ভেজিটেরিয়ান ডায়েট কি স্বাস্থ্যসম্মত?

একজন ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষভোজী হয়ে কিন্তু আপনি অনেকগুলো স্বাস্থ্যগত উপকারীতা লাভ করতে পারবেন, যদিও এ ধরণের খাদ্যাভাস গড়তে প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান ও পরিকল্পনা।

নিরামিষভোজী হয়ে কি লাভ?

 

একটি দিক থেকে সাধারণ বাঙালীরা বেশ সুখে থাকেন। ভেজিটেরিয়ান খাদ্যাভাস যদিও আমাদের কাছে কখনোই অপশন ছিলো না, এবং এটা নিয়ে দ্বীধায়ও ভুগতে হয় না। আসলে আমরা (দেশের বেশিরভাগ মানুষ) মোটামুটি অনৈচ্ছিক ভাবে ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষভোজী। যদি জাতিগত ভাবে ভেজিটেরিয়ান, মিট ইটার্স এর ক্যাটাগরি করা হতো তবে আমরা হতাম পিওর ভেজিটেরিয়ান জাতি। এই কথা বলছি,

  • কারণ বিশ্বে মাংস গ্রহণের পরিসংখ্যান মতে আমাদের দেশে একজন মানুষ গড়ে বছরে মাত্র ৪ কেজি মাংস গ্রহণ করে। এটা এতোই সামান্য, বোধ করি অন্যান্য দেশের একজন ভেজিটেরিয়ানও এর চেয়ে বেশি মাংস গ্রহণ করেন (হয়ত লোভে পড়ে)।

  • এই পরিমাণ অবিশ্বাস্য রকম কম। দৈনিক সুস্থ্য শরীর, মানসিক সক্ষমতা, ক্ষয়পূরণ ইত্যাদি প্রায় ৫০ গ্রামের মত প্রোটিন বা আমিষ দরকার।

  • প্রোটিনের মূল উৎস হচ্ছে মাংস ও মাছ। কিন্তু চার কেজি অর্থাৎ ৪০০০ গ্রাম মাংসকে ৩৬৫ দিয়ে ভাগ দিলে পড়বে মোটে দশ বারো গ্রাম আমিষ।

  • আবার এটা পুরোটাই প্রোটিন না। দশ গ্রাম মাংসে মাত্র ৩ গ্রাম প্রোটিন থাকে। আবার একটা ডিমে থাকে ৭ গ্রাম আমিষ।

  • বেশিরভাগ প্রোটিনের চাহিদা মূলত তবে উদ্ভিজ্জ উৎস থেকেই মেটে। যেমন ১০০ গ্রাম ভাতে আমিষ থাকে ২.৫ গ্রাম।

অন্য দেশ এর সাথে যদি তুলনা দেই, জিম্বাবুয়ের মতো দেশের মানুষ জনপ্রতি গড়ে ১৫ কেজি মাংস গ্রহণ করে, আমেরিকা করে ১২৪ কেজি, ডেনমার্ক ১৪৫ কেজি। হিসাব নিকাশ করে বুঝলাম আমরা ভেজিটেরিয়ানই বটে, সেটা ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায়।

কিন্তু মূল সমস্যাটি হলো, ভেজিটেরিয়ান বা নিরামিষভোজী হওয়াটাও এতো সহজ নয়। মাংসের অভাব যদি পরিকল্পিত ভাবে বিকল্প উদ্ভিজ্জ্ব উৎস থেকে না মেটানো হয়, বুদ্ধিমত্তা, কর্মশক্তি কমবে, অপুষ্টির সম্ভাবনা বাড়বে। চলুন ভেজটেরিয়ান হওয়ার সুবিধা অসুবিধা সহ বিস্তারিত জেনে আসি।

 

ভেগান ডায়েট এবং ভেজিটেরিয়ান ডায়েট কি একই?

আমরা অনেক সময় মনে করি ভেগান আর ভেজিটেরিয়ান সমার্থক শব্দ। কিন্তু আদৌতে এ দুটোর আলাদা আলাদা সঙ্গা আছে। যিনি মাংস, মাছ সহ ডিম, দুধ ও অন্যান্য প্রাণিজাত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকেন তিনি হচ্ছেন ভেগান, অন্যদিকে যিনি শুধু মাছ মাংস খান না তাকে বলা হয় ভেজিটেরিয়ান। ভেজিটেরিয়ানের একটি ভাগ হলো ভেগান, তাছাড়াও এর অন্যান্য ভাগ আছে, যেমন: ভেজিটেরিয়ান কিন্তু ডিম খান এমন মানুষ, শুধু ডিম খান এমন মানুষ ইত্যাদি। 

 

ভেজিটেরিয়ান হওয়ার সুবিধাটা কি?

