্টি ঢালী। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করেছি। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অল্প স্বল্প লেখালেখি করতে ভালো লাগে। আস্থা লাইফের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্লগগুলি মানুষের মধ্যে একটু হলেও সচেতনতা তৈরি করবে বলে আমার বিশ্বাস। ভালো লাগে ঘুমাতে, গান শুনতে, নানা রকম খাবার খেতে আর সবচেয়ে ভালো লাগে কথা বলতে।

Related Articles