  • ভেজিটেরিয়ান হলে আপনি বিভিন্ন ক্রোনিক রোগ ব্যাধি থেকে অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত থাকবেন।

  • ভেজিটেরিয়ানরা অনেক কম কোলেস্টেরল ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট যুক্ত খাবার গ্রহণ করেন।

  • সেই সাথে তাদের ভিটামিন সি ও ই, ফাইবার, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম গ্রহণের হার অনেক বেশি।

  • এতে তাদের শরীরের লো ডেনসিটি (খারাপ) কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেক কম থাকে, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে থাকে ও শরীরের ওজন স্বাস্থ্যকর থাকে।

  • ফলস্বরূপ তারা খাবারের কারণে হওয়া জটিল ক্রোনিক রোগ গুলো থেকে ঝুঁকিমুক্ত থাকেন।

যদিও সম্পুর্ণ ভেজিটেরিয়ান হয়ে যাওয়ার স্বাস্থ্যগত প্রভাবের উপরে অনেক প্রমাণ থাকলেও গবেষণাটি সম্পুর্ণ নয়। চলুন দেখে আসি এ পর্যন্ত পাওয়া ফলাফলে কি কি উপকারিতার কথা জানা গিয়েছে।

১. হৃদরোগের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়

ভেজিটেরিয়ানদের হার্ট এটাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কম থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় জানা গেছে হার্ট এটাকের সাথে রেড মিট গ্রহণের সংযোগ রয়েছে। অন্য একটি গবেষণায় ৭৬ হাজার ভেজিটেরিয়ানদের মধ্যে গবেষণা করে জানা গেছে, অন্যান্য খাদ্যাভাসে অভ্যস্ত মানুষের চাইতে ভেজিটেরিয়ানদের হার্ট এটাকে মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকি ২৫% কম। যদিও হার্ট এটাকের অন্যান্য কারণও রয়েছে, যেমন ধুমপান, এলকোহল গ্রহণ, দ্রুত হজম হওয়া কার্বোহাইডেট জাতীয় খাবারও দায়ী হতে পারে। ভাত, সাদা আটা জাতীয় খাবার রক্তে খুব দ্রুত চিনির পরিমান বাড়িয়ে তোলে যার কারণে নানা রকম ক্রোনিক ডিজিজ যেমন ডায়বেটিস ও হার্টের সমস্যা তৈরি হয়। হার্ট ভালো রাখার জন্য বেশি ফাইবার যুক্ত লাল আটা, ওটস বেশি ভালো।

যেহেতু আপনি মাংস খাচ্ছেন না, মাংসের প্রোটিন, ফ্যাট ইত্যাদির অভাব পূরণ করতে বাদাম আপনার প্রত্যহিক খাদ্য তালিকার অংশ হবে। বাদাম হার্টের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

২. ক্যান্সার এর ঝুঁকি কমবে

এ কথা শতসিদ্ধ যে ফরমূল ও শাকসবজি খেলে অনেক ধরণের ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাশে কমে আসে। সেই সাথে বিভিন্ন জরিপে দেখে গেছে ভেজিটেরিয়ানদের মধ্যে ক্যান্সার হওয়ার প্রবনতা নন ভেজিটেরিয়ানদের চাইতে অনেকাংশেই কম। যদিও ক্যান্সার থেকে বাঁচার প্রসঙ্গ যখন আসে, তখন যারা শাকসবজির সাথে শুধু মাছ খান, তাদের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা সবচাইতে কম। কোলন ক্যান্সার হওয়ার কারণ হিসেবে লাল মাংসকেই সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে ধরা হয়। ভেজিটেরিয়ানরা সেই ঝুঁকি থেকে মুক্ত। শাক সবজিতে তুলনামূলকভাবে ক্যান্সার তৈরি করা এজেন্ট কম থাকে।

৩. টাইপ-২ ডায়বেটিস

একটি গবেষণায় দেখা গেছে ভেজিটেরিয়ানদের চাইতে নন ভেজিটেরিয়ানদের ডায়বেটিস হওয়ার ঝুঁকি প্রায় দ্বীগুন বেশি। হাভার্ড ইউনিভার্সিটিতে নারীদের উপর গবেষণা করে পাওয়া গেছে লাল মাংস ডায়বেটিস এর জন্য দায়ী হতে পারে। এটি ওজন বৃদ্ধি জনিত সমস্যার জন্যও দায়ী। ওজন বৃদ্ধিও ডায়বেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।

 

ভেজিটেরিয়ান খাদ্যাভাস কি পারফেক্ট?

ভেগান এবং নিরামিশভোজী খাদ্যাভ্যাস প্রাকৃতিক না। কারণ মানুষ সর্বভুক প্রাণি। এই কারণে শরীরের কিছু অতি প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ভেজিটেরিয়ান খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব নয়। তবে পরিকল্পিত ভাবে খাবার তালিকা করলে ও অল্প কিছু ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করলে যেকোন প্রকার মাংস এমনকি প্রাণীজ খাদ্য ছাড়াই অধিকতর স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করা সম্ভব। তবে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা উদ্ভিজ উৎস হতে পাওয়া যায় না।

যে উপাদানগুলি প্রাণীজ উৎস ব্যতীত পাওয়া যায় না

  • ভিটামিন বি ১২- এটি মাছ, মাংস ও দুধে পাওয়া যায়। এর অভাবে নিউরোলোজিক্যাল ডিসঅর্ডার সহ অনেক ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

  • ক্রিয়েটিন- এটি মাংসে পাওয়া যায় ও এটি ব্রেইন ও পেশির স্বাস্থ্য ধরে রাখতে সাহায্য করে।

  • কার্নোসিন- পেশির সুষ্ঠ কার্যক্ষমতার জন্য এটি দরকারি।

  • ভিটামিন ডি৩- ক্যান্সার, ডিপ্রেশন, হার্ট ডিজিজ প্রতিরোধে এটির ভূমিকা রয়েছে।

 

পৃথিবী বাঁচাতে ভেজিটেরিয়ান বিপ্লব

ভেজিটেরিয়ান হয়ে আপনি শুধু বিভিন্ন রোগ থেকেই মুক্তি পাচ্ছেন না, আপনি পৃথিবী ও পরিবেশ রক্ষায়ও অবদান রাখছেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কার্বন এমিশন ও স্বাদু পানি ব্যাবহৃত হয়ে যায় দুগ্ধ ও মাংস খাতে। অনেক বেশি জায়গা, শক্তি অর্থ প্রয়োজন হয় মাংস উৎপাদনে যা পথিবীকে খুব তাড়াতাড়িই সবুজ শুন্য বিরান উষ্ণ প্রান্তর বানাতে যথেষ্ট। অন্যদিকে ভেজিটেরিয়ান খাদ্যাভ্যাস পৃথিবী ও পরিবেশের খুব একটা ক্ষতিকর না। যদিও কৃষিজ জমি প্রয়োজন হয়ই। কিন্তু মাংস উৎপাদনে তার সাত গুন বেশি জায়গা প্রয়োজন হয়। 

 

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিরামিষভোজী খাদ্যাভ্যাস

শুরুতে যে বলছিলাম আমরা অনৈচ্ছিক ভেজিটেরিয়ান তার মূলে বলতে গেলে আমাদের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামোই দায়ী। এখানে চাইলেই একটা মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের মাংসের চাহিদার সম্পুর্ণ মেটাতে পারে না। ভেজিটেরিয়ান না হলেও ভেজিটেরিয়ান খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে জ্ঞান রাখা এই প্রেক্ষাপটে বেশ উপকারী হতে পারে। যেমন কোন খাদ্যগুলো মাংসের পরিপূরক, মাংস গ্রহণ পর্যাপ্ত না হলে কি কি সমস্যা দেখা দিতে পারে ও তা কিভাবে মোকাবেলা করবেন ইত্যাদি।

 

পরিশেষ

খাদ্যাভ্যাস সম্পুর্ণ মানুষের ব্যক্তিগত ব্যপার। পৃথিবীকে সবুজ রাখতে ভেজিটেরিয়ানদের অবদান (কখনো ত্যাগ) প্রশংসার দাবিদার, সেই সাথে আমার যারা মাংস খাই তাদেরও দোষ দেওয়া যায় না। তবে স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় একেবারে ভেজিটেরিয়ান না হলেও পরিমিত খাবার গ্রহণ ও লাল মাংস গ্রহণের পরিমাণ কমানো অবশ্যই একটি স্বাস্থ্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।

Default user image

দিগ্বিজয় আজাদ, লেখক, আস্থা লাইফ

আমি শিল্প সাহিত্যের লোক, একই সাথে বিজ্ঞানের কৌতুহলী ছাত্র। লিখালিখি আঁকাআঁকি করতে ভালোবাসি, পড়ালেখা করছি মাইক্রোবায়োলোজি নিয়ে। আস্থা ব্লগে কাজ করতে পেরে চরিত্রের দুটো দিকই যেন সমানভাবে সন্তুষ্ট হচ্ছে। চেষ্টা করি কত সহজে আপনাদের সামনে প্রয়োজনীয় তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এবং এই প্রক্রিয়ায় যদি কেউ লাভবান হন, বা কিছু শিখতে যদি পারি সেই আমার পরম প্রাপ্তি। ব্যক্তিগত জীবনে শখের মিউজিশিয়ান। নেশার মধ্যে বই পড়া ও ঘুরে বেড়ানো।

Related Articles